Ajker Patrika

বিজেপির দিল্লি জয়

একদলীয় শাসনের পদধ্বনি!

এম আর রহমান
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬: ৪৫
দিল্লি বিধানসভায় বিজেপির অর্জন ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় পরিবর্তন এনেছে। ছবি: এএফপি
দিল্লি বিধানসভায় বিজেপির অর্জন ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় পরিবর্তন এনেছে। ছবি: এএফপি

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ জয় ভারতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ নির্বাচনে বিজেপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে (৭০টির মধ্যে ৪৮টি) জিতেছে, যা ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। প্রায় ২৭ বছর পর দিল্লি বিধানসভায় বিজেপির এই অর্জন দেশটির রাজনৈতিক মানচিত্রে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। কারণ ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির (আপ) ব্যাপক জনপ্রিয়তা বিজেপির অনেক সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছিল।

আম আদমি পার্টির জন্য এবার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল তার ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্কুল, হাসপাতালসহ বেশ কিছু বিষয়ে দলটির সাফল্য থাকলেও ব্যর্থতা কম ছিল না। দলের নাম আম আদমি বা আমজনতা হলেও দলের নেতা কেজরিওয়ালের সরকারি পয়সায় গড়ে তোলা শীশমহল তাঁকে ব্যঙ্গ করে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে বিজেপি পদে পদে বাধা দিয়েছে কেজরিওয়ালের সরকার পরিচালনায়। তিনি এ নিয়ে অভিযোগ করলেও, সমাধান করতে পারেননি। আর সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে বিজেপি।

বিজেপির প্রচারের জোয়ারে ভেসে গেছে সব

বিজেপির শক্তিশালী প্রচার ও কৌশলগত পদক্ষেপের কারণে তাদের জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তবে এত বড় জয় হবে, তা অনেকে ভাবেননি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টি বিজেপি আধুনিক প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং পেশাদার কৌশল ব্যবহার করে ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার কী কী উন্নয়নকাজ করেছে, তা প্রচার করা হয়েছে জোরালোভাবে। এই দ্বিমুখী প্রচারে দিল্লির ভোটাররা যে আস্থা রেখেছেন, ফলাফলে তা পরিষ্কার।

মধ্যবিত্ত গরিষ্ঠ দিল্লির রাজনীতি সাধারণত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মুখ্য। দিল্লির নাগরিকদের মধ্যে কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ বিল, পরিবহনব্যবস্থা এবং শিক্ষাব্যবস্থা একটি বড় ইস্যু। বিজেপি এসব সমস্যার সমাধানে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে দিল্লির উন্নয়ন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ যেমন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’, ‘স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিজেপি এসব ইস্যুকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

বিজেপি তাদের নির্বাচনী প্রচারে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির সমর্থন সংগ্রহে সফল হয়েছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং যুবসমাজের সমর্থন পেয়েছে। তার সঙ্গে মুসলিম ভোটব্যাংকের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে, যা বিজেপির জন্য ইতিবাচক হয়েছে। বিজেপির সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর প্রচারণা মুসলিম ভোটের মধ্যেও কিছুটা সমর্থন পেয়েছে। বিজেপি নির্বাচনী প্রচারে সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিশ্রুতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। তারা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য এককালীন ২১ হাজার ৫০০ রুপি সহায়তা এবং ৫০০ রুপিতে রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার বিতরণের মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।

সক্রিয় আরএসএস, সাফল্য বিজেপির

ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে বর্তমানে ১৬টিতে বিজেপি ক্ষমতায়। এই বাকি ১২টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু বাদ দিলে বাকি ছয়টি কমবেশি ছোট রাজ্য বলে পরিচিত। ভারতের রাজনীতিতে তাদের তেমন গুরুত্ব নেই। যে রাজ্যগুলো ধরে রাখলে বিজেপি ভবিষ্যতে আরও অনেক দিন ভারত শাসনের যোগ্যতা ধরে রাখতে পারবে, তার সবই তাদের দখলে। এ বছরের শেষে বিহারে নির্বাচন। সেখানে নীতীশ কুমারকে ডুবিয়ে বিজেপি ক্ষমতার স্বাদ ফিরে পেতে মরিয়া। যেমনটা তারা মহারাষ্ট্রে করেছে। আর ২০২৬-এর শুরুতে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। ইতিমধ্যে খেলা শুরু হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে বিজেপি ৭৭ থেকে এক লাফে ১৪৪-এর লক্ষণরেখা পার করতে চায়।

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে মোদির বিজেপির বড় ধাক্কার পর এভাবে ফিরে আসাটা বিস্ময়কর। লোকসভায় বিজেপি এককভাবে সাড়ে ৩০০-এর বেশি আসন পাবে বলে দাবি করেছিল। বুথফেরত সমীক্ষায়ও তেমনটি দেখানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ২৪০টি আসন পেয়ে মোদি সরকার তৃতীয় মেয়াদে এসে একক গরিষ্ঠতা হারায়। শরিকদের বুকে টেনে নিয়ে সরকার গড়তে হয় মোদিকে। এরপরই আসলে এগিয়ে আসে বিজেপির পিতৃসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)। আরএসএস বুঝতে পারে মোদির ভোট-আকর্ষণী ক্ষমতাক্রম অদৃশ্যমান। সে জন্য নানা অঙ্গসংগঠন নিয়ে এগিয়ে আসে তারা। হরিয়ানার মতো ছোট রাজ্যে ভোটের বেশ আগে ৩০ হাজার ছোট-বড় সভা করে। সংগঠনের সেবকদের সক্রিয় করে। হরিয়ানার ভোট থেকে দূরে রাখে মোদিকে। তারপরও সাফল্য এসে ধরা দেয়। একই কাজ আরএসএস মহারাষ্ট্র ও দিল্লিতে করেছে। এটা করার একটা বড় কারণ মোদির ভোট আকর্ষণী ব্যক্তিত্ব থেকে বিজেপিকে মুক্ত করা। এতে মোদির রাশ টানাও সম্ভব হয়েছে, পাশাপাশি বিজেপিতে আরএসএসের আধিপত্য ফের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরএসএসের এখন নজর বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে।

ছন্নছাড়া ইন্ডিয়া জোট

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া নামের জোট তৈরি হয়েছিল। প্রায় ২৬টি আঞ্চলিক দল ছিল এই জোটে। এর আগের দুটি লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ২০২৪-এ জোটের সাফল্য ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু নির্বাচন চলে যেতেই জোটে ফাটল। এখন মমতা, অখিলেশ, কেজরিওয়ালসহ আরও কয়েকজন ইন্ডিয়ার মধ্যে উপজোটের ঘোঁট পাকিয়েছেন। এর জন্য কংগ্রেস কম দায়ী না। হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী কংগ্রেস জোটের শরিকদের কাউকে পাত্তা দেয়নি। ফলাফল হার। তাতেও কংগ্রেস কিছু শেখেনি। মহারাষ্ট্রে একই কাজ করল তারা। লোকসভার নির্বাচনের আলোকে কংগ্রেস জোটের ২০০-এর বেশি আসন পাওয়ার কথা। অথচ হলো উল্টোটা।

আর দিল্লির নির্বাচনে কেজরিওয়াল কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো ধরনের জোট না করার সিদ্ধান্ত নেন। ভোটের ফলাফলে দেখা যায় বিজেপি (৪৫.৫৬ শতাংশ) আম আদমি পার্টির (৪৩.৫৭ শতাংশ) চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে ৪৮টি আসনে জিতল। আর আম আদমি পেল বাকি ২২টি। আর ৬.৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো শূন্য সিট পাওয়ার রেকর্ড গড়ল কংগ্রেস। অথচ এই দুটি দল জোট বাঁধলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তাদের খাতায় যেত। মোদির দিল্লি জয় তৃতীয়বারের মতো অধরা থেকে যেত।

এক দল এক দেশ

কংগ্রেস ছাড়াও ইন্ডিয়া জোটের আরও অনেক দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিজেপিবিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেছে। বিরোধীদের এই বিভাজন ভোটারদের আরও বেশি করে বিজেপির দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিজেপি ইতিমধ্যে এক দেশ এক ভোট অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোতে একই সময়ে ভোট আয়োজনের জন্য বিল নিয়ে এসেছে। বিজেপিবিরোধীদের এ নিয়ে প্রবল আপত্তি থাকলেও তারা এই ছন্নছাড়া অবস্থায় কতটা এর মোকাবিলা করতে পারবে বলা কঠিন।

বিজেপি এমনিতেই তার বিরোধীদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছে। এক দেশ এক ভোট আইন হলে তা কঠিনতর হয়ে উঠবে। আর এ ধরনের বিরোধীপক্ষ থাকলে ২৮ রাজ্যের মধ্যে ২৬টিতে বিজেপি ক্ষমতাসীন থাকবে—সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত