Ajker Patrika

রাজনীতি যদি মানবিক না হয়...

আনোয়ারুল হক
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগের একটানা শাসন এক যুগ পেরিয়ে দেড় দশকে পৌঁছালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে এমন এক বাস্তবতা গড়ে ওঠে—যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করাই হয়ে ওঠে একমাত্র সাফল্যের মানদণ্ড। সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ—বিশেষত যাঁদের কাজ চিন্তা করা, নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখা বা গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়া—তাঁদের অনেকে ক্ষমতাকে সমর্থন করাকেই বুদ্ধিবৃত্তির দায়িত্ব বলে মনে করতে শুরু করলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, গায়ক-গায়িকা, খেলোয়াড়—কেউই বাদ গেলেন না এই সমর্থনের প্রতিযোগিতা থেকে।

এই সমর্থন অবশ্য একরৈখিক ছিল না। কেউ কেউ ক্ষমতাকে প্রশ্নহীন সমর্থন জানিয়ে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘চেতনার যোদ্ধা’ বলে দাবি করলেন, আবার কেউ কেউ নীরব থেকে সরকারবিরোধী যেকোনো কণ্ঠকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকলেন। এই দুই ধারার মাঝে মিল ছিল—তাঁরা সবাই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতার বলয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছিলেন। কেউ পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার, কেউ বিশেষ অনুদান, কেউ বিদেশযাত্রার অনুমতি, কেউ রাষ্ট্রীয় তহবিলের ভর্তুকি, আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, মহাপরিচালকের পদ। কেউ কেউ সত্যিই এসব পদ ও সুবিধার যোগ্য ছিলেন, কিন্তু তাঁরা নিজ যোগ্যতার চেয়ে সুবিধার প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে বাকি সবাইকে স্তব্ধ করে দিতে আগ্রহী ছিলেন।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল সেইসব প্রগতিশীল বা বামমনা মানুষদের ভূমিকা, যাঁরা অতীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনে ছিলেন। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে প্রতিরোধের নামে তাঁরা একসময় ‘আওয়ামী আধিপত্যে’ নিজেরাই আশ্রয় নিলেন। অথচ একই সঙ্গে তাঁরা স্বীকার করতেন আওয়ামী লীগেও রয়েছে গোঁড়ামি, কর্তৃত্ববাদ, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সুবিধাবাদ। তারপরেও তাঁরা নিজেরাই হয়ে উঠলেন সেই ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। কেউ কেউ বললেন, ‘আওয়ামী লীগই একমাত্র প্রতিরোধশক্তি’, কেউ বললেন, ‘বিকল্প নেই’।

২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় এই শ্রেণির কেউ কেউ সরকারের ‘নিয়মরক্ষার নির্বাচন’কে জাস্টিফাই করতে গিয়ে বলেছিলেন—‘সাময়িকভাবে একটা ফাঁকা সংসদ মেনে নিতে হবে গণতন্ত্র রক্ষার খাতিরে।’ তখন বলা হয়েছিল, ‘ছয় মাস পর সব দলের অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন হবে।’ হয়েছে কি? হয়নি। বিএনপি নির্বাচনের আগেই বর্জন করে আন্দোলনের ডাক দেয় এবং এক মাসব্যাপী হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে নামে। কিন্তু জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকায়, এবং সরকার যে নিপীড়নের যন্ত্র তৈরি করেছিল, তা ব্যবহার করে আন্দোলনটিকে ভেঙে দেওয়া হয়। সেই সময়ে যাঁরা সরকারপন্থী ছিলেন, তাঁরা বললেন, ‘বিএনপি সহিংসতা করছে’, অথচ তারাই ২০০৬ সালে এর চেয়েও বড় সহিংসতার পথে হেঁটেছিলেন।

২০১৮ সালের নির্বাচন হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক ভোটপ্রক্রিয়া—যেখানে ব্যালট রাতে পূর্ণ করে ফেলা হয়, কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই ভোট হয়ে যায়। যেসব তরুণ, যারা বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ডে বিতুষ্ট হয়েও রাজনৈতিক ভারসাম্য চেয়েছিল, তারাও হতাশ হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে হেরে গিয়ে নয়, বরং ভোটাধিকার হরণ হয়ে যাওয়ায় বিরোধী দল সংসদে গিয়েও কার্যকর হতে পারেনি। মূলত তখন থেকেই দেশে ‘ভিন্নপন্থার মাধ্যমে পরিবর্তনের চিন্তা’ জন্ম নেয়।

আওয়ামী লীগ কি তা বোঝেনি? নিশ্চয়ই বুঝেছে। শেখ হাসিনা নিজেও অতীতে ভোটের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি মনে করলেন, ভারতকে পাশে পেলেই সবকিছু চলে যাবে। দেশের মধ্যকার অসন্তোষ, বিরোধী দলের হতাশা, তরুণদের বিচ্ছিন্নতা—সবকিছুকে পাত্তা না দিয়ে শুধু এক প্রতিবেশী দেশের সমর্থনেই চলার নীতি গ্রহণ করলেন। পশ্চিমা বিশ্ব ধীরে ধীরে বিরূপ হয়ে উঠল, যুক্তরাষ্ট্র বারবার মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলল। শেখ হাসিনা বললেন—‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুদৃঢ়’—কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। দেশের ভেতরে এক নীরব ভীতি, প্রশ্নবিদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আর বিরোধী কণ্ঠ দমন করার চর্চা দিন দিন গা-সওয়া হয়ে উঠল।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো—এই অবস্থার মধ্যে যাঁরা নিজেদের ‘প্রগতিশীল’, ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘মানবতাবাদী’ বলে দাবি করতেন, তাঁরাও চুপ থাকলেন। কেউ কেউ ফেসবুকে কবিতা লিখে বর্তমান সময়কে গৌরবময় ঘোষণা করলেন, কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাতা বলে বর্ণনা করলেন। কিন্তু যাঁরা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ ছিলেন, তাঁরা দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে গেলেন। অনেকেই মনে করতেন, ‘আওয়ামী লীগ না থাকলে ক্ষমতায় ধর্মান্ধ শক্তি আসবে।’ কিন্তু তাঁরা ভুলে গেলেন—আওয়ামী লীগের একনায়কতন্ত্র টিকে গেলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক শক্তির চেয়ে উগ্র শক্তি গড়ে উঠবে, কারণ দমন-পীড়ন, ভোট চুরি ও বৈষম্য দীর্ঘ হলে রাগ গড়ে তোলে উগ্রতা।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা নির্বাচন পার করলেন, কারণ বন্দুকের নল তখনো বিরোধীদের দিকে ছিল। কিন্তু সেই বন্দুকের দিক বদলাতে খুব বেশি দিন লাগেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলন একটিমাত্র দাবিতে শুরু হয়ে এমন এক ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, যা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ, ছাত্র হত্যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এই সরকার আর নিজের ভিত ধরে রাখতে পারছে না। পরিস্থিতি এতটাই অসহনীয় হয়ে ওঠে যে, নিজেরাই পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এটাকে শুধু ‘রেজিম চেঞ্জ’ বললে ভুল হবে। এটা ছিল এক দীর্ঘ জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ।

এই সময় যাঁরা বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকলেও রাজপথে নেই। নিজেরা কিছু লেখেন না, শুধু শেয়ার করেন, ফরোয়ার্ড করেন। কেউ কেউ বলছেন—‘সবকিছু পরিকল্পনার অংশ ছিল।’ কিন্তু এতে কি ইতিহাস রক্ষা পাবে? একটি জাতিকে কু-শাসন থেকে বের করে আনার সংগ্রামকে কেবল বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে দায় চাপিয়ে দিলে দায়িত্ব এড়ানো হয়, ভবিষ্যৎ রচনায় সহায়তা করা হয় না।

রাজনীতি যদি মানবিক না হয়, যদি তা মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না হয়, তাহলে তা যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক, সে শেষ হয়। রাজনীতি জনগণের সমর্থনে গঠিত হয়। তরুণদের এই জাগরণ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে—তারা কেবল ভোট নয়, তারা জীবনের অধিকার চায়। তারা অংশীদারত্ব চায়, সম্মান চায়, বিশ্বাসযোগ্য রাষ্ট্র চায়।

এখন প্রশ্ন হলো, এই তরুণদের পাশে কে দাঁড়াবে? যাঁরা একসময় ভুল পথে হেঁটেছেন, তাঁরা কি সেই ভুল স্বীকার করে নতুন যাত্রার অংশ হবেন? যাঁরা আওয়ামী চেতনায় আশ্রয় নিয়ে অন্য সব বিকল্পকে অযোগ্য বলেছিলেন, তাঁরা কি এবার নতুন বিকল্প গঠনের অংশ হবেন?

ভুল হতেই পারে। রাজনীতিতে, জীবনে, সমাজে—সবখানেই ভুল হয়। ভুলের মধ্যে গ্লানি থাকতে পারে, কিন্তু তা স্বীকার করলে সম্ভাবনার নতুন দরজা খোলে। আজ যাঁরা অতীতে আওয়ামী আধিপত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে এখন নীরব, তাঁরা যদি এই মুহূর্তে বাম, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির পাশে দাঁড়ান—তাহলে সামগ্রিকভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ধর্মান্ধ, উগ্র, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকল্প হতে হলে দরকার বিশ্বাসযোগ্য প্রগতিশীল বিকল্প।

সময়ের সঙ্গে স্রোত বদলায়, কিন্তু ইতিহাস কাউকে ছেড়ে দেয় না। জীবনের স্রোত সামনে যায়, পেছনে নয়। তাই যাঁরা নিজেদের ‘আলোকিত’ ভাবেন, তাঁদের উচিত নিজ ছায়াকে প্রশ্ন করা। যাঁরা নিজেদের চিন্তার অভিভাবক ভাবেন, তাঁদের উচিত নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে বোঝা।

এই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। মুখ ফেরানোর নয়, সামনে তাকানোর সময়। ভবিষ্যতের পথ তৈরি হয় বর্তমানের সাহসী সিদ্ধান্তে। এখনই সময় সিদ্ধান্তের।

লেখক: সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইরানের ‘দানবীয় ক্ষেপণাস্ত্রের’ সামনে উন্মুক্ত ইসরায়েলের ‘অ্যাকিলিস হিল’

ভারতীয় বিমানবন্দরে ১১ দিন ধরে পড়ে আছে ব্রিটিশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, ঘনাচ্ছে রহস্য

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল আজ, যেভাবে দেখবেন

মামদানি শতভাগ কমিউনিস্ট উন্মাদ, দেখতেও খারাপ: ট্রাম্প

সারজিস আলমের পোস্ট: সেই সাবরেজিস্ট্রারের অফিসে দুদকের অভিযান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত