Ajker Patrika

ঢাকাকে এখনই বাঁচাতে হবে

মো. সাইদুর রহমান
ঢাকাকে এখনই বাঁচাতে হবে

রাজধানী ঢাকায় বসবাস যেন দিন দিন একধরনের ‘রাশিয়ান রুলেট’ খেলার মতো হয়ে উঠছে। কখন, কোথা থেকে মৃত্যু আসবে—কেউ জানে না। একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি, কোনো ভবনের অবৈধ অংশ, নড়বড়ে বিল্ডিং, খোলা ড্রেন কিংবা গ্যাসলাইনের সামান্য ফাঁক, সড়ক দুর্ঘটনা, এমনকি ছিনতাইকারীদের হাত যেকোনো মুহূর্তে কেড়ে নিতে পারে জীবন।

পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে মৃত্যু আর মৃত্যু। আর এ মৃত্যুর কারণ যেন স্বয়ং ঢাকা শহর। এখানে সামান্য বৃষ্টি হলে তৈরি হয় মৃত্যুর ফাঁদ। এ বছরের ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বংশালের নাজিরাবাজার এলাকায় সড়কে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে পড়ে আমিন হোসেন নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, পানিতে বিদ্যুতের তার ছিল, ফলে তিনি বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। চা খেতে বসলেও যেন মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।

এ বছরের ২৬ অক্টোবর চা খেতে বসা এক ব্যক্তি মেট্রোরেলের ৩৫ কেজির একটি ‘বিয়ারিং প্যাড’-এর আঘাতে প্রাণ হারান। ২০২৪ সালে শুধু ঢাকা বিভাগেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১,৮৪০ জনের। ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে ৫,২৫৮ শিশুসহ মোট ১০২,৪৫৬ জন মানুষ বায়ুদূষণের প্রভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করে, যার ৪৮ শতাংশের মৃত্যু হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামে। গত ১০ মাসে শুধু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেই ১৯৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

ঢাকা শহরের গড় শব্দমাত্রা ৮০-৯০ ডেসিবেল, যা ‘ডব্লিউএইচও’ নির্ধারিত নিরাপদ সীমা দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল থেকে অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত শব্দ দীর্ঘ মেয়াদে বধিরতা, কানের রোগ, মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ, ঘুমের ব্যাঘাত ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়; এমনকি গর্ভস্থ শিশু ও শিশু-কিশোরদের শেখার ক্ষমতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদিও সরাসরি শব্দদূষণে মৃত্যুর আলাদা কোনো রেকর্ড করা হয় না। তবে ‘ডব্লিউএইচও’ শব্দজনিত হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোককে অকালমৃত্যুর ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচনা করে।

২০২৪ সালে সারা দেশে মোট ২৬ হাজার ৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭৩টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ১৪০ জন নিহত ও ৩৪১ জন আহত হয়েছেন, যার অধিকাংশই ঢাকা শহরে।

এরপর ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ নগরগুলোর একটি, কারণ এটি বঙ্গোপসাগরীয় প্লেটের সীমানা, সক্রিয় ফল্ট লাইন এবং দুর্বল ভবন কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষ কেঁপে ওঠে এবং ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি মাত্রা ৭ কিংবা তার আশপাশে হয়, তাহলে ঢাকা শহরে মৃত্যুর মহাপ্রলয় ঘটে যাবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ৬ মাসে রাজধানীতে কমপক্ষে ৭০টি মুক্তিপণের মামলা করা হয়েছে। একই সময়ে ৫০টি থানা থেকে অন্তত ৩৩টি ডাকাতি, ২৪৮টি ছিনতাই, ১২১টি খুন এবং ১,০৬৮টি চুরির মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এসব অপরাধের সময় অনেক অপরাধী খুনসহ নরহত্যা ঘটিয়ে থাকে। গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিকের রিপোর্ট অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫—এক বছরে দেশে ৬৩৭ জনকে মব লিঞ্চিংয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর অধিকাংশ ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। ২০২৫ সালের ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল প্রাঙ্গণে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। তাতে প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু ঘটে। এসবের বাইরে রয়েছে ঢাকার হোটেল-রেস্টুরেন্টের অস্বাস্থ্যকর খাবার, যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের মরণব্যাধি তৈরি করে যাচ্ছে।

ঢাকার এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যু ও জীবনের অনিশ্চয়তার মূল কারণ হলো, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অতিমাত্রায় কেন্দ্রীয়করণ, যা শহরের জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও সেবা খাতের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছে, যে কারণে প্রতিটি মৌলিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় প্রায় সব অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক সুযোগ কেন্দ্রীভূত থাকায় কোটি মানুষ এখানে ভিড় করে; কিন্তু সেই অনুপাতে রাস্তা, ড্রেনেজ, গ্যাস-বিদ্যুৎ, বর্জ্য, পরিবহন, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কাঠামো উন্নয়ন হয়নি। ফলে অতিরিক্ত জনঘনত্বের মধ্যে সীমিত অবকাঠামোর ওপর চাপ পড়ে। খোলা ড্রেন, পুরোনো বিদ্যুৎ-লাইনে শর্টসার্কিট, ফুটপাত দখল, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, অবৈধ নির্মাণ—প্রতিটি দৈনন্দিন বাস্তবতা সরাসরি প্রাণহানির উৎসে পরিণত হয়েছে। একইভাবে অতিরিক্ত যানবাহন ও অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। নগরের গাছপালা ধ্বংস হওয়ায় বায়ুদূষণ প্রাণঘাতী হয়েছে। মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতায় ডেঙ্গু-মহামারি। বিপুল আবাসনের কারণে রয়েছে অগ্নিঝুঁকি। অপরাধ দমন দুর্বল হওয়ায় ছিনতাই ও সহিংসতা বৃদ্ধি। এমনকি দুর্বল ভবন কাঠামো ও গাদাগাদি বসবাস ঢাকাকে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে। অর্থাৎ সমস্যা একটি ঘটনা নয়—অপরিকল্পিত, অসংগঠিত শহরচিন্তা ও ব্যবস্থাপনার কারণে নগরের প্রতিটি উপাদানই এমনভাবে ব্যর্থ হয় যে, তা একটি প্রাণঘাতী ঘটনাকে অনিবার্য করে তোলে, আর সে ব্যর্থতার সামগ্রিক ফলই হলো ঢাকায় প্রতিদিনকার মৃত্যু।

এখনই ঢাকার এই মৃত্যুঝুঁকি কমাতে না পারলে, অদূর ভবিষ্যতে ঢাকার এই মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হবে। তাই ঢাকার এই মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নগরায়ণ ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, যাতে রাজধানীর ওপর মানুষের অস্বাভাবিক চাপ কমে। জরুরি অবকাঠামো যেমন ড্রেনেজ, গ্যাস-বিদ্যুৎ, রাস্তা, ফুটপাত ও ভবনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও কঠোর মানদণ্ডে নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। বায়ু ও শব্দদূষণ কমাতে গণপরিবহন সম্প্রসারণ, শিল্পকারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, সবুজায়ন বৃদ্ধি ও সাইলেন্স জোন বাস্তবায়ন জরুরি। ডেঙ্গু ও জনস্বাস্থ্যের জন্য স্থায়ী মশক নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানো ও খাদ্যনিরাপত্তা তদারকি করা দরকার। সড়ক নিরাপত্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন, নিবন্ধন-ফিটনেস কঠোর করা ও পথচারী সুবিধার উন্নয়ন। অপরাধ দমনে আধুনিক নজরদারি ও দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা। আগুন ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নবায়ন, জরুরি মহড়া, নিরাপত্তা আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং নির্মাণের প্রতিটি ধাপে জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হবে টেকসই সমাধান।

লেখক: শিক্ষার্থী পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...