Ajker Patrika

স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যালট ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা 

আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ১৬
স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যালট ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা 

১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরই ডাকসু বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে প্যানেল দিয়ে অংশ নিয়েও জয়লাভ করতে পারেনি। অথচ এক বছর আগে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। বাহাত্তরের ডাকসু নির্বাচনে জয়ের পর ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমছিল, আর বাড়ছিল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের। স্বাধীন দেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের যে ডাক ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি বা বলা যায়, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়ে চলাটা ছাত্ররা ভালোভাবে নেয়নি। বরং ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগের সরকার তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী গরম গরম বক্তব্য সাধারণ ছাত্রদের বেশি আকর্ষণ করতে থাকে। রোমান্টিকতা তারুণ্যের ধর্ম- এটা অস্বীকার করা যায় না।

একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমাদের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সলিমুল্লাহ খান। তিনি বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ভালো ছাত্র এবং জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সলিমুল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলাভবনে চক্কর দিতেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর স্বাধীন ও ভিন্ন চিন্তার জন্য তখন অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে ‘হিরো’ ছিলেন। ছফা ভাই সলিমুল্লাহ খানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন ‘সলিমুল্লাহর মতো মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনো আসেনি’। সলিমুল্লাহর কারণেও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জাসদ ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকতো বলে আমার ধারণা।

একসময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রগতিশীল ধারার প্রতি আকর্ষণ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের নামে আরও একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করার পর মেধাবীদের একটি অংশ ওদিকে চলে যায়, ছাত্র ইউনিয়নে কিছুটা মেধার সংকট দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি গুলিতে দুই কর্মীর মৃত্যু ও কয়েকজন আহত হওয়ার পর ছাত্র ইউনিয়ন আকস্মিকভাবে জ্বলে ওঠলেও আবার দপ করে নিভে যায়। এটা অনেকের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের ‘আত্মসমর্পণ’ বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পাল্টা হামলা মোকাবিলায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব ‘সিপিবির পরামর্শে’ ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে বলে, এমনকি, ছাত্র ইউনিয়নের অনেক কর্মী ও সাধারণ সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেছে। যেভাবে ও যেসব যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটাও সাধারণ ছাত্ররা পছন্দ করেনি। স্বাধীনতার পর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজে হাত দিলেও কিছু মহলের ক্রমাগত অপপ্রচার বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কেও ভুল ধারণা তৈরি করতে থাকে। তাঁর অতি উদার মানবিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো অবাধে ষড়যন্ত্র-নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের একটি অংশও এমন সব কাজে জড়াতে থাকেন, যেটা মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করতে থাকে। নবসৃষ্ট জাসদ নেতৃত্ব এবং প্রবীণ নেতা মওলানা ভাসানীসহ আরও নানা শক্তির কঠোর মুজিববিরোধী ও ভারতবিরোধী রাজনীতি দেশের ভেতর একটি গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তোলে।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর, থানা-ফাঁড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশার শিকার তরুণদের একাংশ বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হয়। সুযোগ নেয় রাজাকার আলবদর আলশামসের সদস্যরাও।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সারাদিন ভোট গ্রহণ হয়। ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ উল আলম লেনিন এবং জিএস পদে ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। সংক্ষেপে বলা হতো লেনিন-গামা পরিষদ। অন্যদিকে ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ। ভিপি পদে আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জিএস পদে জহুর হোসেন।

নির্বাচনী প্রচার দেখে মনে হয়েছিল, লেনিন-গামা পরিষদের বিজয় ঠেকায় কে! কিন্তু আসলে তা হয়নি। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী- সমর্থকেরা খুব ভালোভাবে নেয়নি বলেই আমার ধারণা। হয়তো বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির পছন্দের বাইরে হতো না, তাই ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের মনোভাবের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে যৌথ প্যানেলে নির্বাচনে গিয়েছিল। এতে ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রশংসিত হয়নি। আবার ছাত্রলীগের মধ্যেও ছাত্র ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল। ফলে বাইরে বাইরে যৌথ প্যানেল নিয়ে যেরকম রমরমা ভাব ছিল, ভেতরে ভেতরে তেমন ছিল না।

অন্য হলের কথা আমি ভালো জানি না, কিন্তু জগন্নাথ হলে আমি ঐক্যবিরোধী মনোভাবই প্রবল দেখেছি। যৌথ প্যানেলের পক্ষে কর্মীদের বোঝানোর জন্য একাধিক মিটিং জগন্নাথ হলে হয়েছে। তার একটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও উপস্থিত ছিলেন। আমি ওই সভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখিছি, সেলিম ভাইয়ের মতো তুখোড় নেতা, যিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় ছিলেন অতুলনীয়, তাঁকেও সাধারণ কর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না মেনে উপায় নেই বলেই যৌথ প্যানেল হয়েছিল কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এটা মেনে নেননি। জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন শক্তি ছিল মজবুত। এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া অন্য সংগঠন থাকলেও সদস্য-সমর্থক বেশি ছিল না। একক নির্বাচন করলেও এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয় ছিল নিশ্চিত। এই অবস্থায় ছাত্রলীগকে আসন ছেড়ে দিতে আপত্তি ছিল সঙ্গত।

সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এমন মনোভাব কেন তৈরি হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা না করাটি ছিল তখন একটি বড় ভুল। দেশে তখন দ্রুত এমন সব ঘটনা ঘটছিল যা ছিল অপ্রত্যাশিত। উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণের কারণে ছাত্রলীগের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিরোধ ছিল, গ্রুপিং ছিল। স্বাধীনতার পর শফিউল আলম প্রধানকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। শফিউল আলম প্রধানের বাবা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা। তিনি শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্পিকার ছিলেন।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই পর্যায়ে হঠাৎ মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প সময় পরই আমিও বাংলা বিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি যে এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম তা নয়। কারণ যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমার ভয় ছোটবেলা থেকেই। আমি স্কুলে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। বিস্কুট দৌড় নামে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। আমি এই ভেবে অংশ নিয়েছিলাম যে পুরস্কার না পেলেও দড়িতে ঝোলানো একটি বিস্কুট অন্তত মুখে পুড়তে পারব! অবশ্য ওই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগী কম থাকায় একটি পুরস্কার আমিও পেয়েছিলাম। তিনজনের মধ্যে আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। এমন বিপুল সাফল্যের পর প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলতাম কোনো না কোনো অজুহাত তুলে। পরে অবশ্য বাঙালির তিন হাতের কথা জেনেছি। ডান হাত, বাম হাতের চেয়েও আমাদের শক্তিশালী তৃতীয় হাতটির নাম অজুহাত।

বাংলা বিভাগের নির্বাচনে আমাকে কেন প্রার্থী করা হলো তার কারণ আমি জানি না। হয়তো মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকা এবং ততদিনে ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’র কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই এর কারণ ছিল। আমি মনে করি, আমার চেয়ে যোগ্যপ্রার্থী ছিল জুলিয়াস, খোন্দকার শওকত হোসেন। সে ঢাকায় লেখাপড়া করেছে। জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তাছাড়া ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের কাজের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। আমি মফস্বল থেকে আসা একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। পোশাকেরও তেমন ছিরিছাঁদ ছিল না। মনোনয়নপত্র জমা দিলাম প্রচার সম্পাদক পদে।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আমার ভয় দূর না হয়ে গেল বহুগুণে বেড়ে। হেরে গেলে তো লজ্জার ব্যাপার। আবার এটাও মনে হলো, কোথায় যেন শুনেছি, জয়ের চেয়ে নাকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দই বেশি।

আনন্দের খবর পেতে অবশ্য আমাকে ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জানা গেল আমি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় আমার বিজয় নিশ্চিত হয়।

আমরা অবশ্য বিভিন্ন বর্ষের ক্লাসে গিয়ে প্যানেলের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছি। ভিপি পদে আমাদের প্রার্থীর নাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে জিএস প্রার্থী ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তার বাড়িও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে। মিজান ভাই দেখতে সুদর্শন ছিলেন। হাঁটতেন একটু খুড়িয়ে। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে তিনি যখন করিডোরে হাঁটতেন, তখন তাকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতোই লাগতো। নামে যেমন মিল, দেখতেও যেন কিছুটা মিল ছিল।

মিজান ভাই ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। তার কথায় মুগ্ধ হওয়ার অনেক উপাদান থাকতো। ক্লাসে ক্লাসে তিনি যখন ভোট চেয়ে বক্তৃতা করতেন তখন সবাই মনোযোগ দিয়েই শুনতেন। ফলে তিনি যে ভোটে জিতবেন- এটা আমি বুঝতে পারছিলাম। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএসসহ কয়েকজন এবং ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপিসহ কয়েকজন জেতেন। একটি ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে।

তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড. নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একই সঙ্গে রোকেয়া হলের প্রভোস্টও ছিলেন। আমাদের সংসদের প্রথম মিটিংয়ে ঘটলো এক মজার ঘটনা। সভা শুরু হওয়ার আগে প্রথমেই কথা বললেন জিএস মিজান ভাই। তিনি শুরু করলেন এভাবে: আমাদের সভা শুরু হলো। আজকের সভায় সভাপতিত্ব করছি আমি মিজানুর রহমান চৌধুরী।

ছাত্রলীগের থেকে নির্বাচিত ভিপি (নাম মনে নেই) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? আমি ভিপি, সভায় সভাপতিত্ব করব আমি। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত অন্যরাও বললেন, জিএস নয়, সভাপতিত্ব করবেন ভিপি।

মিজান ভাই এক অদ্ভুত যুক্তি হাজির করলেন। বললেন, দেশে এখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি নেই। এখন প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারপ্রধান। কখনো শুনেছেন, এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন? এখন মন্ত্রিসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখানে আমাদের এই সংসদেও ভিপি নন, জিএসই সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিতরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়েই বোধহয় মিজান ভাইয়ের প্রস্তাব মেনে নেন।

মিজান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কিন্তু বাংলা বিভাগের জন্য একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমার মনে আছে, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আমরা প্রচুর বই সৌজন্য হিসেবে এনেছিলাম। বিভাগীয় প্রধান নীলিমা আপা ছাত্রলীগের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হলেও আমাদেরও তিনি অসহযোগিতা করেননি।

মিজান ভাইয়ের ক্যারিশমার কারণে পরের বছর বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের পুরো প্যানেল জয়লাভ করেছিল। সেবার ভিপি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জিএস হয়েছিলেন উম্মে তুকা মোকাদ্দেসা আপা, পুরো নাম এখন পড়ছে না।

মিজান ভাই পরে বিটিভিতে অভিনয় করেছেন, বিটিভির জন্য একাধিক নাটকও লিখেছেন। তার লেখা একটি নাটক একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শেষ দিকে মিজান ভাই ঢাকা থেকে বীরগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। বীরগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন বেশ কয়েক বছর।

ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরি নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। প্রতিটি হলে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। অধিকাংশ ভোটারের বুকে ঝুলছিল লেনিন-গামা পরিষদের ব্যাজ, মাহবুব-জহুর পরিষদের ব্যাজও ছিল, তবে তুলনামূলক কম। যৌথ প্যানেলের নেতা-কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে চরকির মতো ঘুরছিলেন। আমি শুরুতে লেনিন-গামা পরিষদের বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান থাকলেও শেষদিকে মনে হচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এই প্যানেলই জিতবে। মাহবুব-জহুর পরিষদের উপস্থিতি নজর এড়ানোর মতো না থাকলেও কিছুটা নিষ্প্রভ তো ছিলই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মতো একটি সংগঠনের মিলিত প্যানেল জিতবে না– এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ভেতরে ভেতরে যে একটি চোরাস্রোত বইছিল, সেটা আমাদের অনেকের উপলব্ধিতে ছিল না।

ভোট শেষে আমি হল থেকে বেরিয়ে কলাভবনে গিয়েছিলাম ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে জানতে। হলে হলে ভোট গননা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ডাকসুর ফল ঘোষণা হবে মনে করে আমি কলাভবনের সামনে গিয়েছিলাম। কলাভবনের চারতলায় সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলে যে যৌথ প্যানেল জিতবে তাতে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। আমাদের হলে জাসদ ছাত্রলীগের সামান্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তবে যারা হলে না থেকে বাইরে থাকতেন তাদের কিছু ভোট তারা পাবে কিন্তু সেটা শয়ের ঘর পেরুবে না বলে আমার ধারণা ছিল। মেয়েদের দুই হলে জেতার ব্যাপারেও আমার কোনো সংশয় ছিল না।

সন্ধ্যা হয় হয় সময় দেখলাম রোকেয়া হলের প্রভোস্ট নীলিমা ইব্রাহিম হন্তদন্ত হয়ে কলাভবনের সামনে এসে শেখ শহীদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ কামালসহ নেতাদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলে আবার হলে ফিরে গেলেন। নেতাদের একটু চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন মনে হলো। শেখ কামাল তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে একটি জিপে উঠে এসএম হলের দিকে গেলেন। কিছু একটা ঘটছে– এ আশঙ্কা থেকে আমি প্রায় দৌড়ে হলে ফিরলাম। জগন্নাথ হলের অ্যাসেমব্লি ভবনে ভোট গননা চলছিল। ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে জটলা করছিল আর ফল শোনার অপেক্ষা করছিল।

আমি অ্যাসেমব্লির সামনে যেতে না যেতেই দেখি ১৫/২০ জনের একটি মিছিল পূর্ববাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিচ্ছিল। দেখতে না দেখতেই তারা যেখানে ভোট গননা চলছিল সেখানে ঢুকে গেল এবং গুলি বা পটকা ফোটানোর শব্দ কানে এলো। ওই মিছিলকারীরা চিৎকার করে মুজিববাদীদের খুঁজছিল।

মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে এবং সেটা করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। দৌড়াদৌড়ি ধ্বস্তাধ্বস্তিও কিছু হলো। কে যে কাকে ধাওয়া করছে বুঝতে না পেরে আমি উত্তরবাড়ির দিকে একটি নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ মিছিল। স্লোগান দেওয়া হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথা জাসদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অল্প সময়ের মধ্যে এটাও জানা গেল যে নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাসদ ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই করেছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করা হলেও ঘটনা যে উল্টো তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আমি যাদের জগন্নাথ হলে ঢুকতে দেখেছি, তাদের দুয়েকজনকে আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগের মিছিলে আগে দেখেছি। তাছাড়া ওই সময়ে যে অবস্থা ক্যাম্পাসে ছিল তাতে জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে ব্যালট ছিনতাই করা অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার এই মনোভাব তাৎক্ষণিকভাবে কারো কাছে প্রকাশ করিনি।

দশে চক্রে ভগবান ভূত। সবাই মিলে তখন আমরা জাসদের গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করলাম। ভোটের পরদিন সকালেই সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও জয়ধ্বনি সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, সকাল ১১টায় জাসদ ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন। আমি যেন জয়ধ্বনির পক্ষ থেকে ওই সংবাদসম্মলনে উপস্থিত থেকে ওরা কি বলে তা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে জানাই।

আদেশ শিরোধার্য করে আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বলাকা ভবনে জাসদ ছাত্রলীগ কার্যালয়ে উপস্থিত হলাম। একটু ভয় যে করছিল না, তা নয়। আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে চিনে যদি গণধোলাই শুরু করে তাহলে কী হবে ভাবছিলাম। তবে আমি ঢাকায় তখনো ছাত্র ইউনিয়নের সামান্য কর্মীর মতোই ছিলাম। তাই আমাকে মেরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে চাইবে না- এটাও মনে হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য মূলত মুজিববাদী ছাত্রলীগকেই দায়ী করা হয়। বলা হয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ছাত্রলীগ এটা করেছে। রোকেয়া হলের ভোট গননা শেষ হয়েছিল। যৌথ প্যানেল হেরেছিল।

আমার তখনই আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়ে যায়। যৌথ প্যানেল হেরেছে দেখে ফল ঘোষণা না করে নীলিমা আপা নেতাদের কাছে গিয়ে তাদের পরাজয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরাজয় এড়ানোর জন্যই ব্যালট ছিনতাই নাটক।

সংবাদ সম্মেলনে জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা আরও নানা তথ্যাদি উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ঘটনাটি তারা ঘটাননি। যা হোক, সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি ১০ নম্বর পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবিস্তারে সব কিছু জানাই।

পরের দিন দৈনিক সংবাদে আব্দুল কাইয়ুম মুকুলের (এখন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক) একটি লেখা ছাপা হয়, যে লেখায় নানা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা হয় যে জাসদ ছাত্রলীগই ডাকসুর ব্যালট ছিনতাই করেছে।

ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনার দায় যেভাবে জাসদ ছাত্রলীগের ওপর চাপানো হয়েছিল, সেটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ছাত্রলীগের অপকর্মের ভাগ বহনের এই নীতি মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে। আমরা আমাদের ভালোত্ব দিয়ে ছাত্রলীগকে খারাপ কাজকর্ম থেকে বিরত করে ভালোর পথে নিয়ে আসব– এই ধারণা থেকেই তো তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি ভাবা হয়েছিল বলে আমি মনে করেছিলাম। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আমরা তাদের খারাপটা শুধু মেনে নিলাম না, খারাপের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিলাম।

নেতারা তখন যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন, সেগুলো আমার কাছে অনেকটা কুযুক্তি মনে হয়েছে। ডাকসু জাসদ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে গেলে দেশে কী এমন ওলটপালট হতো তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। কোনো সংগঠনের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল না আমার পরিচিত তেমন শিক্ষর্থীরা আমাকে বলতো, তোমরা হলে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়ছিল।

একবার কোনো সংগঠনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে তাতে আবার জোয়ার সৃষ্টি করা সহজ নয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন ছাত্র ইউনিয়নকে পেছনে ঠেলেছে, আর সামনে সেভাবে আগানোর কোনো উপলক্ষ তৈরি হয়নি বা বলা যায় ছাত্র ইউনিয়ন তেমন উপলক্ষ তৈরিও করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ শিরোধার্য করে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিনির্ধারণ করায় কিছু সমস্যা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থ আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ নিশ্চয়ই অভিন্ন ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র ইউনিয়ন তার গণভিত্তি মজবুত করতে পেরেছিল এ কারণেই যে তখন কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সোভিয়েতের সরাসরি নিয়মিত নির্দেশনা ছিল না। 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি মহলের বিতর্কিত কথাবার্তা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩২

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। ‌এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।

দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।

কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?

এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।

গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।

এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।

মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?

একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।

এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?

ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।

সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?

এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।

জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।

যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

আজাদুর রহমান চন্দন
এখানেই দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে। ছবি: আজকের পত্রিকা
এখানেই দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে। ছবি: আজকের পত্রিকা

ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিসি-ইউএনও পাঠিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকার। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এগুলোর সল্যুশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে হয় না। এগুলো করতে পারে একটি রাজনৈতিক সরকার। কারণ তাদের এ মোরাল সল্যুশন করার সক্ষমতা থাকে। তাদের ভয়েসটা দিতে পারে। তাদের কর্মীরা আছে। তাদের সেটআপ আছে। কিন্তু এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডিসিকে পাঠিয়ে, ইউএনওকে পাঠিয়ে এগুলো কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট।’ উপদেষ্টা ‘রাজনৈতিক সরকার’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেও কার্যত নির্বাচিত সরকারকেই বুঝিয়েছিলেন। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অনির্বাচিত সরকার রাখার বাসনা যাদের, তারা এ বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতেও পারেন। তবে অনির্বাচিত সরকারের একটি সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরায় সালেহউদ্দিন আহমেদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা কুড়াবেন আরও বহুদিন।

অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়-সন্দেহ পিছু ছাড়েনি এক দিনের জন্যও। দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। কে না জানে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। সবশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে, যিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আগের মাসেই চট্টগ্রামে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা কঠিন।

হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যা-ই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির ঘোষিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস। সে সময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের এবং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তাঁর কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর আগে এবং বলা চলে হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর এক ছাত্রনেতা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে বিএনপিকে দায়ী করে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানেরও ডাক দেন। শোনা যাচ্ছে, ওই ছাত্রনেতাও নাকি ঢাকা-৮ আসনে নিজ দলের প্রার্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হাদির সঙ্গে তাঁরই মূলত ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে বদনামের ভাগীদার বিএনপি!

হাদির ওপর হামলার মাধ্যমে কেউ এক ঢিলে বহু পাখি মারার চেষ্টা করেছে কি না, সেটি এখনই বলা যাবে না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন করলেও করতে পারে। তবে বিষয়টি যে বিএনপিকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এভাবেই কি চলতে থাকবে? তাহলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না—এটা আজকে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছে। এগুলোতে তো সন্দেহ জাগে। একজন উপদেষ্টা মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বলে দিলেন, জনগণ তো আমাদের ম্যান্ডেট দেয়নি কত দিন থাকব। সবকিছু মিলিয়েই নানা সন্দেহ, নানা সংশয়, নানা ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে।’

এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক সদস্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, যারা ওসমান হাদির ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা একটি গণমাধ্যমে জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে তারা আবার এসে প্রচার কাজে যোগ দেয়। কেউ কেউ সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে একজনের অতীত ‘লীগসংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণ করতেও বেজায় তৎপর।

এ তৎপরতা দেখে কেবলই মনে পড়ছে, গণ-অভ্যুত্থানের নায়কের আদলে যেসব ‘মুখ’ এখন ঝলসে উঠছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু একই রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল। অর্থাৎ তখন তারা ছিল লীগের ‘মুখোশ’। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও তেমনই একজন মুখোশধারী কি না, কে বলতে পারে? কারণ এই ব্যক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে ১৭ লাখ টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। আগে লীগসংশ্লিষ্ট হয়েও এখন তাহলে কোন সংশ্লিষ্টতার জাদুবলে এত সহজে জামিন পেয়ে ইনকিলাব মঞ্চে ভিড়ে একেবারে সংগঠনের শীর্ষনেতার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ পেয়ে গেল?

এক দলের সদস্য হয়েও অন্য দলে কাজ করার নজির যে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল, তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাবস্থায় দলটির অনেক সদস্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো বড় দলে কাজ করতেন। তবে তাঁরা ওই দলগুলোর জন্য বদনাম বয়ে আনার মতো কোনো কাজ করেননি। বরং তাঁদের কারণে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই উপকৃত হয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদও একসময় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও ন্যাপের নেতা ছিলেন। পরে বাকশাল হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামী লীগের ন্যাপ নেতা’ হিসেবে। সেই পরিচয় ছিল গৌরবের। তাঁরা কারও সঙ্গে প্রতারণা বা ছলনা করেননি। সে প্রসঙ্গ থাক।

জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি থেকেই অনেকের মুখের মুখোশ খসে পড়ছিল। ৫ আগস্টের পর তো অনেকের মুখ থেকে মুখোশ পরার মাজেজাও বেরিয়ে আসে অবলীলায়। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে মুখ ও মুখোশের খেলা। সামনের দিনগুলোতে নাকি এ খেলা জমজমাট হবে। এক অনুজ সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মুখোশ পরায় পারদর্শী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাকি কিছুদিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিতে তাঁদের কত লোক আছে, তা জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ওই ব্যক্তিরাও ততই বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসবেন মুখোশ ছেড়ে! তথ্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, গত সপ্তাহেই নরসিংদীতে একটি ইউনিয়ন বিএনপির ৭৫ নেতা-কর্মী অন্য একটি দলে যোগ দিয়েছেন।

এমনিতেই গত বছর লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরকের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপর বিভিন্ন কারাগার, থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরক লুট করা হয়েছিল। এসব অস্ত্রশস্ত্র কাদের অবৈধ দখলে থাকতে পারে, তা কি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব? অস্ত্রের রাজনীতিতে কারা সিদ্ধহস্ত, তা কি সবার অজানা? এই অস্ত্রধারীরা যে এক মুখোশ ছেড়ে নতুন কোনো মুখোশ নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা

সম্পাদকীয়
রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রায় ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ১২৪ জন মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও চুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমবাজারটি আবার চালু হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র আবারও তাদের পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছে।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় জনতা ট্রাভেলসের মালিক ও বিসিবির পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনালের সেলিনা আলী ও নাবিলা আলীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকায় ইঙ্গিত দেয়, এই অনিয়ম কেবল সামান্য কিছু এজেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

যে শ্রমিকেরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, বিদেশে কাজের জন্য নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন, তাঁদের এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া চরম অমানবিকতা। সরকার যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে এজেন্সির এমন মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।

আমাদের প্রশ্ন, সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কীভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই অনিয়ম করতে পারল? তদারকি সংস্থাগুলো কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশেই এ দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে? দুদকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি কেবল অতিরিক্ত অর্থ আদায়ই নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলার শামিল।

দুদকের মামলা করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে কেবল মামলা করাই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়; বরং তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত রাখতে এবং কর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জনশক্তি রপ্তানিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

শহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।

সেলিম জাহান 
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৭
বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।

পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।

তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয‍্যা।

পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।

একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।

শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত