বাজেট ভাবনা
বিভুরঞ্জন সরকার
বাজেট নিয়ে এখন আর আগের মতো শোরগোল হয় না। কেউ মাথায় ছাতা রেখে টিভির সামনে বসে থাকেন না। সামাজিক মাধ্যমে দু-একটি চটকদার পোস্ট হয়, তারপর সেটিও থেমে যায়। অথচ বাজেট তো একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নকশা—কে কতটা পাবে, কে কতটা দেবে, কার ঘাড়ে কতটা চাপ বাড়বে, কার ঘরে ভাত-তরকারি থাকবে, কে থাকবে না খেয়ে। এই যৎসামান্য কথাগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় বিপুল আলাপ-আলোচনার গহ্বরে।
এবারের বাজেট ঘোষণার পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম এমন: ‘বদল সামান্য, সবই আগের মতো’, ‘বাজেট স্মল, কিন্তু বিউটিফুল নয়’, ‘দিন পার করার বাজেট’, ‘পুরনো ছকেই নতুন বাজেট’, ‘জটিল সময়ে মামুলি বাজেট’, ‘করজালে নিরুত্তাপ বাজেট’, ‘চাপ সামলানোর বাজেট’, কিংবা ‘নতুন বাংলাদেশে পুরনো বাজেট’—এসব থেকে সহজেই আঁচ করা যায় যে বাজেট বক্তব্য পঠিত হলেও নাগরিক মনে খুব একটা সাড়া ফেলেনি। বরং কোথাও কোথাও একরকম বিমূঢ়তা স্পষ্ট—এই বুঝি কর বাড়ল, ওখানে আবার ট্যাক্স কমল, অথচ পকেটের চাপ থেকে কিছুই কমছে না।
প্রতিবছর বাজেট আসে, অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়ে টানা পড়ে যান দীর্ঘ বক্তব্য। ব্যাগ থেকে ব্যালান্সশিট বের হয়, গ্রাফ দেখানো হয়, উন্নয়নের ফিরিস্তি দেওয়া হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজেট যেন ‘সংখ্যার অরণ্য’ হয়ে থাকে। এ অরণ্যে সাধারণ মানুষের জন্য পথদিশা থাকে না। থাকলে তা হয় ধাঁধার মতো। এবারও তেমনই হয়েছে। বাজেট শুনে দোকানদার শুধু এটুকুই বোঝেন, নতুন করে আবার কিছু জিনিসের দাম বাড়বে। গৃহিণী বোঝেন, বাজারে গেলে আগের দামে কিছুই আর পাওয়া যাবে না। কৃষক বোঝেন, তাঁর ফসলের দাম কবে বাড়বে সেটা নিয়ে বাজেট নিশ্চুপ। আর তরুণেরা বোঝেন, চাকরি কবে আসবে তা বাজেটও জানে না।
মূল বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ছিল: ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথরেখা: উন্নয়ন, বৈষম্য হ্রাস ও শুভ শাসন। ‘কিন্তু এসব শব্দের ভারে আর মন ভরে না। ‘সমৃদ্ধ’ শব্দটি এমন একটি সময়ে উচ্চারিত হয়েছে, যখন ডিম, পেঁয়াজ, চাল, মুরগি—সব কিছুর দাম সাধারণের নাগালের বাইরে।
এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার আয় করতে পারবে যা, তা দিয়ে সব খরচ চালানো যাবে না। যে অংশ ঘাটতি, তা ঋণ করে মেটাতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই ঋণের বোঝা যাবে কার ঘাড়ে? নিঃসন্দেহে আমাদের, সাধারণ নাগরিকদের ওপরই তা চাপবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।
চিন্তা করে দেখা দরকার, করের আওতায় কারা এসেছেন। ধরা যাক, কেউ অনলাইনে বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছেন—তাঁর ওপর ১০০ টাকায় ১০ টাকা পর্যন্ত কর। নতুন করে এটিকে কর সংযোজন না বলে বলা হয়েছে ‘সংযোজিত মূল্য সংযোজন কর’ কিংবা ‘মার্জিনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’! এ ধরনের পরিভাষা সাধারণ নাগরিকের জন্য দুর্বোধ্য ও বিভ্রান্তিকর।
আবার যেসব নাগরিক নিয়মিত কর দেন, তাঁদের ওপর করের হার বাড়ানো হয়েছে। অথচ কর ফাঁকি দেওয়া বিত্তশালীদের বিষয়ে তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ চাইলে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ টাকা বৈধ করতে পারবেন। প্রশ্ন হলো, যাঁরা নিয়ম মেনে আয় করে কর দেন, তাঁদের প্রতি এটা কী ধরনের বার্তা? তাঁরা কী শিখবেন? আইনের অপব্যবহার করলেই পুরস্কার?
কথায় আছে, বাজেট হলো রাষ্ট্রের স্বপ্নপত্র। কিন্তু যখন সেই স্বপ্ন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন সেটি কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার রূপকথা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ বাস্তবতা বলছে, বিদ্যুতের ঘাটতি, ডলারের টানাপোড়েন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হ্রাস, বিনিয়োগ স্থবিরতা ইত্যাদি কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এমনকি আমাদের দেশের নিজস্ব গবেষণা সংস্থা সিপিডিও বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে অনেক কম। তাহলে বাজেটে কিসের ভিত্তিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলো?
একইভাবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ গত বছরের অভিজ্ঞতা বলে, গড় মূল্যস্ফীতি ৯-১০ শতাংশের কাছাকাছি থেকেছে। বাজারে গিয়ে কেউ কি বলতে পারবেন—‘না, দামে কোনো সমস্যা নেই’? চাল, ডাল, সবজি, মুরগি, লবণ, তেলের দাম—সবই ক্রমাগত বাড়ছে। তাহলে বাজেটের এই মূল্যস্ফীতি কমার অঙ্কটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপে খায় কীভাবে?
জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক—এই তিন শ্রেণির কথা সরকার বহুবার বলেছে। কিন্তু বাজেট এলে দেখা যায়, তাঁদের জন্য বরাদ্দ বরাবরই কম। কৃষির জন্য এবার ৩৫ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে, যার বড় অংশই যাবে ভর্তুকিতে। কৃষক সরাসরি কতটা সুবিধা পাবেন, তা অস্পষ্ট। কৃষি যন্ত্রপাতি, বীজ, সার—এসবের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য কীভাবে পাবেন, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি বা শ্রমবাজারে নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো বড় ঘোষণা নেই। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন পে-স্কেল না এলেও বলা হয়েছে ‘বেতনকাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হবে’। এটা কবে হবে, কীভাবে হবে—তা বলা হয়নি। বেসরকারি শিক্ষকদের কথা কেউ তোলেনি। বরাবরের মতোই তাঁরা ‘পেছনের সারির মানুষ’ হয়েই থাকলেন।
একটি দেশের উন্নয়নের মৌলিক দুই ভিত্তি—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, যা জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো, যা জিডিপির ১ শতাংশের কম। এ দুই খাতের বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও কম। অথচ এই দুটি খাতেই সাধারণ মানুষের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
সরকারি হাসপাতালে ওষুধ নেই, চিকিৎসকের সংকট, নার্সের সংকট। আবার শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট আরও গভীর—বেতন কম, শ্রেণিকক্ষ নেই, পাঠ্যবইয়ে ভুল। এসব নিয়ে বাজেট বক্তব্যে তেমন কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে সরকার এবার কর আদায়ের যন্ত্রটি আরও শক্ত করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তো এমন কর বসানো হয়েছে, যা ‘করের কর’ মনে হয়। ধরা যাক, একটি মোবাইল ফোন কিনলে শুধু সেটের দাম নয়, তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ ট্যারিফ, ১০ শতাংশ সম্পূরক কর—এসব বসে। আবার সেটা অনলাইনে কিনলে সেই লেনদেনের ওপর আবার ১০ শতাংশ আরেকটি কর। অর্থাৎ আমরা যা ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি কর দিচ্ছি।
এই কর বৃদ্ধির লক্ষ্য যদি হয় রাজস্ব আদায়, তবে তা হতে হবে ন্যায়সংগত। এমন নয় যে যাঁরা বেশি দেন, তাঁরাই আরও বেশি দেবেন। করের বোঝা যদি গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর পড়ে, আর ধনীরা কর ফাঁকি দিয়েই পার পান, তবে সে বাজেট ন্যায়সংগত নয়।
এবারের বাজেটে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান নিয়ে বড় কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। ‘স্টার্টআপ’ ফান্ডের কথা বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি অতীতেও ছিল—তার বাস্তব ফল কোথায়? বিনিয়োগে যে স্থবিরতা চলছে, তা কাটাতে কী পরিকল্পনা রয়েছে বাজেটে?
বিদ্যুতের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনি জটিলতা—এসব কাটিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি না হলে বাজেট যতই বড় হোক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। তরুণেরা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত—এ বাজেট তাঁদের আশ্বাস দেয়নি।
এবারের বাজেট নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সময়ে এসেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি অস্থির, অভ্যন্তরীণ রিজার্ভের সংকট, ডলারের চাপ, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি—সব মিলিয়ে একটা চাপে থাকা অর্থনীতিতে বাজেট দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই বাজেট সেই চাপের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং যেন চাপকে আরও সুসংহতভাবে ভাগ করে দেওয়া। সাধারণ নাগরিক কিছুই বুঝলেন না, শুধু বুঝলেন—এবারও তাঁকে কিছুটা বেশি দিতে হবে, কিছুটা কম পেতে হবে।
বাজেট একটি দেশের অর্থনৈতিক নকশা। এটি এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হয়। কিন্তু বর্তমান বাজেট সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এটি সংখ্যার অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প। তাই বাজেট প্রণয়নে মানুষের প্রয়োজন ও বাস্তবতা বিবেচনা করা জরুরি। বাজেট যেন শুধু কাগজ-কলমে না থাকে, বাস্তবে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে—এই প্রত্যাশা সবার।
অর্থনীতি মানে শুধু সংখ্যা নয়, মানুষ। যদি সেই মানুষের মুখে হাসি না ফোটে, যদি সে বাঁচার ভরসা না পায়, তবে বাজেট বড় কিংবা ছোট হয়ে কী লাভ?
বাজেট নিয়ে এখন আর আগের মতো শোরগোল হয় না। কেউ মাথায় ছাতা রেখে টিভির সামনে বসে থাকেন না। সামাজিক মাধ্যমে দু-একটি চটকদার পোস্ট হয়, তারপর সেটিও থেমে যায়। অথচ বাজেট তো একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নকশা—কে কতটা পাবে, কে কতটা দেবে, কার ঘাড়ে কতটা চাপ বাড়বে, কার ঘরে ভাত-তরকারি থাকবে, কে থাকবে না খেয়ে। এই যৎসামান্য কথাগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় বিপুল আলাপ-আলোচনার গহ্বরে।
এবারের বাজেট ঘোষণার পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম এমন: ‘বদল সামান্য, সবই আগের মতো’, ‘বাজেট স্মল, কিন্তু বিউটিফুল নয়’, ‘দিন পার করার বাজেট’, ‘পুরনো ছকেই নতুন বাজেট’, ‘জটিল সময়ে মামুলি বাজেট’, ‘করজালে নিরুত্তাপ বাজেট’, ‘চাপ সামলানোর বাজেট’, কিংবা ‘নতুন বাংলাদেশে পুরনো বাজেট’—এসব থেকে সহজেই আঁচ করা যায় যে বাজেট বক্তব্য পঠিত হলেও নাগরিক মনে খুব একটা সাড়া ফেলেনি। বরং কোথাও কোথাও একরকম বিমূঢ়তা স্পষ্ট—এই বুঝি কর বাড়ল, ওখানে আবার ট্যাক্স কমল, অথচ পকেটের চাপ থেকে কিছুই কমছে না।
প্রতিবছর বাজেট আসে, অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়ে টানা পড়ে যান দীর্ঘ বক্তব্য। ব্যাগ থেকে ব্যালান্সশিট বের হয়, গ্রাফ দেখানো হয়, উন্নয়নের ফিরিস্তি দেওয়া হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজেট যেন ‘সংখ্যার অরণ্য’ হয়ে থাকে। এ অরণ্যে সাধারণ মানুষের জন্য পথদিশা থাকে না। থাকলে তা হয় ধাঁধার মতো। এবারও তেমনই হয়েছে। বাজেট শুনে দোকানদার শুধু এটুকুই বোঝেন, নতুন করে আবার কিছু জিনিসের দাম বাড়বে। গৃহিণী বোঝেন, বাজারে গেলে আগের দামে কিছুই আর পাওয়া যাবে না। কৃষক বোঝেন, তাঁর ফসলের দাম কবে বাড়বে সেটা নিয়ে বাজেট নিশ্চুপ। আর তরুণেরা বোঝেন, চাকরি কবে আসবে তা বাজেটও জানে না।
মূল বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ছিল: ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথরেখা: উন্নয়ন, বৈষম্য হ্রাস ও শুভ শাসন। ‘কিন্তু এসব শব্দের ভারে আর মন ভরে না। ‘সমৃদ্ধ’ শব্দটি এমন একটি সময়ে উচ্চারিত হয়েছে, যখন ডিম, পেঁয়াজ, চাল, মুরগি—সব কিছুর দাম সাধারণের নাগালের বাইরে।
এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার আয় করতে পারবে যা, তা দিয়ে সব খরচ চালানো যাবে না। যে অংশ ঘাটতি, তা ঋণ করে মেটাতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই ঋণের বোঝা যাবে কার ঘাড়ে? নিঃসন্দেহে আমাদের, সাধারণ নাগরিকদের ওপরই তা চাপবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।
চিন্তা করে দেখা দরকার, করের আওতায় কারা এসেছেন। ধরা যাক, কেউ অনলাইনে বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছেন—তাঁর ওপর ১০০ টাকায় ১০ টাকা পর্যন্ত কর। নতুন করে এটিকে কর সংযোজন না বলে বলা হয়েছে ‘সংযোজিত মূল্য সংযোজন কর’ কিংবা ‘মার্জিনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’! এ ধরনের পরিভাষা সাধারণ নাগরিকের জন্য দুর্বোধ্য ও বিভ্রান্তিকর।
আবার যেসব নাগরিক নিয়মিত কর দেন, তাঁদের ওপর করের হার বাড়ানো হয়েছে। অথচ কর ফাঁকি দেওয়া বিত্তশালীদের বিষয়ে তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ চাইলে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ টাকা বৈধ করতে পারবেন। প্রশ্ন হলো, যাঁরা নিয়ম মেনে আয় করে কর দেন, তাঁদের প্রতি এটা কী ধরনের বার্তা? তাঁরা কী শিখবেন? আইনের অপব্যবহার করলেই পুরস্কার?
কথায় আছে, বাজেট হলো রাষ্ট্রের স্বপ্নপত্র। কিন্তু যখন সেই স্বপ্ন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন সেটি কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার রূপকথা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ বাস্তবতা বলছে, বিদ্যুতের ঘাটতি, ডলারের টানাপোড়েন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হ্রাস, বিনিয়োগ স্থবিরতা ইত্যাদি কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এমনকি আমাদের দেশের নিজস্ব গবেষণা সংস্থা সিপিডিও বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে অনেক কম। তাহলে বাজেটে কিসের ভিত্তিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলো?
একইভাবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ গত বছরের অভিজ্ঞতা বলে, গড় মূল্যস্ফীতি ৯-১০ শতাংশের কাছাকাছি থেকেছে। বাজারে গিয়ে কেউ কি বলতে পারবেন—‘না, দামে কোনো সমস্যা নেই’? চাল, ডাল, সবজি, মুরগি, লবণ, তেলের দাম—সবই ক্রমাগত বাড়ছে। তাহলে বাজেটের এই মূল্যস্ফীতি কমার অঙ্কটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপে খায় কীভাবে?
জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক—এই তিন শ্রেণির কথা সরকার বহুবার বলেছে। কিন্তু বাজেট এলে দেখা যায়, তাঁদের জন্য বরাদ্দ বরাবরই কম। কৃষির জন্য এবার ৩৫ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে, যার বড় অংশই যাবে ভর্তুকিতে। কৃষক সরাসরি কতটা সুবিধা পাবেন, তা অস্পষ্ট। কৃষি যন্ত্রপাতি, বীজ, সার—এসবের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য কীভাবে পাবেন, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি বা শ্রমবাজারে নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো বড় ঘোষণা নেই। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন পে-স্কেল না এলেও বলা হয়েছে ‘বেতনকাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হবে’। এটা কবে হবে, কীভাবে হবে—তা বলা হয়নি। বেসরকারি শিক্ষকদের কথা কেউ তোলেনি। বরাবরের মতোই তাঁরা ‘পেছনের সারির মানুষ’ হয়েই থাকলেন।
একটি দেশের উন্নয়নের মৌলিক দুই ভিত্তি—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, যা জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো, যা জিডিপির ১ শতাংশের কম। এ দুই খাতের বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও কম। অথচ এই দুটি খাতেই সাধারণ মানুষের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
সরকারি হাসপাতালে ওষুধ নেই, চিকিৎসকের সংকট, নার্সের সংকট। আবার শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট আরও গভীর—বেতন কম, শ্রেণিকক্ষ নেই, পাঠ্যবইয়ে ভুল। এসব নিয়ে বাজেট বক্তব্যে তেমন কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে সরকার এবার কর আদায়ের যন্ত্রটি আরও শক্ত করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তো এমন কর বসানো হয়েছে, যা ‘করের কর’ মনে হয়। ধরা যাক, একটি মোবাইল ফোন কিনলে শুধু সেটের দাম নয়, তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ ট্যারিফ, ১০ শতাংশ সম্পূরক কর—এসব বসে। আবার সেটা অনলাইনে কিনলে সেই লেনদেনের ওপর আবার ১০ শতাংশ আরেকটি কর। অর্থাৎ আমরা যা ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি কর দিচ্ছি।
এই কর বৃদ্ধির লক্ষ্য যদি হয় রাজস্ব আদায়, তবে তা হতে হবে ন্যায়সংগত। এমন নয় যে যাঁরা বেশি দেন, তাঁরাই আরও বেশি দেবেন। করের বোঝা যদি গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর পড়ে, আর ধনীরা কর ফাঁকি দিয়েই পার পান, তবে সে বাজেট ন্যায়সংগত নয়।
এবারের বাজেটে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান নিয়ে বড় কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। ‘স্টার্টআপ’ ফান্ডের কথা বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি অতীতেও ছিল—তার বাস্তব ফল কোথায়? বিনিয়োগে যে স্থবিরতা চলছে, তা কাটাতে কী পরিকল্পনা রয়েছে বাজেটে?
বিদ্যুতের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনি জটিলতা—এসব কাটিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি না হলে বাজেট যতই বড় হোক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। তরুণেরা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত—এ বাজেট তাঁদের আশ্বাস দেয়নি।
এবারের বাজেট নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সময়ে এসেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি অস্থির, অভ্যন্তরীণ রিজার্ভের সংকট, ডলারের চাপ, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি—সব মিলিয়ে একটা চাপে থাকা অর্থনীতিতে বাজেট দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই বাজেট সেই চাপের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং যেন চাপকে আরও সুসংহতভাবে ভাগ করে দেওয়া। সাধারণ নাগরিক কিছুই বুঝলেন না, শুধু বুঝলেন—এবারও তাঁকে কিছুটা বেশি দিতে হবে, কিছুটা কম পেতে হবে।
বাজেট একটি দেশের অর্থনৈতিক নকশা। এটি এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হয়। কিন্তু বর্তমান বাজেট সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এটি সংখ্যার অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প। তাই বাজেট প্রণয়নে মানুষের প্রয়োজন ও বাস্তবতা বিবেচনা করা জরুরি। বাজেট যেন শুধু কাগজ-কলমে না থাকে, বাস্তবে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে—এই প্রত্যাশা সবার।
অর্থনীতি মানে শুধু সংখ্যা নয়, মানুষ। যদি সেই মানুষের মুখে হাসি না ফোটে, যদি সে বাঁচার ভরসা না পায়, তবে বাজেট বড় কিংবা ছোট হয়ে কী লাভ?
সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত কোনো কোনো শিরোনাম ও সংবাদ বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পড়তে চান পাঠক। আজকের পত্রিকায় ৩১ মে প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম, ‘৬ মাসের টানাটানিতে ভোট’ শীর্ষক সংবাদটি সম্পর্কে আমাকে একজন সম্পাদক ফোন করে প্রশংসা করলেন। আমি বুঝতে পারলাম শিরোনামটি যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভোট নিয়ে জনগণের আগ
১৮ ঘণ্টা আগেঈদ—এই শব্দটির সঙ্গে অগণিত মানুষের হৃদয়ে যে অনুভব জাগে, তা আনন্দ, উৎসব আর মিলনের। ঘরে ঘরে নতুন জামা, সুস্বাদু খাবার, কোলাকুলি আর রঙিন খুশির চিত্র যেন ঈদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সেই পরিচিত দৃশ্যের বাইরে যে একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো—ঈদ কি সবার জন্য একরকম? ঈদের দিন কি সকলের মুখেই সমান হাসি? ঈদের আনন
১৮ ঘণ্টা আগে১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈদ এসেছিল। সেই ঈদের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটা বিশেষ নাটক লিখেছিলাম। যুদ্ধরত শিল্পীদের অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়ে নাটকটি প্রচারিত হয়েছিল ঈদের আগের দিন। নাটকটির নাম ছিল ‘চান্দের তলোয়ার’। ঈদের চাঁদ সাধারণত আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। খুশির এই ঈদের বড় প্রতীক হলো চাঁদ।
১৮ ঘণ্টা আগেদরজায় কড়া নাড়ছে মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। প্রতিবছর আরবি বর্ষপঞ্জির ১০ জিলহজ ঈদের নামাজ ও পশু কোরবানির মাধ্যমে উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। আনন্দ-উল্লাসের পাশাপাশি এই উৎসবের লক্ষ্য—ত্যাগের মহিমায় সমাজটা সুন্দর করে তোলা, স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া।
১৮ ঘণ্টা আগে