Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

বৈষয়িক ও বাহ্যিক উন্নতি ঘটছে; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একসময় তিনি ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সাপ্তাহিক কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এখনো তিনি আজকের পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত হন। ২৩ জুন ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার

জন্মদিনে আপনাকে শুভেচ্ছা। জীবনের ৮৯ বছর পেরিয়ে আসলেন, কেমন লাগছে, আপনার অনুভূতি কী?

আপনাকেও শুভেচ্ছা। এতগুলো জন্মদিন পেরিয়ে এসে আজ পড়ন্ত বেলায় অনেকগুলো অনুভূতির একটি হলো, এই দীর্ঘ সময়কালে ঘটনা ও দুর্ঘটনা অনেক দেখলাম। কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে আমারও যে স্বপ্ন ছিল, সেটা বাস্তবায়িত হলো না। হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হয়নি। সমাজে ফাটল ধরেছে, রাষ্ট্রে ভাঙচুর দেখলাম; কিন্তু ব্যবস্থাটা আগের মতোই রয়ে গেল। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একাত্তরে খুব বড় মাপের আশা জেগেছিল, আশা ভেঙে যাওয়াটা তাই খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। তবু আশা রাখি যে নতুন দিন আসবে। সেই অভ্যুদয় আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু যারা থাকবে তারা দেখবে; এমন আশা বুকের মধ্যে ধারণ করি। স্বপ্নের জন্য হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। বাঁচার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রামের অব্যাহত ধারা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ আশা সব সময়ই ছিল; এখনো সেটা কমছে না। বরং বাড়ছেই, দেখতে পাচ্ছি।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ নজরে না নেওয়ার কারণ কী?

এর কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহির দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটছে সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।

দেখা যায় যে, অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় সরকারি লোকদের আশ্রয়ে, নয়তো প্রশ্রয়ে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য—উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। কখনো কখনো তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে—এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরও বেশি ধনী হয়। তা ছাড়া, এমন ঘটনাও তো ঘটে যে ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। বর্তমানে শাসকশ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে।

মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসকশ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইনকানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সবকিছুই মজুত রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।

বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তাঁরা বুদ্ধিজীবী কেন; কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকে সরকারের পক্ষে, কথা বলে ইনিয়ে-বিনিয়ে সরকারের মুখ চেয়ে। এরা হয়তো ইতিমধ্যেই সুবিধা পেয়েছে, নয়তো পাবে বলে আশা করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা বলেন তাঁরাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামী দিনে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাঁদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাঁদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না, ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধমত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।

বুর্জোয়া কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেগুলোর দিকে যেতে চায় না। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য, সেটা তারা মানতে চায় না। মানলে তাদের খুবই অসুবিধা। তারা চায় ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তারা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিতে চায়; দেয়ও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুক, তারা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নয়, এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।

তা ছাড়া, এটাও তো মানতে হবে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নেই। সরকারসংশ্লিষ্টরা আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায়, চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে—এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরং উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।

আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না, তাঁদের সংখ্যা অল্প। যাঁরা আছেন তাঁরাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাঁদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাঁদের অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাঁদের অবাঞ্ছিত বলে জানে।

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যে যোগাযোগ থাকার কথা, তা কি লক্ষ করা যায়?

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয়-উপার্জন সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে। জনগণ যা বলতে চায়, রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনা বিচারে ও নির্দ্বিধায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলবার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।

রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে আছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে, তা সে বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দুই পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহির জায়গায় নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকারপক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকেরা সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়ে পড়েছেন বরাবরের মতোই সরকারপন্থী। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।

দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দুটি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত, তা পাওয়া যাচ্ছে না।

রাষ্ট্রের ধর্ম দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে প্রতিরোধ; তার কোনোটাই বর্তমান সময়ে হচ্ছে না, এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়ার প্রশ্নেই উঠছে না।

আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। ওপর-কাঠামোতে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক-শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক, সে রকমেরই রয়ে গেছে। পুরোনো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসকেরা এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। হঠাৎ করে ক্ষমতা পাওয়া নব্য ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করছে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনো আছে বৈকি। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ-পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপসের কোনো সুযোগ দেখি না।

জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন, বিষয়টা কতটা পরিষ্কার হয়েছে পাঠকের কাছে বলে আপনি মনে করেন?

জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ধারণা ও একধরনের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই ধারণা গড়ে ওঠে এবং পরিষ্কার হয়। শুধু লেখার কারণেই যে মানুষের কাছে জিনিসটা পরিষ্কার হবে তা নয়। অভিজ্ঞতাই শেখাবে জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য কী ও কতটা।

জাতীয়তাবাদ আসলেই খুব জরুরি ব্যাপার। এর ইতিবাচক গুণ আছে, রয়েছে নেতিবাচক দুর্বলতাও। ইতিবাচক দিক হলো, এই যে জাতীয়তাবাদ ঐক্যের সৃষ্টি করে এবং সে ঐক্যের ভিত্তিতে থাকে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম সমষ্টিগত উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেম মানুষকে সংবেদনশীল এবং সচেতন করে। দুটোই খুব বড় গুণ। তদুপরি দেশপ্রেম বিচ্ছিন্নতা কমায়।

জাতীয়তাবাদের শত্রু বাইরে থাকে, ভেতরেও থাকে। বাইরের শত্রু আক্রমণ করে, আগ্রাসন চালায়, দখল করে নিতে চায়। এ যুগে বিশ্ব পুঁজিবাদ ওই কাজটাই করছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ মানুষের ভয়ংকর শত্রু।

কিন্তু জাতীয়তাবাদের শত্রু আবার জাতীয়তাবাদের ভেতরেই রয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদ উগ্রতা, অন্ধত্ব, অহমিকা ইত্যাদি তৈরি করে। এর অন্তরে রয়েছে একনায়কতন্ত্রী প্রবণতা। জাতীয়তাবাদ নেতা খোঁজে এবং ব্যক্তিকে একক নেতা করে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিকাশে সহায়তা দেয়। এসব জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা।

তবে জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ মূল শত্রুটা হচ্ছে বৈষম্য। জাতির অভ্যন্তরে শ্রেণিবৈষম্য থাকে। ওই বৈষম্য ঐক্য গড়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ধনীরা কর্তা হয়ে বসে এবং গরিবকে দমন করে। আমরা সবাই একই জাতির সদস্য, পরস্পরের আত্মীয়, জাতীয়তাবাদীরা এই বোধটা সঞ্চারিত করে শ্রেণিদ্বন্দ্বের সত্যটাকে আড়ালে রাখতে চায়। শাসকশ্রেণি জাতির নামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শ্রেণিশোষণকে ভুলিয়ে দেয়। শ্রেণিবৈষম্য আবার পুঁজিবাদেরই অবদান। ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকমের যে পুঁজিবাদ বাইরে থেকে তো বটেই, ভেতর থেকেও শত্রুতা করছে। বাইরে সে আগ্রাসী, ভেতরে সে অন্তর্ঘাতী।

জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে আমি জনগণের মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ এবং শ্রেণিবিভাজনের দরুন জাতীয়তাবাদের ভেতরে কার্যকর দুর্বলতা, দুটোই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। দেখাতে চেয়েছি যে বাইরে যেমন ভেতরেও তেমনি, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ এবং তাকে পরাভূত করতে না পারলে মানুষের মুক্তি নেই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে তাই নিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের দিকে, বক্তব্যটা এ রকমের।

বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো স্বঘোষিতরূপেই জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তাদের কোনোটিই পুঁজিবাদবিরোধী নয়। জাতি বলতে তারা নিজেদেরকেই মনে করে। এদের জাতীয়তাবাদ জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করে না। এদের জাতীয়তাবাদ ধনিকশ্রেণির এবং সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসকামী। জাতীয়তাবাদী শাসকেরা নিজেদের শ্রেণির বান্ধব, জনগণের বান্ধব নন।

জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ব্রিটিশের শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে ধর্মকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার দরুন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের ধনিকশ্রেণির জীবনে মাতৃভাষার চর্চা কমে এসেছে। এটাও প্রমাণ করে যে এরা দেশপ্রেমিক অবস্থানে নেই।

আমরা জাতি-রাষ্ট্রের কথা শুনি। এ যুগে এক রাষ্ট্রে এক জাতি বসবাস করবে, এটা সম্ভব নয়। এক রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকে এবং থাকবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালি, কিন্তু তাই বলে এখানে অবাঙালি জাতিসত্তা যে নেই, তা নয়। অবশ্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটা হবে ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। আসলে আমরা যা চাই তা জাতি-রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে বাঙালি থাকবে অবাঙালিও থাকবে, কিন্তু প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য।

রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমস্যা থেকে উত্তরণ এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেটি আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নেই বললেই চলে। কেন?

দেশপ্রেম একেবারেই নেই, এটা সত্য নয়। আছে; তবে সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে নেই। ধনীদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম কমছে। দুই কারণে। ধনীরা নিজেদেরকে দেশের গরিব মানুষদের সমপর্যায়ের মনে করে না। ভাবে, তারা স্বতন্ত্র, কারণ তারা ধনী। তারা যে স্বতন্ত্র, এটা প্রমাণ করার জন্য দেশের ভেতরেই তারা বিদেশিদের মতো আচরণ করে। তাদের জীবনাচার, ভোগ-বিলাসিতা, সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি অনীহা, অনেক ক্ষেত্রে অবজ্ঞা প্রমাণ করে যে তারা দেশপ্রেমিক নয়। এরা ধরেই নেয় যে এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই সম্পদ, সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি সবকিছু এরা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে রাখে। তবে ধনীদের মধ্যেও একধরনের দেশপ্রেম জেগে ওঠে, যখন তারা বিদেশিদের দ্বারা অপমানিত হয়। তখন তারা মানসিকভাবে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে, কিন্তু পায় না।

ধনীরা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও কর্তৃত্বকারী বাস্তবতা। পুঁজিবাদ মানুষকে উৎপাটিত করে, নিরাশ্রয় করে ছাড়ে। গরিব মানুষের জন্য কিন্তু বড় বিশ্ব বলে কিছু নেই; তাদের জন্য নিজের গ্রাম, শহর, দেশ এগুলোই হলো বিশ্ব। মাতৃভাষাই তাদের একমাত্র ভাষা। অন্য কোনো দেশ নেই, অন্য কোনো ভাষাও নেই। এরা যখন বিদেশে যায় তখনো দেশপ্রেমিকই থাকে। দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, খেয়ে না-খেয়ে টাকা পাঠায়, যে টাকার অনেকটাই ধনীদের তৎপরতার দরুন বিদেশে ফেরত চলে যায়।

গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে, নইলে ভেঙে পড়ত। ধনীরা দেশের ক্ষতি করে; তারা তাদের দেশপ্রেমের নিম্নগামিতাকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত করে দেয়। তাদের অত্যাচার-অনাচারে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়।

আপনি এ দেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী, যেমন দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা—এসব নিয়ে কিছু বলুন।

দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, এসব বড় বড় ঘটনা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার বয়সী সবাইকেই এই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

দেশভাগ ছিল আমাদের দেশের জন্য মস্ত বড় এক দুর্ঘটনা। ১৭৫৭-তে পলাশীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এটি অবশ্যই সে মাপের নয়, তবে কাছাকাছি বটে। ১৭৫৭-তে যে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু, ১৯৪৭-এ তার অবসান ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি। নব্য-ঔপনিবেশিকতা রয়ে গেছে এবং দেশভাগের ফলে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি ঘটেছে, সেটা অপূরণীয়।

১৯৫২-তে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ওই অভ্যুত্থান একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ওই পথে এগিয়ে আমরা উনসত্তরের জন-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি এবং একাত্তরের যুদ্ধে শামিল হয়েছি। ওটি ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি চূড়ান্ত পর্যায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল পুরোনো পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যে আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেয়েছিল রাষ্ট্রের সংবিধানে। কিন্তু রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে একেবারে ধুয়েমুছে ফেলাতে। শাসকশ্রেণির একাংশ ওই নীতিগুলোকে বাদ দিয়েছে, অপর অংশগুলো যে তাদেরকে ফেরত আনতে আগ্রহী, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

১৯৪৭-এর দেশভাগ মুসলিম মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল বৈষয়িক উন্নতির। ১৯৭১-এ তাদের সে সুযোগ আরও প্রসারিত হয়েছে। উন্নতি ঘটেছে পুরোনো পুঁজিবাদী পন্থাতেই। সে উন্নতি অল্পকিছু মানুষের এবং অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে। জনগণ মুক্তি পায়নি, মুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ।

মুক্তির লড়াইটা অপরিহার্যরূপে পুঁজিবাদবিরোধী। সে লড়াই আজ বিশ্বব্যাপী চলছে। বাংলাদেশেও তাকে অব্যাহত রাখা চাই। নইলে সমষ্টিগতভাবে আমরা কেবলই নিচে নামতে থাকব, এখন যেমন নামছি।

দেশভাগকে বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল বলে আপনি মনে করেন?

অবশ্যই। এ ছিল মস্ত বড় ভুল এবং বিপর্যয়। যেটা উচিত ছিল তা হলো ঔপনিবেশিক শাসকদের যথার্থ বিতাড়ন। প্রয়োজন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতিগুলোর প্রতিটির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা।

এই উপমহাদেশ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, দেশভাগের সময় এখানে কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল, তাদের প্রতিটির জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আবশ্যক ছিল। রাষ্ট্রগুলো জাতি-রাষ্ট্র হতো না, এক রাষ্ট্রে অন্য জাতির মানুষও থাকত, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি হতো জাতীয়তাবাদী। ধর্মভিত্তিক নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেলে শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা করাটা সহজ হতো।

কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা সেটা চায়নি। তারা কৃত্রিমভাবে দেশভাগ করে নিজেদের অনুগত লোকজনের হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গেছে। দেশি শাসকেরা পুঁজিবাদী এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি অনুগত। ফলে দেখা গেছে যে ইংরেজ সরে গেছে বটে, কিন্তু না ভেঙেছে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, না তাদের হাতে-গড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। করুণ সত্য এটাই যে জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি এবং সমষ্টিগত মুক্তিও অর্জিত হয়নি।

সমাজ দর্শনের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমাদের বর্তমান সমাজ কোন দিকে এগিয়ে চলছে?

বর্তমানে অগ্রগামিতা মোটেই ভালোর দিকে নয়; খারাপ দিকে বটে। ধর্মান্ধতার অভিমুখে বললে ভুল হবে না। উন্নতি যা ঘটছে তা বৈষয়িক ও বাহ্যিক; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য। যত উন্নতি তত বৈষম্য বৃদ্ধি, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মবিধি। এমন সুবিস্তৃত বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্য এবং ক্ষোভ দুটোকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধনীরাই আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও ভোগবাদিতা বঞ্চিত মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।

জীবনের এ পর্যায়ে এসেও লিখে চলছেন অবিরত, কথা বলেন সাহসী কণ্ঠে। কোথায় খুঁজে পান এত প্রাণরস?

আমার ক্ষেত্রে লেখাই বেশি ঘটেছে, বলা কম। অবশ্য লেখার ভেতরেও বক্তব্য থাকে। লিখি কিছুটা অভ্যাসবশত, অনেকটা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে। তবে সূত্রাকারে বলতে গেলে বলতে হয় বাইরের অবস্থা এবং ভেতরের সংবেদনশীলতাই দায়ী লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে আমার যুক্ত থাকার জন্য।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নতুন করে পুরোনো ভাবনা

জাহীদ রেজা নূর  
নতুন করে পুরোনো ভাবনা

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।

গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।

কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।

২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।

দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।

সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।

প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।

৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।

বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।

৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।

সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।

তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’

তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।

ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?

আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ২০
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক নয়। এমনকি গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ছবি: আজকের পত্রিকা
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক নয়। এমনকি গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ছবি: আজকের পত্রিকা

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।

তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।

একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।

ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।

অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।

যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।

স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দুস্থের অধিকার হরণ কেন

সম্পাদকীয়
দুস্থের অধিকার হরণ কেন

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।

ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।

শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।

সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।

যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।

অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মৃতের শরীরে লবণ

সম্পাদকীয়
মৃতের শরীরে লবণ

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।

টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।

ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!

আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?

জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।

ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত