Ajker Patrika

উন্নত বিশ্বের চাওয়া-পাওয়া পাল্টে গেছে

আব্দুর রাজ্জাক 
আধুনিক ডিভাইস তৈরিতে প্রয়োজন ‘রেয়ার আর্থ মেটাল’, যা উন্নত বিশ্বের চাওয়া। ছবি: পেক্সেলস
আধুনিক ডিভাইস তৈরিতে প্রয়োজন ‘রেয়ার আর্থ মেটাল’, যা উন্নত বিশ্বের চাওয়া। ছবি: পেক্সেলস

একসময় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, আরও যত শক্তিধর রাষ্ট্র ছিল তারা ছোটখাটো দেশ দখল করে যেসব কাজ করত, কালের বিবর্তনে সেগুলোর ধরন পাল্টে গেছে। একসময় তারা আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর থেকে সস্তা শ্রম নিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো কাজে লাগাত।

ব্রিটিশরা আমাদের দেশ দখল করে নীল চাষ থেকে শুরু করে লবণ চাষ পর্যন্ত করিয়েছে জনগণকে দিয়ে, তাদের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করিয়ে সেগুলো উৎপাদন করে নিয়ে গেছে। সেই সময় জনমত উপেক্ষা করে চা-বাগান করেছে। অর্থাৎ স্থানীয় জনগণের চাহিদাকে কোনো সময়ই তারা মূল্য দেয়নি। বিভিন্ন দেশ দখল করে তারা মূল্যবান খনিজ সম্পদ নিয়েছে একসময়। তারপর তারা বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে তেল নিয়েছে। পরবর্তীকালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে মূল্যবান ধাতু, ইউরেনিয়ামসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ লুটে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। দুই দশক আগে কোনো এক সময় সুদান থেকে শত শত বছরের পুরোনো কাঠ পর্যন্ত তারা নিয়ে গিয়েছে।

পৃথিবী পাল্টে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে নতুন নতুন পণ্যের। বর্তমান কম্পিউটারের যুগে যেসব ডিভাইস ব্যবহৃত হয়, তার যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যেসব ধাতুসহ অন্যান্য দ্রব্যের দরকার হয়, তার সন্ধানে নেমেছে পশ্চিমা বিশ্বসহ আমেরিকা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পশ্চিমাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকদের বলেছে, তোমরা কাজের পারিশ্রমিক পাবে, এই পারিশ্রমিক দিয়ে ধীরে ধীরে সম্পদের মালিক হবে, জমির মালিক হবে।

এসব ফাঁকা বুলি শত শত বছর পুরোনো। কারণ, আগেও ব্যবসায়ীরা উৎপাদন করাত তাদের চাহিদা অনুসারে, আবার উৎপাদিত পণ্য তারাই কিনে নিত। এখানে শ্রমিকদের কোনো প্রতিবাদ করার উপায় ছিল না। সারা জীবন শ্রমিকেরা দাস হিসেবেই থেকে গেছে। দৃষ্টিনন্দন ছোট ছোট দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনো ব্যবহার করে ওই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ‘ট্যুরিস্ট স্পট’ হিসেবে।

আসল কথা বলার আগে ছোট্ট একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। ছোটবেলায় আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিনের একটি ছোটগল্প পড়েছিলাম—‘নীল গাইয়ের সন্ধানে’। গল্পটি বিশ্লেষণ করলে এই দাঁড়ায় যে, বনাঞ্চলে নীল গাই পাওয়া যায়, সেখানে পাহাড়ি জনগণ নির্দিষ্ট জামাকাপড় পরে এই নীল গাই শিকার করে রাতে। ভদ্রলোকদের মতো আধুনিক পোশাক পরে অস্ত্র নিয়ে শিকারে গেলে নীল গাই শিকার করা যায় না। অর্থাৎ, পরিবেশ ও কাজ অনুযায়ী মানানসই পোশাক ব্যবহার করতে হয়, সেই সঙ্গে কথাবার্তা, আচার-আচরণও পরিবেশ বুঝেই করতে হয়।

বর্তমান বিশ্বে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়। এইসব প্রযুক্তি তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থের প্রয়োজন। লোহা, তামা, সিসা, সোনা, অ্যালুমিনিয়াম—এইসব প্রচলিত ধাতুর পাশাপাশি সূক্ষ্ম ডিভাইস তৈরির জন্য ‘রেয়ার আর্থ মেটাল’ দরকার পড়ছে এখন। ১০০ বছর আগে হয়তো এইসব মেটালের তেমন একটা প্রয়োজন পড়ত না। বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে, এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর কোন অঞ্চলে কোন ধরনের ধাতু আছে, এটা মোটামুটি নির্ণয় করা যায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে ইউরেনিয়ামের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকা হন্যে হয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল তাদের শক্তি প্রদর্শন করে অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। ১০০ থেকে ১৫০ বছর আগে তারা এ রকমভাবেই উত্তোলন করে নিত সোনা ও প্লাটিনাম।

মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, মহাকাশযান ও এর বিভিন্ন ডিভাইস বানানোর জন্য এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দরকার রেয়ার আর্থ মেটাল। এইসব মেটাল আছে সাইবেরিয়া, রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। আরও আছে চীনে, বিশেষ করে চীনের দক্ষিণ দিকটা—যার কিছুটা অঞ্চল পড়েছে মিয়ানমার এবং রাখাইনের মধ্যে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন, এই রেয়ার আর্থ মেটালের ১২ শতাংশ আছে মিয়ানমারের দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বেশির ভাগ জায়গা হলো রাখাইনে। রাখাইনের ওপরে বিশ্বের পরাশক্তির এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মূল কারণ এটাই।

এইসব অপ্রচলিত ধাতু অর্থাৎ রেয়ার মেটালের মধ্যে আছে ক্যাডমিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল ইত্যাদি। এইসব মেটাল ওজনে হালকা হতে হবে, সঙ্গে খুবই মজবুত হতে হবে। অতি অল্প বিদ্যুৎও যেন এইসব মেটালের মধ্য থেকে পরিবাহিত হতে পারে নিখুঁতভাবে। যার গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। একটু ছোট, ব্যবহারযোগ্য, কিন্তু দামে অনেক বেশি। তাই তো বর্তমানে এই রেয়ার মেটালের কদর বেড়ে গেছে পশ্চিমাদের কাছে। হন্যে হয়ে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত খুঁজছে তারা।

কোনো জাতি, শক্তি বা পরাশক্তি কিংবা ক্ষমতাধর কোনো রাষ্ট্র বিনা লাভে কোনো কিছুতে বিনিয়োগ করে না। কোনো জাতিকে উন্নত করার জন্য, পশ্চাৎপদ জাতিকে আধুনিক করার জন্য কারও দায় নেই। নিজের স্বার্থে বিনিয়োগের কয়েক গুণ বেশি লাভ না করতে পারলে কোনো অনগ্রসর অঞ্চলে তারা টাকা ঢালবে না।

তবে পশ্চিমা পরাশক্তিরা ১০০ বছর পর কী দরকার হবে, সেটা মাথায় নিয়ে সবকিছু পরিকল্পনা করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যে যুদ্ধ বেধেছে, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনকে

শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করে সেখানে পশ্চিমা শক্তি ভর করে কোনো এক সময় রাশিয়াকে ভেঙে দেওয়া, সাইবেরিয়া অঞ্চল আলাদা করা—আগেই উল্লেখ করেছি সেখানে আছে রেয়ার আর্থ মেটাল। হয়তো ৫০ বছর বা ১০০ বছর পরে, সেটা বিভিন্ন ছলেবলেকৌশলে পশ্চিমাদের চাই। অত্যাধুনিক সূক্ষ্ম দামি যন্ত্রপাতি তৈরিতে অবশ্যই দরকার হবে সেই ধরনের মেটালের।

অপেক্ষার দিন গুনছি, কবে আমাদের সম্পদ আমরাই ব্যবহার করব। সে জন্য হয়তো দরকার দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের।

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাস্তায় নারীকে চড় মেরে বাইকচালক বললেন, ‘নিজের দেশে ফিরে যাও!’

ইরানের জন্য ইসরায়েলকে বিসর্জন দেবে রাশিয়া?

নেতানিয়াহু বাংকারে লুকিয়ে, ট্রাম্পের একটি ফোনকলই যথেষ্ট: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইরানের ভান্ডারে কত ক্ষেপণাস্ত্র আছে—কত দিন যুদ্ধ চলবে এতে

মেয়াদের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পরিকল্পনা সরকারের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত