Ajker Patrika

তীব্র ঠান্ডায়ও মেরু ভালুকের লোমে বরফ জমে না যে কারণে

মেরু ভালুকের পিচ্ছিল ত্বক শিকারি হিসেবে তাদের ‍বিশাল সুবিধা দেয়। ছবি: পোলার বিয়ারস ইন্টারন্যাশনাল
মেরু ভালুকের পিচ্ছিল ত্বক শিকারি হিসেবে তাদের ‍বিশাল সুবিধা দেয়। ছবি: পোলার বিয়ারস ইন্টারন্যাশনাল

হিমশীতল বরফে আচ্ছাদিত প্রত্যন্ত আর্কটিক অঞ্চলে বসবাস করে বিশালদেহী সাদা লোমের পোলার বিয়ার বা মেরু ভালুক। এই তীব্র ঠান্ডায় থাকলেও তাদের লোমে বরফ জমে না। তাই মেরু ভালুকের লোম নিয়ে বেশ আগ্রহী হন বিজ্ঞানীরা। প্রাণীটির লোম নিয়ে গবেষণা করে এর কারণ খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। মূলত তৈলাক্ত হওয়ায় লোমগুলো জমে যায় না।

সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেরু ভালুকের ত্বকের গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত একটি তেলজাতীয় পদার্থ তাদের লোমকে সাব জিরো তাপমাত্রাও (শূন্যের নিচে মাইনাস তাপমাত্রা) জমে যেতে বাধা দেয়। এই আবিষ্কারটি পরবর্তীতে পিএফএএস (পের-অ্যান্ড পলিফ্লুরোঅলকাইল সাবস্ট্যান্সেস) নামের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের বিকল্প তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। পিএফএএস-কে ‘ফরেভার কেমিক্যাল’ বলা হয়। কারণ এগুলো পরিবেশে শতাব্দী ধরে টিকে থাকে।

মেরু ভালুকের প্রাকৃতিকভাবে তৈলাক্ত লোমের বরফ–প্রতিরোধী ক্ষমতা অত্যাধুনিক মানবসৃষ্ট ফাইবারগুলোর সমান। এসব ফাইবারে পিএফএএস–এর প্রলেপ থাকে। এগুলো তেল, তাপ, পানি ও বরফ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। তবে মেরু ভালুকের বরফ প্রতিরোধের সক্ষমতা পুনরায় তৈরি করার মাধ্যমে এই বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের স্বাস্থ্যকর বিকল্প তৈরি করার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

এই গবেষণার প্রধান লেখক গবেষক বডিল হোলস্ট বলেন, ‘যদি আমরা মেরু ভালুকের তেল থেকে পাওয়া উপাদানগুলোর সমন্বয় অনুসরণ করি, তাহলে পরিবেশে ক্ষতি না করে বরফ প্রতিরোধী উপকরণ তৈরি করা সম্ভব। মেরু ভালুকের ত্বক থেকে নিঃসৃত এই তেলটি বিশেষ ধরনের লিপিড এবং কোলেস্টেরলের মিশ্রণ, যা এদের লোমকে বরফের সংস্পর্শে আসা থেকে প্রতিরোধ করে।’

প্রায় পাঁচ বছর আগে মেরু ভালুকের লোমের আগ্রহ জন্মে বিজ্ঞানী বডিল হোলস্টের। সেসময় জার্মান টেলিভিশন প্রোগ্রামে আর্কটিক প্রাণীদের কথা বলা হচ্ছিল। সেখানে মেরু ভালুকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা ছিল। এই আলোচনা তাকে ভাবাতে শুরু করে, কীভাবে তাদের লোম পানিতে ডুব দেওয়ার পরেও বরফ মুক্ত থাকে।

মেরু ভালুকের পিচ্ছিল ত্বক শিকারি হিসেবে তাদের ‍বিশাল সুবিধা দেয়। যতক্ষণ না কোনো সিল পৃষ্ঠে উঠে আসে ততক্ষণ সমুদ্রের বরফের মধ্যে গর্তের কাছে লুকিয়ে থাকে। এরপর তারা বরফের ওপর নিজেদের পেট এলিয়ে দেয়। তারপর সিলের দিকে আগাতে থাকে। মেরু ভালুকের লোম তৈলাক্ত হওয়ায় লোম ও বরফের মধ্যে কম ঘর্ষণ হয়। ফলে সিল এদের উপস্থিতি টের পায় না।

ইনুইট আদিবাসীরা দিয়ে স্যান্ডেল তৈরি করত, যাতে বরফের ওপর প্রায় নীরবে চলাফেরা করা যায়। মেরু ভালুকের লোম রহস্য সমাধান করার জন্য এক ডজনেরও বেশি বিজ্ঞানীকে একত্রিত করেন হোলস্ট।

মেরু ভালুকের লোম বরফ প্রতিরোধে কতটা কার্যকর, তা পরীক্ষা করার জন্য ভালুকের লোমের ধোয়া এবং না ধোয়া নমুনাগুলোর সঙ্গে বরফের ব্লক লাগিয়ে পরীক্ষা করেন গবেষকেরা। এ ছাড়া, তারা মানুষের চুল (যা একটি কৃত্রিম মাথার সঙ্গে যুক্ত ছিল) এবং পিএফএএস (পের-অ্যান্ড পলিফ্লুরোঅলকাইল সাবস্ট্যান্সেস) যুক্ত স্কি যন্ত্রপাতি নিয়েও এটি পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় নিজের চুল ব্যবহার করেন গবেষক জুলিয়ান ক্যারোলান।

গবেষণার প্রধান লেখক ক্যারোলান বলেন, ‘এটা খুবই অস্বস্তিকর ছিল। আমি এক সপ্তাহ ধরে আমার চুল খুব তৈলাক্তভাবে রাখতে হয়েছিল, যা দেখতে তেমন ভালো ছিল না। তারপর আমি আমার চুল যতটা সম্ভব স্কাল্পের কাছে ছেঁটে ফেললাম, যা খুবই কঠিন ছিল। কারণ চুল ছিল তৈলাক্ত।

পরীক্ষায় দেখা যায়, মেরু ভালুকের তৈলাক্ত লোম এবং পিএফএএস যুক্ত স্কি যন্ত্রপাতি বরফের সঙ্গে লেগে যাওয়ার থেকে প্রতিরোধ করে। অপরদিকে তেলযুক্ত মানব চুল এবং ধুয়ে ফেলা লোমের নমুনাগুলো বরফে লেগে যায়। মেরু ভালুকে লোমে থাকা ‘সেবাম’ বলে আখ্যায়িত করেন তেলকে বিজ্ঞানীরা। একটি রাসায়নিক বিশ্লেষণে জানা যায় যে, এটি কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য লিপিডের সংমিশ্রণ। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সেবাম থেকে এটি আলাদা।

গবেষকেরা এখন এই তেল থেকে পাওয়া সূত্র অনুসরণ করে পিএফএএস-মুক্ত কোটিং তৈরি করতে চান, যা দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশে থেকে যায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যদিও ব্যবহারিক প্রয়োগে কয়েক বছর সময় লাগবে।

কার্বন ও ফ্লুরিনের শক্তিশালী আণবিক বন্ধনের কারণে ননস্টিক রান্নার পাত্র, পানি প্রতিরোধী পোশাক, খাবারের প্যাকেজিং, ডেন্টাল ফ্লসসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে পিএফএএস। বিশ্বব্যাপী পিএফএএস বা ‘ফরেভার কেমিক্যাল’–এর ব্যবহার পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রাসায়নিকগুলো পানি, খাবার এবং অন্যান্য উপকরণের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে অবস্থান করে এবং জনস্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

তবে, মেরু ভালুকের তেলের এই নতুন বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এই গবেষণা ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত এবং টেকসই বিকল্প তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।

তথ্যসূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইউএস-বাংলার বহরে যুক্ত হলো তৃতীয় এয়ারবাস ৩৩০, এয়ারক্র্যাফট দাঁড়াল ২৫টিতে

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ল ১৫ শতাংশ, সঙ্গে শর্ত

আজকের রাশিফল: আপন গোপন তথ্য সামলে রাখুন, প্রচুর ভালোবাসুন

গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে এক দিনে ১৫৩ টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েল

যুগান্তকারী উদ্ভাবন: চোখে চিপ বসিয়ে দেখতে পাচ্ছেন দৃষ্টিহীনেরা

এলাকার খবর
Loading...