Ajker Patrika

দারিদ্র্যকে হার মানিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের গল্প

কারিমুল ইসলাম
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ২৭
টুর্নামেন্টজুড়ে ৮ ম্যাচে ক্রান্তির শিকার ৯ উইকেট। উইকেট সংখ্যার চাইতেও কার্যকরী বোলিংয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন এই পেসার। ছবি: এক্স
টুর্নামেন্টজুড়ে ৮ ম্যাচে ক্রান্তির শিকার ৯ উইকেট। উইকেট সংখ্যার চাইতেও কার্যকরী বোলিংয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন এই পেসার। ছবি: এক্স

জীবন কখনো কখনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। সময় কখনো দেয় দুই হাত ভরে, যা একসময় ভাবা হয়নি, তার চেয়েও অনেক বেশি। ঈর্ষণীয় সাফল্য এমনি ধরা দেয় না। এসবের পেছনে থাকে অধ্যবসায়ের গল্প। শুধু কঠোর পরিশ্রম আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন দিয়েই স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায়। লেখা যায় নতুন ইতিহাস। ঠিক তেমন কিছুই করে দেখালেন ক্রান্তি গৌড়। স্বপ্নকে তাড়া করতে গিয়ে তিনি এখন বুন্দেলখন্ডের ছোট শহর ঘুয়ারা ছাপিয়ে গোটা ভারতের গর্বের কারণ।

ক্রান্তি প্রমাণ করলেন, প্রবল ইচ্ছা, তাড়না বা লেগে থাকার তীব্র শক্তি থাকলে কোনো প্রতিকূলতাই দমিয়ে রাখতে পারে না। কঠোর অধ্যবসায়ে দারিদ্র্যকে হার মানিয়ে স্বপ্নকে আলিঙ্গন করা যায়। দরিদ্র পরিবারে সাত ভাই-বোনের মধ্যে ক্রান্তিই সবার ছোট। বাবা পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন একসময়। কিন্তু কয়েক বছর আগে চাকরি হারান তিনি। তাতে দুর্দশা বাড়ে। পরিবারের চাকা ঘোরাতে বড় ভাইয়েরা কেউ দিনমজুর, কেউ আবার বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতেন। এমন পরিস্থিতিও ক্রান্তির মনে ব্যাট-বলের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়তে দেয়নি। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন। যে লড়াই ক্রান্তির হাতে তুলে দিয়েছে বিশ্বকাপের ট্রফি। যেটা ভারতের ইতিহাসে প্রথম।

ফাইনালে ৩ ওভারে ১৬ রান দেন ক্রান্তি। ছবি: এক্স
ফাইনালে ৩ ওভারে ১৬ রান দেন ক্রান্তি। ছবি: এক্স

নভি মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে নতুন ইতিহাস লিখেছেন ভারতের মেয়েরা। ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫২ রানের জয়ে গোটা দেশ ভেসেছে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে। হারমানপ্রীত কৌরের দলের এই প্রাপ্তির পেছনে যে কয়েকজনের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে ক্রান্তির নামটা আলাদাভাবেই নিতে হবে। দীপ্তি শর্মা, শেফালি বার্মা, স্মৃতি মান্ধানা, জেমিমা রদ্রিগেজদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও ক্রান্তি যা করেছেন, আক্ষরিক অর্থে সেটাও অনেক কিছু।

ফাইনালের দিন গোটা ভারতের নজর ছিল ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামের দিকে। টিভি পর্দার সামনে বসে দলের প্রতিটি চার, ছক্কা কিংবা বোলারদের উইকেট নেওয়া উপভোগ করেছেন সবাই। পিছিয়ে ছিল না ঘুয়ারার বাসিন্দারাও। নিজেদের মেয়ে ক্রান্তি বিশ্বকাপ দলের অংশ বলে কথা। ফাইনালের দিন তাই একটুকরো উৎসবের নগরীতে রূপ নেয় ঘুয়ারা। খেলা দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় এলইডি স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ম্যাচ শুরুর বেশ আগে থেকে নির্ধারিত জায়গায় জড়ো হতে থাকে সবাই। ভারতের জয় নিশ্চিত হতেই ঢোল বাজিয়ে, আতশবাজি ফুটিয়ে, নেচেগেয়ে শুরু হয় শিরোপা উদ্‌যাপন। ক্রান্তি বিশ্বকাপ দলের অংশ হওয়ায় কারণেই যে এত আয়োজন সেটা বলা বাহুল্য।

ক্রান্তির সফলতার গল্পটা যেন সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো খুব যত্ন করে লেখা। যার শুরুতেই আছে নাটকীয়তা। যে গল্পে কুড়িয়ে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে নায়কের ভূমিকায় ক্রান্তি। ২২ বছর বয়সী ক্রিকেটারের শুরুটা হয়েছিল টেপ টেনিস দিয়ে। একদিন বিশেষ এক ম্যাচে একজন খেলোয়াড়ের কম থাকায় একাদশে সুযোগ পেয়ে যান ক্রান্তি। সেই যে শুরু, আর থামেননি এই পেসার। এরপর একে একে নিজেকে প্রমাণ করে গেছেন। যে মঞ্চ পেয়েছেন, সেখানেই দিয়েছেন নিজের সেরাটা। সর্বশেষ বিশ্বকাপের মঞ্চে বুন্দেলখন্ড ছাপিয়ে গোটা দেশের নায়ক বনে গেলেন।

পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ২০ রানে ৩ উইকেট নেন ক্রান্তি। ছবি: এক্স
পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ২০ রানে ৩ উইকেট নেন ক্রান্তি। ছবি: এক্স

সেই টেপ টেনিস ম্যাচে ব্যাট-বল দুই বিভাগেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে সেরা খেলোয়াডড়ের পুরস্কার জেতেন ক্রান্তি। সেদিন দর্শকদের মধ্যে ছিলেন ছত্রপুর জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কোচ এবং সচিব রাজীব বিলথ্রে। খেলায় মুগ্ধ হয়ে ক্রান্তিকে প্রশিক্ষণের জন্য ডাকেন। একই সঙ্গে এই ক্রিকেটারের ফিটনেস এবং কৌশলগত উন্নতি নিয়েও কাজ শুরু করেন তিনি। এভাবেই ক্রান্তিকে টেপ টেনিস থেকে চামড়ার বলের ক্রিকেটারে রূপান্তরিত করেন বিলথ্রে। তাঁর সহায়তায় ক্রান্তি ছত্রপুর একাডেমিতে যোগ দেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ মহিলা দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০২৪ সালে প্রথমবারের মধ্যপ্রদেশকে আঞ্চলিক ওয়ানডে শিরোপা জেতাতে বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ক্রান্তি।

মধ্যপ্রদেশের হয়ে নিজেকে প্রমাণ করে উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পান ক্রান্তি। ১০ লাখ টাকায় তাঁকে কিনে নেয় ইউপি ওয়ারিয়র্স। এই দলের হয়ে দারুণ বোলিংয়ে নজর কাড়েন, প্রথমবারের মতো ডাক পান ভারত নারী দলে। জাতীয় দলের ইংল্যান্ড সফরে সাড়া ফেলে দেন এই তরুণী। চেস্টার লে স্ট্রিটে ৫২ রানে ৬ উইকেট নিয়ে খবরের শিরোনাম হন। এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা।

বিশ্বকাপেও নিজেকে প্রমাণ করেন আলাদাভাবেই। টুর্নামেন্টজুড়ে ৮ ম্যাচে তাঁর শিকার ৯ উইকেট। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ভারতের নারী ক্রিকেটের যে নতুন ইতিহাস রচিত হলো, এর শুরুর দিকেই ছিল পাকিস্তান বধের আনন্দ। লিগ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রতিবেশী দেশকে ৮৮ রানে হারায় ভারত। সে ম্যাচে ১০ ওভার বল করে মাত্র ২০ রানে প্রতিপক্ষের ৩ ব্যাটারকে ফেরান ক্রান্তি। জেতেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

ভারতের ইতিহাস রচনার সারথি হয়ে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ক্রান্তি। তার সফলতায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে পরিবার। ফাইনালে ভারতের জয় নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দের বন্যা বয়ে যায় ঘুয়ারার দুই কক্ষের একটি বাড়িতে। মেয়ের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখে সেই বাড়িতে বসে আনন্দে কেঁদেছেন বৃদ্ধ মা-বাবা। দর্শনার্থী এবং সংবাদমাধ্যমের সামনে বোনকে নিয়ে কথা বলেছেন ক্রান্তির ভাই-বোনেরা। হয়তো তখন পরিবারের সবার ছোট মানুষটাকে নিয়ে গর্বে বুক ভরে গেছে তাঁদের। বিশ্বকাপজয়ী দলের একজন সদস্যকে নিয়ে এমন অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘সাকিবের পোস্টার স্টেডিয়ামে ঢুকবে কি না, বিসিবির ডিসিপ্লিনারি কমিটি দেখবে’

আন্তর্জাতিক সালিসের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ-আদানি

দলীয় মনোনয়ন পছন্দ না হওয়ায় বিশৃঙ্খলা, বিএনপির ৪ নেতা বহিষ্কার

‘তোমার জন্যই খুন করেছি’, স্ত্রীকে হত্যার পর প্রেমিকাকে সার্জনের বার্তা

জোটেই ভোট করবে জামায়াত, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা শিগগির

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ