Ajker Patrika

বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে লেজার যন্ত্র

বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে লেজার যন্ত্র

শ্রীযুক্ত নকুড়চন্দ্র বিশ্বাসকে মনে আছে? ওই যে সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কুর গিরিডি বাড়ি কাম কর্মক্ষেত্রে যিনি বিনা নোটিশে হাজির হয়েছিলেন। এই কাহিনি সেই সোনার শহর এল ডোরাডো নিয়ে। সে যাক। কাহিনির নকুড় চরিত্রটির ছিল ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা, যা শঙ্কুর ভাষ্যমতে বল লাইটনিংয়ের ফল হতে পারে। বজ্রপাত তো এই মৌসুমি ঋতুর দেশে হামেশাই ঘটে। এই বজ্র ও বজ্রপাত নিয়ে কিংবদন্তির তো কোনো শেষ নেই। প্রফেসর শঙ্কুতেও স্থান পেয়েছে এমনই একটি। শুধু কল্পজগতের বিজ্ঞানীই নন, বাস্তবের বিজ্ঞানীরাও এই বজ্র নিয়ে ভাবছেন বহুদিন।

গোটা বিশ্বের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো বা আবহাওয়াকে নিজের ইচ্ছামতো বদলে দিতে বিজ্ঞানীরা হাত বাড়াতে চেয়েছেন এই প্রাকৃতিক বিদ্যুতের খনিতে। কিন্তু সে হাত পুড়ে না গেলেও বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। এবার অবশ্য কিছুটা আশার কথা শোনা যাচ্ছে। 

বিজ্ঞানীরা এবার বজ্রকে পোষ মানাতে বিরাটকায় লেজার যন্ত্রের শরণ নিয়েছেন। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক আল্পস পর্বতের সান্টিস শিখরে লেজার যন্ত্র বসিয়েছেন, যা আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর কাজটি করতে পারবে। এই লেজার যন্ত্র এতটাই বড় যে, এর পুরো কাঠামোটির ওজন ২৯ টন। যন্ত্রটি বসানোর ভিত তৈরিতেই লেগেছে ১৮ টন কংক্রিট। লেজারটি থেকে সেকেন্ডে ১ হাজারটি রশ্মি নির্গত হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রশ্মির ক্ষমতা বিশ্বের সবগুলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সৃষ্ট শক্তির সমান বলে দাবি করেছেন গবেষক দলের নেতা জ্যঁ-পিয়েরে উলফ। 

সুইস পদার্থবিজ্ঞানী জ্যঁ-পিয়েরে উলফ লেজার নিয়ে ২০ বছরের বেশি সময় কাজ করছেন। স্বপ্ন—লেজার রশ্মির মাধ্যমে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ। শুনে আকাশকুসুম কল্পনা মনে হলেও লেজার কিন্তু যেনতেন বিষয় নয়। কী হয় না লেজারে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পদার্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্ত হিরা কাটা থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার কিংবা বিভিন্ন পণ্যের গায়ে হিজিবিজি করে লেখা বারকোড পাঠের মতো বিচিত্র সব কাজ এই লেজারের মাধ্যমে হয়। এ তালিকা বেশ দীর্ঘ। আর জ্যঁ-পিয়েরে উলফ মনে করেন তালিকায় তিনি আরেকটি বিষয়কে যুক্ত করতে পারবেন। আর তা হলো বজ্রপাত থেকে রক্ষা করা। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণার সঙ্গে জেনেভার পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে প্যারিস ও লুসানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। রয়েছে রকেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আরিয়ান গ্রুপ ও লেজার উৎপাদনকারী জার্মান প্রতিষ্ঠান ট্রাম্ফ। গবেষণাটি চলছে অনেক দিন ধরে। মহামারির কারণে কিছুটা বিলম্বে হলেও অবশেষে গবেষকদের তৈরি লেজার যন্ত্রটি সুইজারল্যান্ডের আওতাধীন আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্টিসে স্থাপন করা হয়েছে। 

কথা হলো এত জায়গা থাকতে সান্টিসে কেন? কারণ ব্যাখ্যা করতে সিএনএনকে উলফ বলেন, ‘ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত যেখানে হয়, তার একটি এটি। এখানে যে রেডিও ট্রান্সমিশন টাওয়ার আছে, সেখানে বছরে ১০০-৪০০টি বজ্রপাত হয়। তাই আমাদের পরীক্ষার জন্য এটিই ভালো জায়গা।’ 

সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে মেঘের ভেতরে জলকনা ও বরফকনার মধ্যে প্রবল গতিসম্পন্ন বাতাসের উপস্থিতির কারণে সেখানে বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। একবার শুরু হলে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক—দুই বিপরীত চার্জের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় এটি বাড়তে থাকে। আর একপর্যায়ে যখন বিপুল পরিমাণ চার্জ সঞ্চিত হলে এই বিদ্যুৎ আর আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে না সংশ্লিষ্ট মেঘ। তখনই বজ্রপাত হয়। উলফদের তৈরি লেজার যন্ত্রটি ঠিক প্রাকৃতিক এই ঘটনারই অনুকরণ করবে। লেজারের মাধ্যমে মেঘে থাকা পরমাণুর ভেতরের ইলেকট্রনকে তারা সরিয়ে আনবেন। এতে কৃত্রিমভাবেই মেঘের ভেতরে দুই চার্জিত মেরু সৃষ্টি করা যাবে। আর তৈরি হওয়া বিদ্যুতের সঞ্চারটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এখনো নিয়ন্ত্রণে সফল না হলেও চেষ্টাটি সে লক্ষ্যেই। 

এই লেজার যন্ত্র থেকে উৎপন্ন সবচেয়ে শক্তিশালী রশ্মির শক্তি বিশ্বের সবগুলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত শক্তির চেয়ে বেশি বলে দাবি করেছেন গবেষক দলের নেতা সুইস পদার্থবিজ্ঞানী জ্যঁ-পিয়েরে উলফআল্পসের সান্টিস চূড়া ভূপৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার মিটার (৮ হাজার ২০০ ফুট) উঁচু। তার ওপরে রয়েছে ১২০ মিটার উচ্চতার সেই রেডিও ট্রান্সমিশন টাওয়ার। উলফসহ গবেষকেরা এই টাওয়ারের ওপর থেকেই লেজার ব্যবহার করতে চাইছেন। উলফ বলছেন, এই লেজার যন্ত্র দ্বারা সৃষ্ট লেজার রশ্মি দিয়ে তাঁরা বজ্র যেমন তৈরি করতে পারবেন, তেমনি কাছেপিঠে তৈরি হওয়া বজ্র পতনের আগেই তাকে ধরে ফেলা যাবে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে আঘাত হানার আগেই তাকে বন্দী করা যাবে। আবার মেঘের ভেতর সৃষ্টি হওয়া বিদ্যুতের মাত্রা কমানো বাড়ানোর কাজটিও করা যাবে। অর্থাৎ বজ্রপাতের আগেই এর শক্তি কমিয়ে দেওয়া যাবে। 

সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রাথমিক পর্যায়েই পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে স্যাটেলাইট নিয়ে যাওয়ার সময় রকেটগুলো বজ্রপাত সম্পর্কিত যে জটিলতার মুখে পড়ে, তা কমিয়ে আনা যাবে নতুন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। এ ছাড়া বিশেষত ঝড়ের সময় বিমানবন্দরগুলোতে এটি ব্যবহার করা যাবে। 

বজ্রপাত অনেক আগে থেকেই সংকট হিসেবে রয়েছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গোটা পৃথিবীতেই বজ্রপাতের হার বেড়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে বিস্তর আলোচনা করতে হবে। তবে বজ্রপাত ও এর ফলে হওয়া ক্ষতির পরিমাণ যে বেড়েছে, তা বুঝতে শুধু বাংলাদেশের দিকে তাকালেই হবে। গতকাল সোমবারও সারা দেশে বজ্রপাতে নয়জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এমন খবর এখন প্রতিনিয়ত আসছে। এটা শুধু বাংলাদেশের বাস্তবতাই নয়। গোটা বিশ্বের। বজ্রপাতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৬ থেকে ২৪ হাজার মানুষ মারা যায়। সঙ্গে ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে শুরু করে নানা অবকাঠামোর ক্ষতি তো রয়েছেই। এই যাবতীয় ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েই এমন একটি গবেষণায় বিনিয়োগ করেছে ইইউ। 

এত শক্তিশালী একটি লেজার সক্রিয় হলে একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী তো তৈরি করতেই হয়। এর ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। এটি সক্রিয় হলে এর চারপাশে ৫ কিলোমিটার এলাকাকে নো-ফ্লাই জোন হিসেবে ধরা হবে। প্রফেসর শঙ্কুর ভক্তদের কথা মাথায় রেখে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবশ্য নেওয়া হয়নি। হলে ভালো হতো। কারণ, নকুড়চন্দ্রের মতো দারুণ ক্ষমতার অধিকারী হতে যদি কেউ এই বলয়ে ঢুকে পড়ে। আর তখনই যদি জেগে ওঠে লেজার লাইট। তখন তো সেই ভূ-ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা তারও আয়ত্তে আসবে—ভাবতে ক্ষতি কী!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বন্দর-করিডর আপনার এখতিয়ারে নেই, বিদেশি উপদেষ্টাকে বিদায় করুন: ইউনূসকে সালাহউদ্দিন

জামায়াতের কেউ ইমাম-মুয়াজ্জিন হতে পারবে না: আটঘরিয়ায় হাবিব

আলটিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই আসতে পারে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ঘোষণা

পাইপলাইনে জ্বালানি পরিবহন: ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প স্থবির

দায়িত্ব পেয়েই ‘অনিয়ম-দুর্নীতিতে’ মাসুদ রানা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত