Ajker Patrika

বিভাজনের রাজনীতি ও অনিশ্চিত উত্তরণ

আনোয়ারুল হক
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক সরাসরি যমুনা ও শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশের ডাক দেন। 	ছবি: সংগৃহীত
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক সরাসরি যমুনা ও শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশের ডাক দেন। ছবি: সংগৃহীত

নানা মত ও পথের তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি যাত্রার শুরু থেকেই বারবার হোঁচট খাচ্ছে। তাদের আজও কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। একেক নেতা একেকভাবে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিন্যাস ব্যাখ্যা করছেন। মূল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে উত্তর বা দক্ষিণ বাংলার আঞ্চলিক নেতারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করছেন, যা পরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বাধ্য হয়েই স্বীকৃতি দিতে হচ্ছে। সংগঠন হিসেবে তাঁদের জমায়েত ক্ষমতা ও সাংগঠনিক শক্তি এখনো দুর্বল, ফলে প্রায়ই তাঁরা সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির ওপর নির্ভর করছেন। এই নির্ভরতা তাঁদের ঘোষিত মধ্যপন্থী অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিপজ্জনক রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্ম দিচ্ছে।

ছাত্র সমন্বয়কারীদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে বলেছিল, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। অথচ পরে হঠাৎ করে ছাত্র সমন্বয়কদের সহায়তায় গঠিত নতুন দলটির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক সরাসরি যমুনা ও শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশের ডাক দেন। প্রথমে সাড়া দেয় জামায়াত, হেফাজত ও ছাত্রশিবির। পরে মূল নাগরিক পার্টি বাধ্য হয়ে ওই সমাবেশে যোগ দেয়। বিএনপিসহ অন্য দলগুলো বরাবরই বলেছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, কিন্তু বিচার যেন হয় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায়—মব তৈরি করে নয়। সে জন্যই তারা ওই সমাবেশে যোগ দেয়নি।

সমাবেশের চিত্রে দেখা গেছে, সাধারণ ছাত্র ও তরুণদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। বরং এটি ছিল জামায়াত-হেফাজত-শিবিরপ্রধান একটি সমাবেশ। সেখানে যখন কিছু তরুণ জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করেন, জামায়াত-শিবির বাধা দেয় এবং স্লোগান তোলে—‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’। এটি শুধু একটি স্লোগান নয়, এই শ্রেণির রাজনৈতিক বিশ্বাসের নগ্ন প্রকাশ।

বিভাজনের একটি শক্তিকে সরিয়ে দিয়ে আজ কি আমরা এক নতুন, আরও হিংস্র ও উন্মত্ত বিভাজনের মুখোমুখি? এ শক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিল। তারা সেই সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিল। এই ইতিহাসের দায় আজও তারা স্বীকার করেনি। বরং তারা দাবি করে, একাত্তরে জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল ‘দূরদর্শিতার’ জায়গা থেকে। তখন জামায়াতের আমির গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘কোনো ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে থাকতে পারে না।’

জুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা আবারও বলছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং যারা সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তারা বুঝে না বুঝেই ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে—এমন দাবিও করেছে তাদের সংবাদপত্র।

এই পরিস্থিতিতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যতই ফেসবুকে লিখে যান—‘৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা চাইতে হবে’—তা তেমন কোনো কাজে আসছে না। কারণ তাদের কাছে ফ্যাসিস্ট বলতে বোঝায় না স্বৈরাচার, বোঝায় মুক্তিযুদ্ধ। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও কথা বলেন, তারা দুই দিন পরে আপনাকেও ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ বলে চিহ্নিত করবে।

জামায়াতপন্থীদের এই দুঃসাহসের পেছনে রয়েছে নাগরিক পার্টির একটি অংশের নীরব সমর্থন ও সহযোগিতা। এদের সঙ্গে নিয়েই বগুড়ায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছে, উদীচী কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় এখনো স্পষ্ট অবস্থান নেননি নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব।

সরকারও অনেক সময় এদের বিরুদ্ধে নীরব থেকেছে, কখনো কখনো নমনীয় থেকেছে। ফলে আন্দোলনের ছাত্রদের সঙ্গেই যাঁরা একসময় একতাবদ্ধ ছিলেন, আজ তাঁরাই সরকারি উপদেষ্টাকে বোতল ছুড়ে মারছেন, লাঞ্ছিত করছেন। অবাক হতে হয়, এই ঘটনায় ‘গণতন্ত্রের অধিকার’ ও ‘শারীরিক লাঞ্ছনার বর্বরতা’ নিয়ে স্ট্যাটাস দেন হাসনাত আবদুল্লাহ, যিনি নিজেই বহুবার একই ধরনের ঘটনা উসকে দিয়েছেন। তিনি কি তাঁর পুরোনো স্ট্যাটাসগুলো ফিরিয়ে দেখবেন?

এই দ্বিচারিতা—মুখে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাণী, অথচ অন্তরে বিভাজন ও ফ্যাসিবাদী উগ্রতা—সাম্প্রতিক রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। বহুত্ববাদ ও স্থিতিশীলতাবিরোধী এই শক্তিগুলো সক্রিয় আছে সরকার ও বিরোধী উভয় শিবিরেই। তাই কেবল ‘আওয়ামী ভূত’ খুঁজে বেড়ানো যথেষ্ট নয়, নিজেদের শিবিরের মধ্যেও সতর্ক নজর দেওয়া জরুরি।

এখানেই আবার প্রশ্ন আসে মাহফুজ আলমের দ্বৈত অবস্থানের। তিনি একদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বলেন, অন্যদিকে কোনো আলোচনাবিহীন প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণকে সমর্থন করেন। এই পদ্ধতিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়ক নয় বলে মনে করছেন।

এখানে মনে রাখতে হবে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত আইনের ভিত্তিতে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে। তবে বিচার ও প্রতিকারের নামে যদি নির্বিচারে অভিযুক্ত করা হয়, তাহলে তা মামলাকে দুর্বল করে দেবে। যেমন দুর্বল হয়ে গেল গণতন্ত্রে উত্তরণপ্রক্রিয়া—একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে।

আওয়ামী লীগ কি আদৌ কার্যকর কোনো রাজনৈতিক দল ছিল এই মুহূর্তে? জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর তাদের অবস্থান এতটাই নৈতিকভাবে পরাজিত ছিল যে তারা নিজেরাই কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। শুধু মাঝে মাঝে কিছু জনসমর্থনহীন ঝটিকা মিছিল বা পুরোনো বক্তৃতা ছাড়া তারা দৃশ্যপটে ছিল না। তাদের যদি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হতো, দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হতো এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনসমর্থন যাচাই হতো, তাহলে তাদের পরিণতি নিশ্চিত করুণ হতো।

বরং নিষিদ্ধ করে তাদের ‘মজলুম’ বানানো হলো। আর মজলুমদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি জন্মায়—ইতিহাস তা-ই বলে। এই কৌশল গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে না, বরং অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়।

আজকের বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিভাজনের রাজনীতি যতই গভীর হয়, ততই রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল হয়, সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ে এবং গণতন্ত্রের সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে পড়ে। জাতীয় নাগরিক পার্টির মতো নতুন উদ্যোগগুলোর সামনে সুযোগ ছিল একটি নতুন ঐক্য নির্মাণের—যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মীয় সহাবস্থানের জায়গা একসঙ্গে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেই সুযোগকে তারা নিজেরাই ভূলুণ্ঠিত করছে বিভাজনের পুরোনো শক্তিগুলোর সঙ্গে আপস করে।

আওয়ামী লীগ হোক বা বিএনপি—কারোরই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু দায়মুক্তি কখনোই অন্যায়ের দায় হালকা করে না, বরং নতুন অন্যায়কে উসকে দেয়। আমরা যদি সত্যিই একটি বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে উত্তরণ চাই, তাহলে বিচারের নামে প্রতিশোধ নয়, আইনি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রেখে ইতিহাসের সত্যকে সম্মান করার রাজনৈতিক সাহস দেখাতে হবে।

যে প্রজন্ম জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—তারা কি ভিন্ন রাজনীতির ভেতরে থেকেও একটি ভিন্ন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? নাকি তারাও পুরোনো হিসাব-নিকাশে হারিয়ে যাবে? বাংলাদেশ আজ তাকিয়ে আছে সেই উত্তরদাতাদের দিকে, যারা বিভাজন নয়, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের নকশা আঁকবে।

লেখক: সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত