অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতির এক বছর
সেলিম জাহান
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। তাদের শাসন আমলে একটি নতুন অর্থবছরেরও সূচনা হয়েছে। আজ বছর পেরিয়ে অনেকেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন—অর্জন কতটুকু, ব্যর্থতা কোথায় এবং অন্তরায় কী কী? এমন একটি হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার যখন দেশ পরিচালনায় এসেছিল, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছিল। প্রাপ্ত সব তথ্য-উপাত্তই অর্থনীতির নানান দুর্বলতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল এবং এটা খুব পরিষ্কার ছিল যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্যে ছিল। অর্থনীতির আপাত দৃশ্যমান সমস্যা ভিন্ন। নানান কাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। যেমন অর্থনৈতির শৃঙ্খলার অভাব, সুশাসনের অনুপস্থিতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতার ভেঙে পড়া কাঠামো, অর্থনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, দেশের সম্পদ পাচার, সরকারি উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস ইত্যাদি।
গত ১২ মাসে অর্থনীতির বিভিন্ন অঙ্গনে কিছু কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন বৈদেশিক মুদ্রা মজুত এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের কিছু কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে, বিদেশ থেকে শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যও কিছুটা নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শুল্কযুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা আদায় করতে পেরেছে।
সেই সঙ্গে নানান অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কথাও বলেছেন অনেক বিজ্ঞজন। অর্থনৈতিক শ্লথতা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩-৪ শতাংশের বেশি নয়। দেশজ উৎপাদন তার আগের জায়গায় ফেরত যায়নি। কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। দেশের ২৭ লাখ মানুষ এখনো বেকার।
যদিও মূল্য পরিস্থিতিতে কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে, কিন্তু দেশের মূল্যস্ফীতি এখনো খুব বেশি। বাজারে চালের দাম এখনো কমেনি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো বিরাজমান, এবং তারা এখনো স্বস্তির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। অর্থনীতিতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। অর্থনীতিতে দেয় ভর্তুকি এবং বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট বোঝা হয়ে থাকছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আরও ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়তে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থবছরের বাজেটকে ‘প্রথাগত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ বাজেট জনগণকে উদ্দীপ্ত বা উজ্জীবিত—কোনোটাই করতে পারেনি।
এ পটভূমিতে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় কী কী অন্তরায় আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। তিন রকমের অন্তরায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে—একটি রাজনৈতিক, অন্যটি সামাজিক এবং তৃতীয়টি অর্থনৈতিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্তরায়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না, এগুলো দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি বড় সমস্যা, যা দেশের অর্থনীতির ওপর বিরাট একটা প্রভাব ফেলবে। যদিও নির্বাচনের সময় ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন ঘিরে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের নানান বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে—সংবিধান সংস্কার, জনপ্রশাসন কাঠামোর সংস্কার, রাজনৈতিক মতৈক্য ইত্যাদি। তিনটি পন্থায় এসব রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাগুলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। প্রথমত, এসব রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশি বা বিদেশি কোনো রকমের বিনিয়োগই প্রত্যাশিত হারে অর্থনীতিতে আসছে না। বিনিয়োগের শ্লথতা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে, যার ফলে দেশে কর্মহীনতা বাড়ছে এবং দেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আমাদের বাণিজ্য অংশীজনেরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত নয় এবং সে কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চুক্তি করতে ইতস্তত করছে। যেমন তৈরি পোশাক খাতে বৈদেশিক চাহিদা প্রত্যাশিত হারে ত্বরান্বিত হয়নি। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নানান মহলে অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে নানান প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এ-জাতীয় জনদৃষ্টিভঙ্গি একটি নাজুক অর্থনীতির উত্তরণের পক্ষে শুভ নয়।
সামাজিক অঙ্গনে বাংলাদেশ অর্থনীতি নানান অন্তরায়ের সম্মুখীন। সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সার্বিক একটি নিরাপত্তাহীনতার উপলব্ধি, দুর্নীতির বিস্তার ব্যবসা-বাণিজ্যকে শঙ্কিত করছে, যেখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা ব্যবসায়ীরা নিরাপদ বোধ করছেন না। এ অবস্থায় উৎপাদন, বাণিজ্য কিংবা সেবা প্রদান উন্নতি করতে পারে না। সেই সঙ্গে আমাদের সমাজে ‘মব সংস্কৃতি’ ব্যতিক্রম নয়, নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গনেও সংঘাত এবং সহিংসতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নানান গ্যাং, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বেপরোয়া চাঁদাবাজি, অর্থ এবং নানান নিয়মবহির্ভূত সুবিধার বেআইনি দাবির শিকার হচ্ছে। এসব কিছু ব্যবসা-বিস্তারকে অবরুদ্ধ করে। যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাস্তা অবরোধ, যত্রতত্র সমাবেশ, আন্দোলন এবং সেই সঙ্গে সংঘাত, সহিংসতা এবং সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ-জাতীয় কর্মকাণ্ড পরিবহন ও যাতায়াতব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে এবং দেশের প্রতিদিনকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে। দেশের বর্তমান সামাজিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় বিরাট এক অন্তরায়।
আগামী দিনগুলোতে নানান অর্থনৈতিক অন্তরায়ের সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। এর কিছু কিছু দেশজ, কিছু কিছু বৈশ্বিক। দেশজ অঙ্গনে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে অব্যাহত থাকবে। শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং বিস্তৃত কর্মহীনতা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে থাকবে। দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এখনো প্রার্থিত স্তরে পৌঁছায়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এবং সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা এই উৎপাদন স্তরকে আরও বিপর্যস্ত করতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করবে।
দারিদ্র্যের বিস্তার এবং সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাজুকতার সম্ভাবনার বৃদ্ধি আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। নানান তথ্য-উপাত্ত থেকে দেশে দারিদ্র্যের বিস্তার এবং নাজুকতার গভীরতা সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। যেমন নিম্ন আয়ের মানুষের ৮৮ শতাংশ মানুষ দুবেলা ভাত খেতে পারে না। তারা একবেলা পাউরুটি কিংবা বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেয়। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের মাসিক আয় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাঁদের তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ আজকাল সকালের নাশতা খায় না, কারণ সেটা খাওয়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। এ প্রবণতা চলতে থাকলে পুষ্টিহীনতা একটি মানব উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে, বিশেষত শিশুদের মধ্যে। দেশে অসমতা ঊর্ধ্বমুখী এবং বৈষম্য শুধু আয় ও সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বৈষম্য আজ সুযোগের মধ্যে বিস্তৃত। এ সুযোগের মধ্যে আছে শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিগমনের সুযোগ। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশি সমাজে সার্বিক অসমতার অন্যতম চালিকাশক্তি হবে সুযোগের বৈষম্য।
যদিও দেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেমন বিধিনিষেধের যথাযথ প্রয়োগ, অর্থ পাচার বন্ধ ইত্যাদি; কিন্তু ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যাংকিং শৃঙ্খলা প্রয়োগ এখনো অর্জিত হয়নি। কু-ঋণ, ঋণের অপর্যাপ্ততা, অদক্ষতা ও অকার্যকারিতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এ খাতের সমস্যা হিসেবে এখনো বিরাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি সু-অবস্থানে আছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি অধিক পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করেছে বলে, নাকি বৈদেশিক খাতে কাঠামোগত উন্নতির ফলে? আগামী দিনগুলোতে সরকারি ঋণ একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হবে। বর্তমান অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকারি ঋণ ৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে—৫ লাখ কোটি টাকা থেকে ৯ লাখ কোটি টাকায়। বর্তমান বছরের প্রথম তিন মাসে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪৫ কোটি ডলার বেড়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত সময় শিগগিরই উতরে যাবে। তখন ঋণ পরিশোধের চাপ অর্থব্যবস্থায় টের পাওয়া যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২৮ সালের অর্থবছর নাগাদ সরকারের ঋণভার ২৮ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করবে। একদিকে উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় একটি সমস্যা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেয় ভর্তুকিও একটি ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে আমদানিকৃত উপকরণের ওপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। জ্বালানি খাতে যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেয়। জ্বালানি খাতে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ভোগ করে সমাজের ধনাঢ্য এবং সম্পদশালী অংশ। আমাদের জ্বালানি খাতে দেয় ভর্তুকির ৫৪ শতাংশই যায় আমাদের দেশের ৪০ শতাংশ সবচেয়ে সম্পদশালী গোষ্ঠীর কাছে।
আগামী দিনগুলোতে রাজস্ব আদায়ের শ্লথতা বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। এই ঘাটতির নানান কারণ রয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথতা, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ছাঁটাই, বেশ কিছুদিন ধরে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং কর্মবিরতি। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য মনে করেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাই বাস্তবসম্মত ছিল না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব প্রবণতার কিছু কিছু আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে। সুতরাং রাজস্ব আদায়ের সমস্যাগুলোও আগামী সময়ে অব্যাহত থাকবে। অধিকন্তু, এখনো বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ আয়করের মতো প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভর করে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে অধিকতর রাজস্ব আহরণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের শর্তও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান কতগুলো মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা এ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেমন, আর্থিক খাতে কিছু কিছু উন্নতি হলেও আর্থিক শৃঙ্খলা, বিধিনিষেধের প্রতিস্থাপন এখনো তেমনভাবে হয়নি। দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি এখনো অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত করা যায়নি। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মাঝে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন অন্তরায় মোকাবিলা করার জন্য আগাম প্রস্তুতির সংস্কৃতিও লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত।
বৈদেশিক খাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি তিনটে বিষয়ে চাপের সম্মুখীন হবে। প্রথমত, এ বছর এবং আগামী বছরও বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি প্রবৃদ্ধি-শ্লথতায় ভুগবে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতি এড়াতে পারবে না। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হবে। এসব শুল্কের মোকাবিলা বাংলাদেশকে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু কিছু সুযোগ হারাবে, যেমন, স্বল্প বা শূন্য শুল্কে রপ্তানি সুবিধা, অনুদান সুবিধা ইত্যাদি। সুতরাং উত্তরণ-পরবর্তীকালে উত্থিত বাংলাদেশকে বিষয়গুলোকেও মোকাবিলা করতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্বের নানান জায়গার যুদ্ধ এবং সংঘাতের প্রভাবও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে।
আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ জটিলতাগুলো অব্যাহত থাকবে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতা এসব অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলবে। সেই সঙ্গে থাকবে নানান বৈশ্বিক সংকট। আগামী বছর নির্বাচনের পর একটি নির্বাচিত সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অন্তরায়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিজ নিজ অর্থনৈতিক ইশতেহার তৈরি করা, যার ভিত্তিতে তারা নির্বাচন করবে এবং সরকার গঠন করলে কালক্ষেপণ না করে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথযাত্রার একটি রূপরেখা দিতে পারে।
লেখক:– অর্থনীতিবিদ
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। তাদের শাসন আমলে একটি নতুন অর্থবছরেরও সূচনা হয়েছে। আজ বছর পেরিয়ে অনেকেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন—অর্জন কতটুকু, ব্যর্থতা কোথায় এবং অন্তরায় কী কী? এমন একটি হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার যখন দেশ পরিচালনায় এসেছিল, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছিল। প্রাপ্ত সব তথ্য-উপাত্তই অর্থনীতির নানান দুর্বলতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল এবং এটা খুব পরিষ্কার ছিল যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্যে ছিল। অর্থনীতির আপাত দৃশ্যমান সমস্যা ভিন্ন। নানান কাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। যেমন অর্থনৈতির শৃঙ্খলার অভাব, সুশাসনের অনুপস্থিতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতার ভেঙে পড়া কাঠামো, অর্থনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, দেশের সম্পদ পাচার, সরকারি উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস ইত্যাদি।
গত ১২ মাসে অর্থনীতির বিভিন্ন অঙ্গনে কিছু কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন বৈদেশিক মুদ্রা মজুত এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের কিছু কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে, বিদেশ থেকে শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যও কিছুটা নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শুল্কযুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা আদায় করতে পেরেছে।
সেই সঙ্গে নানান অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কথাও বলেছেন অনেক বিজ্ঞজন। অর্থনৈতিক শ্লথতা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩-৪ শতাংশের বেশি নয়। দেশজ উৎপাদন তার আগের জায়গায় ফেরত যায়নি। কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। দেশের ২৭ লাখ মানুষ এখনো বেকার।
যদিও মূল্য পরিস্থিতিতে কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে, কিন্তু দেশের মূল্যস্ফীতি এখনো খুব বেশি। বাজারে চালের দাম এখনো কমেনি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো বিরাজমান, এবং তারা এখনো স্বস্তির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। অর্থনীতিতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। অর্থনীতিতে দেয় ভর্তুকি এবং বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট বোঝা হয়ে থাকছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আরও ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়তে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থবছরের বাজেটকে ‘প্রথাগত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ বাজেট জনগণকে উদ্দীপ্ত বা উজ্জীবিত—কোনোটাই করতে পারেনি।
এ পটভূমিতে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় কী কী অন্তরায় আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। তিন রকমের অন্তরায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে—একটি রাজনৈতিক, অন্যটি সামাজিক এবং তৃতীয়টি অর্থনৈতিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্তরায়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না, এগুলো দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি বড় সমস্যা, যা দেশের অর্থনীতির ওপর বিরাট একটা প্রভাব ফেলবে। যদিও নির্বাচনের সময় ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন ঘিরে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের নানান বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে—সংবিধান সংস্কার, জনপ্রশাসন কাঠামোর সংস্কার, রাজনৈতিক মতৈক্য ইত্যাদি। তিনটি পন্থায় এসব রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাগুলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। প্রথমত, এসব রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশি বা বিদেশি কোনো রকমের বিনিয়োগই প্রত্যাশিত হারে অর্থনীতিতে আসছে না। বিনিয়োগের শ্লথতা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে, যার ফলে দেশে কর্মহীনতা বাড়ছে এবং দেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আমাদের বাণিজ্য অংশীজনেরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত নয় এবং সে কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চুক্তি করতে ইতস্তত করছে। যেমন তৈরি পোশাক খাতে বৈদেশিক চাহিদা প্রত্যাশিত হারে ত্বরান্বিত হয়নি। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নানান মহলে অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে নানান প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এ-জাতীয় জনদৃষ্টিভঙ্গি একটি নাজুক অর্থনীতির উত্তরণের পক্ষে শুভ নয়।
সামাজিক অঙ্গনে বাংলাদেশ অর্থনীতি নানান অন্তরায়ের সম্মুখীন। সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সার্বিক একটি নিরাপত্তাহীনতার উপলব্ধি, দুর্নীতির বিস্তার ব্যবসা-বাণিজ্যকে শঙ্কিত করছে, যেখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা ব্যবসায়ীরা নিরাপদ বোধ করছেন না। এ অবস্থায় উৎপাদন, বাণিজ্য কিংবা সেবা প্রদান উন্নতি করতে পারে না। সেই সঙ্গে আমাদের সমাজে ‘মব সংস্কৃতি’ ব্যতিক্রম নয়, নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গনেও সংঘাত এবং সহিংসতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নানান গ্যাং, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বেপরোয়া চাঁদাবাজি, অর্থ এবং নানান নিয়মবহির্ভূত সুবিধার বেআইনি দাবির শিকার হচ্ছে। এসব কিছু ব্যবসা-বিস্তারকে অবরুদ্ধ করে। যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাস্তা অবরোধ, যত্রতত্র সমাবেশ, আন্দোলন এবং সেই সঙ্গে সংঘাত, সহিংসতা এবং সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ-জাতীয় কর্মকাণ্ড পরিবহন ও যাতায়াতব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে এবং দেশের প্রতিদিনকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে। দেশের বর্তমান সামাজিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় বিরাট এক অন্তরায়।
আগামী দিনগুলোতে নানান অর্থনৈতিক অন্তরায়ের সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। এর কিছু কিছু দেশজ, কিছু কিছু বৈশ্বিক। দেশজ অঙ্গনে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে অব্যাহত থাকবে। শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং বিস্তৃত কর্মহীনতা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে থাকবে। দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এখনো প্রার্থিত স্তরে পৌঁছায়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এবং সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা এই উৎপাদন স্তরকে আরও বিপর্যস্ত করতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করবে।
দারিদ্র্যের বিস্তার এবং সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাজুকতার সম্ভাবনার বৃদ্ধি আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। নানান তথ্য-উপাত্ত থেকে দেশে দারিদ্র্যের বিস্তার এবং নাজুকতার গভীরতা সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। যেমন নিম্ন আয়ের মানুষের ৮৮ শতাংশ মানুষ দুবেলা ভাত খেতে পারে না। তারা একবেলা পাউরুটি কিংবা বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেয়। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের মাসিক আয় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাঁদের তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ আজকাল সকালের নাশতা খায় না, কারণ সেটা খাওয়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। এ প্রবণতা চলতে থাকলে পুষ্টিহীনতা একটি মানব উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে, বিশেষত শিশুদের মধ্যে। দেশে অসমতা ঊর্ধ্বমুখী এবং বৈষম্য শুধু আয় ও সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বৈষম্য আজ সুযোগের মধ্যে বিস্তৃত। এ সুযোগের মধ্যে আছে শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিগমনের সুযোগ। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশি সমাজে সার্বিক অসমতার অন্যতম চালিকাশক্তি হবে সুযোগের বৈষম্য।
যদিও দেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেমন বিধিনিষেধের যথাযথ প্রয়োগ, অর্থ পাচার বন্ধ ইত্যাদি; কিন্তু ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যাংকিং শৃঙ্খলা প্রয়োগ এখনো অর্জিত হয়নি। কু-ঋণ, ঋণের অপর্যাপ্ততা, অদক্ষতা ও অকার্যকারিতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এ খাতের সমস্যা হিসেবে এখনো বিরাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি সু-অবস্থানে আছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি অধিক পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করেছে বলে, নাকি বৈদেশিক খাতে কাঠামোগত উন্নতির ফলে? আগামী দিনগুলোতে সরকারি ঋণ একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হবে। বর্তমান অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকারি ঋণ ৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে—৫ লাখ কোটি টাকা থেকে ৯ লাখ কোটি টাকায়। বর্তমান বছরের প্রথম তিন মাসে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪৫ কোটি ডলার বেড়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত সময় শিগগিরই উতরে যাবে। তখন ঋণ পরিশোধের চাপ অর্থব্যবস্থায় টের পাওয়া যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২৮ সালের অর্থবছর নাগাদ সরকারের ঋণভার ২৮ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করবে। একদিকে উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় একটি সমস্যা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেয় ভর্তুকিও একটি ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে আমদানিকৃত উপকরণের ওপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। জ্বালানি খাতে যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেয়। জ্বালানি খাতে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ভোগ করে সমাজের ধনাঢ্য এবং সম্পদশালী অংশ। আমাদের জ্বালানি খাতে দেয় ভর্তুকির ৫৪ শতাংশই যায় আমাদের দেশের ৪০ শতাংশ সবচেয়ে সম্পদশালী গোষ্ঠীর কাছে।
আগামী দিনগুলোতে রাজস্ব আদায়ের শ্লথতা বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। এই ঘাটতির নানান কারণ রয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথতা, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ছাঁটাই, বেশ কিছুদিন ধরে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং কর্মবিরতি। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য মনে করেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাই বাস্তবসম্মত ছিল না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব প্রবণতার কিছু কিছু আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে। সুতরাং রাজস্ব আদায়ের সমস্যাগুলোও আগামী সময়ে অব্যাহত থাকবে। অধিকন্তু, এখনো বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ আয়করের মতো প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভর করে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে অধিকতর রাজস্ব আহরণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের শর্তও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান কতগুলো মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা এ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেমন, আর্থিক খাতে কিছু কিছু উন্নতি হলেও আর্থিক শৃঙ্খলা, বিধিনিষেধের প্রতিস্থাপন এখনো তেমনভাবে হয়নি। দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি এখনো অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত করা যায়নি। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মাঝে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন অন্তরায় মোকাবিলা করার জন্য আগাম প্রস্তুতির সংস্কৃতিও লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত।
বৈদেশিক খাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি তিনটে বিষয়ে চাপের সম্মুখীন হবে। প্রথমত, এ বছর এবং আগামী বছরও বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি প্রবৃদ্ধি-শ্লথতায় ভুগবে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতি এড়াতে পারবে না। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হবে। এসব শুল্কের মোকাবিলা বাংলাদেশকে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু কিছু সুযোগ হারাবে, যেমন, স্বল্প বা শূন্য শুল্কে রপ্তানি সুবিধা, অনুদান সুবিধা ইত্যাদি। সুতরাং উত্তরণ-পরবর্তীকালে উত্থিত বাংলাদেশকে বিষয়গুলোকেও মোকাবিলা করতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্বের নানান জায়গার যুদ্ধ এবং সংঘাতের প্রভাবও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে।
আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ জটিলতাগুলো অব্যাহত থাকবে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতা এসব অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলবে। সেই সঙ্গে থাকবে নানান বৈশ্বিক সংকট। আগামী বছর নির্বাচনের পর একটি নির্বাচিত সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অন্তরায়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিজ নিজ অর্থনৈতিক ইশতেহার তৈরি করা, যার ভিত্তিতে তারা নির্বাচন করবে এবং সরকার গঠন করলে কালক্ষেপণ না করে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথযাত্রার একটি রূপরেখা দিতে পারে।
লেখক:– অর্থনীতিবিদ
আমরা যেন এক কদম সামনে বাড়লে পিছিয়ে পড়ি আরও দশ কদম। তখন সেই এক কদম এগিয়ে যাওয়াকে বড্ড ম্লান মনে হয়। গত প্রায় এক দশক ধরেই ঢাকার বায়ু ও পরিবেশ দূষণের শিকার। এখনো আমরা শীর্ষ বা এর আশপাশে অবস্থান করছি। এত সংস্কার কমিটি হলো, শুনেছি পরিবেশ উন্নয়নের জন্যও নাকি কমিটি গঠিত হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে কোনোটিরই কি কো
৪ ঘণ্টা আগেবাসটা ধাক্কা দিয়েছে এক শিক্ষার্থীকে, শিক্ষার্থী করেছে তার প্রতিবাদ। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসের চালক, চালকের সহকারী ও অন্য কর্মীরা শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়েছে বাসে। ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়েছে। বাসের যাত্রীরা প্রশ্ন করেছে, কিন্তু ‘চোর’কে পেটানো হচ্ছে বলা হলে তারা নির্বিকার বসে থেকেছে আসনে। চোর হলেও যে তাকে পু
৪ ঘণ্টা আগেযে রকম পরিস্থিতিতে দেশ চলছে, তাতে দেশের জনগণের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় সেই অস্বস্তি থেকে বের হয়ে আসার আপাতত একটা পথের দিশা পাওয়া গেল। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা এই ভাষণ দেওয়ার আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে...
১ দিন আগে১৯৭৮ সালে আর্থার সি ক্লার্ক দ্য মাইন্ড মেশিনস-এ একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে কিংবদন্তি এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী বক্তব্য তুলে ধরেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ এবং যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ৫০ বছর পরে তাঁর পূর্বাভাস আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে।
১ দিন আগে