Ajker Patrika

বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার সমগ্রতা

সৌভিক রেজা
বিষ্ণু দে [জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯০৯; মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২]
বিষ্ণু দে [জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯০৯; মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২]

বিষ্ণু দে কাব্যসাধনার একেবারে শুরুতে ‘মহাভারত’ পাঠের অভিজ্ঞতার সূত্রে খুঁজে পেয়েছিলেন এক অনন্য ‘শান্ত কর্মৈষণা’, যা কিনা নানা ধরনের পরিবর্তনের, দ্বন্দ্বের আর বৈপরীত্যের গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে এখনো টিকে রয়েছে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চেতনায়, অভিজ্ঞতায়, উপলব্ধিতে। সে-সঙ্গে এটিও দেখতে পাই যে দ্বন্দ্বের আর বৈপরীত্যের গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার মূলসূত্র ক্রমাগত একটা দৃঢ়তর ভিত্তি পেয়েছে। এই প্রবণতার ভেতরে সরলীকরণের কোনো ঝোঁক কিন্তু কখনো দেখা যায় না। বস্তুত তাঁর কাব্যচিন্তায় যেকোনো ধরনের সরলীকরণের বিপক্ষে ছিলেন বিষ্ণু দে। সরলীকরণের ঝোঁকটাকে তাঁর কাছে মনে হয়েছে একধরনের ‘ভাববিলাসের’ প্রতি মোহ, যা কিনা গভীর কোনো ভাববিন্যাসের দিকে মানুষকে কখনো নিয়ে যায় না। সে-কারণেই কি সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে, কি ঐতিহ্যচেতনার দিক থেকে, চৈতন্যের জটিলতাকে বিষ্ণু দে কখনোই এড়িয়ে যাননি; বরং জটিলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি তাকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন, পর্যালোচনা করতে উৎসাহিত বোধ করেছেন।

বিষ্ণু দে যৌক্তিকভাবেই মনে করতেন, ‘আমাদের ইতিহাস মোটেই সরল নয়, তাতে কালের ও নানা পাত্রের নানান জট...যেমন ইতিহাসে তেমনি স্বতন্ত্রভাবে সাহিত্যবিচারেও জট আমাদের খুলতে হবে।’ নানা সময়ের এসব বিভিন্ন জট খোলার প্রত্যয়ে স্থিত ছিলেন বলেই তিনি সতর্কতার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘সঙ্গত দৃষ্টির ও আপেক্ষিক উক্তির জটিল ও ধৈর্যশীল পথেই আমাদের ভবিষ্যৎ, যান্ত্রিক প্রয়োগের লোভে বা ভাববিলাসের আশু-তৃপ্তিতে দক্ষিণ থেকে বাম, বাম থেকে দক্ষিণাচারে যেন আমরা না-ভুলি।’ এইভাবে নিজস্ব পথরেখায় স্থিত রাখতে মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্ব কবিকে সামর্থ্য জুগিয়েছিল।

আমাদের এটিও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কি জীবনে কি সাহিত্য-চিন্তায় সব রকমের উগ্র মতবাদের বিরোধী ছিলেন বিষ্ণু দে। তাঁর কাছে মনে হয়েছে, পরিপ্রেক্ষিতহীন যেকোনো ধরনের উগ্র মতবাদ শিল্প-সাহিত্যে, এমনকি স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের বিকাশের পক্ষেও প্রতিকূল। আর সে-কারণেই তিনি মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হয়েও সেই দর্শনের যান্ত্রিক প্রয়োগের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘মার্ক্সিয় দর্শনে...চিরকালের জন্য একবার অর্জিত অভ্যাসের যান্ত্রিকতা অচল। সে-দর্শনের ভিত্তিই হচ্ছে চিরদ্বৈতাদ্বৈতের গতিশীল জীবন্ত পরিণতিতে, প্রথাসিদ্ধ দার্শনিকতার জড় অবসর মার্ক্সিজমে নেই।’ প্রথাসিদ্ধতার জড় অবসরের হাতে পড়বার কারণেই সারা বিশ্বে মার্ক্সবাদ আজ তার অস্তিত্বের সংকটে পতিত—এই সত্যিটা আজ আমাদের বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। বিশেষ কোনো মতবাদে কখনোই চরম আস্থা স্থাপন করেনি বলেই হয়তো সাহিত্যের পাশাপাশি কবি বিষ্ণু দের বন্ধুত্বের পরিবৃত্তটি ছিল বেশ বিচিত্র। সেখানে কমিউনিস্ট-বিরোধী সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন একেবারেই রাজনীতিবিমুখ বুদ্ধদেব বসু। আবার কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়—এঁরাও ছিলেন। বন্ধুত্বের এই বিচিত্র-বৃত্তটি ছিল বিষ্ণু দের ব্যক্তিত্বের সমগ্রতারই পরিচায়ক। কাউকেই বর্জন করে নয়; বরং সবাইকে নিয়েই আত্মবিকাশের ও আত্মপ্রকাশের একটা নিরন্তর তাগিদ নিজের মধ্যে সব সময় অনুভব করেছেন এই কবি। ব্যক্তিক সমন্বয়ের এই উদাহরণ নিয়েই তিনি শুধু সন্তুষ্ট ছিলেন না; তাঁর সাহিত্যচেতনার মধ্যেও আমরা দেখতে পাই সেই বৈচিত্র্যের সমাহার।

দেশ-বিদেশের নানা জাতের সাহিত্য থেকে শুরু করে আমাদের লোকসাহিত্য, আদিবাসীদের সাহিত্য, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অবহেলিত সাহিত্যের প্রতিও কবি বিষ্ণু দের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। এ ছাড়া চিত্রকলা, সংগীত—এসবকেও বিষ্ণু দে তাঁর কবিতা তথা নন্দনবিশ্বের সঙ্গে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সে কারণেই যামিনী রায়ের মতো চিত্রশিল্পী তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। যামিনী

রায় সম্পর্কে বিষ্ণু দে বলেছেন, ‘যামিনী রায়ের চিত্রসাধনায় যে শুধু আমাদের শিল্পের মুক্তি, তা-ই নয়, আমাদের সাধারণ বাংলার মানুষের চোখের আনন্দে তিনি আমাদের মনোজগৎকেও রূপ দিয়েছেন—দৃশ্যপথে। এবং এই আনন্দ যেহেতু দেশের আনন্দে, মানুষের শান্তিতে প্রসাদে মৃন্ময়; তাই আমরা সবাই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।...যামিনী রায়ের শান্ত ও রঙিন চিত্রলোক আমাদের যেন সেই নিশান নির্দেশে সমৃদ্ধ করে—আমাদের দ্বিধান্বিত অসম্পূর্ণতায়, গৌণতার গ্লানির মধ্যে অপরাজেয়।’ এইভাবে একজন চিত্রশিল্পীর প্রতি শুধু শ্রদ্ধা জানিয়েই বিষ্ণু দে তাঁর দায়িত্ব শেষ করতে চাননি। বরং এই চিত্রকলার এই দায়বোধকে তিনি তাঁর কবিতার মধ্যেও আত্মস্থ করে নিতে চেয়েছেন।

বিষ্ণু দের মতো একজন নিরন্তর সৃষ্টিশীল কবি, সংবেদনশীল মানুষের কাছে সংগীতের ভূমিকা কতখানি ছিল, সেটি জিষ্ণু দের সাক্ষ্য থেকে আরও একবার বুঝে নেওয়া যেতে পারে। কবি-পুত্র আমাদের জানিয়েছেন, ‘আমার বাবার কাছে কবিতা লেখা ও “গান শোনা’’ একই রকম ছিল।’ অন্যদিকে প্রয়াত সমালোচক অরুণ সেনের মতে, বিষ্ণু দের কবিসত্তার মধ্যেই নিহিত ছিল ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের ‘বহুধা বৈচিত্র্য’; তিনি অবশ্য এটিও স্বীকার করেছেন যে পাশ্চাত্য সিম্ফনি ও ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত—এই দুই ঐতিহ্যের সংগীতই জীবনের দ্বন্দ্ব ও উত্তীর্ণ সুষমাকে প্রকাশ করেছে বিষ্ণু দের কবিতা। এইভাবেই ঐতিহ্যের প্রবহমানতা বজায় রেখে রাজনীতি, চিত্রকলা থেকে থেকে সংগীত—সবকিছু মিলিয়ে জীবনের সমগ্রতাকে নিরূপণ করতে চেয়েছিলেন বিষ্ণু দে। আর এসবের মধ্য দিয়ে এই কবির রুচির সমগ্রতাকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

‘সমগ্রতার এই বোধ’ তাঁর চেতনার কতটা গভীরে বিস্তৃত সেটা বুঝে নিতে পারা যায়, বিষ্ণু দে যখন বলেন, যদি কারও শুধু আধুনিক সংগীত ভালো লাগে অথচ আধুনিক কাব্য বা চিত্র অসহ্য মনে হয়, তাহলে তাঁর সততায় বা তাঁর স্বভাবের সমগ্রতায় সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। যাকে বিষ্ণু দে বলেছেন স্বভাবের সমগ্রতা, সেটা যে একজন মানুষের রুচির সমগ্রতারই রকমফের, সেটি লেখাই বাহুল্য।

৩ ডিসেম্বর কবির প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আরও দুই মিত্র হারালেন মাদুরো, লাতিনে ভেনেজুয়েলার পাশে এখন কারা

সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক উদ্বোধন বৃহস্পতিবার, তোলা যাবে ২ লাখ টাকা

তালাকের ১ মাসের মাথায় ফের বিয়ে করলেন ত্বহা-সাবিকুন

খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে গেলেন ৩ বাহিনীর প্রধানেরা

হঠাৎ বিদেশে শাহবাজ শরিফ, সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে সিডিএফ নিয়োগ নিয়ে বিড়ম্বনায় পাকিস্তান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ