Ajker Patrika

কথা বলতে ভোকাল কর্ড লাগবে না, বাকশক্তি হারানোদের জন্য নতুন আশা

কথা বলতে ভোকাল কর্ড লাগবে না, বাকশক্তি হারানোদের জন্য নতুন আশা

কথা বলার জন্য মানুষের ভোকাল কর্ড বা স্বরতন্ত্রীর প্রয়োজন হয়। ভোকাল কর্ডে কোনো সমস্যা হলে মানুষ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। বিজ্ঞানীরা ভোকাল কর্ড ছাড়াই কথা বলার একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা। এই ডিভাইস একটি চারকোনা পাতলা পট্টিচের মতো। ডিভাইসটি গলায় আঁকড়ে থাকতে পারে। নমনীয় ডিভাইসটি পেশির নড়াচড়া অনুসারে কথায় রূপান্তর করতে পারে। ফলে ভোকাল কর্ড ছাড়াও কথা বলা যায়।

ডিভাইসটি শুধু কথা বলার জন্য গলার নড়াচড়া শনাক্ত করে না, সেই সঙ্গে বিদ্যু শক্তি উৎপাদনের জন্য এই নড়াচড়াকে কাজে লাগায়। অর্থাৎ ডিভাইসটি ব্যাটারি বা বাইরের বিদ্যুৎশক্তির সঙ্গে সংযোগ ছাড়াই কাজ করতে পারবে। 

গত ১২ মার্চ নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষণায় বলা হয়, যারা ক্ষতিগ্রস্ত বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভোকাল কর্ডের কারণে কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে কথা বলতে পারেন না, ডিভাইসটি তাঁদের সাহায্য করবে। এমনকি ক্যানসারের জন্য গলার অস্ত্রোপচার থেকে সেরে উঠছেন তাঁদেরও এই ডিভাইস সাহায্য করতে পারবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) বায়োইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান লেখক জুন চেন বলেন, বেশ কয়েক ঘণ্টা বক্তৃতা দেওয়ার পর স্বরযন্ত্র ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাঁর মাথায় এমন একটি ধারণা আসে। তিনি এই সমস্যা সমাধানের একটি উপায় কল্পনা করতে শুরু করেন, যাতে একজন ব্যক্তির পক্ষে ভোকাল কর্ড ব্যবহার না করেই কথা বলা সম্ভব হয়!

এই চিন্তা থেকেই চেন ও তাঁর সহকর্মীরা একটি নমনীয় পট্টির নকশা তৈরি করেন। এটি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে বা ক্ষণস্থায়ী ভোকাল ডিসঅর্ডার থেকে সেরে ওঠার পর কথা বলতে সক্ষম করে তোলে।

চেন বলেন, ২০২১ সালে নেচার ম্যাটেরিয়ালস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ওপর নির্ভর করে এই পট্টির নকশা করা হয়েছে। তিনি এই গবেষণা প্রতিবেদনটিরও প্রধান লেখক।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বিজ্ঞানীরা জানেন যে, যান্ত্রিক চাপের মাধ্যমে কিছু অনমনীয় ধাতুর চুম্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তন করা যেতে পারে। এর একটি উদাহরণ হলো, লোহা ও গ্যালিয়ামের একটি সংকর ধাতু। এই ধাতুকে গ্যালফেনল বলা হয়। ধাতুটির ওপর চাপ প্রয়োগ করলে বা বিকৃত করলে চুম্বকীয় অবস্থার পরিবর্তন হয়।

চেন ও তাঁর সহকর্মীরা ২০২১ সালের গবেষণায় দেখেন যে, পাতলা সিলিকনের ভেতরে প্রবিষ্ট করা ক্ষুদ্র চুম্বক দিয়ে তৈরি একটি নমনীয় উপাদানের মাধ্যমে এই ধারণা কাজ করতে পারে।

গবেষক দলটির সর্বশেষ গবেষণায় উপাদানটিকে একটি পট্টির আকার দেওয়া হয়েছে। এই পট্টি গলার পেশির নড়াচড়ার সূক্ষ্ম চাপগুলোর মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখায়। যখন কোনো ব্যক্তি কথা বলার জন্য গলার পেশির প্রয়োজনীয় নড়াচড়া করেন, তখন উপাদানটি বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে প্রতিক্রিয়া জানায় যা কণ্ঠস্বরে অনুবাদ করা যেতে পারে।

এই ফলাফল পাওয়ার জন্য খুব পাতলা পাঁচটি স্তর দিয়ে পট্টিটি তৈরি করা হয়েছে। পট্টির বাইরের স্তরগুলো একটি নমনীয় সিলিকন উপাদান দিয়ে তৈরি। আর সিলিকন ও মাইক্রোম্যাগনেটের মধ্যম স্তরটি একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে যা গলার পেশিগুলোর নড়াচড়ার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এর চারপাশে তামার তারের কয়েল দিয়ে তৈরি দুটি স্তর রয়েছে। এই স্তর চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনগুলোকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে। অনেকটা স্পিকারের কৌশলের মতো।

এই বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো এরপর তখন মেশিন–লার্নিং অ্যালগরিদমের ভেতরে দেওয়া হয় যা স্পন্দনগুলোকে কথায় অনুবাদ করে। অ্যালগরিদম প্রশিক্ষণের জন্য গবেষণায় প্রতিটি অংশগ্রহণকারী পাঁচটি ছোট বাক্যাংশ ১০০ বার পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময় প্রোগ্রামটি তাঁদের গলার গতিবিধি ট্র্যাক করে। এর মাধ্যমে সিস্টেমটি বিভিন্ন শব্দগুচ্ছকে নির্দিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে শেখে। 

ক্যাপ: পট্টির বাইরের স্তরগুলো একটি নরম, নমনীয় সিলিকন উপাদান দিয়ে তৈরিকণ্ঠের সমস্যা ছাড়া আটজন ব্যক্তিতে এই পট্টি পরিয়ে কথা বলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পট্টিটির বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো কথায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে অ্যালগরিদমটি প্রায় ৯৫ শতাংশ নির্ভুল ছিল। এই পরীক্ষায় সংক্ষিপ্ত বাক্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এসব বাক্যের মধ্যে রয়েছে: ‘মেরি ক্রিসমাস’ ও ‘আমি আশা করি, আপনার পরীক্ষাগুলো ভালো মতো হচ্ছে’ ইত্যাদি। অংশগ্রহণকারীরা এসব বাক্য দাঁড়িয়ে, হেঁটে ও দৌড়ানোর মতো বিভিন্ন অবস্থায় উচ্চারণ করেছেন।

ফলাফলগুলো আশাব্যঞ্জক হলেও পট্টিটি এখনো বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আর পরীক্ষাটি শুধু আটজন লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এসব ব্যক্তি নির্দিষ্ট কিছু বাক্যাংশ বলেছেন। এটি এখনো স্বরযন্ত্রের ব্যাধিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পরীক্ষা করা বাকি।

চেন বলেন, গবেষণার আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো পট্টির জন্য বর্তমান উৎপাদন প্রক্রিয়াটি আরও উন্নত করা এবং প্রচুর পরিমাণে তৈরি করার জন্য আরও দক্ষ লোক তৈরি। ভবিষ্যতে এই ডিভাইসটির সক্ষমতা বাড়াতে চান গবেষকেরা।

ল্যারিঙ্গোস্কোপ জার্নালে প্রকাশিত ২০০৫ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যক্তির জীবনে অন্তত একবার কণ্ঠের সমস্যা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ৩ থেকে ৯ শতাংশ ব্যক্তির অ্যাফোনিয়া দেখা দেয় বা কণ্ঠস্বর হারানোর সমস্যা হয়। কণ্ঠস্বর কর্কশ হওয়া, ফ্যাঁসফ্যাসে হওয়া, ফিসফিস করে কথা বলতে না পারা বা কণ্ঠস্বরের সম্পূর্ণ ক্ষতিকে অ্যাফোনিয়া বলা হয়।

যারা কথা বলতে পারে না তাদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোর একটি হলো—একটি ছোট ব্যাটারি–চালিত যন্ত্র— ইলেক্ট্রোলারিনক্স। এগুলো ব্যয়বহুল বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থাপন করতে হয়। বেশিরভাগ মানুষই সেগুলো কিনতেও পারে না। অন্যান্য ডিভাইসগুলো টেক্সট বা সংকেতের ওপর নির্ভর করে অনুবাদ করে। ফলে ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা যায় না। 

নতুন এই প্রযুক্তি কথা বলার জন্য আরও বেশি সুবিধা দেবে বলে গবেষকেরা আশা করছেন। 

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত