Ajker Patrika

নারীর প্রজনন সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা

সেলিম জাহান 
নারীর প্রজনন সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫০ লাখ বলে প্রাক্কলিত হয়েছে, যার অর্ধেক নারী। প্রাক্কলন করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা ভান্ডার তাদের ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে, যা কদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ৫০ লাখের নিরিখে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২ শতাংশ মাত্র। সেই সঙ্গে উপর্যুক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নারী ও পুরুষ উভয়েরই প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৈশ্বিক গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৪ বছর, যেখানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ বছর। অন্যদিকে বাংলাদেশে নারীর গড় আয়ু ৭৭ বছর, যার বিপরীতে সংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক সংখ্যাটি হচ্ছে ৭৬ বছর। এই সার্বিক উপাত্তগুলোকে বিভাজিত করলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিষয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে।

প্রথমত, বাংলাদেশের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫-৬৪ বছর)। এ রকমের অনুপাত জনমৈতিক লভ্যাংশ সুবিধা গ্রহণের একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কিন্তু অন্যদিকে, একটি সমাজের বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠী (যাঁদের বয়স ৬৫ বছর এবং তার বেশি) অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য সমাজের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপরই নির্ভর করে। বাংলাদেশে বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ, অর্থাৎ তাঁদের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। যেহেতু বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে গেছে, তাই বয়োবৃদ্ধ মানুষের দীর্ঘ সময়ের জন্য সহায়তা প্রয়োজন হবে। এ সহায়তা দরকার হবে বৃদ্ধ ভাতা, সামাজিক সহায়তা এবং সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী পারিবারিক বন্ধনের ওপরই বেশি নির্ভর করে। জনসংখ্যার এই যে পরিবর্তিত কাঠামো, তার প্রভাব শুধু আর্থিক নয়, বরং এই প্রভাব গৃহাভ্যন্তরে সেবাকর্মের ওপরও পড়বে। নারীর দৈনন্দিন সময় ব্যবহারও এতে প্রভাবিত হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২০ থেকে ৩০ শতাংশই বয়ঃসন্ধিক্ষণের কিশোর-কিশোরী। নির্ভরতা-অনুপাতের একটা বড় অংশই এরা, যারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল। যদি বৃহত্তর তরুণ জনগোষ্ঠীকে বিবেচনা করা হয়, যার সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, তারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। যেহেতু এই তরুণ জনগোষ্ঠী সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনের মূল চালিকাশক্তি, তাই তারা একদিকে জনমৈতিক লভ্যাংশের অংশীজন হবে, কিন্তু অন্যদিকে যদি এই জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত না করা যায়, কিংবা যদি তাদের দক্ষভাবে কাজে লাগানো না যায়, তাহলে তারা কর্মবিহীন হয়ে দেশের এখনকার ২৭ লাখ বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেবে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০-১২ শতাংশ, যা দেশের সার্বিক বেকারত্ব হারের চেয়ে অনেক বেশি।

তৃতীয়ত, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার হচ্ছে ২.১। এর দুটি দিক আছে। এক, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে প্রজনন হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের প্রজনন হার ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হার ক্রমান্বয়ে দ্রুত হারে কমে ২.১-এ এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার হার কমানোর পেছনে প্রজনন হারের এই হ্রাস একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। দুই, বাংলাদেশের বর্তমান প্রজনন হার (২.১) একটি ‘প্রজনন ধাঁধা’র মধ্য-অবস্থানে রয়েছে, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রজনন হার ০.৮। বাংলাদেশের প্রজনন হার (২.১) জনসংখ্যা প্রতিস্থাপন স্তরে রয়েছে সত্যি, কিন্তু তবু বয়ঃসন্ধিকালীন গর্ভধারণ এ দেশে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিবাহ, সীমিত প্রজনন স্বাস্থ্যসুবিধা এবং যৌনতা শিক্ষার অভাব এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা ভান্ডারের ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের প্রতিবাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘প্রকৃত পারিবারিক সংকট: পরিবর্তিত বিশ্বে প্রজনন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতার লক্ষ্য অনুসরণ’। এই প্রতিবেদনটি জনমিতিতে বহুল উচ্চারিত ‘বিশাল জনসংখ্যা’ কিংবা ‘কম জনসংখ্যা’র ধারণাটিকে খণ্ডন করেছে এবং যুক্তি উপস্থাপন করেছে যে, জনসংখ্যার ক্ষেত্রে সমস্যাটি সংখ্যার নয়, সমস্যাটি প্রজনন সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাবিষয়ক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবিশ্যি ‘সংখ্যা’ এবং ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা’—দুটি বিষয়ই অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক।

প্রথমত, শুধু সংখ্যার দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা দুই দিক থেকে ভাবনার বিষয়। এক, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা-ঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, কিন্তু দেশের ভূমির পরিধি বাড়েনি। সুতরাং আবাদি জমি, বাড়িঘর, ভৌত কাঠামো এবং সামাজিক সেবা সুবিধার চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের মোট ভূমির কতটা পর্যাপ্ত, সেটা একটি চিন্তার বিষয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ‘অধিক জনসংখ্যা’ বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবে অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক।

দ্বিতীয়ত, তার চেয়েও বড় কথা যে, বাংলাদেশের মতো দেশে প্রজনন সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রজনন এবং প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রায়ই বাংলাদেশের নারী এবং তরুণসমাজ তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং চাওয়া-পাওয়া অর্জন করতে পারে না। সমাজের বিভিন্ন রকমের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এ ব্যর্থতার পেছনে কাজ করে। বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ নারী গর্ভধারণ বিষয়ে নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের এই সংখ্যা সংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক গড়সংখ্যা ৬৩ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। তেমনিভাবে, এ দেশের মাত্র ২৩ শতাংশ নারী তারা যতটি সন্তান চেয়েছিল, ততটি সন্তানের জননী হতে পেরেছে। বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি হচ্ছে ৩৭ শতাংশ। প্রজনন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের স্বাধীনতার অনুপস্থিতিই এ সংখ্যাগুলো প্রতিফলিত করে। এর কারণ অবশ্য বিবিধ—অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অনুপস্থিতি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার অভাব, সামাজিক চাপ এবং সর্বোপরি পুরুষতন্ত্র।

অযাচিত গর্ভধারণ বাংলাদেশে বেশ ব্যাপক এবং তার কারণগুলোও বিবিধ। এ দেশের ১১ শতাংশ নারী স্বাধীনভাবে গর্ভনিরোধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, ১৬ শতাংশ নারীকে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভধারণ করতে হয়, সন্তান চাওয়া সত্ত্বেও ১৫ শতাংশ নারীকে গর্ভনিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। প্রায় ১৯ শতাংশ নারী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা লাভ করেন না এবং প্রতি তিনজন নারী অভিযোগ করেছেন যে চাইলেও তাঁরা সহবাসে অস্বীকৃতি জানাতে পারেননি। এসবের ফলে এ দেশের ৩৩ শতাংশ নারী অযাচিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত সামাজিক প্রথা নারীকে অল্প বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে এবং মা হতে চাপ দেয়। এসব কিছুর কারণে নারীর মজুরিবিহীন সেবাকর্মের বোঝা বেড়ে যায়, বৃদ্ধি পায় গৃহাভ্যন্তরে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। এর ফলে নারীর প্রজনন সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা আরও খর্ব হয়। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক চাপ ও কষ্ট, স্বাস্থ্যসেবার বিশাল ব্যয়, ব্যয়বহুল শিশুসংস্থান, সীমিত পিতৃ-মাতৃ ছুটি ইত্যাদি কারণে বহু দম্পতি সন্তান গ্রহণ বিলম্বিত করা কিংবা একেবারে নাকচ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশি নারীর প্রজনন সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করতে হলে তাঁদের নানাভাবে সহায়তা প্রদান করতে হবে। এসব সহায়তার মধ্যে থাকবে প্রয়োজনীয় প্রজননস্বাস্থ্য সুবিধার বিস্তার, একটি অভিজ্ঞ ধাত্রীদল, ওষুধ এবং গর্ভনিরোধের নানান পন্থার অবিচ্ছিন্ন জোগান ইত্যাদি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন হবে সার্বিক যৌনতা শিক্ষা, ব্যয়সাধ্য আবাসন, ব্যয়সাধ্য শিশুসংস্থান এবং বেতনসহ পিতৃ-মাতৃ ছুটি। এসবের জন্য স্বাস্থ্য খাতে সরকারি অর্থসংস্থান বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৭ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ ব্যয়িত হয়। এই অবস্থা নিশ্চিতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়—না বৈশ্বিক মানদণ্ডে, না আঞ্চলিক মানদণ্ডে। এই দুটি ব্যয়ের অনুপাত অন্ততপক্ষে জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত হওয়া উচিত। আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে বাংলাদেশি নারীর প্রজনন সিদ্ধান্ত বিচার্য নয়, সমর্থিত হতে হবে এবং এ দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং সম্মানের সঙ্গে তাদের নিজ নিজ জীবনকে সাজাতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার পর বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাকে ফেরত নেওয়ার অনুরোধ কাতারের

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি জানাবে ইউজিসি

বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করল যুক্তরাষ্ট্র

শেখ হাসিনার ‘ফেরার পরিকল্পনা’ ঘিরে গোপন বৈঠক, গ্রেপ্তার ২২ নেতা-কর্মী কারাগারে

পর্যটকদের জন্য দ্বার খুলে দিচ্ছে বিশ্বের অন্যতম নিঃসঙ্গ একটি দেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত