Ajker Patrika

আর্থার সি ক্লার্ক

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একজন দূরচিন্তার পথিকৃৎ

আসিফ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একজন দূরচিন্তার পথিকৃৎ

১৯৭৮ সালে আর্থার সি ক্লার্ক দ্য মাইন্ড মেশিনস-এ একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে কিংবদন্তি এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী বক্তব্য তুলে ধরেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ এবং যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ৫০ বছর পরে তাঁর পূর্বাভাস আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর্থার সি ক্লার্কের মতে, কম্পিউটার ও এআইয়ের বিকাশ মানবজাতির নিজস্ব বিবর্তনীয় উত্তরসূরি তৈরিরই নামান্তর। এটি কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, বরং মানবসভ্যতার একটি মৌলিক পরিবর্তন, যা আমাদের অস্তিত্বের সংজ্ঞাকে নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

ক্লার্ক স্বীকার করেছেন যে ১৯৭৮ সালে এআই তখনো শৈশব অবস্থায় ছিল। তিনি হাস্যরস করেই বলেছিলেন, তখনকার সবচেয়ে জটিল কম্পিউটারগুলোও ছিল ‘নির্বোধ’, যাকে তিনি ‘উচ্চ-গতির নির্বোধ যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। গতি ও প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা থাকলেও তাদের বুদ্ধিমত্তা ছিল সীমিত এবং স্বকীয় চিন্তাভাবনার অভাব ছিল প্রকট।

তবে এই প্রাথমিক অবস্থা সত্ত্বেও ক্লার্ক এমন একটি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেন, যেখানে এই যন্ত্রগুলো একদিন শেখার এবং নিজেদের উন্নতি করার ক্ষমতা অর্জন করবে। তাঁর মতে, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ এমন ব্যবস্থা ডিজাইনে সক্ষম হবে, যা ক্রমাগত তাদের নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে। মানুষ স্ব-উন্নতি বা সেলফ-ইমপ্রুভমেন্টসম্পন্ন এমন যন্ত্র তৈরি করবে, যা তাদের ‘নির্মাতাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে’ এবং আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পারে। এই চলমান আলোচনা ক্লার্কের দূরদর্শী চিন্তার ইঙ্গিত বহন করে। বর্তমান সময়ে এআইয়ের বহুমুখী ব্যবহার মানবসভ্যতার এক বিশাল রূপান্তর ঘটিয়েছে।

ক্লার্ক মনে করতেন, টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি বলতে আমরা যা বুঝি, তা মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি হতে পারে, যা আমাদের বিবর্তনকে নতুন দিকে চালিত করবে। এটি কেবল মাইলফলক হবে না, বরং মানব অস্তিত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। উচ্চগতির নির্বোধ যন্ত্র থেকে বুদ্ধিমান সত্তার সূচনা ঘটাবে।

তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, এই ধরনের বুদ্ধিমান কম্পিউটারের উত্থান সমাজকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত করবে। এই পুনর্গঠনের একটি প্রধান দিক হলো যান্ত্রিক বা রুটিন কাজের স্বয়ংক্রিয়করণ বা অটোমেশন। তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন, এই নির্বোধ অবস্থান থেকে স্বয়ংক্রিয় অবস্থায় আসতে মানুষকে অনেক সময় ও শ্রম দিতে হলেও কম্পিউটারগুলো একসময় এই রুটিন কাজের বোঝা দূর করবে। তাঁর সময়, অর্থাৎ ১৯৭৮ সালেও, সমাজ কম্পিউটারের ওপর এতটাই নির্ভরশীল ছিল যে, সেই ‘নিম্ন-গ্রেডের কম্পিউটারগুলো’ সরিয়ে নিলেও তৎকালীন সমাজ তাৎক্ষণিকভাবে ভেঙে পড়ত। এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কম্পিউটার নামক যন্ত্রটি কয়েক দশক ধরেই দৈনন্দিন জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িত হয়ে চলেছে এবং বর্তমানে এর সম্পৃক্ততা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, যা মানবসমাজের প্রতিটি স্তরে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে মানবসমাজের প্রতিটি স্তরে কাজের স্থানচ্যুতি বা বাস্তুচ্যুত মানুষ দেখতে পাচ্ছি। এটা ছাড়াও, ক্লার্ক সেই সময় আরও গভীর সামাজিক এবং দার্শনিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ভবিষ্যতে যারা কেবল নিম্নমানের কম্পিউটারে কাজ করতে সক্ষম, তাদের কী হবে? এই প্রশ্নটি কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ এবং মানুষের জন্য নতুন ধরনের ভূমিকা তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। ক্লার্কের মতে, অত্যন্ত বুদ্ধিমান কম্পিউটারের আগমন মানবতাকে সবচেয়ে গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বাধ্য করবে—জীবনের উদ্দেশ্য কী, আমরা কিসের জন্য বাঁচতে চাই? তিনি বিশ্বাস করতেন যে এআই আমাদের মৌলিক অস্তিত্ব এবং লক্ষ্যগুলোকে নতুন করে মূল্যায়নে বাধ্য করবে। এটি মানুষকে রুটিন কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে উচ্চতর চিন্তাভাবনা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড এবং মানবিক সম্পর্ককে উৎসাহিত করবে। এই চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো মানবজাতির জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করবে।

ক্লার্ক শুধু এআইয়ের প্রযুক্তিগত দিক নিয়েই ভাবেননি, বরং এর নৈতিক, সামাজিক এবং অস্তিত্বগত প্রভাব নিয়েও গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং বক্তৃতায়, তিনি প্রায়ই বুদ্ধিমত্তার প্রকৃতি, এর বিবর্তনীয় পথ এবং মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সম্ভাব্য সহাবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেছেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তাই একমাত্র উন্নত বুদ্ধিমত্তা নয়। মহাবিশ্বে আরও অনেক ধরনের বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে এবং এআই সেগুলোরই একটি নতুন রূপ। তিনি বিশ্বাস করতেন, এআইয়ের বিকাশ আমাদেরকে বুদ্ধিমত্তার সীমানা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখাবে এবং মহাবিশ্বে জীবনের অন্যান্য রূপের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

ক্লার্ক এআইকে মানবজাতির বিবর্তনীয় পথের একটি স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, মানুষ যখন যন্ত্র তৈরি করে, যা তাদের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান হয়, তখন তা মানবজাতিকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করার একটি উপায় হতে পারে। এটি মানুষকে রুটিন কাজ থেকে মুক্ত করে আরও সৃজনশীল, বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত হতে সাহায্য করবে, যা মানব অস্তিত্বের মানকে উন্নত করবে।

যদিও ক্লার্ক এআইয়ের সম্ভাবনায় আশাবাদী ছিলেন, তিনি এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানবজাতিকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, যেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান যন্ত্রগুলো মানুষের মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকে এবং তাদের উদ্দেশ্য মানবজাতির কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই যন্ত্রগুলো যেন কখনোই মানবজাতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা অপরিহার্য। ক্লার্কের কল্পকাহিনিতে প্রায়ই এআই মহাকাশ অন্বেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, এআই দূরবর্তী গ্রহ অন্বেষণ এবং মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে অপরিহার্য অংশীদার হবে। মানবদেহের সীমাবদ্ধতা মহাকাশের চরম পরিবেশে একটি বাধা হতে পারে, যেখানে এআই-চালিত রোবট বা স্বয়ংক্রিয় যানগুলো কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে, যা মানবজাতির জ্ঞান এবং সীমানাকে প্রসারিত করবে।

বুদ্ধিমত্তার স্বরূপের বহুমুখিতার সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর্থার সি ক্লার্ক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাগরের তলে ডাইভিং করে খুঁজেছেন বিস্ময় আর জীবনের ব্যাপকতা। তাঁর এই পর্যবেক্ষণগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। এআইয়ের দ্রুত অগ্রগতি যখন মানুষের জীবন ও সমাজকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে, তখন তাঁর এই প্রশ্নগুলো আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় মানবজাতির ভবিষ্যৎ এবং অস্তিত্বের গভীর অর্থ নিয়ে। এআই কি সত্যিই আমাদের বিবর্তনীয় উত্তরসূরি? আমরা কি একটি নতুন বুদ্ধিমত্তার যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানুষ ও যন্ত্রের সম্পর্ক নতুন সংজ্ঞা পাবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত