আসিফ
মস্তিষ্ক বিকাশের কারণে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে বুদ্ধিমত্তা মানে চারপাশ থেকে সরাসরি শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেই সঙ্গে বিচারবুদ্ধিও। যার মাধ্যমে তথ্যগুলোকে সমন্বয় সাধন ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কে আগে আভাস পাওয়া সম্ভব হয়, যা জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্কেরও উদ্ভব ঘটেছে। লাখ লাখ বছর ধরে জটিলতা ও তথ্য ধারণের মধ্য দিয়ে এটি বিকাশ লাভ করেছে।
জিনের চেয়ে বর্তমানে আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি জানে। কেননা মস্তিষ্ক লাইব্রেরি ১০ হাজার গুণ বড়। এরপর আমরা প্রয়োজনবোধ করলাম মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু জানতে, সেই সময়টা এসেছিল ১০ হাজার বছর আগে। ফলে শরীরের বাইরে বিশাল পরিমাণে তথ্য মজুত রাখার পদ্ধতি আমরা শিখেছিলাম। মস্তিষ্কের বাইরে তথ্য সংরক্ষণের প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। স্মরণ, তুলনা, সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ এবং বিমূর্ত তৈরি করার মতো ক্ষমতার কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। ফলে এই গ্রহে আমরাই একমাত্র প্রাণী, যারা এমন এক স্মৃতি সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে সামর্থ্য হয়েছিলাম, যার জন্য আমাদের জিনেরও দরকার নেই, এমনকি মস্তিষ্কেরও দরকার নেই। স্মৃতির এই আধারকে বলা হয় গ্রন্থাগার। এটাই এক্সট্রসোমেটিক নলেজ। এই প্রবণতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার।
মূলত মিসরের গ্রিক রাজারা এই গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। আলেক্সান্দারের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁরা শিক্ষার ব্যাপারে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন। শত শত বছর গবেষণাকর্মকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন এবং সে যুগের সবচেয়ে বড় মনীষীদের কাজকর্মের জন্য গ্রন্থাগারের পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। গ্রন্থ তৈরি হয় গাছপালা থেকে। এটা হলো সমতল ও নমনীয় অংশগুলোর (এখনো যাকে ‘পাতা’ই বলা হয়) সমাবেশ যাতে গাঢ় রঞ্জক পদার্থ দিয়ে আঁকাবাঁকা প্যাঁচানো হস্তাক্ষরের লেখা ছাপানো হয়। এতে একবার ক্ষণিকের দৃষ্টি দিলে আপনি শুনতে পাবেন অন্য ব্যক্তির কণ্ঠস্বর—হয়তো হাজার হাজার বছর আগের মৃতদের কারও। সহস্র বছর দূর থেকে লেখক আপনার মাথার ভেতরে স্পষ্ট ও নিশ্চুপভাবে আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে।
লিখন পদ্ধতি সম্ভবত মানবজাতির মহত্তম উদ্ভাবন, যা জনমানুষকে, দূরবর্তী সময়ের নাগরিকদের একত্রে বাঁধে, যারা কখনোই পরস্পরকে চেনে না। গ্রন্থ সময়ের শৃঙ্খলা ভাঙে, মানুষের জাদুকরি সামর্থ্যকে প্রমাণ করে। প্রাচীনতম লেখকদের কেউ কেউ কাদামাটির ওপর লিখেছিলেন। পশ্চিমা বর্ণমালার সুদূর পূর্বসূরি কীলকাকার (কিউনিফর্ম—পারস্য অ্যাসিরিয়া প্রভৃতি দেশের প্রাচীন শিলালিপিতে দৃষ্ট কীলকাকার বর্ণমালা) লিখন উদ্ভাবিত হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নিকট-প্রাচ্যে। নথিপত্র সংরক্ষণ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য—শস্য ক্রয়, জমি বিক্রি, রাজার বিজয়, যাজকদের মূর্তি, নক্ষত্রগুলোর অবস্থান, দেবতাদের কাছে প্রার্থনা। হাজার হাজার বছর ধরে, লিখনকে কাদামাটি ও পাথরের মধ্যে খোদাই করা হতো, আঁচড় কাটা হতো মোম বা গাছের ছাল বা চামড়ায়; বাঁশ বা পেপিরাস বা সিল্কে রং মাখিয়ে আঁকা হতো। কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় অন্তলিখনগুলো ছাড়া একেবারে একটি কপি সর্বদা ক্ষুদ্রসংখ্যক পাঠকগোষ্ঠীর জন্য সীমিত থাকত। তারপর দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে কাগজ, কালি এবং খোদাই করা কাঠের ব্লকসম্পন্ন মুদ্রণপদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছিল চীনে। ফলে কোনো রচনার অনেক কপি প্রস্তুত এবং বিতরণ করা গেল। এই ধারণাটি অনুধাবনে পিছিয়ে থাকা সুদূর ইউরোপের এক হাজার বছর সময় লেগে গিয়েছিল।
তারপর হঠাৎ পৃথিবীব্যাপী গ্রন্থগুলো ছাপা হতে লাগল। ঠিক স্থানান্তর টাইপ উদ্ভাবনের পূর্বে, প্রায় ১৪৫০ সালের দিকে, সমগ্র ইউরোপে ৩০-৪০ হাজারের চেয়ে বেশি ছিল না, সবই হস্তলিখিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে চীনে অথবা আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে যতগুলো ছিল,
সেটা তার মাত্র এক-দশমাংশ। অথচ এর মাত্র ৫০ বছর পরই, প্রায় এক কোটি ছাপানো বই ছড়িয়ে পড়ল ১৫০০ সালের দিকে। পড়তে পারা সবার কাছে জ্ঞান অর্জন অনেক সহজসাধ্য হয়ে গেল। যেন সর্বত্র জাদুর ছোঁয়া লাগল!
অতিসম্প্রতি গ্রন্থগুলো, বিশেষত সুলভ সংস্করণ বিপুল সংখ্যায় ও স্বল্পব্যয়ে ছাপা হয়। মধ্যম মানের খাদ্যমূল্যের বিনিময়ে আপনি ভাবতে পারেন রোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন, প্রজাতির উৎপত্তি, স্বপ্নের ব্যাখ্যা, বস্তুর প্রকৃতি নিয়ে। আপনি অ্যালিমেন্টসের জ্যামিতিকে আত্মস্থ করতে পারেন। মানব প্রজাতির কী বিশাল অর্জন! অথচ জ্ঞানার্জন ডিগ্রির হাতে বন্দী হলো, ভাবতে অবাক লাগে। গ্রন্থ হলো বীজের মতো। শত শত বছর ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তারপর সবচেয়ে সম্ভাবনাহীন ক্ষেত্রকেও ফুল ফুটিয়ে বিকশিত করতে পারে।
বিশ্বের বড় বড় গ্রন্থাগার ধারণ করে লাখ লাখ খণ্ড, শব্দের বিবেচনায় ১০-১৪ বিট তথ্যের সমতুল্য এবং সম্ভবত ছবির বিবেচনায় ১০-১৫ বিটের সমতুল্য। এগুলো আমাদের জিনের তথ্য ধারণক্ষমতার চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি, এমনকি আমাদের মস্তিষ্কের চেয়েও ১০ গুণ বেশি। যদি সপ্তাহে একটা বইও শেষ করি, আমার জীবনে শুধু স্বল্প কয়েক হাজার বই আমি পড়ব, যা আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগারগুলোর ধারণকৃত ১ শতাংশের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। কৌশলটি হলো জানা বা বোঝা—কোন বইটি পড়তে হবে। গ্রন্থগুলোর জন্ম মুহূর্ত থেকেই এর তথ্য স্থিরকৃত নয়। বরং ঘটনাগুলোর প্রভাবে নিয়ত পরিবর্তনশীল।
আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পর তেইশ শ বছরের পথ অতিক্রম করে আমরা এই বর্তমানে। যদি কোনো বই না থাকত, কোনো লিখিত নথিপত্র না থাকত, চিন্তা করি কত বিস্ময়কর ও অপরিমেয় একটা সময় হতো তেইশ শ বছর! চারটি প্রজন্ম নিয়ে প্রতি শতাব্দী হলে, তেইশ শতাব্দী ধারণ করে প্রায় এক শ প্রজন্মের মানুষকে। যদি তথ্যগুলো শুধু মুখের কথায় প্রবাহিত হতো, কত অল্প আমাদের অতীত সম্পর্কে জানা সম্ভব হতো, কত ধীর হতো আমাদের অগ্রগতি! প্রাচীন অনুসন্ধানগুলো সম্বন্ধে আমাদের দৈবাৎ জানার ওপর প্রত্যেক জিনিস নির্ভর করত এবং সেই সঙ্গে সেগুলোর সত্যতার মাত্রাও। অতীতের তথ্যাবলি হয়তো শ্রদ্ধাযোগ্য বলেই বিবেচিত হতো, কিন্তু পর্যায়ক্রমিকভাবে পুনঃকথন বা বর্ণনায় এটা হয়ে উঠত বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্তিকর এবং শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যেত।
যেমনটি আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমরা দুদিন আগের ঘটনা নিয়েও ধূম্রজাল তৈরি করি, বিভিন্নজনের মতামত আমাদের বিভ্রান্তির জালে ফেলে দেয়। আমরা যদি অন্তত দৈনিক পত্রিকার (সংবাদ, ইত্তেফাক, অবজারভার) আর্কাইভগুলো অনলাইনে মেলে ধরতে পারি, টাইমলাইন তৈরি করতে পারি, তাহলে গোলমেলে সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। পুনরাবৃত্তি থেকে সামনের দিকে পথ চলতে পারি।
পূর্বপুরুষদের জ্ঞানার্জন ও প্রজ্ঞা আরোহণে বইগুলো আমাদের সময় ভ্রমণে অনুমোদন দেয়। গ্রন্থাগার প্রকৃতি থেকে কষ্ট সহকারে বের করা মহাপ্রতিভাদের অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের সংযুক্ত করে। সংযুক্ত করে সমগ্র গ্রহ থেকে ও আমাদের ইতিহাসের সব অংশ থেকে বের করে আনা সর্বোত্তম শিক্ষকদের সঙ্গে; যাঁরা কোনো একসময় বেঁচে ছিলেন, যাঁরা ক্লান্তিহীনভাবে আমাদের দিকনির্দেশনা দেন এবং মানব প্রজাতির সামগ্রিক জ্ঞানে নিজেদের অবদান যোগ করতে আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। পাবলিক গ্রন্থাগারগুলো নির্ভর করে স্বেচ্ছাসেবামূলক ভূমিকার ওপর। আমি মনে করি, আমাদের সভ্যতার সমৃদ্ধি, আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তিকে অবলম্বন করে আমাদের সচেতনতার গভীরতা এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের উদ্বেগ—সবকিছু যাচাই হতে পারে কতটা আমাদের গ্রন্থাগারগুলোকে গুরুত্ব দিই তার ওপর।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
মস্তিষ্ক বিকাশের কারণে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে বুদ্ধিমত্তা মানে চারপাশ থেকে সরাসরি শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেই সঙ্গে বিচারবুদ্ধিও। যার মাধ্যমে তথ্যগুলোকে সমন্বয় সাধন ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কে আগে আভাস পাওয়া সম্ভব হয়, যা জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্কেরও উদ্ভব ঘটেছে। লাখ লাখ বছর ধরে জটিলতা ও তথ্য ধারণের মধ্য দিয়ে এটি বিকাশ লাভ করেছে।
জিনের চেয়ে বর্তমানে আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি জানে। কেননা মস্তিষ্ক লাইব্রেরি ১০ হাজার গুণ বড়। এরপর আমরা প্রয়োজনবোধ করলাম মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু জানতে, সেই সময়টা এসেছিল ১০ হাজার বছর আগে। ফলে শরীরের বাইরে বিশাল পরিমাণে তথ্য মজুত রাখার পদ্ধতি আমরা শিখেছিলাম। মস্তিষ্কের বাইরে তথ্য সংরক্ষণের প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। স্মরণ, তুলনা, সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ এবং বিমূর্ত তৈরি করার মতো ক্ষমতার কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। ফলে এই গ্রহে আমরাই একমাত্র প্রাণী, যারা এমন এক স্মৃতি সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে সামর্থ্য হয়েছিলাম, যার জন্য আমাদের জিনেরও দরকার নেই, এমনকি মস্তিষ্কেরও দরকার নেই। স্মৃতির এই আধারকে বলা হয় গ্রন্থাগার। এটাই এক্সট্রসোমেটিক নলেজ। এই প্রবণতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার।
মূলত মিসরের গ্রিক রাজারা এই গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। আলেক্সান্দারের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁরা শিক্ষার ব্যাপারে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন। শত শত বছর গবেষণাকর্মকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন এবং সে যুগের সবচেয়ে বড় মনীষীদের কাজকর্মের জন্য গ্রন্থাগারের পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। গ্রন্থ তৈরি হয় গাছপালা থেকে। এটা হলো সমতল ও নমনীয় অংশগুলোর (এখনো যাকে ‘পাতা’ই বলা হয়) সমাবেশ যাতে গাঢ় রঞ্জক পদার্থ দিয়ে আঁকাবাঁকা প্যাঁচানো হস্তাক্ষরের লেখা ছাপানো হয়। এতে একবার ক্ষণিকের দৃষ্টি দিলে আপনি শুনতে পাবেন অন্য ব্যক্তির কণ্ঠস্বর—হয়তো হাজার হাজার বছর আগের মৃতদের কারও। সহস্র বছর দূর থেকে লেখক আপনার মাথার ভেতরে স্পষ্ট ও নিশ্চুপভাবে আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে।
লিখন পদ্ধতি সম্ভবত মানবজাতির মহত্তম উদ্ভাবন, যা জনমানুষকে, দূরবর্তী সময়ের নাগরিকদের একত্রে বাঁধে, যারা কখনোই পরস্পরকে চেনে না। গ্রন্থ সময়ের শৃঙ্খলা ভাঙে, মানুষের জাদুকরি সামর্থ্যকে প্রমাণ করে। প্রাচীনতম লেখকদের কেউ কেউ কাদামাটির ওপর লিখেছিলেন। পশ্চিমা বর্ণমালার সুদূর পূর্বসূরি কীলকাকার (কিউনিফর্ম—পারস্য অ্যাসিরিয়া প্রভৃতি দেশের প্রাচীন শিলালিপিতে দৃষ্ট কীলকাকার বর্ণমালা) লিখন উদ্ভাবিত হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নিকট-প্রাচ্যে। নথিপত্র সংরক্ষণ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য—শস্য ক্রয়, জমি বিক্রি, রাজার বিজয়, যাজকদের মূর্তি, নক্ষত্রগুলোর অবস্থান, দেবতাদের কাছে প্রার্থনা। হাজার হাজার বছর ধরে, লিখনকে কাদামাটি ও পাথরের মধ্যে খোদাই করা হতো, আঁচড় কাটা হতো মোম বা গাছের ছাল বা চামড়ায়; বাঁশ বা পেপিরাস বা সিল্কে রং মাখিয়ে আঁকা হতো। কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় অন্তলিখনগুলো ছাড়া একেবারে একটি কপি সর্বদা ক্ষুদ্রসংখ্যক পাঠকগোষ্ঠীর জন্য সীমিত থাকত। তারপর দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে কাগজ, কালি এবং খোদাই করা কাঠের ব্লকসম্পন্ন মুদ্রণপদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছিল চীনে। ফলে কোনো রচনার অনেক কপি প্রস্তুত এবং বিতরণ করা গেল। এই ধারণাটি অনুধাবনে পিছিয়ে থাকা সুদূর ইউরোপের এক হাজার বছর সময় লেগে গিয়েছিল।
তারপর হঠাৎ পৃথিবীব্যাপী গ্রন্থগুলো ছাপা হতে লাগল। ঠিক স্থানান্তর টাইপ উদ্ভাবনের পূর্বে, প্রায় ১৪৫০ সালের দিকে, সমগ্র ইউরোপে ৩০-৪০ হাজারের চেয়ে বেশি ছিল না, সবই হস্তলিখিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে চীনে অথবা আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে যতগুলো ছিল,
সেটা তার মাত্র এক-দশমাংশ। অথচ এর মাত্র ৫০ বছর পরই, প্রায় এক কোটি ছাপানো বই ছড়িয়ে পড়ল ১৫০০ সালের দিকে। পড়তে পারা সবার কাছে জ্ঞান অর্জন অনেক সহজসাধ্য হয়ে গেল। যেন সর্বত্র জাদুর ছোঁয়া লাগল!
অতিসম্প্রতি গ্রন্থগুলো, বিশেষত সুলভ সংস্করণ বিপুল সংখ্যায় ও স্বল্পব্যয়ে ছাপা হয়। মধ্যম মানের খাদ্যমূল্যের বিনিময়ে আপনি ভাবতে পারেন রোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন, প্রজাতির উৎপত্তি, স্বপ্নের ব্যাখ্যা, বস্তুর প্রকৃতি নিয়ে। আপনি অ্যালিমেন্টসের জ্যামিতিকে আত্মস্থ করতে পারেন। মানব প্রজাতির কী বিশাল অর্জন! অথচ জ্ঞানার্জন ডিগ্রির হাতে বন্দী হলো, ভাবতে অবাক লাগে। গ্রন্থ হলো বীজের মতো। শত শত বছর ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তারপর সবচেয়ে সম্ভাবনাহীন ক্ষেত্রকেও ফুল ফুটিয়ে বিকশিত করতে পারে।
বিশ্বের বড় বড় গ্রন্থাগার ধারণ করে লাখ লাখ খণ্ড, শব্দের বিবেচনায় ১০-১৪ বিট তথ্যের সমতুল্য এবং সম্ভবত ছবির বিবেচনায় ১০-১৫ বিটের সমতুল্য। এগুলো আমাদের জিনের তথ্য ধারণক্ষমতার চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি, এমনকি আমাদের মস্তিষ্কের চেয়েও ১০ গুণ বেশি। যদি সপ্তাহে একটা বইও শেষ করি, আমার জীবনে শুধু স্বল্প কয়েক হাজার বই আমি পড়ব, যা আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগারগুলোর ধারণকৃত ১ শতাংশের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। কৌশলটি হলো জানা বা বোঝা—কোন বইটি পড়তে হবে। গ্রন্থগুলোর জন্ম মুহূর্ত থেকেই এর তথ্য স্থিরকৃত নয়। বরং ঘটনাগুলোর প্রভাবে নিয়ত পরিবর্তনশীল।
আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পর তেইশ শ বছরের পথ অতিক্রম করে আমরা এই বর্তমানে। যদি কোনো বই না থাকত, কোনো লিখিত নথিপত্র না থাকত, চিন্তা করি কত বিস্ময়কর ও অপরিমেয় একটা সময় হতো তেইশ শ বছর! চারটি প্রজন্ম নিয়ে প্রতি শতাব্দী হলে, তেইশ শতাব্দী ধারণ করে প্রায় এক শ প্রজন্মের মানুষকে। যদি তথ্যগুলো শুধু মুখের কথায় প্রবাহিত হতো, কত অল্প আমাদের অতীত সম্পর্কে জানা সম্ভব হতো, কত ধীর হতো আমাদের অগ্রগতি! প্রাচীন অনুসন্ধানগুলো সম্বন্ধে আমাদের দৈবাৎ জানার ওপর প্রত্যেক জিনিস নির্ভর করত এবং সেই সঙ্গে সেগুলোর সত্যতার মাত্রাও। অতীতের তথ্যাবলি হয়তো শ্রদ্ধাযোগ্য বলেই বিবেচিত হতো, কিন্তু পর্যায়ক্রমিকভাবে পুনঃকথন বা বর্ণনায় এটা হয়ে উঠত বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্তিকর এবং শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যেত।
যেমনটি আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমরা দুদিন আগের ঘটনা নিয়েও ধূম্রজাল তৈরি করি, বিভিন্নজনের মতামত আমাদের বিভ্রান্তির জালে ফেলে দেয়। আমরা যদি অন্তত দৈনিক পত্রিকার (সংবাদ, ইত্তেফাক, অবজারভার) আর্কাইভগুলো অনলাইনে মেলে ধরতে পারি, টাইমলাইন তৈরি করতে পারি, তাহলে গোলমেলে সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। পুনরাবৃত্তি থেকে সামনের দিকে পথ চলতে পারি।
পূর্বপুরুষদের জ্ঞানার্জন ও প্রজ্ঞা আরোহণে বইগুলো আমাদের সময় ভ্রমণে অনুমোদন দেয়। গ্রন্থাগার প্রকৃতি থেকে কষ্ট সহকারে বের করা মহাপ্রতিভাদের অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের সংযুক্ত করে। সংযুক্ত করে সমগ্র গ্রহ থেকে ও আমাদের ইতিহাসের সব অংশ থেকে বের করে আনা সর্বোত্তম শিক্ষকদের সঙ্গে; যাঁরা কোনো একসময় বেঁচে ছিলেন, যাঁরা ক্লান্তিহীনভাবে আমাদের দিকনির্দেশনা দেন এবং মানব প্রজাতির সামগ্রিক জ্ঞানে নিজেদের অবদান যোগ করতে আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। পাবলিক গ্রন্থাগারগুলো নির্ভর করে স্বেচ্ছাসেবামূলক ভূমিকার ওপর। আমি মনে করি, আমাদের সভ্যতার সমৃদ্ধি, আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তিকে অবলম্বন করে আমাদের সচেতনতার গভীরতা এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের উদ্বেগ—সবকিছু যাচাই হতে পারে কতটা আমাদের গ্রন্থাগারগুলোকে গুরুত্ব দিই তার ওপর।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯ ঘণ্টা আগেদেশে প্রতিবছর বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বাস্তবায়নের সময় মাঝে মাঝে সংবাদ চোখে পড়ে যে প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কাটা পড়ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, খাল ও জলাভূমি ভরাট হচ্ছে, নির্মাণস্থলে নির্মাণকাজের ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো প্রকল্প গ্রহণের ফলে পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব...
১৯ ঘণ্টা আগেপাহাড় রক্ষা করা যখন খুবই জরুরি, তখন সে পাহাড় কেটে গোটা অঞ্চলের জন্য বিপদ ডেকে আনছে একদল দুর্বৃত্ত। খাগড়াছড়ির পানছড়ি এলাকায় অবাধে পাহাড় কাটা হচ্ছে, অথচ সরকারি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছেন।
১৯ ঘণ্টা আগে১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন, তাঁকে করা হয়েছিল দলের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে শামসুল হক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
২ দিন আগে