Ajker Patrika

খালেদা জিয়ার বিদেশ গমন, দেশের রাজনীতির নতুন বিন্যাস

আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮: ৩৫
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জাতীয় স্বার্থ, মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং শাসনকাঠামোর পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি আগামী দিনে ঠিক কোন অবয়ব লাভ করবে, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনীতিতে যে রূপ বদলের আঁচ লেগেছে, তা বলা যেতেই পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একদিকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতা চলছে, অন্যদিকে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে এবং নতুন প্রেক্ষাপটে নিজেদের অভিযোজনের চেষ্টাও লক্ষণীয়। এই পরিবর্তনের ধারায় মুক্তিযুদ্ধ ও বাহাত্তরের সংবিধান প্রশ্নে বিএনপির প্রকাশ্য অবস্থান এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতভিন্নতা রাজনীতিতে নতুন মাত্রা সংযোজনের ইঙ্গিতবাহী। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়াও মোটেই তাৎপর্যহীন নয়।

গত ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে সমাবেশ ডেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে’ বলে হুংকার দিয়েও শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে পারেনি। ৩১ ডিসেম্বর তাদের পূর্বঘোষিত এবং বহুল আলোচিত ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ জারি করা হয়নি। বরং তারা কর্মসূচি পরিবর্তন করে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ পালন করেছে। ফলে সংবিধান বাতিল কিংবা বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা আসতে পারে বলে যে গুঞ্জন ছিল, তা সত্য হয়নি। যে কারণে বাহাত্তরের ‘সংবিধানের কবর’ও রচিত হয়নি! তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাময়িকভাবে পিছু হটলেও তারা আসলে কোথায় গিয়ে তাদের ‘আন্দোলন’ শেষ করবে, তা নিশ্চিত করে কে বলতে পারবে? রাজনীতিতে শেষ কথা নেই বলে যে প্রচারণা আছে, আপাতত তাতে আস্থা রাখা ছাড়া আর কী বিকল্প আছে?

১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য সুবিধাজনক বলে মনে করা হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ঐক্যে ফাটল ধরেছে। সরকারের রিসেট বাটন টেপার পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রশ্নে বিএনপি নতুন প্রজন্মকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। বিএনপির অনেক নেতাই এখন একাত্তরের পক্ষে কথা বলছেন।

বহু বছর ধরে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়কে নিজেদের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধকে তার দলীয় পরিচয়ের কেন্দ্রে রেখেছিল এবং বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিককালে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন এবং বাহাত্তরের সংবিধানের পক্ষে কথা বলছে।

বাহাত্তরের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যা একসময় বিএনপির মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলার একক অধিকার আওয়ামী লীগ নিয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ মাঠছাড়া। কিন্তু একাত্তর তো বাঙালির সবচেয়ে বড় গৌরবের ঠিকানা। বিএনপির নেতৃত্ব এখন সম্ভবত একাত্তরের সঙ্গে অধিক মাত্রায় সংলগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সুবিধা ঝুলিতে ভরার চেষ্টা করছেন।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে একটি ছাত্র-গণজাগরণ তথা অভ্যুত্থানের কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। সরকার পরিবর্তনের ওই মুহূর্তে একদিকে বিএনপির কাছে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতাও প্রবল হয়ে ওঠে।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে যে দুর্নীতি, দমননীতি ও স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ উঠেছিল, তা থেকে শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ জনগণ বিকল্প রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সন্ধানে রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক শক্তির অভাব দেখা দিচ্ছে, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। বিএনপিকে এই শূন্যতা পূরণের জন্য তাদের মতাদর্শ এবং সাংগঠনিক শক্তিকে পুনর্গঠিত করতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতি সব সময় একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। তবে গত কয়েক দশকে ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই সহিংসতা ও ব্যক্তিস্বার্থের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে শিক্ষার্থীরা একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রজন্মের ছাত্রনেতারা পুরোনো রাজনৈতিক দলের অনুশাসন এবং বিতর্কিত ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে তাদের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে কতটা আগ্রহী, সেটা অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়।

এটি বিশেষত বিএনপির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে ছাত্ররাজনীতি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল। ছাত্রদের নতুন উদ্যোগ বিএনপির জন্য বাড়তি চাপ হিসেবে এসেছে। সে জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নতুন দিকনির্দেশনা দরকার। ক্ষমতার পালাবদল, ছাত্ররাজনীতির পুনর্গঠন এবং জামায়াতের মতো বিতর্কিত দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির সামনে সুযোগ এসেছে নিজেদের মতাদর্শ পুনর্গঠন করার।

তবে এই সম্ভাবনার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে সর্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্রের জন্য সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ও চাহিদার সঙ্গে নিজেদের একীভূত করা।

এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরোনো মতপার্থক্যের পরিবর্তে এখন দরকার একটি নতুন ঐক্য ও মানসিকতার পরিবর্তন। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি, ছাত্রদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং জামায়াতের সঙ্গে বিভেদ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। একটি নির্মোহ এবং ইতিবাচক রাজনীতি গড়ে উঠলে তা কেবল বিএনপির জন্য নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

দুই.

দেশের রাজনীতি যখন কিছুটা ভারসাম্যহীন, ঠিক তখন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনযাত্রা শুধু একটি মানবিক কিংবা চিকিৎসাবিষয়ক ঘটনা নয়; এটি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকেও নতুন এক মোড় এনে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যসংকট বরাবরই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল। তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন, ছাত্র-জনতার গণজাগরণ এবং ক্ষমতা বদলের পর তাঁর বিদেশযাত্রা একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। তাঁর সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের আকস্মিক সৌজন্য সাক্ষাৎ পুরো বিষয়টিকে তাৎপর্যময় করে তুলেছে।

২০১৮ সালে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা কখনোই থেমে থাকেনি। তাঁর মুক্তি কিংবা বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে পরিবারের পাশাপাশি দলও বারবার সোচ্চার হয়েছে। তবে তৎকালীন সরকার এ দাবিতে সাড়া না দিয়ে প্রমাণ করেছে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মানবিকতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে মানবিক ইস্যুকে রাজনৈতিক অন্তরায় হিসেবে ব্যবহার না করে সমাধানের চেষ্টা দেখা যায়।

খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার প্রাক্কালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাক্ষাৎকে অনেকেই সৌজন্য সাক্ষাৎ হিসেবে দেখলেও, এটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি কৌশলগত বার্তা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সেনাবাহিনী কর্তৃক জনগণের দাবির প্রতি সংবেদনশীল হয়ে ওঠা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। বিএনপি বা তার সমর্থকেরা এটিকে তাদের প্রতি সেনাবাহিনীর আন্তরিকতা হিসেবে দেখতেই পারেন। এই সাক্ষাৎ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আস্থা তৈরির একটি পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর পুনর্মিলন। তারেক রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার এই সাক্ষাৎ শুধু একটি মা-ছেলের আবেগঘন মুহূর্ত হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিএনপির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে কৌশলগত আলোচনার ক্ষেত্রও হতে পারে। যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী তারেক রহমান প্রায় এক যুগ ধরে দল পরিচালনা করলেও দলটির বেশির ভাগ নেতা ও সমর্থকের কাছেই তাঁকে দূরবর্তী বলে মনে হয়। খালেদা জিয়ার সক্রিয় নির্দেশনা এবং নতুন দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা এবং দলীয় কাঠামো পুনর্গঠনের বিষয়ে নতুন পরিকল্পনা করা হতে পারে।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো একটি আন্তর্জাতিক সমীকরণেরও ইঙ্গিত। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে কাতারের এই পদক্ষেপ শুধু মানবিকতার চেয়ে বেশি কিছু। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ এবং সম্পর্ক উন্নয়নের এক কৌশল হিসেবেও দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার পাশাপাশি জনস হপকিন্স হসপিটালে সম্ভাব্য চিকিৎসার পরিকল্পনা বিশ্ব মঞ্চে খালেদা জিয়া এবং বিএনপির গুরুত্বকে তুলে ধরছে।

বিদেশে উন্নত চিকিৎসা শেষে বিএনপির চেয়ারপারসনের পবিত্র ওমরাহ পালন এবং সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা একদিকে তাঁর পুনরুত্থানের বার্তা দেয়, অন্যদিকে গণতন্ত্রের প্রতি দলের দায়বদ্ধতাও দৃশ্যমান করে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন গতিশীলতা আসতে পারে। আর বিএনপির নেতা-কর্মীরা আশাবাদী যে খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তন দলের ঐক্য আরও দৃঢ় করবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁকে পুনরায় শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে।

তবে খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিপরীতমুখী আলোচনাও আছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রায় বিলম্ব এবং তারেক রহমানের দেশে না ফেরা নিয়েও নানা ধরনের গুঞ্জন আছে। বিশ্লেষকদের কেউ মনে করছেন, চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার নিশ্চয়তা তিনি সেনাপ্রধানের কাছ থেকে পেয়েছেন। আবার চিকিৎসা শেষে তাঁর দেশে ফেরার অনিশ্চয়তাও কেউ কেউ দেখছেন। কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনিশ্চয়তা দূর হয়নি। এ নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো দেওয়া হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার বিকল্প নেই

রাজিউল হাসান
বাংলাদেশের প্রথম কার্বন নিরপেক্ষ শিশুর স্বীকৃতি পেয়েছে আয়ান। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রথম কার্বন নিরপেক্ষ শিশুর স্বীকৃতি পেয়েছে আয়ান। ছবি: সংগৃহীত

একটি দুঃসংবাদ আর একটি আশাপ্রদ খবর দিয়ে শুরু করছি। প্রথম দুঃসংবাদ হলো, আইসল্যান্ডে মশা পৌঁছে গেছে। দ্বিতীয় সংবাদ, অস্ট্রেলিয়ায় চিরহরিৎ বনাঞ্চল কার্বন শোষণের চেয়ে নিঃসরণ করছে বেশি। দুটি তথ্যই জানিয়েছেন গবেষকেরা। আপাতদৃশ্যে খুব সাধারণ মনে হলেও, দুটি খবরই ভয়ংকর এক পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছে। তা হলো, উষ্ণ হয়ে উঠছে বিশ্ব।

আশাপ্রদ খবরটি হলো, গত ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম কার্বন নিরপেক্ষ শিশু। তার নাম আয়ান খান রুহাব। তার বাবা-মা ৫৮০টি গাছ লাগিয়েছেন। শিশু আয়ান তার জীবদ্দশায় যত কার্বন নিঃসরণ করবে, এই গাছগুলো তা শোষণ করে নেবে। আয়ান যদি দেশের প্রথম কার্বন নিরপেক্ষ শিশু হয়, তাহলে বিশ্বের প্রথম কার্বন নিরপেক্ষ শিশু কে? সে ভারতের তামিলনাড়ুর আদাভি। ২ বছর বয়সী এই শিশু জন্মানোর আগেই তার বাবা-মা প্রায় ৬ হাজার গাছ লাগিয়েছেন। এই দুটি উদ্যোগ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের জন্য বড় আশার খবর।

কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার প্রচেষ্টার আগে দুঃসংবাদ দুটি নিয়ে আগে কিছু কথা বলি। বিশ্বে এত দিন দুটি জায়গা মশামুক্ত ছিল। এর একটি অ্যান্টার্কটিকা, অপরটি আইসল্যান্ড। এখন রইল বাকি অ্যান্টার্কটিকা। সে হিসেবে বলাই যায়, বিশ্ব এখন মশার কবজায়। মশার কামড় থেকে মানুষ বেশ কয়েক ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া অন্যতম। এ ছাড়া জিকা, ফাইলেরিয়া ও ওয়েস্ট নাইল রোগের ভাইরাসও ছড়ায় মশার মাধ্যমে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ (সিডিসি) সংস্থার হালনাগাদ তথ্যমতে, মশা হলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে শুধু ম্যালেরিয়ায় প্রায় ৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বের প্রায় ৩২০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশি। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ ৪০০ কোটির মতো মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বেশি। ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের প্রকোপ বেশি যুক্তরাষ্ট্রে। জিকার প্রকোপ বেশি আফ্রিকা, আমেরিকা, প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে। ফাইলেরিয়ার ঝুঁকিতে আছে বিশ্বের ৪৪টি দেশের অন্তত ৫ কোটি মানুষ।

গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বই উষ্ণ হচ্ছে। ফলে মশার জন্য পরিবেশ আরও আদর্শ হয়ে উঠছে। উষ্ণ ও আর্দ্র এলাকায় মশার উৎপাত সবচেয়ে বেশি। নতুন গবেষণাগুলো বলছে, আর্কটিক অঞ্চল বাকি বিশ্বের তুলনায় চার গুণ বেশি উষ্ণ হচ্ছে। চলতি বছর আইসল্যান্ড সবচেয়ে বেশি গরমে পুড়েছে। বর্তমানে দেশটিতে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আর শীতে সে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যায়। মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নামে তাপমাত্রা। উষ্ণায়নের কারণে এখন দেশটির এই অবস্থা। আগে দেশটি আরও শীতল ছিল।

গবেষকদের তথ্য মতে, আইসল্যান্ডে হিমবাহ গলে যাওয়া, ভেঙে যাওয়ার ঘটনা বেশ আগেই শুরু হয়েছে। সম্প্রতি দেশটিতে উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের মাছ ম্যাকেরেল পাওয়া গেছে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।

এবার আসা যাক অস্ট্রেলিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চলের বিষয়টিতে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ২০টি চিরহরিৎ বনের ওপর গবেষণা করে একটি গবেষণানিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এতে তাঁরা দাবি করেছেন, চিরহরিৎ এই বনগুলো এখন আর আগের মতো কার্বন শোষণ করছে না। বরং তারা কার্বন শোষণের চেয়ে নিঃসরণ করছে বেশি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই বনগুলোয় দাবানলসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা কারণে নতুন গাছ জন্মানো কমে গেছে। তার চেয়ে গাছ মরছে বেশি। গাছের মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় সেসব গাছের দেহাবশেষ থেকে কার্বন নিঃসরণও বেড়ে গেছে। অপর দিকে নতুন গাছের জন্ম কমে যাওয়ায় কার্বন শোষণ কমে গেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের বনাঞ্চলের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের সব চিরহরিৎ বনেই হয়তো এখন এই পরিস্থিতি চলছে। কারণ, চিরহরিৎ বনগুলোর প্রকৃতি একই রকম হয়।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমরা মানুষেরা কী করছি? একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন, প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষই নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রকৃতির বিনাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। অনেকটা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো। আমরা সবাই জানি, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, পরিবেশ ও বায়ুদূষণসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তারপরও এগুলোর নেশা আমরা ছাড়তে পারি না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাঁর প্রথম মেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাঁর দেশের সরকারের নানা উদ্যোগ হয় বন্ধ করেছেন, না হয় কাটছাঁট করেছেন। তিনি গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর অভিষেক ভাষণেই খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে তেল-গ্যাস আহরণে উৎসাহ দিয়েছেন।

প্রায় একই ধরনের কাজ করে গেছেন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন বনাঞ্চল তাঁর দেশেই। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে আমাজন ধ্বংস করে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছিলেন অনেকগুলো। একইভাবে বিশ্বের নানা দেশে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, না হয় সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে জীবাশ্ম জ্বালানির আহরণ। অথচ উষ্ণায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে এই জীবাশ্ম জ্বালানিই। বিজ্ঞানীরা আমাদের সামনে নানা বিকল্প হাজিরও করেছেন। যেমন সৌরশক্তি, বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু সেসবে আমাদের আগ্রহ নেই। বরং মাটি খুঁড়ে পৃথিবীর বুক আর কতটা ছিন্নভিন্ন করা যায়, তার প্রচেষ্টা যেন আরও গতি পেয়েছে।

অথচ প্রতিবছরই জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ) বিভিন্ন রাষ্ট্র নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন রুখে দিতে অনেক ভালো ভালো কথা বলেন নেতারা। তহবিল সংগ্রহে জোর তাগিদ দেয় জাতিসংঘ। কিন্তু গুটিকয়েক দেশ বাদে বাকি দেশগুলোয় আজ পর্যন্ত সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাটা পর্যন্ত দেখা যায়নি। জাতিসংঘের তহবিলে যে যৎসামান্য অর্থের জোগান আসে, তার প্রয়োগও দেখা যায় না। জাতিসংঘ অবশ্য বেশ আগেই ‘খোঁড়া হাতিতে’ পরিণত হয়েছে। তা না হলে তার সামনেই কীভাবে বিশ্বে এত অস্থিরতা চলতে পারে, নতুন করে যুদ্ধে জড়াতে পারে দেশগুলো, গাজায় কীভাবে গণহত্যা চলতে পারে?

কাজেই এ কথা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়, নেতা, রাষ্ট্র আর বিশ্ব সংস্থার দিকে তাকিয়ে থাকলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা কোনো দিনই সম্ভব হবে না। আসন্ন এই বিপদকে রুখতে হলে বিশ্বের প্রতিটা মানুষকেই উদ্যোগী হতে হবে। আর আমরা সবাই জানি, একমাত্র গাছই হলো ‘উষ্ণায়ন নামক রোগটির’ মহৌষধ। সেই মহৌষধ আমাদের সাধ্যের মধ্যেই আছে। আমরা প্রত্যেকেই কার্বন নিরপেক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করি, তাহলে এই বিশ্বটা গাছে ভরে উঠতে খুব বেশি দিন লাগবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গাজার ছাই থেকে ফিলিস্তিনের পুনর্জন্ম

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
গাজার ছাই থেকে ফিলিস্তিনের পুনর্জন্ম

হাজার বছরের অপমান, বঞ্চনা আর বন্দিত্বের নাগপাশ পেরিয়ে ফিলিস্তিন আবার নবজন্ম নিচ্ছে, যেখানে প্রতিটি শিশুর কান্না ইতিহাসে প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠছে।

দীর্ঘ দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে এক বিভ্রম ছড়ানো হয়েছিল—‘শুধু আলোচনাই শান্তি আনতে পারে।’ সেই বাক্যটি ছিল সভ্যতার মুখে পরানো এক মুখোশ, যার আড়ালে জমে উঠেছিল নীরব হত্যার ইতিহাস। অসলো চুক্তি ছিল সেই মুখোশের শীর্ষ অলংকার—যেখানে কূটনৈতিক কলমের আড়ালে চাপা পড়েছিল রক্ত, অবরোধ আর পরাধীনতার ক্রন্দন। বিশ্বের চোখে সেটি ছিল শান্তির মাইলফলক; কিন্তু গাজার শিশুর চোখে, হেবরনের মাতৃহারা নারীর কণ্ঠে আর পশ্চিম তীরের বালুময় মাটিতে সেটি কেবল এক নিঃশব্দ প্রতারণা। এই শান্তির মুখোশের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা—দখলদারি, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দীর্ঘ ছায়া।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিধানে ‘শান্তি’ মানে ছিল আনুগত্য—এমন এক নতজানু নেতৃত্ব, যারা স্বাধীনতার দাবিকে গিলে ফেলে ‘সংলাপ’-এর নামে আত্মসমর্পণ করবে। সেই ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ হয়ে উঠেছিল দখলের এক নতুন রূপ—এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রহসন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শান্তি শিল্প’। ফিলিস্তিনকে নিয়ে নানা সময়ে নানা সংলাপ হয়েছে, কনফারেন্সে বাজানো হয়েছে করতালি, কিন্তু বাস্তবে গড়ে উঠেছে আরও উঁচু প্রাচীর। ইয়াসির আরাফাত, যিনি একদা মুক্তির প্রতীক ছিলেন, সেই প্রহসনের বৃত্তে প্রবেশ করেছিলেন আশায় যে আলোচনার টেবিলে হয়তো রক্তের ইতিহাসের অবসান ঘটবে। কিন্তু নির্মম সত্য হলো—তিনি যত ছাড় দিয়েছেন, তত বেড়েছে বন্দিত্বের পরিধি। তাঁর জনগণ পেয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, চেকপোস্টের দীর্ঘ সারি আর ছিন্নভিন্ন মানচিত্র। অসলো চুক্তি তাই হয়ে উঠেছিল প্রতারণার দলিল। এখন সময় এসেছে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার: আলোচনার নয়, আত্মত্যাগের আগুনেই জেগে উঠতে হবে ফিলিস্তিনবাসীকে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই।

১৯৫০-এর দশকে যখন আরব জাতিরা পরাজয়ের ভারে নুয়ে পড়েছিল, তখন এই সংকীর্ণ উপত্যকার বালুময় প্রান্তরে জন্ম নেয় ফেদায়িন আন্দোলন—মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গে প্রস্তুত এক প্রজন্ম। সমাজতান্ত্রিক স্লোগান, ইসলামি বিশ্বাস আর মুক্তিকামী রক্ত মিলেমিশে গড়ে তোলে এক আগুনে জনপদ—গাজা। যেখানে পশ্চিম তীরের শহরগুলো দমনযন্ত্র ও প্রশাসনিক বেষ্টনীর নিচে নিস্তব্ধ, সেখানে গাজা ছিল অগ্নিদীপ্ত দুর্গের মতো—এক ক্ষুদ্র স্পার্টা, যে জানে, পরাজয় মানে দাসত্ব, আর প্রতিরোধ মানে জীবন।

২০০৬ সালে হামাসের নির্বাচনী বিজয়ের পর শুরু হয় আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম অবরোধ—একটি নগরীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় পৃথিবী থেকে, যেন তাকে নিঃশেষ করা যায় ক্ষুধা, অন্ধকার ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু গাজার মানুষ আত্মসমর্পণ করেনি। ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরের ইট দিয়ে তারা আবার ঘর তুলেছে; ভাঙা স্কুলের দেয়ালে লিখেছে বর্ণমালা; শত্রুর ফেলে যাওয়া গোলা দিয়ে বানিয়েছে নিজের অস্ত্র। এই প্রতিরোধ কোনো দলের নয়—এটি এক জাতির হৃদ্‌স্পন্দন, যা রক্তে, মাটিতে, শিশুর আঁকায় আর মায়ের অশ্রুতে মিশে আছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে আজ অবধি চলছে গাজার ওপর বোমা নিক্ষেপ। কিছু দিন আগেও যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেটা আসলে ছিল একটা প্রতারণার ফাঁদ। অবশ্য কিছু দিন বোমা নিক্ষেপ বন্ধ থাকলেও, আবারও শুরু হয়েছে আগের মতো পরিস্থিতি।

তবুও গাজার মানুষ নত হচ্ছে না। মৃত্যুর ছায়াতেও তারা খুঁজে নিয়েছে জীবনের আলো। যে শহরে আকাশ মানে এখন ড্রোনের গুঞ্জন, সেখানেও মায়েরা শিশুর কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘আমরা মরে যাব, কিন্তু হার মানব না।’ এই বাক্য কোনো সামরিক কৌশল নয়—এটি এক আত্মিক প্রতিজ্ঞা, এক জাতির পুনর্জন্মের ঘোষণা। ‘যে জাতি মৃত্যুকেও অবরোধ করতে শেখে, তাকে পৃথিবীর কোনো শক্তি দমন করতে পারে না।’

ইতিহাসে কিছু যুদ্ধ শুধু ধ্বংস নয়—তারা হয়ে ওঠে এক জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্লিখন। গাজার যুদ্ধ তেমনই এক অধ্যায়। ইসরায়েল এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বর্ষণ করেছে দুই লাখ টনেরও বেশি বিস্ফোরক—ধ্বংস করেছে শহর, হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির। কিন্তু বিজয়ের মুকুট আজ তাদের মাথায় নয়। গাজার ধূলি আর ধোঁয়ার মধ্যেই ফিলিস্তিনের পতাকাই উড়ছে—অমর প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে। দুই হাজারেরও বেশি সামরিক যান ভস্মীভূত, শত শত ‘মেরকাভা’ ট্যাংক ইতিহাসের জঞ্জালে। যা করতে পারেনি কোনো আরব সেনাবাহিনী, তা করেছে অবরুদ্ধ গাজার মানুষ—নিজেদের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে।

আজ গাজার মাটি পুরো আরব জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। ইসরায়েলের নিজস্ব ইতিহাসবিদ ও সেনা কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন—গাজায় তাঁরা কেবল ব্যর্থ নয়, পরাজিত। গাজার মানুষ পুনরুদ্ধার করেছে তিনটি সত্য—আত্মসম্মান, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতিসত্তা। এই প্রতিরোধ কোনো দলের নয়, কোনো মতবাদের নয়—এটি ফিলিস্তিন নামক আত্মার জয়গান, যা রক্তে লেখা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান। গাজার ধ্বংসস্তূপ তাই শুধু যুদ্ধের সাক্ষী নয়; এটি নবজাগরণের প্রতীক—এক জাতির পুনর্জন্ম, যে জাতি জানে, ইতিহাসের শেষ কথা বলে তারাই, যারা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে।

ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্ম বুঝে গেছে, স্বাধীনতা চাওয়া যায় না—অর্জন করতে হয়। গাজা প্রমাণ করেছে, প্রতিরোধই একমাত্র ভাষা যা দখলদার বুঝতে পারে—এক ভাষা যেখানে শব্দ নেই, আছে আগুন; নেই বক্তৃতা, আছে আত্মত্যাগের সুর। যে নগরী মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয়েছে, সেখান থেকেই উঠেছে জীবনবোধের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা—‘আমরা আছি, আমরা থাকব।’ এই বাক্য কেবল এক জাতির নয়—এটি পুরো মানবজাতির বিবেকের উচ্চারণ। কারণ, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে সভ্যতার ভণ্ড শান্তিনীতি, আর উঠে এসেছে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন। যদি কেউ প্রশ্ন করে—‘শেষ পর্যন্ত কে জিতেছে?’ উত্তরটি লেখা আছে গাজার আকাশেই—যেখানে বোমার ধোঁয়া সরে গেলে দেখা যায় এক পতাকা, রক্তে ভেজা কিন্তু উড়ছে অবিচল; যেখানে প্রতিটি শিশুর চোখে প্রতিফলিত হয় সেই অমর ঘোষণা—‘আমরা আছি, আমরা থাকব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ভবিষ্যৎ বিশ্বের কান্ডারি ‘এআই’

আব্দুর রহমান 
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৪৩
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

প্রযুক্তিই সব সময় মানবসভ্যতার ইতিহাসের গতিপথ বদলেছে। একসময় আগুন ও চাকা করেছিল এ কাজটি। এরপর বিজ্ঞান মানুষকে মাটির নিচ থেকে ‘তরল সোনা’ তেল আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছে। এই আবিষ্কারের পর দীর্ঘদিন ধরে ভূ-রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে একে কেন্দ্র করে। এমনকি এখনো। যদি আমরা রাশিয়াকে রুখতে পশ্চিমা বিশ্বের তোড়জোড় দেখি, তাহলেই বুঝব—তেল এখনো কৌশলগত অস্ত্র। কিন্তু সেই অবস্থাও দ্রুত বদলাচ্ছে। ক্রমেই তেলের জায়গা নিচ্ছে তথ্য এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)।

মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় ক্ষমতার ভারসাম্য সব সময়ই প্রযুক্তির সীমানা দিয়ে নির্ধারিত হয়েছে। যে প্রথম লোহা গলিয়েছে, সে-ই রাজ্য গড়েছে। যে প্রথম বন্দুক বানিয়েছে, সে-ই সাম্রাজ্য চালিয়েছে। আর এখন—যে প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ করবে, সে-ই পুরো সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেবে। ২১ শতকের ভূ-রাজনীতিতে ক্ষমতা ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ডেটা, অ্যালগরিদম আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতায়। এআই-ই হয়ে উঠছে আগামী দিনের নতুন ‘পারমাণবিক বোমা।’ যার কাছে এই ‘অস্ত্র’ থাকবে, তথ্য থাকবে, আগামীর বিশ্ব থাকবে তারই পদতলে।

আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলোর একটি—ডেটা। আর এর পরিচালনার ইঞ্জিন ‘অ্যালগরিদম।’ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নিক বোস্ট্রম লিখেছিলেন, ‘যে মুহূর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবমস্তিষ্ককে ছাড়িয়ে যাবে, সেই মুহূর্তে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে কাদের হাতে সেই শক্তি থাকবে তার ওপর।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো হয়তো সেই অবস্থানে যায়নি, কিন্তু এরই মধ্যে তা বিশ্বরাজনীতির নয়া ‘হট জোনে’ পরিণত হয়েছে। একে শুধু প্রযুক্তিগত বিপ্লব বলা যায় না; বরং এটি ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোসেফ নাই বলেছেন, যে রাষ্ট্র তথ্যপ্রবাহ ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে, ভবিষ্যতের ক্ষমতার ভারসাম্য তার হাতেই থাকবে। বিষয়টি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে বর্তমান বিশ্বের দুই শীর্ষ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এর বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানও প্রবেশ করেছে এই প্রতিযোগিতায়।

এআই বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ধারণাও পাল্টে গেছে। এখন যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ নয়, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মেশিন। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে চালু করে জয়েন্ট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার (জেএআইসি), যার লক্ষ্য যুদ্ধক্ষেত্রে এআই ব্যবহার বাড়ানো। পরে এটি একীভূত হয় চিফ ডিজিটাল অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অফিসের (সিডিএও) সঙ্গে, যা এখন পেন্টাগনের এআই কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘প্রজেক্ট মেভেন’-এর উদ্যোগে মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে হাজারো ঘণ্টার ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করা হয় কয়েক সেকেন্ডে।

অন্যদিকে, চীনও বসে নেই। প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ২০১৭ সালে ঘোষণা দেন ‘নিউ জেনারেশন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের।’ যেখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীন হবে বিশ্বের প্রধান এআই শক্তি। দেশটির সেনাবাহিনী বা পিপলস লিবারেশন আর্মি এখন ‘ইন্টেলিজেন্টাইজড ওয়ারফেয়ার’ ধারণার ওপর কাজ করছে। এই ধারণা অনুযায়ী, ভবিষ্যতের যুদ্ধ মানবশক্তি নয়, তথ্যশক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে। এরই মধ্যে চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত রোবট ডগ, বিভিন্ন ধরনের ড্রোন তৈরি করার কাজে লেগে পড়েছে। এসব কাজে গতি আনতে চীন তাদের ‘সামরিক-বেসামরিক সমন্বয়’ নীতির মাধ্যমে বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানি যেমন বাইদু, আলিবাবা ও টেনসেন্টকে সরাসরি প্রতিরক্ষা গবেষণায় যুক্ত করেছে।

নিজ দেশে নৈতিকতার কথা বললেও ওরাকল, মাইক্রোসফট, আমাজন, গুগল, স্টারলিংক, পলান্টির, ক্লিয়ারভিউয়ের মতো মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ইউক্রেনকে তাদের ‘নেক্সট জেনারেশন ওয়ারফেয়ারের’ প্রযুক্তিভিত্তিক অস্ত্র পরীক্ষার ‘এআই ওয়ার ল্যাবে’ পরিণত করেছে। তবে বিষয়টি কেবল পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েল এরই মধ্যে গাজায় আরবেল নামক এআই–চালিত এক ধরনের অস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে।

তাই বলা যায়, বিশ্ব নতুন এক ডিজিটাল শীতল যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অস্ত্র হলো ডেটা, যুদ্ধক্ষেত্র হলো ক্লাউড, আর সৈনিকের নাম এআই। এর লক্ষণ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনে মার্কিন উৎপাদিত চিপ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। বিপরীতে চিপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিরল খনিজ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে চীন।

এ তো গেল ছোট উদাহরণ। বড় পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র এখনো হয়তো এআই নিয়ে মাঠে নেমে যুদ্ধ করছে না, কিন্তু তারা এই খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেই চলেছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি এআই খাতে বিনিয়োগ ছিল ১০৯.১ বিলিয়ন ডলার, যা চীনের ৯.৩ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক বেশি। তবে গবেষণায় কিন্তু এগিয়ে চীন। দেশটি ২০১৪-২০২৩ পর্যন্ত ৩৮,২১০টি জেনারেটিভ এআই সম্পর্কিত আবিষ্কার করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ৬,২৭৬টির তুলনায় অনেক বেশি। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, চীন প্রায় ৮.২ বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় তহবিল ঘোষণা করেছে, যা এআই উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করা হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৫ সালের মধ্যে এআই উন্নয়নে ২০০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। ফ্রান্সও এআই উন্নয়নে ১০৯ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এআই খাতে নীতি ও নিয়ন্ত্রণকাঠামো শক্তিশালী করতে চাইলেও তারা উদ্ভাবনে পিছিয়ে আছে এবং বাজারে তার প্রভাব কম। এর বাইরে, আগামী দিনে ব্যবসায় বিনিয়োগের অন্যতম জায়গা হয়ে উঠতে যাচ্ছে ডেটা সেন্টার। এমনকি দুনিয়ার বুক থেকে ডেটা সেন্টার মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়ার নীরব এক প্রতিযোগিতা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

এআই এখনো হয়তো ব্যাপকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু হয়নি। কিন্তু এমন দিন দেরি নয়, যেখানে আমরা মানুষের পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে মেশিন দেখতে পাব। চীনের রোবট ডগ, ইসরায়েলের এআই-চালিত অস্ত্র ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি। ফলে, এটি স্পষ্ট যে যত সময় যাবে—এআইকে যুদ্ধক্ষেত্রে তো বটেই, কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। এই আশঙ্কায় ‘এআই গডফাদার’ খ্যাত জিওফ্রে হিনটন বলেছিলেন, ‘যদি কোনো ধনী দেশ গরিব দেশ আক্রমণ করতে চায়, তবে তাদের বড় সুবিধা দেবে লেথাল অটোনমাস ওয়েপনস বা স্বচালিত স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র।’

তবে পদার্থবিদ ও গবেষক ম্যাক্স টেগমার্ক সতর্ক করেছেন, ‘যে মুহূর্তে মেশিন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করবে, তখনই যুদ্ধ মানবিক সীমা ছাড়িয়ে যাবে।’ যার প্রমাণ আমরা গাজায় পেয়েছি। মানবিকতার সব উদাহরণ সেখানে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তবু বড় শক্তিগুলো এখনো প্রতিযোগিতায় বুঁদ হয়ে আছে। কারণ, যে দেশ আগে এআই সামরিক ব্যবহারে এগিয়ে যাবে, ভবিষ্যতের ক্ষমতার মানচিত্র সে-ই আঁকবে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ বিশ্ববাণিজ্যের গতিপথও অনেকটাই নির্ধারিত হবে এই এআই দিয়েই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঘুষ

সম্পাদকীয়
ঘুষ

আজকের পত্রিকায় অনলাইন ভার্সনে ঘুষবিষয়ক একটি সংবাদ চোখে পড়ল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নানা টানাপোড়েনের মধ্যে সংবাদটিকে নিরীহ গোছের সংবাদ হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু যিনি ঘুষ গ্রহণ করেছেন তিনি অকপটে তা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ঘুষ হিসেবে তিনি পাকা কলা গ্রহণ করেছেন। যিনি কলা দিয়েছেন ঘুষ হিসেবে, তিনি অবশ্য বলেছেন কলার সঙ্গে ১০ হাজার টাকাও দিতে হয়েছে ঘুষ গ্রহণকারীকে। ফলে জমে গেছে খেলা। স্বীকারোক্তির কারণে বদলি হয়েছেন যশোর জেলা পরিষদের সেই উচ্চমান সহকারী। ২৬ অক্টোবর রোববার যশোরে গণশুনানি চলাকালে দুদক কমিশনার মিয়া মোহাম্মদ আলী আকবর আজিজী এই আদেশ দেন।

ঘুষ নিয়ে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ অফিসারদের ঘুষ বিষয়টি বোঝানোর জন্য কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন। একবার হাতেনাতে ঘুষ খাওয়া ধরা পড়েছিল। ব্রিটিশ অফিসার দেখলেন, অভিযুক্ত কর্মচারীকে কলা দেওয়া হচ্ছে। কলাকে যখন ঘুষ বলা হলো, তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন, ঘুষ খাওয়া শরীরের জন্য ভালো। সে কারণেই কিনা জানি না, শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর ঘুষ এখনো সরকারি বিভিন্ন মহলে দেদার খাওয়া হচ্ছে।

ঘুষ, দুর্নীতি আর লুটপাট মূলত হয় অসৎ আমলা, ব্যবসায়ী আর রাজনৈতিক নেতার অসৎ মেলামেশা থেকে। দুর্নীতি, ঘুষ ও লুটপাট বনেদি অপরাধ। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় এরা অভিজাতন্ত্র মেনে চলে। খুবই সহজ একটি কাজকে জটিল বানিয়ে ঘুষ খাওয়ার রেওয়াজ বন্ধ করা কঠিন। যাঁরা ঘুষের খবর প্রকাশ করবেন কিংবা যাঁরা ঘুষখোরকে শায়েস্তা করবেন, তাঁরাও অনেক সময় কী কারণে নিশ্চুপ হয়ে যান, তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। মুশকিল হলো, আমাদের যে নৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে, সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই।

একজন ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ তাঁর দামি গাড়িটা নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন দেশ, সবাই তাঁকে সমীহ করে চলেছে, এ রকম ঘটনা কি দুর্লক্ষ্য? যাঁর বেতন ৫০ হাজার টাকা, তিনি সে মাসের বেতন দিয়ে স্ত্রীকে দুই ভরি স্বর্ণালংকার কিনে দিচ্ছেন, সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন গাড়ির চাবি, এ রকম ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, টাকাটা কোত্থেকে এল সে প্রশ্ন কেউ আর তুলতে চায় না। এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যেত যদি পারিবারিক শিক্ষায়, বিদ্যায়তনের পরিবেশে এবং সামাজিক শৃঙ্খলায় গড়ে তোলা যেত নতুন প্রজন্মকে। একটি শিশু জন্মের পরই যখন চারপাশে অনৈতিকতার চাষবাস দেখে, তখন তার কাছ থেকে সাচ্চা আদর্শবান একজন মানুষকে পাওয়ার ভাবনা শুধু বোকারাই করতে পারেন।

কলা হোক আর টাকা হোক, ঘুষ বিষয়টা যে অন্যায়, তা যদি অন্তর থেকে না বোঝা হয়, শুধু কথা বলার রাজনীতি দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়, তাহলে ঘুষ, দুর্নীতি দূর হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। যশোরের ওই উচ্চমান সহকারীর মতো হয়তো বদলির ঘটনা ঘটবে, কিন্তু ঘুষকে বদলি করার পর ঘুষহীন সমাজ তাতে গড়ে উঠবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত