Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

প্রতিটি বিষয়ের একটা শেষ থাকতে হয়

আবুল কাসেম ফজলুল হক

আবুল কাসেম ফজলুল হক শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শিক্ষার্থীদের নতুন দল গঠন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৫, ১৫: ২২

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বাংলাদেশের রাজনীতি রাজনৈতিক নেতাদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। আগে দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ক্রাইসিসের সময় সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করত। এ সময়ের অন্তর্বর্তী সরকারও সেনাবাহিনীর সরকার না। এ সরকার হলো সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সরকার।

বর্তমানে মানুষের কাছে নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কীভাবে খেয়ে-পরে বাঁচবে? এ আশঙ্কাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত। সাধারণ মানুষ ক্রমাগত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান খুব দুর্বল। অন্যদিকে কৃষকেরা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করছেন এবং শ্রমিকেরাও কলকারখানায় কাজ করছেন। এতে কৃষিতে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু রাজনীতিতে রাজনীতিবিদেরা কোনো উন্নতি ঘটাতে পারছেন

না। তাঁরা নিজেদের উন্নয়নের বিষয়টা বিবেচনায় নেননি। এ কারণে জনগণ থেকে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ক্ষমতা চলে গেছে সুশীল সমাজের হাতে। এটাই হলো আমাদের দেশের এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা।

এটা কী কারণে হলো?

মানুষের অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। আবার মানুষের মধ্যে অনেক ধরনের ভালো গুণও থাকে। যেমন সাহস, বুদ্ধি ইত্যাদি। আবার শ্রম ও চিন্তাশক্তির জোরে মানুষ ভালো কাজ করতে পারে। ভালো ও মন্দের এই বিরোধ ব্যক্তি মানুষের মধ্যে আছে। যে কাজ করবে না বলে মানুষ প্রতিজ্ঞা করে, অনেক সময় সেই কাজ করে ফেলে। আবার অনেক সময় যে কাজ করার প্রতিজ্ঞা করে, সেই কাজ করতে পারে না। এর মধ্যে কেউ কেউ ভালোটা অনেক বেশি করতে পারে এবং মন্দ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

তেমনি যাঁরা কোনো জাতি ও সমাজকে নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের হতে হবে উন্নত চরিত্রের, সাধারণ মানুষ যাতে তাঁদের কাজ আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতে পারে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে গুণাবলি, সেটার কোনো চিন্তা ও চর্চা নেই। বহু বছর ধরে শুধু ভোটাভুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এভাবে তো রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ হবে না। এ ছাড়া এ দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে রাজনীতি কি ফিরে আসবে না? এ কারণে নির্বাচনের কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছে। যদি রাজনীতিবিদের চরিত্র উন্নত না হয়, তাহলে রাজনীতির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই।

শিক্ষার্থীদের নতুন দল নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

নতুন দল নিয়ে আমার বক্তব্য হলো, সামনে যা দেখা যাচ্ছে, সেটা সব না। আমরা অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি না, সে ব্যাপারটা এদের মধ্যে আছে। এ জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। তবে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজন খুব দরকার। এ দেশে যাঁরা মার্ক্সবাদী রাজনীতি করেন, তাঁরা সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেন। কিন্তু তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা সেভাবে বলেন না। ফলে তাঁদের বক্তব্য অনেকটা বিমূর্ত থেকে গেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার বা পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়, সেটা জনগণকে বোঝালে জনগণ বুঝত।

জাতীয় নাগরিক পার্টি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির চেয়ে একটা সুশৃঙ্খল পার্টি গঠন করতে চাইছে জনগণের কল্যাণে। কিন্তু সমস্যা অনেক জটিল। রাজনীতি আসলে সহজসাধ্য বিষয় না, অনেকটা কঠিন। যারা কায়েমি স্বার্থবাদী, তাদের রাজনীতি একরকম, সেটা চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। তারা একটা পদ্ধতিতে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং দেশবাসীকেও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। আর ক্ষমতায় গিয়ে স্বার্থ রক্ষা করে অল্প কিছু ধনী লোকের। কিন্তু আমাদের দেশেও ভালো কোনো সিস্টেম দাঁড়াল না। এর কারণ হলো, আমাদের জাতীয় রাজনীতির পুরো ইতিহাস থেকে জানা যায় পরনির্ভর রাজনীতি। বিদেশিরা এখানে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আমাদের দেশের দলগুলো পরনির্ভরতা থেকে কেন বের হতে পারছে না?

পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো থেকে দেশকে রক্ষা, জনগণকে রক্ষা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মনোভাব শাসকশ্রেণির কোনো দলের মধ্যেই নেই। সেনাবাহিনী বা আমলাতন্ত্রের মধ্যেও নেই। আমাদের দেশের সব মানুষ খারাপ হয়ে গেছে, এ ধারণা করাটাই ভুল। কিন্তু যারা কর্তৃত্ব করে ক্ষমতার চর্চা করে, তখন সেই খারাপ দিকটা বের হয় বেশি।

রাজনীতিবিদদের জানা-বোঝার মান খারাপ হওয়ার কারণে ইউরোপীয় ও আমেরিকান শক্তিগুলো বেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ইউনূস সাহেবের নেতৃত্বে যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে, তাঁরা কিছু ভালো কাজ করতে চান। এ জন্য তাঁরা প্রায় ১৫টি সংস্কার কমিটি গঠন করে রাষ্ট্রকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। একটা প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার কাদের স্বার্থে? এতে কিছু লোক নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করবে। তারা কারা? এগুলোকে চিহ্নিত করা দরকার।

এই বাস্তবতায় আমাদের নেতাদের ইতিহাসের যে জ্ঞান থাকা দরকার, সেটা তো তাঁরা চর্চা এবং জানারও চেষ্টা করেন না।

জাতীয় নাগরিক পার্টি সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে, সেটা কতটা যৌক্তিক?

তারা তো সেকেন্ড রিপাবলিক কথাটার মানে কী, সেটা ব্যাখ্যা করে বলেনি। তারা সেটা যদি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করে জনগণের কাছে, তাতে তো তাদের বক্তব্য স্পষ্ট হবে না। তারা সেটা যদি স্পষ্ট করে, তাহলে জনগণ সেটা বুঝতে পারবে। এ জন্য এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।

আপনি দীর্ঘ সময় ধরে বলে আসছেন, আমাদের দেশের বড় দলগুলো বিদেশি দূতাবাসকেন্দ্রিক রাজনীতি করে থাকে। দেশে পটপরিবর্তনের পর কি সে অবস্থার কোনো রকমফের দেখতে পাচ্ছেন?

একটা প্রক্রিয়া চলতে থাকলে সেটাকে হঠাৎ করে বদলে ফেলা যায় না। কিন্তু বদলে দেওয়ার চেষ্টা থাকলে একসময় সেটা বদলে দেওয়া যায়। কোনো রাজনৈতিক দল যা কিছু করতে চায়, সেটার জন্য জনগণকে জাগিয়ে দিয়ে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতি করা দরকার। আমি মনে করি, এটাই হলো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতার কর্তব্য। সে জায়গায় তো আমাদের রাজনীতিবিদদের কোনো চিন্তাভাবনা দেখতে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে সত্তরের দশকের পর থেকে সেটা পাওয়া যায় না। এরশাদবিরোধী আন্দোলন যে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে, সেখানে কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আলাদা ও নতুন কোনো বক্তব্য ছিল? ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’?—এই একটা স্লোগান নিয়ে তো তারা আন্দোলন করেছে। তারা এরশাদকে উৎখাত করতে পেরেছে, কিন্তু তারা কোনো উন্নত শাসনব্যবস্থার নির্দেশনা দিতে পারেনি।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ অন্য কিছু দলের প্রতি জনগণের গভীর আস্থা আছে বলে আমার মনে হয় না। সবটাই ওপরভাসা। সারা দেশে এসব দলের কর্মী-নেতা আছে। কিন্তু প্রকৃত জনসমর্থন বলতে যেটা বোঝায় সেটা আছে কি না, সেটা আমার সন্দেহ। সর্বজনীন কল্যাণের জন্য রাজনীতি নেই বললেই চলে। তারা গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু গণতন্ত্র কী ও কেন? সেই ধারণা জনগণের কাছে এসব পার্টি কখনো দেয়নি। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের এ সম্পর্কে কিছু চিন্তা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও এসব নিয়ে জনগণের কাছে কোনো বক্তব্য হাজির করেননি।

এখানে সব সময় নির্বাচন ছিল সন্দেহের বিষয়। কোনো দলকে জয়ী করা এবং কোনো দলকে হারিয়ে দেওয়া—এই উদ্দেশ্যে নির্বাচন কাজ করেছে। আবার এটাতে নানাভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করা হয়েছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে এসব দল যে আস্থাভাজন হতে পারেনি, সে কারণে একটা রাজনীতির শূন্যতা এখানে আছে। সেই শূন্যতা থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এটা হলো সময়ের দাবি। আমি সব সময় চেয়েছি রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে বক্তব্যগুলো আসুক। তারা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বাস্তবতা লক্ষ করে বলুক—আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার এই এই সংস্কার ও পরিবর্তন দরকার। আমি নিজে ৩১ দফা বক্তব্য নিজের টাকায় ছাপিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সেটার কোনো মূল্যই দেয়নি। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে সবার কাছে সেই পুস্তিকাটি পাঠানো হয়েছিল।

এরপর বিএনপির তো কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নেই। তারা অনেক বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। তারা কী লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করছে এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী, সেটা তারা দেয়নি। তারা ৩১ দফা নামে একটা কর্মসূচি দিয়েছে। এটা আমার কাছে মনে হয় ড. কামাল হোসেন দল গঠনের সময় যে রকম বক্তব্য দিয়েছিলেন, অনেকটা সেই ধরনের। দুনিয়ার তাবৎ ভালো কথা সে বক্তব্যে থাকে, কিন্তু কীভাবে করা যাবে এবং কেন করা হবে, সে রকম কোনো স্পষ্ট কথা নেই। ফলে কামাল হোসেনের দল গঠনের চেষ্টা যেমন সফল হয়নি, তেমনি বিএনপির ৩১ দফার মধ্য দিয়ে তাদের রাজনীতি সফল হবে, সেটা আমার মনে হয় না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর পেশার জায়গায় সফল হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সফল বলে মনে করেন কি?

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সেটা রাজনীতির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। বই পড়ে কিছুটা হয়। বই পড়ে যে কিছুটা হয়, সেটা তাঁর মধ্যে আছে। আরও বৃহত্তর পরিসরে গভীরভাবে দেখে রাষ্ট্রের কী পরিবর্তন করতে হবে—এ ধারায় তো বিশেষ কিছু চিন্তা করছেন না। তিনি একধরনের আদর্শ এনজিওর কথা বলেছেন। সেটা তো আমাদের মন্ত্রীদের দিকে তাকালে বোঝা যায়, তাঁরা অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। এসব করতে কোথায় ও কীভাবে টাকা পেলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেন না। এ রকম একটা বাস্তবতার মধ্যে সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে তারা একধরনের সমর্থন পাচ্ছেন ও পাবেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে ভালো কিছু কাজ করে জনগণের সমর্থন অব্যাহত রাখতে পারবেন, সেই সম্ভাবনাও তো দেখা যাচ্ছে না।

বিএনপি তাড়াতাড়ি নির্বাচন চাইছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে। আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?

এখানে কোনোটাই বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো না। এগুলো তো তাদের কথা। তারা কী করতে চায়, সেটা তো তাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যাবে। যারা আদর্শগত রাজনীতি করে এবং নীতিনিষ্ঠ তাদের সম্পর্কে বলা যায়, এটা এ রকম হবে বা হবে না ইত্যাদি। কিন্তু এদের কোনো আদর্শ নেই। আর একটা কথা, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তো শেষ কথা না থাকলে সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো কথা বলা যায়। তবে প্রতিটি বিষয়ের একটা শেষ কথা থাকতে হয়। ইংরেজের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করেছি। কেন করেছি? করেছি তাদের শাসনের অবসান চেয়েছিলাম এবং নিজেদের জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। একটা স্পষ্ট বক্তব্য ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তো সে রকম কোনো নির্দেশনা দেখতে পাচ্ছি না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বহুজাতিক কোম্পানির খপ্পরে কৃষি

আবু তাহের খান 
জিএমও বীজ কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। ছবি: সংগৃহীত
জিএমও বীজ কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।

কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।

১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।

একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।

যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।

মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?

বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।

উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।

প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।

অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।

দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ক্রিনের আড়ালে নিঃসঙ্গতা

মাহফুজা খাতুন
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।

একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?

গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।

যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।

মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।

ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।

তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।

আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নেদারল্যান্ডসের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির অনুশীলন

শাইখ সিরাজ
তরুণ উদ্যোক্তা ইয়নের সঙ্গে ক্যাপসিকাম খামারে লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
তরুণ উদ্যোক্তা ইয়নের সঙ্গে ক্যাপসিকাম খামারে লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।

এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।

পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।

প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।

একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।

তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?

পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।

অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’

ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।

ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’

তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।

সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!

এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।

আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই

সম্পাদকীয়
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।

কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।

কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?

ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।

মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত