বিধান রিবেরু
রাজনীতি যদি জনগণের জন্য হয়, তাহলে সেই সাধারণ জনগণকে প্রতিদিন ভোগান্তির ভেতর যারা ফেলে, তারা কি আদৌ রাজনৈতিক দল? নাকি মুখে মুখে জনগণের কথা বলা সুবিধাবাদী দল? এই প্রশ্নটি রইল অতি ডান, মধ্যপন্থী ও বাম—সব দলের প্রতি। অন্য দেশেও মানুষ আন্দোলন করে, বিশেষ করে যদি ইউরোপের কথা বলি, সেখানে রাজপথের মাঝে খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে, বড় বড় ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে তারা তাদের দাবি-দাওয়ার কথা লিখে দাঁড়িয়ে থাকে। পথ-চলতি মানুষ, গাড়িঘোড়ায় থাকা যাত্রী সেসব পড়ে। কিন্তু জনগণের চলাচলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এমনকি সেসব দেশেও যানবাহন খাতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। সে ক্ষেত্রে তারা বিকল্প পথ বাতলে দেয় দুদিন আগে, যাতে জনগণের যাতায়াতে অসুবিধা না হয়। এই অভিজ্ঞতা আমার এই বছরের ফেব্রুয়ারিতেই হয়েছে বার্লিনে। সেখানে যাওয়ার প্রথম দিন থেকেই দেখছি রেলশ্রমিকেরা ধর্মঘট করছেন। কিন্তু এক দিনও আমার কাজে যেতে কোনো সমস্যা হয়নি। এক লাইনের রেলগাড়ি বন্ধ তো, অন্য লাইনেরটা তারা খোলা রেখেছে। বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে।
আর আমরা যেন বাংলা সিনেমার সেই খলনায়ক, যেখানে দেখা যায় নায়ককে শায়েস্তা করার জন্য তার প্রিয় কাউকে জিম্মি করে নিজের অভিলাষ বা ইচ্ছা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে খলনায়ক। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ভাবে সরকার বা ক্ষমতাকাঠামো হলো নায়ক, আর তার নায়িকা বা ঘনিষ্ঠজন হলো জনগণ। ব্যস, তারা যত রকম অসুবিধা ও বেকায়দায় ফেলা যায়, সেটার ভেতর জনগণকে ফেলে। এবার তারা নিজেদের দাবির কথা, হোক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক, চিৎকার করে বলতে শুরু করে। ভাবখানা এমন, নায়ক ওরফে সরকার, সব ছুড়ে ফেলে নায়িকা অর্থাৎ জনগণকে রক্ষায় ছুটে আসবে! বাস্তবে বরং উল্টোটাই হতে দেখছি আমরা। আন্দোলনকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে ইদানীং দেখা যাচ্ছে সরকারের তরফ থেকে জলাধারসমেত বিশেষ যান সমাবেশে হাজির করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরানো হচ্ছে, যেন আন্দোলনকারীরা অতি গরমে ক্লান্ত ও নেতিয়ে না পড়ে। চলচ্চিত্রে যেমন কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করা হয়, এখানে তেমন কায়দায় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি সৃষ্টি করা হয়। ওদিকে দুই পাশে কিন্তু বাসযাত্রীদের জিব বেরিয়ে যাচ্ছে গরমে। সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মোটরবাইক আরোহীরা। নারী ও শিশুদের বর্ণনাতীত দুর্ভোগের কথা আর নাইবা বললাম। আর যদি অ্যাম্বুলেন্সে কোনো রোগী থাকে, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না, অভিশাপের যে বৃষ্টি তারা সৃষ্টি করে, সেটা প্রকৃত বর্ষণের চেয়ে হাজার গুণে ভারী।
কয়েক মাস ধরেই রাজধানীর রাস্তাঘাট যে নাজুক পরিস্থিতির ভেতর পড়ছে অনবরত, তা নজিরবিহীন। আপনি রোদ ঝলমলে সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হলেন, কিংবা সন্তানকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, বেরিয়ে মাঝরাস্তায় এসে দেখলেন ভীষণ রকম বিটকেলে যানজট, গাড়ি কোথাও নড়ছে না। কী হয়েছে? গাড়ির বেতারযন্ত্র ছেড়ে বা ইন্টারনেটের দৌলতে জানতে পারলেন, ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তায় একদল শিক্ষার্থী বা রাজনৈতিক কর্মী বা পেশাজীবী গোষ্ঠী বা কারখানার শ্রমিক অথবা সুযোগসন্ধানীরা বসে গেছে। তাদের কোনো না কোনো দাবি আছে। তাদের সব দাবি যে জাতীয় পর্যায়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ বা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট, তা-ও নয়। তো এসবের ভেতরেই রাজনৈতিক দলগুলো আবার প্রায়ই নিজেদের পেশিশক্তি প্রদর্শনের তাড়নায় বাস ভরে, লোক ভাড়া করে আনে তথাকথিত জনসমাবেশে। যাঁরা আসেন, তাঁদের চেহারা দেখেই বোঝা যায়, তাঁরা কোনো আদর্শ বা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে, আদর্শিক জায়গা থেকে জনসভাগুলোতে আসেন না। বাংলাদেশে যত বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা যদি বলি, সেসব নিয়ে কোনো কথা নেই, কারণ সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দিয়েছে। মিছিলের সেসব মুখ দেখলেই বুঝবেন তারা প্রাপ্তির আশায় নয়, বরং বিশ্বাস ও বিবেকের তাড়নায় রাজপথে নেমে এসেছে। আমার আপত্তি সেসব জনসভা ও মিছিল নিয়ে, যেখানে কেবল লোক ভাড়া করে, মানুষের সামনে নিজেদের জনসমর্থন প্রমাণের জন্য করা হয়ে থাকে। এটা তো বাংলাদেশের জনগণ বোঝে। এটা যে প্রতারণা, সেটা সবাই জানে। কোনো রাজনৈতিক দলের আহ্বান যদি সত্যি সত্যি সাড়া জাগায়, তাহলে সেখানে লোক ভাড়া করে আনার প্রয়োজন পড়ে না। লোকজন রাজনৈতিক দলের সভ্য না হলেও, ঠিকই এসে আপনাদের সভায় যোগ দেবে, যদি জনজীবনের ন্যায্য কোনো বিষয় নিয়ে আপনারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেন।
তবে কোনো কোনো দল লোক ভাড়া না করলেও, নিজস্ব অন্ধ সমর্থকগোষ্ঠীর জোরেও তারা রাস্তা দখল করে জনভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেটা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এই শহরটা তাদের শহর নয়, এই শহরে তাদের পরিবার, আত্মীয়পরিজনেরা থাকেন না। তাই যেমন খুশি, যখন খুশি এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বসে পড়া যায়। অচল করে দেওয়া যায় গোটা নগর।
একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, এই মাস তিনেক আগে, প্রচণ্ড দাঁতের ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছি। তেজগাঁও থেকে বনানীতে যাব। নাবিস্কো পর্যন্ত গিয়ে যেন সময় স্থির হয়ে গেল। সব স্থবির। কোনো নড়াচড়া নেই। গাড়ি তো গাড়ি, মানুষজন পর্যন্ত হাঁটাচলা করার সুযোগ পাচ্ছে না। সবকিছু গায়ে গায়ে লেগে আছে। ফুটপাতগুলো তো হাঁটার উপযুক্ত নয়। কাজেই মানুষ রাস্তাতেই নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এগুনো যাচ্ছে না। কোনো রকমে পুলিশের এক কর্মকর্তা পর্যন্ত পৌঁছে জানা গেল, মহাখালীর রাস্তায় বসে পড়েছে একটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিশাল বড় দাবি-দাওয়ার তালিকা তাদের। তো পাঁচ ঘণ্টা ধরে তারা রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বসে আছে, যেন এই আন্দোলন আজ সফল না হলে ঘরের লোকজন না খেয়ে মারা যাবে।
আমরা জাতি হিসেবেই আমার মনে হয়, দিনকে দিন গোঁয়ারগোবিন্দ, একগুঁয়ে, আর অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। কিসে অপরের অসুবিধা হবে, কী করলে লোকে গালাগাল দেবে, কী করলে লোকে উন্মাদ বলবে, সেসবের কোনো পরোয়া নেই। এই বেপরোয়া ও আত্মঘাতী জাতি নিয়ে কি একটি রাষ্ট্র উন্নত হতে পারে?
রাষ্ট্রের অনুন্নত থাকার আরও একটি কারণ বোধ হয়, সবারই রাজনীতিবিদ হতে চাওয়া। চিকিৎসক, সাবেক সেনাসদস্য, আইনজীবী, অধ্যাপক, অভিনয়শিল্পী, এমনকি কবি এবং ইউটিউবারও সংসদ সদস্য হয়ে ক্ষমতাচর্চা করতে চান। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! সবাইকেই এমপি-মন্ত্রী হতে হবে এবং ক্ষমতা উপভোগ করতে হবে। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খাওয়ার লোভ আমাদের ভেতরে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাই, অথবা নিজেই ক্ষমতা হয়ে উঠতে চাই। কেউ সাধারণ থাকতে চায় না। তাই সাধারণের জন্য যে ন্যূনতম সেবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত, সেটা নিয়েও কারও মাথাব্যথা নেই। কারণ, আমরা সবাই তো অসাধারণ, কেউ ক্ষমতার খালু, তো কেউ ক্ষমতার দূরসম্পর্কের ভাই। রাস্তাঘাটে দেখবেন প্রত্যেকেই ক্ষমতার দাপট দেখায়। আগে তারা বলত, তারা প্রধানমন্ত্রীর অমুক-তমুক, এখন বলে প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ। এমনকি কারওয়ান বাজারে এক ট্রাক ড্রাইভার, যে কিনা ভরদুপুরে রাস্তা আটকে ময়লা উঠাচ্ছে, সে-ও এক বাইকচালককে মুখ ঝামটা মেরে বলে দিচ্ছে, আগের দিন শেষ, এখন অমুকের দিন শুরু! পাশ থেকে একজন আরেকজনকে বলছে, আরে এরা সিটি করপোরেশনের ড্রাইভার। এখন গরম গরম ক্ষমতা বদল হলো তো! একটু গরম তো দেখাবেই! অগত্যা সেই ট্রাক ড্রাইভারের গোঁয়ার্তুমির কারণে পেছনে বিশাল লাইন লেগে গেল। রাস্তা আটকে বাজারের আবর্জনা যে দুপুর ১২টায় পরিষ্কার করতে হয় না বা একটি কর্মদিবসে সেটা করার সুযোগ নেই, সেই কাণ্ডজ্ঞান তাকে কে দেবে? কারওয়ান বাজারে অন্তত সেটা কিনতে পাওয়া যায় না, আমি হলফ করে বলতে পারি।
তো রাজনীতিবিদ থেকে ট্রাক ড্রাইভার, এঁদের ভেতর আমি কোনো গুণগত পার্থক্য দেখি না। তাঁরা নিজেদের কলে দম দেওয়া পুতুলের মতো, মস্তিষ্কবিহীন হয়ে কাজ করে। তাতে চারপাশে সব ভেসে যাক, কি মরে পচে যাক, তাতে তাঁর কী? আমার প্রশ্নটা খুব সোজা, ঢাকাকে কি আপনারা প্রাণবন্ত থাকতে দেবেন না? নাকি এর ধমনি-শিরা-উপশিরার মতো রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত বাধা সৃষ্টি করে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন? এর একটা বিহিত হওয়া ভীষণ জরুরি।
লেখক: বিধান রিবেরু
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
রাজনীতি যদি জনগণের জন্য হয়, তাহলে সেই সাধারণ জনগণকে প্রতিদিন ভোগান্তির ভেতর যারা ফেলে, তারা কি আদৌ রাজনৈতিক দল? নাকি মুখে মুখে জনগণের কথা বলা সুবিধাবাদী দল? এই প্রশ্নটি রইল অতি ডান, মধ্যপন্থী ও বাম—সব দলের প্রতি। অন্য দেশেও মানুষ আন্দোলন করে, বিশেষ করে যদি ইউরোপের কথা বলি, সেখানে রাজপথের মাঝে খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে, বড় বড় ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে তারা তাদের দাবি-দাওয়ার কথা লিখে দাঁড়িয়ে থাকে। পথ-চলতি মানুষ, গাড়িঘোড়ায় থাকা যাত্রী সেসব পড়ে। কিন্তু জনগণের চলাচলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এমনকি সেসব দেশেও যানবাহন খাতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। সে ক্ষেত্রে তারা বিকল্প পথ বাতলে দেয় দুদিন আগে, যাতে জনগণের যাতায়াতে অসুবিধা না হয়। এই অভিজ্ঞতা আমার এই বছরের ফেব্রুয়ারিতেই হয়েছে বার্লিনে। সেখানে যাওয়ার প্রথম দিন থেকেই দেখছি রেলশ্রমিকেরা ধর্মঘট করছেন। কিন্তু এক দিনও আমার কাজে যেতে কোনো সমস্যা হয়নি। এক লাইনের রেলগাড়ি বন্ধ তো, অন্য লাইনেরটা তারা খোলা রেখেছে। বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে।
আর আমরা যেন বাংলা সিনেমার সেই খলনায়ক, যেখানে দেখা যায় নায়ককে শায়েস্তা করার জন্য তার প্রিয় কাউকে জিম্মি করে নিজের অভিলাষ বা ইচ্ছা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে খলনায়ক। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ভাবে সরকার বা ক্ষমতাকাঠামো হলো নায়ক, আর তার নায়িকা বা ঘনিষ্ঠজন হলো জনগণ। ব্যস, তারা যত রকম অসুবিধা ও বেকায়দায় ফেলা যায়, সেটার ভেতর জনগণকে ফেলে। এবার তারা নিজেদের দাবির কথা, হোক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক, চিৎকার করে বলতে শুরু করে। ভাবখানা এমন, নায়ক ওরফে সরকার, সব ছুড়ে ফেলে নায়িকা অর্থাৎ জনগণকে রক্ষায় ছুটে আসবে! বাস্তবে বরং উল্টোটাই হতে দেখছি আমরা। আন্দোলনকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে ইদানীং দেখা যাচ্ছে সরকারের তরফ থেকে জলাধারসমেত বিশেষ যান সমাবেশে হাজির করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরানো হচ্ছে, যেন আন্দোলনকারীরা অতি গরমে ক্লান্ত ও নেতিয়ে না পড়ে। চলচ্চিত্রে যেমন কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করা হয়, এখানে তেমন কায়দায় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি সৃষ্টি করা হয়। ওদিকে দুই পাশে কিন্তু বাসযাত্রীদের জিব বেরিয়ে যাচ্ছে গরমে। সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মোটরবাইক আরোহীরা। নারী ও শিশুদের বর্ণনাতীত দুর্ভোগের কথা আর নাইবা বললাম। আর যদি অ্যাম্বুলেন্সে কোনো রোগী থাকে, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না, অভিশাপের যে বৃষ্টি তারা সৃষ্টি করে, সেটা প্রকৃত বর্ষণের চেয়ে হাজার গুণে ভারী।
কয়েক মাস ধরেই রাজধানীর রাস্তাঘাট যে নাজুক পরিস্থিতির ভেতর পড়ছে অনবরত, তা নজিরবিহীন। আপনি রোদ ঝলমলে সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হলেন, কিংবা সন্তানকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, বেরিয়ে মাঝরাস্তায় এসে দেখলেন ভীষণ রকম বিটকেলে যানজট, গাড়ি কোথাও নড়ছে না। কী হয়েছে? গাড়ির বেতারযন্ত্র ছেড়ে বা ইন্টারনেটের দৌলতে জানতে পারলেন, ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তায় একদল শিক্ষার্থী বা রাজনৈতিক কর্মী বা পেশাজীবী গোষ্ঠী বা কারখানার শ্রমিক অথবা সুযোগসন্ধানীরা বসে গেছে। তাদের কোনো না কোনো দাবি আছে। তাদের সব দাবি যে জাতীয় পর্যায়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ বা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট, তা-ও নয়। তো এসবের ভেতরেই রাজনৈতিক দলগুলো আবার প্রায়ই নিজেদের পেশিশক্তি প্রদর্শনের তাড়নায় বাস ভরে, লোক ভাড়া করে আনে তথাকথিত জনসমাবেশে। যাঁরা আসেন, তাঁদের চেহারা দেখেই বোঝা যায়, তাঁরা কোনো আদর্শ বা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে, আদর্শিক জায়গা থেকে জনসভাগুলোতে আসেন না। বাংলাদেশে যত বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা যদি বলি, সেসব নিয়ে কোনো কথা নেই, কারণ সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দিয়েছে। মিছিলের সেসব মুখ দেখলেই বুঝবেন তারা প্রাপ্তির আশায় নয়, বরং বিশ্বাস ও বিবেকের তাড়নায় রাজপথে নেমে এসেছে। আমার আপত্তি সেসব জনসভা ও মিছিল নিয়ে, যেখানে কেবল লোক ভাড়া করে, মানুষের সামনে নিজেদের জনসমর্থন প্রমাণের জন্য করা হয়ে থাকে। এটা তো বাংলাদেশের জনগণ বোঝে। এটা যে প্রতারণা, সেটা সবাই জানে। কোনো রাজনৈতিক দলের আহ্বান যদি সত্যি সত্যি সাড়া জাগায়, তাহলে সেখানে লোক ভাড়া করে আনার প্রয়োজন পড়ে না। লোকজন রাজনৈতিক দলের সভ্য না হলেও, ঠিকই এসে আপনাদের সভায় যোগ দেবে, যদি জনজীবনের ন্যায্য কোনো বিষয় নিয়ে আপনারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেন।
তবে কোনো কোনো দল লোক ভাড়া না করলেও, নিজস্ব অন্ধ সমর্থকগোষ্ঠীর জোরেও তারা রাস্তা দখল করে জনভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেটা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এই শহরটা তাদের শহর নয়, এই শহরে তাদের পরিবার, আত্মীয়পরিজনেরা থাকেন না। তাই যেমন খুশি, যখন খুশি এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বসে পড়া যায়। অচল করে দেওয়া যায় গোটা নগর।
একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, এই মাস তিনেক আগে, প্রচণ্ড দাঁতের ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছি। তেজগাঁও থেকে বনানীতে যাব। নাবিস্কো পর্যন্ত গিয়ে যেন সময় স্থির হয়ে গেল। সব স্থবির। কোনো নড়াচড়া নেই। গাড়ি তো গাড়ি, মানুষজন পর্যন্ত হাঁটাচলা করার সুযোগ পাচ্ছে না। সবকিছু গায়ে গায়ে লেগে আছে। ফুটপাতগুলো তো হাঁটার উপযুক্ত নয়। কাজেই মানুষ রাস্তাতেই নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এগুনো যাচ্ছে না। কোনো রকমে পুলিশের এক কর্মকর্তা পর্যন্ত পৌঁছে জানা গেল, মহাখালীর রাস্তায় বসে পড়েছে একটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিশাল বড় দাবি-দাওয়ার তালিকা তাদের। তো পাঁচ ঘণ্টা ধরে তারা রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বসে আছে, যেন এই আন্দোলন আজ সফল না হলে ঘরের লোকজন না খেয়ে মারা যাবে।
আমরা জাতি হিসেবেই আমার মনে হয়, দিনকে দিন গোঁয়ারগোবিন্দ, একগুঁয়ে, আর অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। কিসে অপরের অসুবিধা হবে, কী করলে লোকে গালাগাল দেবে, কী করলে লোকে উন্মাদ বলবে, সেসবের কোনো পরোয়া নেই। এই বেপরোয়া ও আত্মঘাতী জাতি নিয়ে কি একটি রাষ্ট্র উন্নত হতে পারে?
রাষ্ট্রের অনুন্নত থাকার আরও একটি কারণ বোধ হয়, সবারই রাজনীতিবিদ হতে চাওয়া। চিকিৎসক, সাবেক সেনাসদস্য, আইনজীবী, অধ্যাপক, অভিনয়শিল্পী, এমনকি কবি এবং ইউটিউবারও সংসদ সদস্য হয়ে ক্ষমতাচর্চা করতে চান। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! সবাইকেই এমপি-মন্ত্রী হতে হবে এবং ক্ষমতা উপভোগ করতে হবে। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খাওয়ার লোভ আমাদের ভেতরে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাই, অথবা নিজেই ক্ষমতা হয়ে উঠতে চাই। কেউ সাধারণ থাকতে চায় না। তাই সাধারণের জন্য যে ন্যূনতম সেবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত, সেটা নিয়েও কারও মাথাব্যথা নেই। কারণ, আমরা সবাই তো অসাধারণ, কেউ ক্ষমতার খালু, তো কেউ ক্ষমতার দূরসম্পর্কের ভাই। রাস্তাঘাটে দেখবেন প্রত্যেকেই ক্ষমতার দাপট দেখায়। আগে তারা বলত, তারা প্রধানমন্ত্রীর অমুক-তমুক, এখন বলে প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ। এমনকি কারওয়ান বাজারে এক ট্রাক ড্রাইভার, যে কিনা ভরদুপুরে রাস্তা আটকে ময়লা উঠাচ্ছে, সে-ও এক বাইকচালককে মুখ ঝামটা মেরে বলে দিচ্ছে, আগের দিন শেষ, এখন অমুকের দিন শুরু! পাশ থেকে একজন আরেকজনকে বলছে, আরে এরা সিটি করপোরেশনের ড্রাইভার। এখন গরম গরম ক্ষমতা বদল হলো তো! একটু গরম তো দেখাবেই! অগত্যা সেই ট্রাক ড্রাইভারের গোঁয়ার্তুমির কারণে পেছনে বিশাল লাইন লেগে গেল। রাস্তা আটকে বাজারের আবর্জনা যে দুপুর ১২টায় পরিষ্কার করতে হয় না বা একটি কর্মদিবসে সেটা করার সুযোগ নেই, সেই কাণ্ডজ্ঞান তাকে কে দেবে? কারওয়ান বাজারে অন্তত সেটা কিনতে পাওয়া যায় না, আমি হলফ করে বলতে পারি।
তো রাজনীতিবিদ থেকে ট্রাক ড্রাইভার, এঁদের ভেতর আমি কোনো গুণগত পার্থক্য দেখি না। তাঁরা নিজেদের কলে দম দেওয়া পুতুলের মতো, মস্তিষ্কবিহীন হয়ে কাজ করে। তাতে চারপাশে সব ভেসে যাক, কি মরে পচে যাক, তাতে তাঁর কী? আমার প্রশ্নটা খুব সোজা, ঢাকাকে কি আপনারা প্রাণবন্ত থাকতে দেবেন না? নাকি এর ধমনি-শিরা-উপশিরার মতো রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত বাধা সৃষ্টি করে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন? এর একটা বিহিত হওয়া ভীষণ জরুরি।
লেখক: বিধান রিবেরু
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
ডিসেম্বর আর জুন নিয়ে যে বচসা (বচসা বলাই শ্রেয়, এটাকে সুস্থ মস্তিষ্কের আলোচনা বলার কোনো সুযোগ নেই) শুরু হয়েছে, তার অন্তর্নিহিত কারণ বোঝা দায়। অনেক ইউটিউবারই এই প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন এবং তাঁদের মতো করে আলোচনা করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন...
৬ ঘণ্টা আগেজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আধার। ৭০০ একর বেষ্টিত এই প্রতিষ্ঠানে প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে প্রগাঢ় বন্ধন, তা উচ্চশিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ নিশ্চিত করে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি লেকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সুইজারল্যান্ড নামে পরিচিত...
৬ ঘণ্টা আগেএকসময় যাকে কেবল বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভাবা হতো, সেই ফেসবুক এখন আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হয়ে উঠেছে। বিশেষত, সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে ফেসবুকের ভূমিকা দিন দিন শুধু শক্তিশালীই হচ্ছে না, বরং প্রশ্ন উঠছে, মূলধারার গণমাধ্যম কি ক্রমেই...
৬ ঘণ্টা আগেনারী পুরুষের সমান—এই বাক্যটি আমরা বহুবার শুনেছি। সংবিধানে, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায়, এমনকি সামাজিক প্রচারণাতেও এই কথার উচ্চারণ ঘন ঘন হয়। কিন্তু এই বক্তব্যটি বাস্তব জীবনে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, সে প্রশ্ন আজও বড় হয়ে দেখা দেয়। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আসা বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান
১ দিন আগে