চিররঞ্জন সরকার
তার সাজপোশাকে তথাকথিত উগ্রতা ছিল না। থাকবেই-বা কীভাবে? মাত্র আট বছর বয়সী একটি মেয়েশিশুর পোশাকই-বা কী? আর উগ্রতাই-বা কী? কিন্তু তারপরও সে রেহাই পায়নি। তার সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’, সে ছিল নারী। তাকে ‘ভোগ’ করা যায়, ধর্ষণ করা যায়। হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ফলে মাগুরার সেই ছোট্ট শিশুটি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এ ঘটনায় শুধু ওই মেয়েশিশুই নয়, তার দরিদ্র পরিবারও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বিপর্যস্ত দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অগণিত মানুষ।
বর্তমানে সারা দেশে বল্গাহীনভাবে মেয়েশিশু ও নারীর ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। নির্যাতনকারীদের শাস্তি না হওয়া এবং একধরনের সামাজিক বৈধতা পাওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিথিল ভূমিকা, যেকোনো ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মামলা করতে না দেওয়া বা আপসের জন্য অপরাধীদের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ, সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত না হওয়া, অনেক ক্ষেত্রে মব সৃষ্টি করে নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের ওপর বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধ আরোপ, সামাজিক লোকলজ্জা ও ভীতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এ ধরনের অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। যে কারণে শহর-গ্রামে বয়স্ক নারী, তরুণী থেকে মেয়েশিশুরাও নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি।
আপাতদৃষ্টিতে ধর্ষণকে বিকৃতকামী মানসিকতা বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই বিকৃতকামুকতা সমাজের এক গভীর অসুখ। পুরুষতান্ত্রিক কামবোধের সঙ্গে সংকীর্ণ ধর্মীয় বিভেদমূলক মানসিকতা মিলে চূড়ান্ত অরাজকতা সৃষ্টি করছে! এই অরাজকতাই দিন দিন পোক্ত হচ্ছে। আর সরকার ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ মুলা ঝুলিয়ে যাবতীয় অনাচারের ব্যাপারে চোখ বন্ধ রেখে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিচ্ছে!
সরকার বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি এইচ টি ইমামের ছেলের বাড়িতে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আছে—এমন গুজব ছড়িয়ে ২০-৩০ জন দুর্বৃত্ত দরজা ভেঙে অন্য এক বাড়িতে লুটপাট চালায়, ভিডিওতে সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মাত্র তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজধানীর লালমাটিয়ায় ধূমপান নিয়ে বিরোধের জেরে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় আইন শুধু ধূমপানের অপরাধ দেখছে, অন্য কোনো অপরাধ খুঁজে পাচ্ছে না। এ ছাড়া ছাত্রী উত্ত্যক্তকারীকে ছাড়াতে রাতভর থানা ঘেরাও করে উন্মত্ত মব তাকে গলায় মালা পরিয়ে হাতে কোরআন শরিফ ধরিয়ে দিয়ে প্রকাশ্য মিছিল করে, যা সারা বিশ্ব দেখেছে। পাশাপাশি, পূর্বঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন রাজধানীর মূল সড়কে নিষিদ্ধ পতাকা নিয়ে নৃত্য করে, কিন্তু সরকার তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই করে না, মৃদু লাঠিপেটা ছাড়া। এসব ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং অপরাধীদের প্রতি সহনশীল মনোভাব সমাজে আরও অপরাধকে উৎসাহিত করছে।
প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ যদি নিরাপদে থাকতে না-ই পারে তাহলে আর ‘সুন্দর বাংলাদেশ’ দিয়ে কী হবে? অন্ধকারকে প্রশ্রয় দিয়ে ক্ষমতায় থাকার পথ কখনো মসৃণ হয় না। তাতে সমাজটাই সমাজবিরোধীদের মুক্ত রাজ্য হয়ে ওঠে। একসময় এমন হয়, শাসকেরা চাইলেও তাদের আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আমাদের সমাজও যদি অপরাধীদের দখলে চলে যায়, মানুষ দাঁড়াবে কোথায়?
রাজতন্ত্রে মানুষ অসহায় ছিল, নতুন মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশেও যদি তা-ই হয়, তাহলে তো সব শেষ! রাজতন্ত্রেও কিন্তু ধর্ষণ স্বীকৃতি পায়নি। ধর্ষণের জন্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটার নজিরও আছে। ৫০৯ খ্রিষ্টপূর্বে অত্যাচারী রোমান রাজা তারকুইনের পুত্র সেক্সটাস ধর্ষণ করে কোলাতিনুসের অপরূপা নারী লুক্রেশিয়াকে। যার ডাক নাম লুক্রিশ। এই নারকীয় ঘটনাই বদলে দেয় ইতিহাস। অপমানে লুক্রিশ আত্মহত্যা করতেই প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে সারা দেশ। রাজসিংহাসন উল্টে যায়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনে জন্ম নেয় রোমান প্রজাতন্ত্র। শিল্পীদের ছবিতে ফুটে ওঠে নারীর অসম্মানের চিহ্ন। জনরোষের আগুন। সেই ছবি আজও জ্বলজ্বল করছে রোমের মিউজিয়ামে। সাক্ষ্য দিচ্ছে অন্ধকার ইতিহাসের। অনেক পরে পৃথিবীতে এসেছেন শেক্সপিয়ার। তাঁর মনে জেগে উঠেছে লুক্রিশের যন্ত্রণা। ১৫৯৪-তে লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য রেপ অব লুক্রিশ’।
যৌন হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্ষণের ফলে শুধু একটি নারীই শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ। কারণ, একজন ব্যক্তি নারীর অসম্মান, মানবতার অসম্মান। তাই বলা হয়, খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই। অপরাধ স্বীকার করলে খুনিকে ক্ষমা করা যেতে পারে। তার সংশোধনের সুযোগও গ্রাহ্য। ধর্ষণকারীর বেলায় সেটা খাটে না। কঠোরতম শাস্তি তাকে পেতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন এ কথাই ঘোষণা করেছে।
অথচ আমাদের দেশে একদল মানুষ ধর্ষণ করছে, আরেক দল মানুষ চুপ থেকে ধর্ষণকারীদেরই সমর্থন জোগাচ্ছে। এর ফলে ধর্ষিত হচ্ছে আমাদের সামাজিক নীতিবোধ। ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে যখন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না, একজন ধর্ষণ করে আর অন্যরা যখন নীরব থাকে কিংবা ধর্ষকের পক্ষে যাবতীয় যুক্তি আর সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তখন তাকে সামাজিক ধর্ষণ ছাড়া কী বলা যায়? এটাই এখন আমাদের দেশে বেশি বেশি ঘটছে!
গবেষণা বলছে, প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় অন্তত ৯ জন নারী ধর্ষিত হচ্ছেন বাংলাদেশে। এর মধ্যে কয়টা কেস নথিভুক্ত হচ্ছে? ধর্ষণের অত্যাচার নীরবে সহ্য করাটাই এখন আমাদের সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি আমাদের দেশে সালিস করে ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষণকারীর বিয়ে দেওয়ার প্রথাও আছে। অত্যাচারী রাজা, জমিদারেরা ধর্ষণ করত নিজেদের অধিকারবলে। ধর্ষণের শিকার চুপ করে থাকত, নয়তো আত্মহত্যা করত। সেই ধারা থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যৌনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দীর্ঘকালীন প্রথা ও সংস্কৃতি মেয়েদের মেনে নিতে বাধ্য করেছে, যার ফলে তাদের জীবন যেন এক সন্ত্রাসের জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই জগতে নারীকে অবিশ্বাস, ধর্ষণ ও পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে একা লড়াই করতে হয়। নারীর মন এখানে উপেক্ষিত, অস্বীকৃত; শুধু তার শরীরটুকুই গুরুত্ব পায়, যাকে ঘিরে আদিম কামনা ও ভোগের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ভোগের উৎসবে শামিল হয় শত-সহস্র-লাখো মানুষ। ব্যক্তিগত লালসা থেকে পারিবারিক বিবাদের আক্রোশ—যেকোনো কারণেই নারী সহজ শিকার হয়ে ওঠে। প্রতিশোধের নামে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই হিংস্রতার চক্রে আটকা পড়ে উচ্চশিক্ষিত, সপ্রতিভ নারী থেকে শুরু করে বাসের নিরীহ যাত্রী, গৃহবধূ, হতদরিদ্র বালিকা, এমনকি আট-নয় বছরের স্কুলছাত্রী, মূক-বধির তরুণী কিংবা দুই-তিন বছরের শিশুকন্যা—কারও রেহাই নেই।
আমাদের সমাজে নারীকে আক্রান্ত হওয়ার পরও অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা মহাস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এখানে শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও পিছিয়ে নেই। তারা নিজেরা বুঝতে পারেন না যে তারা আসলে পুরুষতন্ত্রেরই মুখপাত্র, পিতৃতন্ত্রেরই প্রতিনিধি। ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ বা ‘দহন’-এর যন্ত্রণাময় দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়। একবার ধর্ষণের পর প্রতিদিনের ধর্ষণ কীভাবে একজন মেয়ের জীবন তছনছ করে দেয়, কীভাবে তার অস্তিত্ব বেদনার গহ্বরে নিমজ্জিত হয়, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। চূড়ান্ত অবমাননা ও রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণার মধ্যে নারীকে বাধ্য করা হয় নিঃশব্দে সহ্য করতে। শোষণ ও যৌনতা এখানে একাকার হয়ে যায়। গ্রামীণ মোড়লের নির্দেশে নারীকে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানো হয়। চুল কেটে দেওয়া হয়। দিনের আলোতেও যখন পুরুষ সহকর্মীর কামনার কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া নারীর কোনো বিকল্প থাকে না, তখন তাকে শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে হয়। সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিচার, আইনের শাসন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন—বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব আশা করা হয়তো বাড়াবাড়ি। এখন সামাজিক প্রতিরোধ সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুরুষদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা সময়ের দাবি। মনে রাখা দরকার যে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ—এসব অপরাধের মূল হোতা পুরুষ। তাই এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই। তাদের মানসিকতা ও আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। মনুষ্যত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে লাম্পট্য ও পাশবিকতাকে পরাজিত করতে হবে। এটা শুধু নারীর অধিকারের প্রশ্ন নয়, এটা মানবতার দায়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
তার সাজপোশাকে তথাকথিত উগ্রতা ছিল না। থাকবেই-বা কীভাবে? মাত্র আট বছর বয়সী একটি মেয়েশিশুর পোশাকই-বা কী? আর উগ্রতাই-বা কী? কিন্তু তারপরও সে রেহাই পায়নি। তার সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’, সে ছিল নারী। তাকে ‘ভোগ’ করা যায়, ধর্ষণ করা যায়। হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ফলে মাগুরার সেই ছোট্ট শিশুটি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এ ঘটনায় শুধু ওই মেয়েশিশুই নয়, তার দরিদ্র পরিবারও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বিপর্যস্ত দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অগণিত মানুষ।
বর্তমানে সারা দেশে বল্গাহীনভাবে মেয়েশিশু ও নারীর ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। নির্যাতনকারীদের শাস্তি না হওয়া এবং একধরনের সামাজিক বৈধতা পাওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিথিল ভূমিকা, যেকোনো ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মামলা করতে না দেওয়া বা আপসের জন্য অপরাধীদের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ, সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত না হওয়া, অনেক ক্ষেত্রে মব সৃষ্টি করে নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের ওপর বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধ আরোপ, সামাজিক লোকলজ্জা ও ভীতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এ ধরনের অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। যে কারণে শহর-গ্রামে বয়স্ক নারী, তরুণী থেকে মেয়েশিশুরাও নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি।
আপাতদৃষ্টিতে ধর্ষণকে বিকৃতকামী মানসিকতা বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই বিকৃতকামুকতা সমাজের এক গভীর অসুখ। পুরুষতান্ত্রিক কামবোধের সঙ্গে সংকীর্ণ ধর্মীয় বিভেদমূলক মানসিকতা মিলে চূড়ান্ত অরাজকতা সৃষ্টি করছে! এই অরাজকতাই দিন দিন পোক্ত হচ্ছে। আর সরকার ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ মুলা ঝুলিয়ে যাবতীয় অনাচারের ব্যাপারে চোখ বন্ধ রেখে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিচ্ছে!
সরকার বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি এইচ টি ইমামের ছেলের বাড়িতে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আছে—এমন গুজব ছড়িয়ে ২০-৩০ জন দুর্বৃত্ত দরজা ভেঙে অন্য এক বাড়িতে লুটপাট চালায়, ভিডিওতে সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মাত্র তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজধানীর লালমাটিয়ায় ধূমপান নিয়ে বিরোধের জেরে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় আইন শুধু ধূমপানের অপরাধ দেখছে, অন্য কোনো অপরাধ খুঁজে পাচ্ছে না। এ ছাড়া ছাত্রী উত্ত্যক্তকারীকে ছাড়াতে রাতভর থানা ঘেরাও করে উন্মত্ত মব তাকে গলায় মালা পরিয়ে হাতে কোরআন শরিফ ধরিয়ে দিয়ে প্রকাশ্য মিছিল করে, যা সারা বিশ্ব দেখেছে। পাশাপাশি, পূর্বঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন রাজধানীর মূল সড়কে নিষিদ্ধ পতাকা নিয়ে নৃত্য করে, কিন্তু সরকার তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই করে না, মৃদু লাঠিপেটা ছাড়া। এসব ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং অপরাধীদের প্রতি সহনশীল মনোভাব সমাজে আরও অপরাধকে উৎসাহিত করছে।
প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ যদি নিরাপদে থাকতে না-ই পারে তাহলে আর ‘সুন্দর বাংলাদেশ’ দিয়ে কী হবে? অন্ধকারকে প্রশ্রয় দিয়ে ক্ষমতায় থাকার পথ কখনো মসৃণ হয় না। তাতে সমাজটাই সমাজবিরোধীদের মুক্ত রাজ্য হয়ে ওঠে। একসময় এমন হয়, শাসকেরা চাইলেও তাদের আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আমাদের সমাজও যদি অপরাধীদের দখলে চলে যায়, মানুষ দাঁড়াবে কোথায়?
রাজতন্ত্রে মানুষ অসহায় ছিল, নতুন মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশেও যদি তা-ই হয়, তাহলে তো সব শেষ! রাজতন্ত্রেও কিন্তু ধর্ষণ স্বীকৃতি পায়নি। ধর্ষণের জন্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটার নজিরও আছে। ৫০৯ খ্রিষ্টপূর্বে অত্যাচারী রোমান রাজা তারকুইনের পুত্র সেক্সটাস ধর্ষণ করে কোলাতিনুসের অপরূপা নারী লুক্রেশিয়াকে। যার ডাক নাম লুক্রিশ। এই নারকীয় ঘটনাই বদলে দেয় ইতিহাস। অপমানে লুক্রিশ আত্মহত্যা করতেই প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে সারা দেশ। রাজসিংহাসন উল্টে যায়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনে জন্ম নেয় রোমান প্রজাতন্ত্র। শিল্পীদের ছবিতে ফুটে ওঠে নারীর অসম্মানের চিহ্ন। জনরোষের আগুন। সেই ছবি আজও জ্বলজ্বল করছে রোমের মিউজিয়ামে। সাক্ষ্য দিচ্ছে অন্ধকার ইতিহাসের। অনেক পরে পৃথিবীতে এসেছেন শেক্সপিয়ার। তাঁর মনে জেগে উঠেছে লুক্রিশের যন্ত্রণা। ১৫৯৪-তে লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য রেপ অব লুক্রিশ’।
যৌন হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্ষণের ফলে শুধু একটি নারীই শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ। কারণ, একজন ব্যক্তি নারীর অসম্মান, মানবতার অসম্মান। তাই বলা হয়, খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই। অপরাধ স্বীকার করলে খুনিকে ক্ষমা করা যেতে পারে। তার সংশোধনের সুযোগও গ্রাহ্য। ধর্ষণকারীর বেলায় সেটা খাটে না। কঠোরতম শাস্তি তাকে পেতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন এ কথাই ঘোষণা করেছে।
অথচ আমাদের দেশে একদল মানুষ ধর্ষণ করছে, আরেক দল মানুষ চুপ থেকে ধর্ষণকারীদেরই সমর্থন জোগাচ্ছে। এর ফলে ধর্ষিত হচ্ছে আমাদের সামাজিক নীতিবোধ। ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে যখন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না, একজন ধর্ষণ করে আর অন্যরা যখন নীরব থাকে কিংবা ধর্ষকের পক্ষে যাবতীয় যুক্তি আর সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তখন তাকে সামাজিক ধর্ষণ ছাড়া কী বলা যায়? এটাই এখন আমাদের দেশে বেশি বেশি ঘটছে!
গবেষণা বলছে, প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় অন্তত ৯ জন নারী ধর্ষিত হচ্ছেন বাংলাদেশে। এর মধ্যে কয়টা কেস নথিভুক্ত হচ্ছে? ধর্ষণের অত্যাচার নীরবে সহ্য করাটাই এখন আমাদের সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি আমাদের দেশে সালিস করে ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষণকারীর বিয়ে দেওয়ার প্রথাও আছে। অত্যাচারী রাজা, জমিদারেরা ধর্ষণ করত নিজেদের অধিকারবলে। ধর্ষণের শিকার চুপ করে থাকত, নয়তো আত্মহত্যা করত। সেই ধারা থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যৌনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দীর্ঘকালীন প্রথা ও সংস্কৃতি মেয়েদের মেনে নিতে বাধ্য করেছে, যার ফলে তাদের জীবন যেন এক সন্ত্রাসের জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই জগতে নারীকে অবিশ্বাস, ধর্ষণ ও পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে একা লড়াই করতে হয়। নারীর মন এখানে উপেক্ষিত, অস্বীকৃত; শুধু তার শরীরটুকুই গুরুত্ব পায়, যাকে ঘিরে আদিম কামনা ও ভোগের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ভোগের উৎসবে শামিল হয় শত-সহস্র-লাখো মানুষ। ব্যক্তিগত লালসা থেকে পারিবারিক বিবাদের আক্রোশ—যেকোনো কারণেই নারী সহজ শিকার হয়ে ওঠে। প্রতিশোধের নামে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই হিংস্রতার চক্রে আটকা পড়ে উচ্চশিক্ষিত, সপ্রতিভ নারী থেকে শুরু করে বাসের নিরীহ যাত্রী, গৃহবধূ, হতদরিদ্র বালিকা, এমনকি আট-নয় বছরের স্কুলছাত্রী, মূক-বধির তরুণী কিংবা দুই-তিন বছরের শিশুকন্যা—কারও রেহাই নেই।
আমাদের সমাজে নারীকে আক্রান্ত হওয়ার পরও অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা মহাস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এখানে শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও পিছিয়ে নেই। তারা নিজেরা বুঝতে পারেন না যে তারা আসলে পুরুষতন্ত্রেরই মুখপাত্র, পিতৃতন্ত্রেরই প্রতিনিধি। ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ বা ‘দহন’-এর যন্ত্রণাময় দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়। একবার ধর্ষণের পর প্রতিদিনের ধর্ষণ কীভাবে একজন মেয়ের জীবন তছনছ করে দেয়, কীভাবে তার অস্তিত্ব বেদনার গহ্বরে নিমজ্জিত হয়, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। চূড়ান্ত অবমাননা ও রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণার মধ্যে নারীকে বাধ্য করা হয় নিঃশব্দে সহ্য করতে। শোষণ ও যৌনতা এখানে একাকার হয়ে যায়। গ্রামীণ মোড়লের নির্দেশে নারীকে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানো হয়। চুল কেটে দেওয়া হয়। দিনের আলোতেও যখন পুরুষ সহকর্মীর কামনার কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া নারীর কোনো বিকল্প থাকে না, তখন তাকে শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে হয়। সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিচার, আইনের শাসন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন—বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব আশা করা হয়তো বাড়াবাড়ি। এখন সামাজিক প্রতিরোধ সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুরুষদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা সময়ের দাবি। মনে রাখা দরকার যে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ—এসব অপরাধের মূল হোতা পুরুষ। তাই এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই। তাদের মানসিকতা ও আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। মনুষ্যত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে লাম্পট্য ও পাশবিকতাকে পরাজিত করতে হবে। এটা শুধু নারীর অধিকারের প্রশ্ন নয়, এটা মানবতার দায়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জুলাই অভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলাপ-তৎপরতা শুরু হয়। অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি-এনসিপি)...
১৬ ঘণ্টা আগেবিচারহীনতা আজ এই দেশের অলিখিত ঐতিহ্য হয়ে গেছে। এই বিষয়ে আমি-আমরা সবাই আজ নিশ্চিত। তবে বিচার চাই, ফাঁসি চাই, গ্রেপ্তার চাই—এইসব চলছে আর চলবে। শেষ পর্যন্ত কেউ বিচার করবে না, কারও বিচার হবে না, কিচ্ছু পাল্টাবে না।
১৬ ঘণ্টা আগেলোভ মানুষের চরিত্রকে এমনভাবে গ্রাস করে যে সে ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা মুছে ফেলে। একজন বাবা, যিনি সন্তান হারিয়েছেন, তিনিও যখন অর্থের লোভে সন্তান হত্যার মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে—আমরা কোন পথে চলেছি?
১৬ ঘণ্টা আগেআওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ‘বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো’ কর্মকর্তাদের মধ্যে ১১৯ জন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। গত মাসে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
২ দিন আগে