সময়মতো নির্বাচন হলে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এমন অনেক ঘটনাই ঘটতে থাকবে, যা এখন কল্পনার মধ্যেও আসবে না। তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি সশরীরে দেশে এলে বিএনপির রাজনীতি অনেক শক্তিশালী হবে। চাঙা হয়ে উঠবে দলীয় কার্যক্রম।
জাহীদ রেজা নূর
লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে ১৩ জুন স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আপাতত অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের আলোয় অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, দেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইবে। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেমন ছাড় দিয়েছেন, তেমনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও ছাড় দিয়েছেন। ডিসেম্বর নাকি এপ্রিলে নির্বাচন হবে, তা নিয়েই বেধেছিল বিতর্ক। ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি ছিল অনড়, এপ্রিলের ব্যাপারে ছিল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা। অবশেষে লন্ডন বৈঠকে একজন এপ্রিল থেকে নির্বাচনকে ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে এগিয়ে আনার কথা বলেছেন, অন্যজন ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। ফলে ফেব্রুয়ারিতেই আগামী নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
কিন্তু সত্যিই কি এতটা আশাবাদী হওয়া চলে?
কোনো সন্দেহ নেই, অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে সবকিছু লেজেগোবরে করে তুলেছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দল ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব-সন্ত্রাস, নতুন গজিয়ে ওঠা দলগুলোর টাকাপয়সা-সংক্রান্ত মুখরোচক গল্প বুঝিয়ে দেয়, নতুন বন্দোবস্তের যে আলামত দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক কিছু নয়। যাঁদের মুখে নতুন দিনের কথা শোনা যাচ্ছে, তাঁদের আচরণে মনে হয় না যে সেই নতুন দিনগুলো আলোকিত হবে। বরং এদেরই কারও কারও মুখে কোনো কোনো বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাকে হেয় করার আলামত দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা এমন কিছু সন্দেহের সৃষ্টি করে মনে, যা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও এই দেশটির ইতিহাস নিয়ে তাঁদের ধারণা কী—এ প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এই অবস্থায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল ম্যান্ডেটের ওপর নির্ভর করে সংস্কারসহ সরকারের করণীয় কাজগুলো গুছিয়ে নিতে পারবে। আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত দলই পারে অরাজকতার অবসানে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আবারও জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে, সত্যিই কি নির্বাচন হচ্ছে এই ফেব্রুয়ারিতে? এ রকম কোনো স্পষ্ট ঘোষণা কি দিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস?
বিষয়টি অস্পষ্ট, অথচ বিএনপি নাকি ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের স্পষ্ট বার্তা পেয়ে গেছে। তাহলে তো কথাই নেই। এবার মনোনয়নের জন্য দলের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যাবে। শুধু বিএনপি কেন, সব রাজনৈতিক দলই তাদের দলের শক্তিশালী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দেবে। শুরু হবে মিটিং-মিছিল, দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাওয়ার খেলা। চাঙা হয়ে উঠবে রাজনীতির ময়দান। এই দৃশ্যটি বাস্তবে দেখার আগপর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে, এ রকম বিশ্বাস করা কঠিন।
কেন কঠিন?
কারণ হলো, ইউনূস-তারেক আলোচনায় তিনটি ‘কিন্তু’ রয়েছে—বিচার, সংস্কার আর প্রস্তুতি। এই তিনটি ব্যাপারে অগ্রগতি হলেই কেবল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। যদি জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারে আশাপ্রদ অগ্রগতি না হয়? যদি সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অগ্রগতি মন্থর হয়? যদি নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রত্যাশামতো না হয়—তাহলে? এর যেকোনো একটি কারণকে সামনে রেখেই তো ঘোষণা করা হতে পারে—প্রত্যাশামতো অবস্থার উন্নতি হয়নি, সুতরাং পিছিয়ে যাবে নির্বাচন। জনমনে আরও কত প্রশ্নই তো ঘুরপাক খাচ্ছে। তারও কিছুটা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
কোনো সন্দেহ নেই, ইউনূস সরকারের প্রতি যে প্রত্যাশা নিয়ে সমর্থন দিয়েছিল জনগণ, সে প্রত্যাশা অনেকাংশেই সফলতার মুখ দেখেনি। অনেকেই এই সরকারের কার্যক্রমে বিরক্তও হয়েছেন। খোদ প্রধান উপদেষ্টার কথাবার্তায়ও কখনো কখনো নিরাশ হয়েছে জনগণ। উপদেষ্টারা কী কাজ করছেন, কতটা সাফল্যের সঙ্গে তাঁরা তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন, তা নিয়েও রয়েছে অনেক সমালোচনা। ছাত্র উপদেষ্টাদের ব্যাপারেও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তৌহিদি জনতা নামে একশ্রেণির লোক ধর্মকে পুঁজি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তার বিরুদ্ধেও স্পষ্ট কোনো বার্তা দেয়নি এই সরকার। ফলে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রত্যাশা খুব দ্রুত হতাশায় পরিণত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে সংকট বাড়বে।
প্রশ্ন আরও আছে। সব দলের অংশগ্রহণেই কি নির্বাচন হবে? আওয়ামী লীগ কি সেই দলগুলোর মধ্যে পড়বে? চ্যাথাম হাউসের সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য খুব একটা জুতসই হয়নি। তিনি আওয়ামী লীগকে নিয়ে যা বললেন, তাতে অনেকেই অবাক হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বলেছেন তিনি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর এই সন্দেহ কি ধোপে টেকে? যদি আওয়ামী লীগ নিয়ে তাঁর এই সন্দেহ থাকে, তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে তিনি কিছু বলছেন না কেন? আগস্ট অভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক বড় ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত যে আচরণ করেছিল, তাতে তাদের কি রাজনৈতিক দল বলার অবকাশ আছে? কার বিচার হবে? দলের বিচার, নাকি অপরাধীর বিচার? যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদেরই তো বিচার করতে হবে। অপরাধ তো করেছে নির্দিষ্ট মানুষ, সামগ্রিকভাবে দল নয়, তাহলে দলকে ধরে এই টানাহ্যাঁচড়া করা কেন? এই প্রশ্ন কিন্তু ধীরে ধীরে উঠছে। আর আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল, তখন সবাই কেন তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল, সে কথা কি ভুলে গেলে চলবে?
অনেকেই মনে করছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফর ছিল মূলত একটি নিরাপদ প্রস্থান বা সেফ এক্সিট নিশ্চিত করার জন্য তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করা। বাকি যে বিষয়গুলোর কথা বলা হচ্ছে, তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এটা মোটেই রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। তাই এত মানুষসহ লন্ডন যাওয়া নিয়েও সমালোচনা আছে। জুলকারনাইন সায়ের খরচের যে চিত্রটি তুলে ধরেছেন, তা নিয়েও সাধারণ মানুষ ভাবছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের এই বৈঠকের অন্য রকম গুরুত্ব আছে। নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মধ্যে যদি সফল আলোচনা হয়ে থাকে এবং ফেব্রুয়ারিতে যদি সত্যিই নির্বাচন হয়, তাহলে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক ভুল-ত্রুটির কথা ভুলে যাবেন। গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনার যে স্বপ্ন দেখেছে মানুষ, অন্তত তার প্রাথমিক সাফল্য আসবে। এরপর নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রমেই নিশ্চিত হবে, দেশ আসলে কোন পথে যাবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রশ্নগুলো উঠেছিল, তা থেকে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে কি না, কিংবা সেই সংস্কার করা যাবে কি না, তা নিয়ে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, তা মোটেই অমূলক নয়।
লন্ডনে ইউনূস-তারেকের বৈঠক নিয়ে ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির একজন নেতা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আগস্টের অঙ্গীকারের সঙ্গে তা যায় না, এমন কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘লন্ডনে বসে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মিটিং দেশবাসীর স্বার্থ ও গণ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা। শহীদদের রক্তকে অবমাননা করে বিদেশের মাটিতে মিটিং আয়োজন কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে দেশের জনগণের মাধ্যমে, বিদেশি আলোচনায় নয়।’
প্রশ্ন তোলা যায়, কীভাবে কারা কতটা অংশগ্রহণ করে এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল? যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিল, তাদের বড় একটি অংশকেই তো কক্ষচ্যুত করে ফেলা হয়েছে। তাহলে অঙ্গীকারটা পালন করবে কে? গুটিকয় মানুষ? ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে যে আন্দোলন হয়েছে, সে আন্দোলনের সুফল কি সবাই পাচ্ছে?
কোথায় বসে আলোচনা হলো, সেটা বড়, নাকি নির্বাচনের দিকে দেশ একটু এগিয়ে গেল, সেটা বড়—এই কথাটিও তো ভাবতে হবে।
সময়মতো নির্বাচন হলে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এমন অনেক ঘটনাই ঘটতে থাকবে, যা এখন কল্পনার মধ্যেও আসবে না। তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি সশরীরে দেশে এলে বিএনপির রাজনীতি অনেক শক্তিশালী হবে। চাঙা হয়ে উঠবে দলীয় কার্যক্রম। যে দলগুলো এখন অনেকটা সরকারি দলের মতো আচরণ করছে, তাদের অবস্থা তখন কী হবে, সেটা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না। অনেকেই গৃহযুদ্ধ বাধার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সে রকম ষড়যন্ত্র হলে তা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে তো সরকার? সেনাবাহিনীর আচরণ তখন কেমন হবে? সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান কি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করবেন?
এ রকম অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর খোঁজা দরকার। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে। এখন জনগণের নাম করে নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলে জনগণ তা মেনে নেবে না। জনগণের শক্তিকে অবজ্ঞা হলে তা যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে, তার প্রমাণ তো দেশে দেশে ঘটা গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লবগুলোই। তাই, নির্বাচনে জনগণকে টাকাপয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া যায়—এ রকম সরল সমীকরণ করলে তা ভুল হতে বাধ্য। জনগণকে টাকা দিয়ে কেনা গেলে রাতের অন্ধকারে কেউ ব্যালট বাক্স বোঝাই করত না।
জনগণ নির্বাচনে ঠিক রায়টাই দেয়। কিন্তু যাদের পক্ষে দেয়, তারা ভুলের পর ভুল করে দেশকে সার্কাসে পরিণত করে। সেই সার্কাস থেকে বের হওয়ার সময় এসেছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে ১৩ জুন স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আপাতত অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের আলোয় অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, দেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইবে। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেমন ছাড় দিয়েছেন, তেমনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও ছাড় দিয়েছেন। ডিসেম্বর নাকি এপ্রিলে নির্বাচন হবে, তা নিয়েই বেধেছিল বিতর্ক। ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি ছিল অনড়, এপ্রিলের ব্যাপারে ছিল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা। অবশেষে লন্ডন বৈঠকে একজন এপ্রিল থেকে নির্বাচনকে ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে এগিয়ে আনার কথা বলেছেন, অন্যজন ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। ফলে ফেব্রুয়ারিতেই আগামী নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
কিন্তু সত্যিই কি এতটা আশাবাদী হওয়া চলে?
কোনো সন্দেহ নেই, অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে সবকিছু লেজেগোবরে করে তুলেছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দল ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব-সন্ত্রাস, নতুন গজিয়ে ওঠা দলগুলোর টাকাপয়সা-সংক্রান্ত মুখরোচক গল্প বুঝিয়ে দেয়, নতুন বন্দোবস্তের যে আলামত দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক কিছু নয়। যাঁদের মুখে নতুন দিনের কথা শোনা যাচ্ছে, তাঁদের আচরণে মনে হয় না যে সেই নতুন দিনগুলো আলোকিত হবে। বরং এদেরই কারও কারও মুখে কোনো কোনো বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাকে হেয় করার আলামত দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা এমন কিছু সন্দেহের সৃষ্টি করে মনে, যা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও এই দেশটির ইতিহাস নিয়ে তাঁদের ধারণা কী—এ প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এই অবস্থায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল ম্যান্ডেটের ওপর নির্ভর করে সংস্কারসহ সরকারের করণীয় কাজগুলো গুছিয়ে নিতে পারবে। আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত দলই পারে অরাজকতার অবসানে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আবারও জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে, সত্যিই কি নির্বাচন হচ্ছে এই ফেব্রুয়ারিতে? এ রকম কোনো স্পষ্ট ঘোষণা কি দিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস?
বিষয়টি অস্পষ্ট, অথচ বিএনপি নাকি ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের স্পষ্ট বার্তা পেয়ে গেছে। তাহলে তো কথাই নেই। এবার মনোনয়নের জন্য দলের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যাবে। শুধু বিএনপি কেন, সব রাজনৈতিক দলই তাদের দলের শক্তিশালী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দেবে। শুরু হবে মিটিং-মিছিল, দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাওয়ার খেলা। চাঙা হয়ে উঠবে রাজনীতির ময়দান। এই দৃশ্যটি বাস্তবে দেখার আগপর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে, এ রকম বিশ্বাস করা কঠিন।
কেন কঠিন?
কারণ হলো, ইউনূস-তারেক আলোচনায় তিনটি ‘কিন্তু’ রয়েছে—বিচার, সংস্কার আর প্রস্তুতি। এই তিনটি ব্যাপারে অগ্রগতি হলেই কেবল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। যদি জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারে আশাপ্রদ অগ্রগতি না হয়? যদি সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অগ্রগতি মন্থর হয়? যদি নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রত্যাশামতো না হয়—তাহলে? এর যেকোনো একটি কারণকে সামনে রেখেই তো ঘোষণা করা হতে পারে—প্রত্যাশামতো অবস্থার উন্নতি হয়নি, সুতরাং পিছিয়ে যাবে নির্বাচন। জনমনে আরও কত প্রশ্নই তো ঘুরপাক খাচ্ছে। তারও কিছুটা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
কোনো সন্দেহ নেই, ইউনূস সরকারের প্রতি যে প্রত্যাশা নিয়ে সমর্থন দিয়েছিল জনগণ, সে প্রত্যাশা অনেকাংশেই সফলতার মুখ দেখেনি। অনেকেই এই সরকারের কার্যক্রমে বিরক্তও হয়েছেন। খোদ প্রধান উপদেষ্টার কথাবার্তায়ও কখনো কখনো নিরাশ হয়েছে জনগণ। উপদেষ্টারা কী কাজ করছেন, কতটা সাফল্যের সঙ্গে তাঁরা তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন, তা নিয়েও রয়েছে অনেক সমালোচনা। ছাত্র উপদেষ্টাদের ব্যাপারেও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তৌহিদি জনতা নামে একশ্রেণির লোক ধর্মকে পুঁজি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তার বিরুদ্ধেও স্পষ্ট কোনো বার্তা দেয়নি এই সরকার। ফলে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রত্যাশা খুব দ্রুত হতাশায় পরিণত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে সংকট বাড়বে।
প্রশ্ন আরও আছে। সব দলের অংশগ্রহণেই কি নির্বাচন হবে? আওয়ামী লীগ কি সেই দলগুলোর মধ্যে পড়বে? চ্যাথাম হাউসের সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য খুব একটা জুতসই হয়নি। তিনি আওয়ামী লীগকে নিয়ে যা বললেন, তাতে অনেকেই অবাক হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বলেছেন তিনি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর এই সন্দেহ কি ধোপে টেকে? যদি আওয়ামী লীগ নিয়ে তাঁর এই সন্দেহ থাকে, তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে তিনি কিছু বলছেন না কেন? আগস্ট অভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক বড় ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত যে আচরণ করেছিল, তাতে তাদের কি রাজনৈতিক দল বলার অবকাশ আছে? কার বিচার হবে? দলের বিচার, নাকি অপরাধীর বিচার? যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদেরই তো বিচার করতে হবে। অপরাধ তো করেছে নির্দিষ্ট মানুষ, সামগ্রিকভাবে দল নয়, তাহলে দলকে ধরে এই টানাহ্যাঁচড়া করা কেন? এই প্রশ্ন কিন্তু ধীরে ধীরে উঠছে। আর আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল, তখন সবাই কেন তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল, সে কথা কি ভুলে গেলে চলবে?
অনেকেই মনে করছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফর ছিল মূলত একটি নিরাপদ প্রস্থান বা সেফ এক্সিট নিশ্চিত করার জন্য তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করা। বাকি যে বিষয়গুলোর কথা বলা হচ্ছে, তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এটা মোটেই রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। তাই এত মানুষসহ লন্ডন যাওয়া নিয়েও সমালোচনা আছে। জুলকারনাইন সায়ের খরচের যে চিত্রটি তুলে ধরেছেন, তা নিয়েও সাধারণ মানুষ ভাবছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের এই বৈঠকের অন্য রকম গুরুত্ব আছে। নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মধ্যে যদি সফল আলোচনা হয়ে থাকে এবং ফেব্রুয়ারিতে যদি সত্যিই নির্বাচন হয়, তাহলে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক ভুল-ত্রুটির কথা ভুলে যাবেন। গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনার যে স্বপ্ন দেখেছে মানুষ, অন্তত তার প্রাথমিক সাফল্য আসবে। এরপর নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রমেই নিশ্চিত হবে, দেশ আসলে কোন পথে যাবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রশ্নগুলো উঠেছিল, তা থেকে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে কি না, কিংবা সেই সংস্কার করা যাবে কি না, তা নিয়ে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, তা মোটেই অমূলক নয়।
লন্ডনে ইউনূস-তারেকের বৈঠক নিয়ে ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির একজন নেতা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আগস্টের অঙ্গীকারের সঙ্গে তা যায় না, এমন কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘লন্ডনে বসে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মিটিং দেশবাসীর স্বার্থ ও গণ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা। শহীদদের রক্তকে অবমাননা করে বিদেশের মাটিতে মিটিং আয়োজন কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে দেশের জনগণের মাধ্যমে, বিদেশি আলোচনায় নয়।’
প্রশ্ন তোলা যায়, কীভাবে কারা কতটা অংশগ্রহণ করে এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল? যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিল, তাদের বড় একটি অংশকেই তো কক্ষচ্যুত করে ফেলা হয়েছে। তাহলে অঙ্গীকারটা পালন করবে কে? গুটিকয় মানুষ? ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে যে আন্দোলন হয়েছে, সে আন্দোলনের সুফল কি সবাই পাচ্ছে?
কোথায় বসে আলোচনা হলো, সেটা বড়, নাকি নির্বাচনের দিকে দেশ একটু এগিয়ে গেল, সেটা বড়—এই কথাটিও তো ভাবতে হবে।
সময়মতো নির্বাচন হলে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এমন অনেক ঘটনাই ঘটতে থাকবে, যা এখন কল্পনার মধ্যেও আসবে না। তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি সশরীরে দেশে এলে বিএনপির রাজনীতি অনেক শক্তিশালী হবে। চাঙা হয়ে উঠবে দলীয় কার্যক্রম। যে দলগুলো এখন অনেকটা সরকারি দলের মতো আচরণ করছে, তাদের অবস্থা তখন কী হবে, সেটা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না। অনেকেই গৃহযুদ্ধ বাধার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সে রকম ষড়যন্ত্র হলে তা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে তো সরকার? সেনাবাহিনীর আচরণ তখন কেমন হবে? সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান কি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করবেন?
এ রকম অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর খোঁজা দরকার। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে। এখন জনগণের নাম করে নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলে জনগণ তা মেনে নেবে না। জনগণের শক্তিকে অবজ্ঞা হলে তা যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে, তার প্রমাণ তো দেশে দেশে ঘটা গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লবগুলোই। তাই, নির্বাচনে জনগণকে টাকাপয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া যায়—এ রকম সরল সমীকরণ করলে তা ভুল হতে বাধ্য। জনগণকে টাকা দিয়ে কেনা গেলে রাতের অন্ধকারে কেউ ব্যালট বাক্স বোঝাই করত না।
জনগণ নির্বাচনে ঠিক রায়টাই দেয়। কিন্তু যাদের পক্ষে দেয়, তারা ভুলের পর ভুল করে দেশকে সার্কাসে পরিণত করে। সেই সার্কাস থেকে বের হওয়ার সময় এসেছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ডা. মারুফুর রহমান ২০১২ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজিতে ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১২ ঘণ্টা আগেইতিহাসবিদেরা হয়তো ২০২৫ সালের ১৩ জুন তারিখটিকে এমন একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত করবেন, যেদিন বিশ্ব এমন এক সীমা অতিক্রম করল, যেখান থেকে ফিরে আসা সহজ না-ও হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্তব্ধ করে দিয়ে এবং বৈশ্বিক বাজারে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ইসরায়েল ১৩ জুন ভোরে ইরানের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক...
১৩ ঘণ্টা আগেজাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পৃথিবীব্যাপী ১৫ জুনকে প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ বছরের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আলোচনার বিস্তার ঘটানো, লক্ষণ চিনুন এবং ঝুঁকি কমান।’
১৩ ঘণ্টা আগেবরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ ক্রমেই গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৩ জুন আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এক দিনেই তিনজনসহ মোট ১০ জনের মৃত্যু এবং হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ৬০০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগে