মাসুদ কামাল

অভূতপূর্ব সুবিধায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত প্রথমবারের মতো কিছুটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। তবে এ ঝামেলাটা অন্য কেউ তৈরি করেনি, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে।
একটু ডিটেইলে যাই। আগে সুবিধার থাকার বিষয়টা বলি। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে, এত বছরে যখনই যে সরকার দায়িত্বে বসেছে, একেবারে প্রথম দিন থেকেই কারও না কারও অসহযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে। স্বাধীনতার পর নতুন দেশ পরিচালনার শুরু থেকেই জাসদের মতো শক্তিশালী একটা বিরোধী দলকে দেখা গেছে। এদের মূল লক্ষ্যই ছিল সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা। জিয়াউর রহমানের সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠেই সক্রিয় ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সব বিরোধী দল। সেই সময় দারুণভাবে মাঠে ছিল সব ছাত্রসংগঠনও। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলেও আওয়ামী লীগ কিন্তু পরাজয়কে মেনে নেয়নি। সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। প্রথম দিন থেকেই বিরোধিতা করেছে। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেছে, বিএনপি মানেনি, বলেছে—স্থূল কারচুপি হয়েছে। সেই সঙ্গে চলেছে বিরোধিতা, মাঠে-ময়দানে এমনকি জাতীয় সংসদের ভেতরেও। সংসদ বয়কটের এই ধারা অব্যাহত থেকেছে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও। ২০০৮-এর নির্বাচনকেও মেনে নেয়নি বিএনপি, ফলে জনগণ দেখেছে প্রধান দুই দলের সর্বাত্মক অসহযোগিতা। এরপর যে তিনটা নির্বাচন হয়েছে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে, সেগুলোর আলোচনা যত কম করা যায় ততই ভালো। কারণ, এ সময়ে সরকার কেবল বিরোধী দলগুলোকেই নয়, পুরো জাতিকেই তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সামান্যতম আগ্রহও তাদের ছিল না।
এ সময়ে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক নামের অনিয়মিত কয়েকটা সরকারও ছিল। কিন্তু দুটি বাদে বাকিগুলোর আয়ু এতই কম ছিল যে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা না করলেও চলে। যে দুটি নিয়ে আলোচনা করা যায়, তার একটি হলো সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীনের সরকার। ২০০৭ সালের এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বিএনপির বাড়া-ভাতে ছাই দিতেই দায়িত্ব নিয়েছিল, সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হয়নি। কাজেই শুরু থেকেই তারা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন পায়নি। এসবের বিপরীতে এবারের অন্তর্বর্তী সরকার দেশে থাকা সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছে। একেবারে শুরুর দিন থেকেই পেয়েছে। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব এ সময় মাঠে ছিল না, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দেশে যারা ছিল, সাধারণ কর্মী-সমর্থক, তারা হাসিনা সরকারের পতনে শুরুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারা দলের ওপর চেপে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের জন্য খুব একটা হা-হুতাশ করেছিল, তা-ও নয়। বরং ভেবেছিল—যাক, এবার তাহলে একটা ফ্রেশ নেতৃত্ব আসবে। সে কারণে তারাও ড. ইউনূস সরকারের তেমন একটা বিরোধিতা করেনি।
আর আওয়ামী লীগের বাইরে, যত রাজনৈতিক দল আছে, সবাই সম্পূর্ণভাবে সমর্থন দিয়েছে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময় সবাই ছিল এক ছাতার নিচে। তাদের কমন এনিমি ছিল একজনই— শেখ হাসিনা। সেই হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর, তারা সবাই নিজ নিজ রাজনীতিতে ফিরে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তখনো তারা একটি জায়গায় এক ছিল, সেটা হচ্ছে—এই নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়া। সরকারকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সবার চাহিদা ছিল একটাই, সেটা হলো একটা সুন্দর নির্বাচন। নির্বাচনটি হতে হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। তবে রাজনীতির ভিন্নতার কারণে এই চাওয়ার মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য ছিল। সেটা মূলত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে। বিএনপি চেয়েছে দ্রুত নির্বাচন, কারণ তারা ভেবেছে যত দ্রুত নির্বাচন হবে ততই ভালো ফল তারা করবে। বিপরীত দিকে জামায়াত চেয়েছে কিছুটা রয়েসয়ে, সময় নিয়ে নির্বাচন। তারা ভেবেছে, সারা দেশে জনগণের সামনে দলকে নিয়ে যেতে তাদের আরও কিছুদিন লাগবে, তাই যতটা সময় পাওয়া যাবে ততই সুবিধা। এর মধ্যে আবার তৃতীয় শক্তি হিসেবে জন্ম নিল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)। এটা ছাত্রদের দল, ড. ইউনূসের প্ররোচনায় গড়ে ওঠা দল। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা এসে এই দলের কান্ডারির দায়িত্ব নিয়েছেন, আরও দুজন এখনো সরকারের মধ্যেই রয়ে গেছেন। এনসিপির কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডেও স্পষ্ট হয়ে গেল যে তারাও নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়। তারা যে দাবি নিয়েই মাঠে নামে, সরকার তা মেনে নেয়। কদিন আগে তারা দাবি করল, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে, সরকার সে দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করল। প্রথমত, তারা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করল, আর সেই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল যাতে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে পারে, সে রকম একটা আইন পাস করল। আগে কিংস পার্টি হিসেবে উল্লেখ করলেও এ ঘটনার পর সাধারণ মানুষের কাছে ড. ইউনূসের দল হিসেবেই বিবেচিত হতে থাকল এনসিপি।
এত কিছুর পরও বিএনপি, জামায়াত কিংবা বড় অন্য কোনো দলের মধ্যে এই সরকারের প্রতি প্রকাশ্য কোনো অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হয়নি। হয়তো তারা ভেবেছে, কোনোরকমে নির্বাচনটা তো হয়ে যাক। তারপর দেখা যাবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো কথাই বলতে নারাজ সরকারের উপদেষ্টারা। সেই একই গান—ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে। এ নিয়ে এক শীতল যুদ্ধ। তারপরও বিএনপির ধৈর্য অনেককেই অবাক করেছে, তারা সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু শুরুতে যে কথাটা বলছিলাম, এবার সরকার নিজে থেকেই ঝামেলাটা তৈরি করল।
ঘটনা হলো তিনটি। মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের দখল করা রাখাইন রাজ্যের জন্য ‘মানবিক করিডর,’ চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে চালু ও লাভজনক নিউমুরিং টার্মিনালকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেওয়া এবং সবশেষ আদালতের আদেশে মেয়র হওয়া বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ নেওয়ার পথে নানা অজুহাত তৈরি করা। এই তিনটি ঘটনায় সরকার সব দিক দিয়েই বড় ধরনের ঝামেলায় পড়ে গেছে।
প্রথম দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন হচ্ছে বলে সাধারণ্যে নানা আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে তিন বাহিনীর প্রধানেরা দেখা করেছেন সরকারপ্রধানের সঙ্গে। কী কথা হয়েছে তাঁদের মধ্যে, তা জানা যায়নি। পরদিন আবার সেনাপ্রধান লম্বা বৈঠক করেছেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেটাও সংবাদমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। তবে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এই দুই বৈঠক নিয়ে যেসব কথা প্রচারিত হচ্ছে, সেসবের অনেক কিছু বাদ দিয়ে দিলেও যতটুকু থাকে, তাতে বলা যায় সরকার খুব আরামদায়ক অবস্থানে নেই। বন্দর ও করিডর নিয়ে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন মিডিয়াতে সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তাতে তাঁদের মধ্যে একধরনের ঔদ্ধত্যই প্রকাশ পেয়েছে। সেই সঙ্গে এই দুটি বিষয় নিয়ে সরকারের মধ্যে যে একধরনের তাড়া রয়েছে—সেটাও যেন বোঝা গেছে। তাড়াটা কোথায়? আর গোঁয়ার্তুমিটাই বা কেন? তারা কি তাহলে কারও কাছে কমিটেড? অথবা এই কাজগুলো করার মিশন নিয়েই তারা এসেছে? এই কমিটমেন্ট কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টকে পদদলিত করার ঝুঁকি পর্যন্ত তারা নিতে চাইছে? আমি ঠিক বুঝি না, এ দেশের সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব না দেওয়ার আত্মঘাতী প্রবণতা কেন সরকারগুলোর মধ্যে বারবার দেখা যায়? আমরা হয়তো গরিব, আমরা হয়তো অত বেশি জ্ঞানী নই, তারপরও আমরা কারও অনুগ্রহ নিতে চাই না। কোনো দেশ, তা সে যত বড় পরাশক্তিই হোক না কেন, তাদের কাছে নতজানু হতে চাই না। আমাদের একেবারে দরিদ্র, অশিক্ষিত, অতি সাধারণ যেকোনো মানুষের সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলুন, তাদের এই মনোভাব টের পেয়ে যাবেন। সে কারণেই জানবেন, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো মহান কাজে সহায়তা করা সত্ত্বেও ভারতের প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব ইতিবাচক নয়। কারও মাতব্বরি এই জাতি সহ্য করতে চায় না। আমরা কিছু পারি না, সাদা চামড়ার লোকগুলো এসে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যাবে—এই ন্যারেটিভ এ দেশের মানুষকে খাওয়ানো যাবে না। আর যখন এমন মতলবের পেছনের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার বিষয়গুলোও ধীরে উন্মোচিত হতে শুরু করেছে, তখন তো এদের দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
এ তো গেল পোর্টের টার্মিনাল লিজ দেওয়ার বিষয়। করিডর, মানবিক করিডর বা ত্রাণ পাঠানোর জন্য রুট—এ রকম যে নামেই অভিহিত করা হোক না, পুরো বিষয়টাই যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটা বড় ঝুঁকি, এমনটাই মনে করে মানুষ। সম্ভবত সামরিক বাহিনীর চিন্তাও একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সরকারের এ চেষ্টাটাও একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।
অথচ এসব তো এই অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য কাজ হওয়ার কথা ছিল না। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত কোনো নিয়মিত সরকারের, অনির্বাচিত সরকারের নয়। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে—একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। সে কাজে তাদের তেমন কোনো হেলদোল টের পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এরই মধ্যে তারা এমন ব্যবস্থার সূচনা করেছে, যার কারণে দেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে না-ও যেতে পারে।
তৃতীয় ঘটনাটি হচ্ছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে বসতে না দেওয়ার প্রচেষ্টা। যেভাবে আদালতের রায় নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েছেন ডা. শাহাদাত হোসেন, সেই একইভাবে ইশরাক হোসেনও আদালতে রায় পেয়েছেন। ডা. শাহাদাত শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাকের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কী? সহজ এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। ইনিয়েবিনিয়ে যা বলা হচ্ছে, তার সারমর্ম হচ্ছে একজন ‘শিশু উপদেষ্টা’ চান না, তাই হবে না। কিন্তু তিনি না চাইলেই তো আর হবে না। উচ্চ আদালত তো ঠিকই ইশরাকের পক্ষে রায় দিয়ে দিয়েছেন। এখন হয়তো ওই উপদেষ্টা আরও কিছু ফন্দিফিকির করবেন। কিন্তু তাতে ফল কী হবে? অভিজ্ঞতা বলে—যতই টানাটানি করবেন, ততই জটিলতা বাড়বে। এরই মধ্যে ঢাকাবাসী জেনে গেছে, বিএনপির ঢাকা মহানগরের এক নেতার সমর্থকেরা চাইলেই এই সরকারকে অচল করে দিতে পারে। তাহলে পুরো দেশে বিএনপি যদি অসহযোগিতা করে, তাহলে অবস্থা কতটা ভয়ংকর হতে পারে?
কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, এই সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে বিএনপি। তারা এদেরকে সমর্থন দিয়েছে বলেই এরা টিকে আছে। কিন্তু এই বিষয়টা সরকারও বোঝে না, বিএনপিও বোঝে না। তখন সবচেয়ে বড় শক্তির কথা বলেছিলাম। দ্বিতীয় শক্তিটির কথা বলিনি, বলার প্রসঙ্গ ওঠেনি। এখন বলছি। এদের দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে সামরিক বাহিনী। তারাও অনির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে এসেছে।
মর্মান্তিক বাস্তবতা হচ্ছে—সরকার তার প্রধান এই দুই শক্তিকেই পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করতে পারছে না। এর বিপরীতে বাইরের শক্তির প্রতি নিজেদের নতজানু মনোভাব আর অনভিজ্ঞতামিশ্রিত গোঁয়ার্তুমি তাদেরকে এক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

অভূতপূর্ব সুবিধায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত প্রথমবারের মতো কিছুটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। তবে এ ঝামেলাটা অন্য কেউ তৈরি করেনি, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে।
একটু ডিটেইলে যাই। আগে সুবিধার থাকার বিষয়টা বলি। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে, এত বছরে যখনই যে সরকার দায়িত্বে বসেছে, একেবারে প্রথম দিন থেকেই কারও না কারও অসহযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে। স্বাধীনতার পর নতুন দেশ পরিচালনার শুরু থেকেই জাসদের মতো শক্তিশালী একটা বিরোধী দলকে দেখা গেছে। এদের মূল লক্ষ্যই ছিল সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা। জিয়াউর রহমানের সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠেই সক্রিয় ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সব বিরোধী দল। সেই সময় দারুণভাবে মাঠে ছিল সব ছাত্রসংগঠনও। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলেও আওয়ামী লীগ কিন্তু পরাজয়কে মেনে নেয়নি। সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। প্রথম দিন থেকেই বিরোধিতা করেছে। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেছে, বিএনপি মানেনি, বলেছে—স্থূল কারচুপি হয়েছে। সেই সঙ্গে চলেছে বিরোধিতা, মাঠে-ময়দানে এমনকি জাতীয় সংসদের ভেতরেও। সংসদ বয়কটের এই ধারা অব্যাহত থেকেছে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও। ২০০৮-এর নির্বাচনকেও মেনে নেয়নি বিএনপি, ফলে জনগণ দেখেছে প্রধান দুই দলের সর্বাত্মক অসহযোগিতা। এরপর যে তিনটা নির্বাচন হয়েছে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে, সেগুলোর আলোচনা যত কম করা যায় ততই ভালো। কারণ, এ সময়ে সরকার কেবল বিরোধী দলগুলোকেই নয়, পুরো জাতিকেই তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সামান্যতম আগ্রহও তাদের ছিল না।
এ সময়ে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক নামের অনিয়মিত কয়েকটা সরকারও ছিল। কিন্তু দুটি বাদে বাকিগুলোর আয়ু এতই কম ছিল যে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা না করলেও চলে। যে দুটি নিয়ে আলোচনা করা যায়, তার একটি হলো সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীনের সরকার। ২০০৭ সালের এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বিএনপির বাড়া-ভাতে ছাই দিতেই দায়িত্ব নিয়েছিল, সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হয়নি। কাজেই শুরু থেকেই তারা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন পায়নি। এসবের বিপরীতে এবারের অন্তর্বর্তী সরকার দেশে থাকা সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছে। একেবারে শুরুর দিন থেকেই পেয়েছে। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব এ সময় মাঠে ছিল না, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দেশে যারা ছিল, সাধারণ কর্মী-সমর্থক, তারা হাসিনা সরকারের পতনে শুরুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারা দলের ওপর চেপে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের জন্য খুব একটা হা-হুতাশ করেছিল, তা-ও নয়। বরং ভেবেছিল—যাক, এবার তাহলে একটা ফ্রেশ নেতৃত্ব আসবে। সে কারণে তারাও ড. ইউনূস সরকারের তেমন একটা বিরোধিতা করেনি।
আর আওয়ামী লীগের বাইরে, যত রাজনৈতিক দল আছে, সবাই সম্পূর্ণভাবে সমর্থন দিয়েছে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময় সবাই ছিল এক ছাতার নিচে। তাদের কমন এনিমি ছিল একজনই— শেখ হাসিনা। সেই হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর, তারা সবাই নিজ নিজ রাজনীতিতে ফিরে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তখনো তারা একটি জায়গায় এক ছিল, সেটা হচ্ছে—এই নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়া। সরকারকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সবার চাহিদা ছিল একটাই, সেটা হলো একটা সুন্দর নির্বাচন। নির্বাচনটি হতে হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। তবে রাজনীতির ভিন্নতার কারণে এই চাওয়ার মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য ছিল। সেটা মূলত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে। বিএনপি চেয়েছে দ্রুত নির্বাচন, কারণ তারা ভেবেছে যত দ্রুত নির্বাচন হবে ততই ভালো ফল তারা করবে। বিপরীত দিকে জামায়াত চেয়েছে কিছুটা রয়েসয়ে, সময় নিয়ে নির্বাচন। তারা ভেবেছে, সারা দেশে জনগণের সামনে দলকে নিয়ে যেতে তাদের আরও কিছুদিন লাগবে, তাই যতটা সময় পাওয়া যাবে ততই সুবিধা। এর মধ্যে আবার তৃতীয় শক্তি হিসেবে জন্ম নিল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)। এটা ছাত্রদের দল, ড. ইউনূসের প্ররোচনায় গড়ে ওঠা দল। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা এসে এই দলের কান্ডারির দায়িত্ব নিয়েছেন, আরও দুজন এখনো সরকারের মধ্যেই রয়ে গেছেন। এনসিপির কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডেও স্পষ্ট হয়ে গেল যে তারাও নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়। তারা যে দাবি নিয়েই মাঠে নামে, সরকার তা মেনে নেয়। কদিন আগে তারা দাবি করল, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে, সরকার সে দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করল। প্রথমত, তারা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করল, আর সেই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল যাতে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে পারে, সে রকম একটা আইন পাস করল। আগে কিংস পার্টি হিসেবে উল্লেখ করলেও এ ঘটনার পর সাধারণ মানুষের কাছে ড. ইউনূসের দল হিসেবেই বিবেচিত হতে থাকল এনসিপি।
এত কিছুর পরও বিএনপি, জামায়াত কিংবা বড় অন্য কোনো দলের মধ্যে এই সরকারের প্রতি প্রকাশ্য কোনো অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হয়নি। হয়তো তারা ভেবেছে, কোনোরকমে নির্বাচনটা তো হয়ে যাক। তারপর দেখা যাবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো কথাই বলতে নারাজ সরকারের উপদেষ্টারা। সেই একই গান—ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে। এ নিয়ে এক শীতল যুদ্ধ। তারপরও বিএনপির ধৈর্য অনেককেই অবাক করেছে, তারা সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু শুরুতে যে কথাটা বলছিলাম, এবার সরকার নিজে থেকেই ঝামেলাটা তৈরি করল।
ঘটনা হলো তিনটি। মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের দখল করা রাখাইন রাজ্যের জন্য ‘মানবিক করিডর,’ চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে চালু ও লাভজনক নিউমুরিং টার্মিনালকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেওয়া এবং সবশেষ আদালতের আদেশে মেয়র হওয়া বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ নেওয়ার পথে নানা অজুহাত তৈরি করা। এই তিনটি ঘটনায় সরকার সব দিক দিয়েই বড় ধরনের ঝামেলায় পড়ে গেছে।
প্রথম দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন হচ্ছে বলে সাধারণ্যে নানা আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে তিন বাহিনীর প্রধানেরা দেখা করেছেন সরকারপ্রধানের সঙ্গে। কী কথা হয়েছে তাঁদের মধ্যে, তা জানা যায়নি। পরদিন আবার সেনাপ্রধান লম্বা বৈঠক করেছেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেটাও সংবাদমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। তবে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এই দুই বৈঠক নিয়ে যেসব কথা প্রচারিত হচ্ছে, সেসবের অনেক কিছু বাদ দিয়ে দিলেও যতটুকু থাকে, তাতে বলা যায় সরকার খুব আরামদায়ক অবস্থানে নেই। বন্দর ও করিডর নিয়ে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন মিডিয়াতে সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তাতে তাঁদের মধ্যে একধরনের ঔদ্ধত্যই প্রকাশ পেয়েছে। সেই সঙ্গে এই দুটি বিষয় নিয়ে সরকারের মধ্যে যে একধরনের তাড়া রয়েছে—সেটাও যেন বোঝা গেছে। তাড়াটা কোথায়? আর গোঁয়ার্তুমিটাই বা কেন? তারা কি তাহলে কারও কাছে কমিটেড? অথবা এই কাজগুলো করার মিশন নিয়েই তারা এসেছে? এই কমিটমেন্ট কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টকে পদদলিত করার ঝুঁকি পর্যন্ত তারা নিতে চাইছে? আমি ঠিক বুঝি না, এ দেশের সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব না দেওয়ার আত্মঘাতী প্রবণতা কেন সরকারগুলোর মধ্যে বারবার দেখা যায়? আমরা হয়তো গরিব, আমরা হয়তো অত বেশি জ্ঞানী নই, তারপরও আমরা কারও অনুগ্রহ নিতে চাই না। কোনো দেশ, তা সে যত বড় পরাশক্তিই হোক না কেন, তাদের কাছে নতজানু হতে চাই না। আমাদের একেবারে দরিদ্র, অশিক্ষিত, অতি সাধারণ যেকোনো মানুষের সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলুন, তাদের এই মনোভাব টের পেয়ে যাবেন। সে কারণেই জানবেন, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো মহান কাজে সহায়তা করা সত্ত্বেও ভারতের প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব ইতিবাচক নয়। কারও মাতব্বরি এই জাতি সহ্য করতে চায় না। আমরা কিছু পারি না, সাদা চামড়ার লোকগুলো এসে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যাবে—এই ন্যারেটিভ এ দেশের মানুষকে খাওয়ানো যাবে না। আর যখন এমন মতলবের পেছনের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার বিষয়গুলোও ধীরে উন্মোচিত হতে শুরু করেছে, তখন তো এদের দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
এ তো গেল পোর্টের টার্মিনাল লিজ দেওয়ার বিষয়। করিডর, মানবিক করিডর বা ত্রাণ পাঠানোর জন্য রুট—এ রকম যে নামেই অভিহিত করা হোক না, পুরো বিষয়টাই যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটা বড় ঝুঁকি, এমনটাই মনে করে মানুষ। সম্ভবত সামরিক বাহিনীর চিন্তাও একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সরকারের এ চেষ্টাটাও একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।
অথচ এসব তো এই অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য কাজ হওয়ার কথা ছিল না। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত কোনো নিয়মিত সরকারের, অনির্বাচিত সরকারের নয়। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে—একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। সে কাজে তাদের তেমন কোনো হেলদোল টের পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এরই মধ্যে তারা এমন ব্যবস্থার সূচনা করেছে, যার কারণে দেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে না-ও যেতে পারে।
তৃতীয় ঘটনাটি হচ্ছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে বসতে না দেওয়ার প্রচেষ্টা। যেভাবে আদালতের রায় নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েছেন ডা. শাহাদাত হোসেন, সেই একইভাবে ইশরাক হোসেনও আদালতে রায় পেয়েছেন। ডা. শাহাদাত শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাকের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কী? সহজ এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। ইনিয়েবিনিয়ে যা বলা হচ্ছে, তার সারমর্ম হচ্ছে একজন ‘শিশু উপদেষ্টা’ চান না, তাই হবে না। কিন্তু তিনি না চাইলেই তো আর হবে না। উচ্চ আদালত তো ঠিকই ইশরাকের পক্ষে রায় দিয়ে দিয়েছেন। এখন হয়তো ওই উপদেষ্টা আরও কিছু ফন্দিফিকির করবেন। কিন্তু তাতে ফল কী হবে? অভিজ্ঞতা বলে—যতই টানাটানি করবেন, ততই জটিলতা বাড়বে। এরই মধ্যে ঢাকাবাসী জেনে গেছে, বিএনপির ঢাকা মহানগরের এক নেতার সমর্থকেরা চাইলেই এই সরকারকে অচল করে দিতে পারে। তাহলে পুরো দেশে বিএনপি যদি অসহযোগিতা করে, তাহলে অবস্থা কতটা ভয়ংকর হতে পারে?
কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, এই সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে বিএনপি। তারা এদেরকে সমর্থন দিয়েছে বলেই এরা টিকে আছে। কিন্তু এই বিষয়টা সরকারও বোঝে না, বিএনপিও বোঝে না। তখন সবচেয়ে বড় শক্তির কথা বলেছিলাম। দ্বিতীয় শক্তিটির কথা বলিনি, বলার প্রসঙ্গ ওঠেনি। এখন বলছি। এদের দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে সামরিক বাহিনী। তারাও অনির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে এসেছে।
মর্মান্তিক বাস্তবতা হচ্ছে—সরকার তার প্রধান এই দুই শক্তিকেই পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করতে পারছে না। এর বিপরীতে বাইরের শক্তির প্রতি নিজেদের নতজানু মনোভাব আর অনভিজ্ঞতামিশ্রিত গোঁয়ার্তুমি তাদেরকে এক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
৭ ঘণ্টা আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
৭ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
৭ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
৭ ঘণ্টা আগেআবু তাহের খান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।
যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।
মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।
প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।
দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।
যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।
মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।
প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।
দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

অভূতপূর্ব সুবিধায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত প্রথমবারের মতো কিছুটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। তবে এ ঝামেলাটা অন্য কেউ তৈরি করেনি, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে। একটু ডিটেইলে যাই। আগে সুবিধার থাকার বিষয়টা বলি। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে, এত বছরে যখনই যে সরকার দায়িত্বে বসেছে,
২৩ মে ২০২৫
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
৭ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
৭ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
৭ ঘণ্টা আগেমাহফুজা খাতুন

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।
যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।
ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।
তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।
আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।
যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।
ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।
তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।
আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

অভূতপূর্ব সুবিধায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত প্রথমবারের মতো কিছুটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। তবে এ ঝামেলাটা অন্য কেউ তৈরি করেনি, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে। একটু ডিটেইলে যাই। আগে সুবিধার থাকার বিষয়টা বলি। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে, এত বছরে যখনই যে সরকার দায়িত্বে বসেছে,
২৩ মে ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
৭ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
৭ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
৭ ঘণ্টা আগেশাইখ সিরাজ

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।
পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।
প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।
একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’
ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!
এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।
আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।
পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।
প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।
একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’
ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!
এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।
আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

অভূতপূর্ব সুবিধায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত প্রথমবারের মতো কিছুটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। তবে এ ঝামেলাটা অন্য কেউ তৈরি করেনি, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে। একটু ডিটেইলে যাই। আগে সুবিধার থাকার বিষয়টা বলি। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে, এত বছরে যখনই যে সরকার দায়িত্বে বসেছে,
২৩ মে ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
৭ ঘণ্টা আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
৭ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
৭ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?
ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?
ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

অভূতপূর্ব সুবিধায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত প্রথমবারের মতো কিছুটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। তবে এ ঝামেলাটা অন্য কেউ তৈরি করেনি, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে। একটু ডিটেইলে যাই। আগে সুবিধার থাকার বিষয়টা বলি। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে, এত বছরে যখনই যে সরকার দায়িত্বে বসেছে,
২৩ মে ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
৭ ঘণ্টা আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
৭ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
৭ ঘণ্টা আগে