Ajker Patrika

নির্যাতনে নীরবতা নয়, সরব হোন

ইমতিয়াজ মাহমুদ
Thumbnail image

আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিভিন্ন পত্রিকা ও নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান দিয়েছে, এ বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫০৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৩ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই সময়ে ৪৩৫ জন্য নারী নিজের ঘরে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮৩ জন নারী তাঁদের স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন।

এই সংস্থাগুলো বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ করে না। এসব সংখ্যা হচ্ছে শুধু সেই সব ঘটনার, যেগুলো নিয়ে মামলা হয়েছে বা বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার উল্লেখযোগ্য খবর পুলিশ বা আদালত কিংবা সংবাদপত্র পর্যন্ত গড়ায় না। এমনকি ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, অনেক ঘটনাই ভিকটিমের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী অথবা এলাকার মুরব্বিরা মিলে ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন। সুতরাং আমাদের সমাজে নারীরা যে ঠিক কতজন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

কেবল এটা বলতে পারি, দেশের মোট নারী জনসংখ্যার সিংহভাগই কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো মাত্রায় সহিংসতার শিকার হন।নারীর প্রতি সহিংসতা কথাটাকে জাতিসংঘ সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, ‘লিঙ্গভিত্তিক যেকোনো ধরনের সহিংসতা যার ফলে বা সম্ভাব্য ফলাফল হিসেবে নারীকে শারীরিক, যৌন বা মানসিক ক্ষতি বা ভোগান্তিতে ভুগতে হয় অথবা নারীর স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় অথবা সেই ধরনের কোনো কাজের হুমকি—হোক সেটা জনসমক্ষে অথবা ঘরের অভ্যন্তরে।’ (নারীর প্রতি সহিংসতা নিবারণে ১৯৯৩ সালের জাতিসংঘের ঘোষণা থেকে; হুবহু অনুবাদ নয়।) এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনি যদি আপনার নিজের পরিবার, সামাজিক পরিমণ্ডল বা গোটা দেশের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেও কোথাও না কোথাও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ঘরে, পথে-ঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন নারীকে সহিংসতার শিকার হতে হয়।

নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অথচ সেটা নিয়ে মানুষের মধ্যে উচ্চকণ্ঠে কোনো প্রতিবাদ হয় না কেন? শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশের অবস্থা কমবেশি একই রকম। নারীর প্রতি সহিংসতাকে খুব গুরুতর কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সমাজের প্রবণতাটা বরং উল্টো, ভিকটিমকে দোষারোপ করা হয় সর্বত্র এবং নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিকার হিসেবে দেওয়া হয় নারীকে অবরুদ্ধ করার ফয়সালা। 

পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ আমেরিকার কংগ্রেসে ১৯৯০ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণের জন্য একটা বিল উত্থাপন করেন সেই সময়ের ডেমোক্র্যাট সিনেটর জোসেফ বাইডেন জুনিয়র (বর্তমানে এই ভদ্রলোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট)। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতাসংক্রান্ত একটি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, এ আইনটা কংগ্রেসে উত্থাপনের জন্য তাঁকে চার বছর ধরে ক্রমাগত কাজ করে যেতে হয়েছে। সমঝোতা করতে হয়েছে কংগ্রেস ও এর বাইরের নানা দলের ও গ্রুপের লোকজনের সঙ্গে, তাদের বোঝাতে হয়েছে। সে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না।

বাইডেন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে যে উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন সেটা হচ্ছে, একধরনের নীরবতা, অস্বীকৃতি ও অবহেলার মাধ্যমে এ ধরনের সহিংসতাকে ক্রমাগত চলতে দেওয়া হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, হোক সে ঘরের মধ্যে নারীকে মারধর করা বা ধর্ষণ করা বা রাস্তাঘাটে নানাভাবে হয়রানি করা, এই সব কোনোটিই নিবারণ করা যাবে না, যদি না আমরা সমস্যাটাকে প্রকাশ্যে স্বীকার করি এবং সেটাকে মোকাবিলা করি ও নিন্দা করি।

এ কথাটা শুধু আমেরিকায় নয়, বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর আরও অনেক দেশেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সার্বিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আমাদের সমাজে খুব গুরুতর কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কেন হয় না? কেননা নারীকে আমাদের সমাজে পুরুষের সমান মর্যাদার মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। নারীকে বিবেচনা করা হয় পুরুষের অধীন, মানুষের চেয়ে ঊন একধরনের প্রাণী হিসেবে।

নারীর ওপর পুরুষের এ রকম মালিকানার ধারণা এবং পুরুষের তুলনায় নারীকে অধম হিসেবে দেখার ধারণা পিতৃতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গেই তৈরি হয়েছে হাজার বছর আগে। আর পৃথিবীর প্রায় সব বড় ধর্ম এই ধারণাকে প্রচার করে ঐশ্বরিক বিধান হিসেবে। ফলে প্রত্যেক পুরুষ শৈশব থেকে বড় হয় এই ধারণা নিয়ে যে কেবল শারীরিকভাবে পুরুষ হওয়ার কারণে সে নারীর চেয়ে উত্তম এবং নারী কোনোভাবেই পুরুষের সমান মানুষ নন। তাই নারীকে শায়েস্তা করা আমাদের চেতনায় পুরুষের অন্তর্নিহিত একটি বৈধ অধিকার হিসেবে প্রোথিত হয়ে থাকে।

আমরা যখন নারীর প্রতি সহিংসতা নিবারণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস উদ্‌যাপন করি, সেটার তাৎপর্য সেখানেই। আঘাতটা করতে হবে নারীর ওপর পুরুষের মালিকানার শতাব্দীপ্রাচীন গলিত দুর্গন্ধযুক্ত বাজে ধারণার ওপর। হোক সে রাজনীতিতে, অ্যাকটিভিজমে অন্য সব সামাজিক কর্মকাণ্ডে। নারীর প্রতি দয়া বা করুণা থেকে নয়, নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা একটি বড় অপরাধ। কেননা এসব আচরণ কেবল একজন ব্যক্তির প্রতি সহিংসতা নয়, মানব সমাজের অর্ধেকের প্রতি অবমাননার প্রতিফলন মাত্র। 

লেখক: আইনজীবী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত