সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মানুষ স্বভাবতই স্মৃতিকাতর। মার্চ মাস এলে আমিও স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। মনে পড়ে, একাত্তরের উত্তাল মার্চের দিনগুলোর কথা এবং পরের ৯ মাসের কথা। একাত্তরের গণহত্যা কেমন ভয়ংকর আর বীভৎস ছিল, তা আমাদের সবারই জানা। মেহেরুন্নেসা নামে এক নারী কবিতা লিখতেন। তাঁর কথা কেউ এখন আর মনে করে না। গণহত্যার শিকার হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। এই মেহেরুন্নেসার ইতিহাস আমার কাছে পাকিস্তানের ইতিহাস বলে মনে হয়; পাকিস্তানের যন্ত্রণার প্রতীক বলে মনে হয়।
মেহেরুন্নেসার বাবা থাকতেন খিদিরপুরে। খিদিরপুর কলকাতার একটি মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের বাসাও ওখানেই ছিল। মেহেরুন্নেসার বাবার ভবানীপুরে দুটি দোকান ছিল। দাঙ্গার সময় দোকান দুটি লুট হয়ে গেল। মেহেরুন্নেসার বাবা তখন একটা কয়লার আড়ত দিলেন। মেহেরুন্নেসার আর পড়াশোনা হলো না। ছোট্ট মেহেরুন্নেসা তাঁর বাবার দোকানে বসে থাকতেন। বাবাকে সাহায্য করতেন।
তারপর ১৯৫০ সালে দুই পারে ভয়ংকর দাঙ্গা হলো। সে দাঙ্গায় মেহেরুন্নেসারা আর কলকাতায় থাকতে পারলেন না। যৎসামান্য সম্পত্তি আর দোকানপাট যা ছিল, বিক্রি করে তাঁর বাবা ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় তাঁদের থাকার কোনো জায়গা নেই। ধোলাইখালের পাড়ে একটুখানি জায়গা নিয়ে মেহেরুন্নেসার বাবা ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু ব্যবসা করতে তো পুঁজি লাগে। সেই পুঁজি তাঁদের ছিল না। এরই মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা গেলেন।
পরিবারে মেহেরুন্নেসাই তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম। টাকার জন্য তিনি বাংলা একাডেমিতে নকলনবিশি, মানে কপি করতেন। ফিলিপস কোম্পানিতে একটি চাকরি নিয়েছিলেন। আর কবিতা লিখতেন।
মেহেরুন্নেসারা মিরপুরে বিহারি-অধ্যুষিত এলাকায় থাকতেন। খুব তেজি মেয়ে ছিলেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতেন, মিছিল করতেন। বিহারিরা সব জানত। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমির মাঠে বিপ্লবী কবিদের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা সেখানে কবিতা পড়েন। আমি শুনেছি, তাঁর সেই কবিতা ২৫ মার্চ বেগম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
এই ২৫ মার্চেই মেহেরুন্নেসাদের বাড়ি আক্রমণ করল অবাঙালিরা। বাড়িতে ছিলেন মেহেরুন্নেসা আর তাঁর মা ও ভাই। মা কোরআন শরিফ নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। আক্রমণকারীদের বললেন, ‘আমরা তো মুসলমান।’ অবাঙালিরা তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে উন্মত্ত। তারা তিনজনকেই হত্যা করল। এরপর ভাইয়ের মাথা কেটে নিয়ে চলে গেল। আর মেহেরুন্নেসাকে যা করল, সেটা আরও ভয়ংকর। তাঁকে তো মারলই। মেরে পাখার সঙ্গে ঝুলিয়ে পাখা ছেড়ে দিল। সে ঘুরতে থাকল। আমার কাছে এ-ই হলো পাকিস্তানের একটি প্রতীক।
এখন বাংলাদেশে আমরা কোন প্রতীকের কথা বলব? কাকে প্রতীক হিসেবে ধরব? ঘটনা তো অনেক। কোনটা বলব? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখনো তেলের জন্য, কাপড়ের জন্য আমাদের রেশন কার্ড খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে। আর পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখনো দুর্ভিক্ষের অবস্থা ছিল। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১৭ ডিসেম্বর আমি আর আমার এক আত্মীয় বেরিয়েছি। দেখলাম, লুণ্ঠন চলছে। যেন একটা উৎসব।
বিক্রমপুরের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আমাকে দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর তাঁর কমান্ডার তাঁকে বলেছেন, ঢাকায় যেতে হবে। তিনি তাঁর একটা দল নিয়ে ঢাকায় গেলেন। ওই তরুণ তখন বোঝেননি, ঢাকায় কেন যেতে হবে? পরে টের পেয়েছেন, কমান্ডার ঢাকায় এসে ইসলামপুরে সোনা, কাপড় ও ঘড়ির দোকানগুলোয় লুটপাট করেছেন।
ওই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আরেকটা অভিজ্ঞতা হলো, তিনি একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখতে পেলেন, এক লোক মাটি কেটে ঝাঁকায় ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন লোকটি তাঁর পরিচিত। তাঁদের একটা ব্যান্ড পার্টি ছিল। তিনি ব্যান্ড বাজাতেন। গাড়ি থেকে নেমে এসে সেই তরুণ বললেন, ‘চাচা, কী করছেন?’
চাচা তাঁকে বললেন, ‘বলেছিলে না মুক্ত হব? এল তো মুক্তি। এখন আমি মাটি কাটছি।’
এবার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা যাক। তাঁকেও প্রতীক বলতে পারি। সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটিতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। পাকিস্তানিরা এক তরুণকে ধরে নিয়ে এসেছে। কারণ, তরুণটি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে অস্ত্র পাওয়া গেছে। ধরে আনার পর পাকিস্তানিরা ওই তরুণকে প্রশ্ন করেছে, ‘তোর সঙ্গে কে কে ছিল, নাম বল।’ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাটি কারও নামই বলেননি। এরপর পাকিস্তানিরা তাঁর বুকে বন্দুক চেপে ধরে বলেছে, ‘নাম না বললে গুলি করা হবে।’ তবু তিনি বলেছেন, ‘বলব না।’ এরপর তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে মাটি ছুঁয়ে দাঁড়ালেন। আর পাকিস্তানিরা তাঁকে গুলি করল। এই তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধাকেও আমরা বাংলাদেশের প্রতীক বলতে পারি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রাণ দেওয়া নূর হোসেনকে আমরা প্রতীক বলতে পারি। প্রতীক বলতে পারি ডাক্তার মিলনকে।
তবে আমার কাছে প্রতীক বলতে একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। সে একটি মেয়ে। একসময় আমাদের গ্রামে মেয়েদের কোনো বিদ্যালয় ছিল না। আমাদের মায়েদের প্রজন্মে, যাঁদের বাবারা সরকারি চাকরি করতেন, তাঁরাই কিছু লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন। যাঁরা গ্রামে থাকতেন, তাঁরা লেখাপড়ার সুযোগই পাননি। আমাদের গ্রামে মেয়েদের স্কুল হয়েছে, উন্নতি হয়েছে। সেই মেয়েদের স্কুল থেকে একটা মিছিলের ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। মিছিলে লেখা ছিল, ‘বখাটেদের রুখতে হবে’।
গ্রামে বখাটেরা খুব উত্ত্যক্ত করে মেয়েদের। মেয়েরা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে। যে মেয়েটি সামনে ছিল, সে ক্লাস টেনে পড়ে। প্রতিবাদে সে-ই সবচেয়ে মুখর। সবচেয়ে ভালো ছাত্রীও সে। সেই মেয়ে প্রতিবাদ করেছিল। পরে একদিন তারই চেনা এক যুবক তাকে এমন নোংরা কথা বলেছে যে সে নিজেদের বাড়িতে গাছের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে। এই মেয়েকেও আমরা প্রতীক বলতে পারি। মেয়েটি কিন্তু তার নিজের কারণে আত্মহত্যা করেনি। আত্মহত্যা করেছে সমষ্টির হয়ে প্রতিবাদ হিসেবে। তাকে উত্ত্যক্ত করছে যে ছেলে, যে ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে আগেও প্রতিবাদ করেছিল। শেষ প্রতিবাদটা করল নিজের প্রাণ দিয়ে।
এখন এই ২০২৫-এর মার্চেও দেশে চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন। সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে নিষ্ঠুর সব বিবরণ। আহা, নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সাত মাসের মাথায় দেশের এ কী হাল! কোথায় সরকার? কোথায় আইনের শাসন?
আমাদের সমাজে সংস্কৃতির চর্চা আছে, গানবাজনা, শিল্প-সাহিত্য, যাত্রা-নাটক অল্পস্বল্প হলেও রয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক মানের ঊর্ধ্বগতিটা তেমন নেই। শিল্প মাধ্যমগুলোর মধ্য দিয়ে কোন ধরনের বক্তব্য আসছে, সেটা লক্ষ করা হচ্ছে না। চিন্তাধারা ব্যাপক ও গভীর প্রসারতা লাভ করেনি। অবৈজ্ঞানিকতা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রেও দায়িত্ব ছিল মূলত বামপন্থীদেরই। দক্ষিণপন্থীরা তাদের কাজ স্বাভাবিকভাবেই করে যাবে, গোটা শাসনব্যবস্থাটাই তাদের পক্ষে, নগদ পারিতোষিকই বলি, প্রতিশ্রুতি-সম্মানই বলি, সবকিছুই তাদের উসকানি দিচ্ছে, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। তা ছাড়া শাসনব্যবস্থা নিজেই তার প্রচারমাধ্যম, তার আমলা-কর্মচারী, তার বিদেশি সমর্থক ও দেশি তাঁবেদার, তার অর্থ ও আনুকূল্য সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে অনবরত কোলাহল করছে প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে। এর বিপক্ষে গেলে লাভের সম্ভাবনা যত কম, ক্ষতির আশঙ্কা তত বেশি। তদুপরি প্রগতিশীলতা স্বাভাবিক, নয়তো প্রতিক্রিয়াশীলতাই স্বাভাবিক আমাদের পরিবেশে। কেননা প্রগতিশীলতা হচ্ছে স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়ানো। সেটা হচ্ছে মানসিকভাবে নিজেকে স্বাধীন করা। তার জন্য শক্তি লাগে, সাহস লাগে। ব্যক্তিগত ও একক প্রচেষ্টায় এই শক্তি ও সাহস সঞ্চয় এবং সঞ্চিত হলে তার সংরক্ষণ ও প্রবৃদ্ধি কষ্টসাধ্য প্রায় অসম্ভব। সেই জন্য চাই সমষ্টিগত সুসংগঠিত প্রচেষ্টা।
এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী। কেন আশাবাদী, সেই কথাটা বলে শেষ করি। আশার কারণ হলো, মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন না দেখলে মানুষ মানুষ থাকে না। আমার একটা বই বের হয়েছে বছর দু-এক আগে, নাম—স্বপ্ন ছিল, থাকবে। স্বপ্ন আছে বলেই আমরা এখনো আছি। স্বপ্নই টিকে থাকবে আজীবন। স্বপ্ন বলে যে মানুষের মনুষ্যত্ব অপরাজেয়।
অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই যে দেশে আজ গভীর হতাশা বিদ্যমান। এই হতাশার মূল কারণ দেশ যে ঠিক পথে এগোচ্ছে না, এটা বোঝা যাচ্ছে। পুঁজিবাদী পথেই চলেছি বটে কিন্তু সে পথে এগিয়ে যে ব্যাপক জনসাধারণের কোনো উন্নতি হওয়ার আশা নেই, তা জানা হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছিল মানুষকে স্বাধীন করার জন্যই, মানুষকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানিতে ফেলে দেওয়ার জন্য নয়।
মানুষ স্বভাবতই স্মৃতিকাতর। মার্চ মাস এলে আমিও স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। মনে পড়ে, একাত্তরের উত্তাল মার্চের দিনগুলোর কথা এবং পরের ৯ মাসের কথা। একাত্তরের গণহত্যা কেমন ভয়ংকর আর বীভৎস ছিল, তা আমাদের সবারই জানা। মেহেরুন্নেসা নামে এক নারী কবিতা লিখতেন। তাঁর কথা কেউ এখন আর মনে করে না। গণহত্যার শিকার হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। এই মেহেরুন্নেসার ইতিহাস আমার কাছে পাকিস্তানের ইতিহাস বলে মনে হয়; পাকিস্তানের যন্ত্রণার প্রতীক বলে মনে হয়।
মেহেরুন্নেসার বাবা থাকতেন খিদিরপুরে। খিদিরপুর কলকাতার একটি মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের বাসাও ওখানেই ছিল। মেহেরুন্নেসার বাবার ভবানীপুরে দুটি দোকান ছিল। দাঙ্গার সময় দোকান দুটি লুট হয়ে গেল। মেহেরুন্নেসার বাবা তখন একটা কয়লার আড়ত দিলেন। মেহেরুন্নেসার আর পড়াশোনা হলো না। ছোট্ট মেহেরুন্নেসা তাঁর বাবার দোকানে বসে থাকতেন। বাবাকে সাহায্য করতেন।
তারপর ১৯৫০ সালে দুই পারে ভয়ংকর দাঙ্গা হলো। সে দাঙ্গায় মেহেরুন্নেসারা আর কলকাতায় থাকতে পারলেন না। যৎসামান্য সম্পত্তি আর দোকানপাট যা ছিল, বিক্রি করে তাঁর বাবা ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় তাঁদের থাকার কোনো জায়গা নেই। ধোলাইখালের পাড়ে একটুখানি জায়গা নিয়ে মেহেরুন্নেসার বাবা ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু ব্যবসা করতে তো পুঁজি লাগে। সেই পুঁজি তাঁদের ছিল না। এরই মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা গেলেন।
পরিবারে মেহেরুন্নেসাই তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম। টাকার জন্য তিনি বাংলা একাডেমিতে নকলনবিশি, মানে কপি করতেন। ফিলিপস কোম্পানিতে একটি চাকরি নিয়েছিলেন। আর কবিতা লিখতেন।
মেহেরুন্নেসারা মিরপুরে বিহারি-অধ্যুষিত এলাকায় থাকতেন। খুব তেজি মেয়ে ছিলেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতেন, মিছিল করতেন। বিহারিরা সব জানত। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমির মাঠে বিপ্লবী কবিদের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা সেখানে কবিতা পড়েন। আমি শুনেছি, তাঁর সেই কবিতা ২৫ মার্চ বেগম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
এই ২৫ মার্চেই মেহেরুন্নেসাদের বাড়ি আক্রমণ করল অবাঙালিরা। বাড়িতে ছিলেন মেহেরুন্নেসা আর তাঁর মা ও ভাই। মা কোরআন শরিফ নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। আক্রমণকারীদের বললেন, ‘আমরা তো মুসলমান।’ অবাঙালিরা তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে উন্মত্ত। তারা তিনজনকেই হত্যা করল। এরপর ভাইয়ের মাথা কেটে নিয়ে চলে গেল। আর মেহেরুন্নেসাকে যা করল, সেটা আরও ভয়ংকর। তাঁকে তো মারলই। মেরে পাখার সঙ্গে ঝুলিয়ে পাখা ছেড়ে দিল। সে ঘুরতে থাকল। আমার কাছে এ-ই হলো পাকিস্তানের একটি প্রতীক।
এখন বাংলাদেশে আমরা কোন প্রতীকের কথা বলব? কাকে প্রতীক হিসেবে ধরব? ঘটনা তো অনেক। কোনটা বলব? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখনো তেলের জন্য, কাপড়ের জন্য আমাদের রেশন কার্ড খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে। আর পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখনো দুর্ভিক্ষের অবস্থা ছিল। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১৭ ডিসেম্বর আমি আর আমার এক আত্মীয় বেরিয়েছি। দেখলাম, লুণ্ঠন চলছে। যেন একটা উৎসব।
বিক্রমপুরের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আমাকে দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর তাঁর কমান্ডার তাঁকে বলেছেন, ঢাকায় যেতে হবে। তিনি তাঁর একটা দল নিয়ে ঢাকায় গেলেন। ওই তরুণ তখন বোঝেননি, ঢাকায় কেন যেতে হবে? পরে টের পেয়েছেন, কমান্ডার ঢাকায় এসে ইসলামপুরে সোনা, কাপড় ও ঘড়ির দোকানগুলোয় লুটপাট করেছেন।
ওই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আরেকটা অভিজ্ঞতা হলো, তিনি একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখতে পেলেন, এক লোক মাটি কেটে ঝাঁকায় ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন লোকটি তাঁর পরিচিত। তাঁদের একটা ব্যান্ড পার্টি ছিল। তিনি ব্যান্ড বাজাতেন। গাড়ি থেকে নেমে এসে সেই তরুণ বললেন, ‘চাচা, কী করছেন?’
চাচা তাঁকে বললেন, ‘বলেছিলে না মুক্ত হব? এল তো মুক্তি। এখন আমি মাটি কাটছি।’
এবার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা যাক। তাঁকেও প্রতীক বলতে পারি। সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটিতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। পাকিস্তানিরা এক তরুণকে ধরে নিয়ে এসেছে। কারণ, তরুণটি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে অস্ত্র পাওয়া গেছে। ধরে আনার পর পাকিস্তানিরা ওই তরুণকে প্রশ্ন করেছে, ‘তোর সঙ্গে কে কে ছিল, নাম বল।’ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাটি কারও নামই বলেননি। এরপর পাকিস্তানিরা তাঁর বুকে বন্দুক চেপে ধরে বলেছে, ‘নাম না বললে গুলি করা হবে।’ তবু তিনি বলেছেন, ‘বলব না।’ এরপর তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে মাটি ছুঁয়ে দাঁড়ালেন। আর পাকিস্তানিরা তাঁকে গুলি করল। এই তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধাকেও আমরা বাংলাদেশের প্রতীক বলতে পারি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রাণ দেওয়া নূর হোসেনকে আমরা প্রতীক বলতে পারি। প্রতীক বলতে পারি ডাক্তার মিলনকে।
তবে আমার কাছে প্রতীক বলতে একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। সে একটি মেয়ে। একসময় আমাদের গ্রামে মেয়েদের কোনো বিদ্যালয় ছিল না। আমাদের মায়েদের প্রজন্মে, যাঁদের বাবারা সরকারি চাকরি করতেন, তাঁরাই কিছু লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন। যাঁরা গ্রামে থাকতেন, তাঁরা লেখাপড়ার সুযোগই পাননি। আমাদের গ্রামে মেয়েদের স্কুল হয়েছে, উন্নতি হয়েছে। সেই মেয়েদের স্কুল থেকে একটা মিছিলের ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। মিছিলে লেখা ছিল, ‘বখাটেদের রুখতে হবে’।
গ্রামে বখাটেরা খুব উত্ত্যক্ত করে মেয়েদের। মেয়েরা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে। যে মেয়েটি সামনে ছিল, সে ক্লাস টেনে পড়ে। প্রতিবাদে সে-ই সবচেয়ে মুখর। সবচেয়ে ভালো ছাত্রীও সে। সেই মেয়ে প্রতিবাদ করেছিল। পরে একদিন তারই চেনা এক যুবক তাকে এমন নোংরা কথা বলেছে যে সে নিজেদের বাড়িতে গাছের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে। এই মেয়েকেও আমরা প্রতীক বলতে পারি। মেয়েটি কিন্তু তার নিজের কারণে আত্মহত্যা করেনি। আত্মহত্যা করেছে সমষ্টির হয়ে প্রতিবাদ হিসেবে। তাকে উত্ত্যক্ত করছে যে ছেলে, যে ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে আগেও প্রতিবাদ করেছিল। শেষ প্রতিবাদটা করল নিজের প্রাণ দিয়ে।
এখন এই ২০২৫-এর মার্চেও দেশে চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন। সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে নিষ্ঠুর সব বিবরণ। আহা, নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সাত মাসের মাথায় দেশের এ কী হাল! কোথায় সরকার? কোথায় আইনের শাসন?
আমাদের সমাজে সংস্কৃতির চর্চা আছে, গানবাজনা, শিল্প-সাহিত্য, যাত্রা-নাটক অল্পস্বল্প হলেও রয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক মানের ঊর্ধ্বগতিটা তেমন নেই। শিল্প মাধ্যমগুলোর মধ্য দিয়ে কোন ধরনের বক্তব্য আসছে, সেটা লক্ষ করা হচ্ছে না। চিন্তাধারা ব্যাপক ও গভীর প্রসারতা লাভ করেনি। অবৈজ্ঞানিকতা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রেও দায়িত্ব ছিল মূলত বামপন্থীদেরই। দক্ষিণপন্থীরা তাদের কাজ স্বাভাবিকভাবেই করে যাবে, গোটা শাসনব্যবস্থাটাই তাদের পক্ষে, নগদ পারিতোষিকই বলি, প্রতিশ্রুতি-সম্মানই বলি, সবকিছুই তাদের উসকানি দিচ্ছে, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। তা ছাড়া শাসনব্যবস্থা নিজেই তার প্রচারমাধ্যম, তার আমলা-কর্মচারী, তার বিদেশি সমর্থক ও দেশি তাঁবেদার, তার অর্থ ও আনুকূল্য সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে অনবরত কোলাহল করছে প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে। এর বিপক্ষে গেলে লাভের সম্ভাবনা যত কম, ক্ষতির আশঙ্কা তত বেশি। তদুপরি প্রগতিশীলতা স্বাভাবিক, নয়তো প্রতিক্রিয়াশীলতাই স্বাভাবিক আমাদের পরিবেশে। কেননা প্রগতিশীলতা হচ্ছে স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়ানো। সেটা হচ্ছে মানসিকভাবে নিজেকে স্বাধীন করা। তার জন্য শক্তি লাগে, সাহস লাগে। ব্যক্তিগত ও একক প্রচেষ্টায় এই শক্তি ও সাহস সঞ্চয় এবং সঞ্চিত হলে তার সংরক্ষণ ও প্রবৃদ্ধি কষ্টসাধ্য প্রায় অসম্ভব। সেই জন্য চাই সমষ্টিগত সুসংগঠিত প্রচেষ্টা।
এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী। কেন আশাবাদী, সেই কথাটা বলে শেষ করি। আশার কারণ হলো, মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন না দেখলে মানুষ মানুষ থাকে না। আমার একটা বই বের হয়েছে বছর দু-এক আগে, নাম—স্বপ্ন ছিল, থাকবে। স্বপ্ন আছে বলেই আমরা এখনো আছি। স্বপ্নই টিকে থাকবে আজীবন। স্বপ্ন বলে যে মানুষের মনুষ্যত্ব অপরাজেয়।
অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই যে দেশে আজ গভীর হতাশা বিদ্যমান। এই হতাশার মূল কারণ দেশ যে ঠিক পথে এগোচ্ছে না, এটা বোঝা যাচ্ছে। পুঁজিবাদী পথেই চলেছি বটে কিন্তু সে পথে এগিয়ে যে ব্যাপক জনসাধারণের কোনো উন্নতি হওয়ার আশা নেই, তা জানা হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছিল মানুষকে স্বাধীন করার জন্যই, মানুষকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানিতে ফেলে দেওয়ার জন্য নয়।
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ছয় সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, তবে এটি সত্যিকারের যুদ্ধবিরতি বলার চেয়ে বরং ‘অগ্নিকাণ্ড হ্রাস করা’ বলা বেশি যথাযথ হবে। এখনো বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, যা যেকোনো পরিস্থিতিতেই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মুখপাত্রের মতে, ১৯ জানুয়ারির পর থেকে
১৯ ঘণ্টা আগে৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন। কন্যাদের উন্নয়নের এমন দিনে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শিশুদের আর্তনাদের চিত্র ছিল নিরাপত্তাহীন জীবনের প্রশ্নের আরেক নাম। গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মগুলোতে
১৯ ঘণ্টা আগেআইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির খবরগুলোর ভিড়ে দুর্নীতির একটি খবর যেকোনো সচেতন মানুষকে হতবিহ্বল করে তুলতে পারে। সিলেটের কানাইঘাটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী (ইউএফপিএ) পদে কর্মরত মো. জাহাঙ্গীর আলম একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও ১৭ বছরে বাড়ি-গাড়িসহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন
১৯ ঘণ্টা আগেতার সাজপোশাকে তথাকথিত উগ্রতা ছিল না। থাকবেই-বা কীভাবে? মাত্র আট বছর বয়সী একটি মেয়েশিশুর পোশাকই-বা কী? আর উগ্রতাই-বা কী? কিন্তু তারপরও সে রেহাই পায়নি। তার সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’, সে ছিল নারী।
২ দিন আগে