Ajker Patrika

ফেসবুক বনাম মূলধারার গণমাধ্যম

আহমেদ শমসের
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

একসময় যাকে কেবল বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভাবা হতো, সেই ফেসবুক এখন আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হয়ে উঠেছে। বিশেষত, সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে ফেসবুকের ভূমিকা দিন দিন শুধু শক্তিশালীই হচ্ছে না, বরং প্রশ্ন উঠছে, মূলধারার গণমাধ্যম কি ক্রমেই ফেসবুকনির্ভর হয়ে পড়ছে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ, দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্টফোনের ব্যবহার ব্যাপক হারে বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি এবং এর একটি বিশাল অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে।

অনেকে ফেসবুককে ইন্টারনেটের প্রতিশব্দ হিসেবেই চেনে।

এর ফলেই একটি দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে যেখানে ফেসবুক হয়ে উঠেছে সংবাদ জানার প্রধান মাধ্যম। মূলধারার সংবাদপত্রগুলো তাদের খবর পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে ফেসবুককে প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে। পাঠকের এক ক্লিকেই নিউজ পোর্টালের ভেতরে প্রবেশ—এটা এখন দৈনন্দিন বাস্তবতা।

তবে এখানেই প্রশ্ন: ফেসবুক কি কেবল বাহন, নাকি সে-ই হয়ে উঠছে নিয়ন্তা?

বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশে যেমন, বাংলাদেশেও মুদ্রিত সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। পাঠক এখন খবর পড়েন স্মার্টফোনে, ভিডিও দেখেন ইউটিউবে, ব্রেকিং নিউজ পান ফেসবুকের ফিডে। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও টিকে থাকাকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করতে ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

এমনকি এখন অনেক গণমাধ্যম সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘ফেসবুক ফ্রেন্ডলি হেডলাইন’ তৈরি করছে। শিরোনামে চমক, সংক্ষিপ্ত বিবরণ, দ্রুতগতির আপডেট—এসবই যেন পাঠকের ‘স্ক্রল থামিয়ে’ ক্লিক করানোর কৌশল। ফেসবুক এলগরিদম বোঝার মাধ্যমে নিউজ কনটেন্ট সাজানো হচ্ছে।

সাংবাদিকতা মানে শুধু খবর পরিবেশন নয়, বরং তা তথ্য যাচাই, নিরপেক্ষতা, দায়িত্ববোধ এবং জনস্বার্থ রক্ষা করার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ফেসবুক এ জায়গায় সুবিধা যেমন দিয়েছে, তেমনি উদ্বেগও বাড়িয়েছে। সিটিজেন জার্নালিজমের প্রবাহে অনেক সময় ঘটনাস্থল থেকে মুহূর্তেই খবর উঠে আসে, কিন্তু সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ ও দায়বদ্ধতা থাকে না। ফলে ভুয়া খবর, গুজব, বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি গণমাধ্যমে বিবৃতি না দিয়ে সরাসরি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। সেসব স্ট্যাটাস

আবার মূলধারার সংবাদপত্রে খবর হয়ে যায়। এই ‘স্ট্যাটাস-নির্ভরতা’ একদিকে খবরের গতিকে বাড়ালেও, অন্যদিকে সংবাদ বাছাই, সম্পাদনা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাইয়ের মতো প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়। গণমাধ্যম তখন আর তথ্যের উৎস নয়, বরং ফেসবুকের তথ্যের পরিবেশক হয়ে ওঠে।

বর্তমান বাস্তবতায় বলা যায়, ফেসবুক ও গণমাধ্যমের মধ্যে একটি দ্বিমুখী নির্ভরতা গড়ে উঠেছে। ফেসবুক পাঠক বা দর্শককে নিজের প্ল্যাটফর্মে ধরে রাখতে চায়, আর সংবাদমাধ্যম পাঠক বা ভিউয়ার পেতে চায় ফেসবুকের মাধ্যমে। এই দ্বিমুখী সম্পর্ক যতটা পারস্পরিক সহযোগিতামূলক, ততটাই নিয়ন্ত্রণমূলকও।

ফেসবুকের এলগরিদম যদি কোনো খবর কম দেখায়, সেটি পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। যদি কোনো নিউজ লিংক ‘কমপ্লায়েন্স’ ভঙ্গ করে—অর্থাৎ কোনো ফেসবুক নীতিমালা লঙ্ঘন করে, তবে তা অবলীলায় সরিয়ে ফেলা হয়, এমনকি গণমাধ্যমের পেজও সাময়িকভাবে ব্লক হয়ে যেতে পারে। ফলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও প্রকাশের অধিকার প্রযুক্তি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ছে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য শঙ্কার বিষয়।

ফেসবুক যে তথ্যপ্রবাহের গতিকে দ্রুততর করেছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর সঙ্গে সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং পেশাদার নীতিমালার যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

গণমাধ্যমের উচিত প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, তবে তা যেন সাংবাদিকতার মেরুদণ্ড না ভেঙে দেয়। ফেসবুক একটি মাধ্যম, সংবাদ নয়। তাই ফেসবুক-নির্ভর না হয়ে, সংবাদ ও বিশ্লেষণের গুণগত মানকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

ফেসবুককে ব্যবহার করতে হবে সংবাদ পরিবেশনের জন্য নয়, বরং সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার একটি টুল হিসেবে। অন্যথায়, দিন শেষে ফেসবুকই হয়ে উঠবে আমাদের সংবাদ-চিন্তা, তথ্য-অনুসন্ধান এবং মতপ্রকাশের একচ্ছত্র নিয়ন্তা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মবের নামে নাশকতার সুযোগ নেই এখন, সারজিসকে বললেন সেনা কর্মকর্তা

আজহারুলের আপিলে তাজুলের প্রসিকিউশন টিম, স্বার্থের সংঘাত দেখছেন ডেভিড বার্গম্যানও

জি এম কাদেরের বাসভবনে হামলা: উত্তপ্ত রংপুর, সেনা জিজ্ঞাসাবাদে নেতারা

কক্সবাজারে ‘মিলিটারি অপারেশনস জোন’ নিয়ে নর্থইস্ট নিউজের সংবাদের প্রতিবাদ জানাল সেনাবাহিনী

২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোট বাজারে, পাবেন যেসব ব্যাংকে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত