Ajker Patrika

মনের যত্নে মন দিন

সাজেদুল ইসলাম
আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২১, ১২: ৫২
মনের যত্নে মন দিন

শরীরের যত্ন নিতে দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করি। সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করি। অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিই, ওষুধ সেবন করি। শরীর ফিট রাখতে ব্যায়ামাগারে যাই। শরীরচর্চা করি। সকাল-বিকেল পার্কে হাঁটি। এগুলো সবই শরীরের যত্ন নেওয়ার অংশ। সুস্থ থাকার কৌশল। মনেরও যত্ন প্রয়োজন। শরীরের যত্ন নিয়ে আমরা যতটা আগ্রহী, সচেতন ও উদ্বিগ্ন থাকি, মন নিয়ে ততটাই উদাসীন আমরা। এটি ব্যক্তিবিশেষের কথা নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের এই উদাসীনতা নোটিশ করার বিষয়। মনের সুস্থতার জন্য কেউ মনস্তত্ত্ববিদের দপ্তরে গেলে তাঁকে আমরা নির্ঘাত পাগল বলে হাসাহাসি করি। এ ক্ষেত্রে আমরা মানতে চাই না যে একজন সুস্থ মানুষেরও নিয়মিত কাউনসেলিংয়ের প্রয়োজন হয়। শরীরের মতো মনকেও ফিট রাখতে হয়। 

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র `আগন্তুক' থেকে প্রাচীন গ্রিসের এক বিশেষ ধরনের জিমনেসিয়াম বা ব্যায়ামাগারের কথা জানা যায়, যে জিমনেসিয়ামে শরীর ও মন উভয়ের চর্চা হতো। সেখানে প্লেটো, সক্রেটিস ও এরিস্টেটলের মতো দার্শনিকেরা আসতেন, আড্ডা দিতেন, নানা বিষয়ে তর্ক-আলোচনা করতেন। শরীরের সঙ্গে সেখানে মননেরও চর্চা করতেন। মনের চর্চা করা বহু পুরোনো বিষয় হলেও এখন আমরা মনের বিষয়ে বেখবর। সাম্প্রতিক সময়ে এই উদাসীনতা আরও বেড়েছে। একদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখ রেখে সামাজিক হতে গিয়ে আমরা শিকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি, পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের বিচ্ছিন্নতাকে আরও বেশি প্রকট করে তুলেছে অনলাইননির্ভর করে। এই মাত্রাতিরিক্ত অনলাইননির্ভরতা আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে দক্ষতা তৈরিতে সহায়তা করলেও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধকে প্রকট করে তুলছে।

সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদের কথায় আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রসঙ্গটি। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, অধ্যাপকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আয়োজিত শিক্ষণ ঘাটতি ও মনঃসামাজিক চর্চাবিষয়ক এক কর্মশালায় তিনি বলেন, কোভিডকালে শিক্ষায় যে ঘাটতি হয়েছে, তা হয়তো পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু এই সময়ে যে মনঃসামাজিক ঘাটতি হয়েছে বা হচ্ছে, তা অপূরণীয়। তাঁর এই আলাপের যুক্তি হলো, শিক্ষার্থীরা এখন অনেক বেশি গ্যাজেটনির্ভর হয়ে উঠেছে। আগে কাজিন ভাইবোনেরা একত্র হলে গল্প-আড্ডা দিয়ে সময় পার হয়ে যেত। এখন সাত-আটজন কাজিন ভাইবোন একটি কক্ষে একত্র হলেও সবার সময় কেটে যায় নিজ নিজ মোবাইল সেটে চোখ রেখে।

অনলাইনে সামাজিক হতে গিয়ে বাস্তব জীবনে অসামাজিক হয়ে উঠছে আমাদের শিশু-কিশোরেরা। অধ্যাপক নেহাল আহমেদের ভাষ্য, অতিরিক্ত অনলাইননির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক একাকিত্ব তৈরি হয়েছে। তারা এখন একত্র হলেও খুব একটা হইহুল্লোড় করে না। সবাই নিজ নিজ মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকে। তিনি শিক্ষার্থীদের এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে পরিবার ও শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।

কোভিড-১৯ আমাদের জন্য নতুন এক শিক্ষা বয়ে এনেছে উল্লেখ করে কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এস এম আমিরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার অর্থ হলো আত্মোপলব্ধি। কোভিড-১৯ আমাদের ভেতরে সঠিক উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে, সময়ের প্রয়োজনে নিজেদের পরিবর্তন করতে পেরেছি আমরা। কোভিড-১৯-এর কাছে পরাজিত হতে হয়নি আমাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন শিক্ষার দুনিয়ায় প্রবেশ করে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে। আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, মানবসভ্যতা এগিয়ে গেছে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। মানুষ একত্র হয়ে কাজ করছে বলে সভ্যতা প্রতিদিন এগিয়ে চলছে। 

সুতরাং কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা পূরণ করতে হবে। মোহাম্মদ আবুল মনছুর ভুঁঞা বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পিছিয়ে দিতে পারেনি, বরং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। মহামারি না এলে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমাদের আরও বেশি সময় দিতে হতো। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন সত্যিকারের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।

তবে অতিরিক্ত ইন্টারনেটনির্ভরতা শিশু-কিশোরের মনঃসামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের বৈশ্বিক সংস্থা ইউনিসেফের এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে , করোনাকালে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ইউনিসেফ একটি জরিপ করে। সেখানে ২৩৯টি স্কুলের ১ হাজার ২৮১ শিক্ষার্থীর মধ্যে এক পরিসংখ্যানে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে আসে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৪ শতাংশ শিশুর সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ ব্যক্তিগত মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ৩৭ শতাংশ শিশু বাবা-মায়ের ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। জরিপে ১১ বছরের নিচে ২৫ শতাংশ শিশুকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ৬৫ শতাংশ শিশু নিজের পৃথক কক্ষে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। যেখানে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সর্বোচ্চ সুবিধা পাচ্ছে। নিজের ব্যক্তিগত কক্ষ হওয়ায় ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি নিয়ে তাদের প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয় না।

সংস্থাটি বলছে, গত এক বছরে ১০.৮ শতাংশ শিশু তাদের ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছে শেয়ার করেছে। ৫৭ শতাংশ শিশু অনলাইনে অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করেছে। ১৯ শতাংশ শিশু অপ্রীতিকর বার্তা পেয়েছে, ১২ শতাংশ শিশু যৌন আবেদন সম্পর্কিত ছবি/ভিডিও এবং ৫ শতাংশ শিশুকে যৌন সম্পর্কে সম্মতি দিতে জোর করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ জামানায় ইন্টারনেট দুনিয়ায় ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হলেও  সকলে একটি বিষয়ে একমত হতে হয় যে, মনঃসামাজিক দুনিয়ায় অযাচিত-অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আর এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের অনুঘটক হলো ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং শিশু-কিশোরদের হাতে থাকা গ্যাজেট।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মনঃসামাজিক ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। শিক্ষার্থীদের মনের চর্চা যদি যথাযতভাবে না হয়, তাদের ভেতরে গড়ে উঠতে থাকা পারিবারিক ও মূল্যবোধ ভেঙে যদি একাকিত্ব স্থান করে নেয়, তবে পুরো সমাজকাঠামো ভেঙে পড়বে। এ জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সংবেদনশীল মন নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এমন প্রত্যাশা করাটা দোষের কিছু মনে করি না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখামাত্র পুতিনকে গ্রেপ্তারের আহ্বান

যুবককে আটক করা নিয়ে বিজিবি ও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি দাবি

বরিশাল-৩ আসনে বিএনপির দুই হেভিওয়েট নেতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

বরখাস্ত সৈনিককে অস্ত্র দিয়েছেন বিএনপি নেতা, অডিও নিয়ে তোলপাড়

ভূমি অফিসের কাণ্ড: এসি ল্যান্ড দপ্তরের নামে দেড় কোটি টাকা আদায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত