Ajker Patrika

গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে কাঁটা কি কমছে

আজাদুর রহমান চন্দন
গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে কাঁটা কি কমছে

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ‘বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো’ কর্মকর্তাদের মধ্যে ১১৯ জন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। গত মাসে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতিপূরণ পাবেন। ৫০ লাখ টাকা করে পাবেন—এমন কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক। যে কমিটির সুপারিশের আলোকে এই ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার সদস্যসচিব ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান। তাঁর নামও আছে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকায়। এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে নানা মহল থেকে। প্রশ্ন উঠেছে মোখলেস উর রহমানের ব্যাচ থেকে ৫০ জনের পদোন্নতি পাওয়া নিয়েও। বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চনার অজুহাতে ভূতাপেক্ষ সুবিধা নেওয়ার এমন হিড়িক দেশের বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও। প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ কর্মকর্তার স্ত্রী রাজধানীতে চাকরি করতেন। নিজ কর্মস্থলের কাছে স্ত্রীকে বদলি করিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় ওই তরুণ স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক কারণে তখন তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এই দাবি তুলে যথারীতি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে আর্থিক সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। এমন কাণ্ড আরও কত যে ঘটছে!

‘বঞ্চিত’ সরকারি চাকুরেদের ভাগ্যে নানা প্রাপ্তি ঘটলেও আমজনতা সেই তিমিরেই। তাদের প্রাপ্তির তালিকায় বরং যোগ হয়েছে ‘মব’ নামের নতুন আতঙ্ক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে ‘তৌহিদি জনতা’র নামে। এই আতঙ্ক অনেক বেশি নারীদের ক্ষেত্রে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে পথ দেখায়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকেই ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি করেছে এক দুর্বৃত্ত। তাঁকে থানায় দেওয়ার পর ‘তৌহিদি জনতা’র নামে থানা ঘেরাও করে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে বীরদর্পে। এর আগে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে দুই দিনব্যাপী বিক্ষোভ ও গরু জবাই এবং ডেইলি স্টার ভবনের গেট বন্ধ করে বিক্ষোভ ও জুমার নামাজ আদায় কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। আলোচিত প্রতিটি ঘটনায় কয়েক শ লোক জড়ো করে ‘মব’ তৈরির ক্ষেত্রে অভিন্ন কয়েকটি মুখ দেখা গেছে নেতৃত্ব দিতে। তৌহিদি জনতার নামে মব সৃষ্টির বিষয়ে দু-একজন উপদেষ্টা বিভিন্ন সময়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হওয়ার পর বাংলাদেশে দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বা মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়েছে মাস দুয়েক আগেই। এত দিনেও সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পেরেছে কি? শুরু থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত বলা হচ্ছিল, বিপর্যস্ত পুলিশ বাহিনী মনোবল ফিরে না পাওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এটিই কি একমাত্র কারণ? এখনো কি পুলিশ বাহিনী মনোবল ফিরে পায়নি? আমার মনে হয়, সমস্যাটা আসলে অন্যখানে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে আন্দোলনকালে এবং এর পরপর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর যে বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখনো উদ্ধার করা হয়নি পুরোপুরি। অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তখন কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। লুট হওয়া ওই সব অস্ত্র যে এখন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার প্রমাণ মিলেছে অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। ৩ মার্চ রাতে সাতকানিয়া উপজেলার ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় মসজিদের মাইকে ডাকাত আসার ঘোষণা দিয়ে দুই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ওই দুজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন এবং একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার মোহাম্মদ সালেক। চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার পরে সংবাদ সম্মেলনে জানান, ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যুর পর ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ যে পিস্তলটি উদ্ধার করেছে, সেটি নগরের কোতোয়ালি থানা থেকে লুট হওয়া। নিহত হওয়ার আগে ওই পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়েছিলেন নেজাম উদ্দিন। জামায়াতে ইসলামীর সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোছেনের তথ্যমতে, নিহত দুজন জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

সমস্যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনের এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আওয়ামী লীগের প্রায় হারিয়ে যাওয়া অর্থাৎ, দলীয় নেতাদের পলায়ন ও আত্মগোপন এবং দেশের ভেতরে দলটির কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে অনেকটাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় আছে বিএনপি। দলটি সামনে সরকার গঠনের অপেক্ষায় বলেও ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে। বিএনপির দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামী নিজেদের শক্তি সংহত করার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক অন্যান্য দলকে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গড়তে তৎপর। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারে। তাঁদের একজন অতিসম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে নবগঠিত একটি দলের নেতৃত্ব নিয়েছেন। এই শক্তিগুলোর মধ্যে কাকে রেখে কাকে সন্তুষ্ট রাখবে, তা নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন এখন খুবই দ্বিধান্বিত। কাঙ্ক্ষিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই দ্বিধা ও টানাপোড়েনের অবসান হবে বলে মনে হয় না।

নতুন করে টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে বিএনপি, জামায়াত ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে। জাতীয় নির্বাচন কবে হওয়া উচিত, সে নিয়েই এই দ্বন্দ্ব। বিএনপি শুরু থেকেই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছে। জামায়াতে ইসলামী চাইছে, সংস্কার শেষে ‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে নির্বাচন। দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও পক্ষে। অন্যদিকে এনসিপিও আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়ে গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছে। এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম সম্প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের কথা যেন কেউ মুখেও না নেয়। খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে না দেখা পর্যন্ত এই বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ বিএনপি এসব বিষয়কে দেখছে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, নির্বাচনের পর বিচার তো থেমে যাবে না। এক নেতা বলেছেন, ‘যারা গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনছে, হয় তারা বোঝে না অথবা বুঝলেও আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে, স্থানীয় নির্বাচন করতে গেলেই জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই সরকারের ম্যান্ডেটের মধ্যে তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন নাই। তারা করবে জাতীয় নির্বাচন। তারা যদি স্থানীয় নির্বাচনই করতে চায়, তাহলে শুধু স্থানীয় কেন, ট্রেড বডিগুলোর নির্বাচনও তারা করুক, মসজিদ কমিটির নির্বাচন করুক, আরও যত কমিটি আছে, সবগুলোর নির্বাচন করে তারপর জাতীয় নির্বাচন দিক!’

আগামী ডিসেম্বরে কিংবা পরের বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ এতটা সংক্ষিপ্ত না-ও হতে পারে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার নামে মব তৈরি করে কোথাও তল্লাশি কিংবা তৌহিদি জনতার নামে নারীকে হেনস্তা করার পাশাপাশি কোনো কোনো মহল থেকে নানা ইস্যু সামনে আনা এই সন্দেহ সৃষ্টির বড় কারণ। নতুন দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি মন্তব্য এই সন্দেহকে আরও বাড়িয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো জননিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। এ অবস্থায় চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন। সরকার বা তার নিয়ন্ত্রক কোনো মহল যদি দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আন্তরিক না হয়, তাহলে মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, বাস্তবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অজুহাত তৈরি করাটা মোটেই কঠিন কিছু নয়।

আজাদুর রহমান চন্দন, সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত