Ajker Patrika

‘রাক্ষসে’র বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
‘রাক্ষসে’র বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই

ভবিষ্যতের বাংলাকে বাংলাদেশ নামকরণ নিয়ে অবশ্য মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল। পাকিস্তানপন্থীদের কাছ থেকে নয়, তারা তো তখন অপ্রাসঙ্গিকই; স্বাধীনতাপন্থীদের কাছ থেকেই। এঁদের বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ নামকরণে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি অবিচার করা হবে; কারণ বাংলাদেশ তো কেবল পূর্ববঙ্গের নয়, পশ্চিমবঙ্গেরও। আপত্তিটা ছিল জাতীয়তাবাদের উগ্রতার প্রকাশ নিয়েও। এই আপত্তি কিন্তু একাত্তরের মার্চ মাসে যাঁরা ‘স্বাধীনতার’ ইশতেহার পড়েছিলেন তাঁরাও, ষোলো মাস পরে ১৯৭২ সালের ২১ জুলাই তারিখে, ওই পল্টন ময়দানেই, তুলেছিলেন। তখন তাঁরা অবশ্য বিদ্রোহী। একাত্তরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাজাহান সিরাজ ছিলেন স্বাধীনতার ইশতেহারের পাঠক, স্বাধীনতা যখন সদ্য অর্জিত হয়েছে, তখন তিনিই এবং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই তাঁর সম্পাদকীয় রিপোর্টে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘জাতীয়তাবাদ বলতে যেখানে বাঙালির বাঙালিত্বই বোঝায়, সেখানে পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের জন্য কী ব্যবস্থা?’ একাত্তরে-পঠিত স্বাধীনতার ইশতেহারের একটি প্রস্তাবে শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল; বাহাত্তরে-পঠিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে ওই প্রস্তাবকেই বুঝি-বা ‘অপ্রিয়’ সত্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেটা এসেছিল এভাবে: ‘এ দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতা কোনো আন্দোলনের জন্ম বা নেতৃত্ব দেয়নি; বরং জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই “নেতা” সৃষ্টি হয়েছে।’ উল্লেখ্য, একাত্তরে এঁরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিলেন, ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম “বাংলাদেশ” গঠন করে’ ‘পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি’ সৃষ্টি করাকে। বাহাত্তরে এসে, বিদ্রোহীবেশে, ‘পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের জন্য কী ব্যবস্থা’, এ প্রশ্নটি ‘বিদ্রোহী’রা তুলেছিলেন বটে, কিন্তু সেটিকে যে তাঁরা খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা নয়। অনেক বছর পরে, আমেরিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই বিদ্রোহীদের দলনেতা সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ‘আজকে পৃথিবীব্যাপী বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে। কমবেশি সব দেশেই আমাদের অবস্থান রয়েছে। কিন্তু বাঙালির দেশ একটিই–সে হলো বাঙালির এই “জাতি রাষ্ট্র” বাংলাদেশ।’ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে এটি যে একটি জাতি রাষ্ট্র তা নয়; বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর ওই যে দাবি, ‘বাঙালির দেশ একটিই–বাংলাদেশ’, ওই দাবি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মোটেই সন্তুষ্ট করবে না; বরং যখন এটা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়েছে যে হিন্দিবলয়ের কেন্দ্রীয় শাসনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বেশ ভালোভাবেই বিপন্ন এবং আত্মরক্ষার আবশ্যক তাতে অধুনা যখন তারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতেও বাধ্য হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের যে বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে মনেপ্রাণে সমর্থন জানিয়েছেন, যতভাবে পারা যায় তাকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে যে পূর্ববঙ্গের মানুষকে বাংলাদেশ নামটা নিয়ে নেওয়ার দরুন তাঁরা বঞ্চিত বোধ করেছেন। ঢাকায় সফরে এসে কেউ কেউ সেটা বলেছেনও। পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয় যে পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা (ইংরেজিতে বেঙ্গল) করা হোক; সে প্রস্তাব কেন্দ্রীয় বিধায়কেরা মানতে রাজি হননি। যুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকে তাজউদ্দীন আহমদ যখন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাৎ করেন, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন যে, ‘বাংলাদেশ’ বলতে তাঁরা পূর্ববঙ্গকেই বোঝেন, তার বেশি নয় এবং বাংলাদেশের প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকায় লাল বৃত্তের ভেতরে যে বাংলাদেশের মানচিত্রটি রাখা ছিল, সে তথ্যের উল্লেখ তাঁর বক্তব্যকে জোরদার করেছিল। রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশেরও যে আপত্তি ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় একাত্তরের যুদ্ধে পূর্বাপর প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ডা. কালিদাস বৈদ্যের এক লেখায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়েই তাঁর বক্তব্য ছিল এ রকমের: ‘ভারতের খেয়ে-পরে ও ভারতের সাহায্যের সব রকমের আশ্বাস পেয়ে তারা (অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের মানুষেরা) তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ ঘোষণা করল। সে নামের স্বীকৃতিও ভারত সরকার দিল। একটা অংশ হয়ে গেল সম্পূর্ণ। কেননা, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়েই প্রকৃত বাংলাদেশ। [...] এই বাংলাদেশের নামের স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও বাস্তবপক্ষে কাগজে-কলমে তারা পশ্চিমবঙ্গকে বিনা যুদ্ধে কেড়ে নিল। আর বাংলা ভাষার একমাত্র অধিকারী তারাই হলো।’

লাহোর প্রস্তাবের থাকা না-থাকার বিষয়টি আরও একবার স্মরণ করা যেতে পারে। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা এবং শেখ মুজিবের ছয় দফায় লাহোর প্রস্তাব ভালোভাবেই উপস্থিত; ভাসানী ন্যাপের চৌদ্দ দফার ভেতরেও লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের ধারণা কার্যকর। ১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ঘোষিত সংগ্রামী ছাত্রসমাজের এগারো দফায় কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের কথা আর আসেনি। ওই সময়ে সামরিক সরকারের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত ছাত্ররা লাহোর প্রস্তাবকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো আর প্রয়োজনীয় মনে করেনি। তা ছাড়া, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাকেই হয়তোবা তাদের কাছে যুক্তিযুক্তই মনে হয়নি; তাদের আকাঙ্ক্ষা তখন স্বাধীনতার। অধিক যারা অগ্রসর, তাদের স্বপ্ন সমাজতন্ত্রের, তাদের পক্ষে লাহোর প্রস্তাব আরও বেশি অপ্রাসঙ্গিক।

ছাত্রদের এগারো দফা দেওয়ার আগেই (চীনপন্থী বলে পরিচিত) পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) আট দফার একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে। তাদের ওই কর্মসূচিতেও লাহোর প্রস্তাবের কোনো চিহ্নই নেই। অখণ্ড পাকিস্তানে তারা আর বিশ্বাস করে না; ‘এক জাতি, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি ও এক অর্থনীতি, এক রাষ্ট্র, ইসলামী সংস্কৃতি, পাকিস্তান আদর্শ’, এসব ধারণাকে তারা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বাঙালি জাতিসহ পাকিস্তানের প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা চায় এবং পূর্ব বাংলায় এক স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য। দুই পাকিস্তানের মধ্যে ‘১৪০০ মাইলের ব্যবধান’ তাদের কাছে অত্যন্ত প্রত্যক্ষ সত্য। কিন্তু তার পরেও দেখা যাচ্ছে, পার্টির নাম তারা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ই রেখেছে এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে সামনে না এনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, তার বিশ্বস্ত দেশীয় জমিদার-জোতদার-মহাজন এবং বড় ধনিক—এই তিন ‘রাক্ষসে’র বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছেন। ফলে পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার ব্যাপারে তাঁদের যে অভিপ্রায়, সেটা জোরদার হয়নি। তা ছাড়া, দল যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, সেটির বাস্তবায়নের বিষয়ে দলের নেতারা যে কতটা আন্তরিক ছিলেন, তা নিয়েও পার্টির ভেতরেই সংশয় ছিল, যে জন্য পার্টিতে ভাঙন ধরে এবং ১৯৬৮-তে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ—এই ধারণা ব্যক্ত করে এবং মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে দেবেন সিকদার ও আবুল বাশার স্বতন্ত্র একটি পার্টি গঠন করেন, নাম দেন ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)’। কৃষিব্যবস্থায় ধনতন্ত্রই প্রধান–এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আবদুল মতিন ও আলাউদ্দিন আহমদ আরেকটি ধারা তৈরি করতে সচেষ্ট হন। প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারিয়ে কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেনন ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাঙলা সমন্বয় কমিটি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন।

তরুণ সিরাজ সিকদারও (জ. ১৯৪৪) শুরু করেছিলেন চীনপন্থী হিসেবেই, শুরুতে তিনি গড়ে তোলেন ‘মাও সে-তুং চিন্তাধারা অধ্যয়নকেন্দ্র’; এবং মাও সে-তুংয়ের কাছ থেকে তিনি যে বিশেষ শিক্ষাটি নিয়েছিলেন অধিকাংশ চীনপন্থীই সেটা নিতে পারেননি। সেটা হলো এই যে, একটি সমাজে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব থাকে, থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব একসময়ে প্রধান হয়ে ওঠে এবং সেটিকে প্রাধান্য দেওয়াটাই হচ্ছে কর্তব্য। সিরাজ সিকদার ও তাঁর সহযোদ্ধারা দেখতে পেয়েছিলেন যে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে প্রধান দ্বন্দ্বটি ছিল ‘পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের সঙ্গে জনগণের দ্বন্দ্ব’। সে জন্যই রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান কর্তব্যটি তাঁরা ঠিক করেছিলেন পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত করা। সেই উপলব্ধি থেকে ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকেই তাঁরা নিজেদের সংগঠনের নাম রাখেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, স্লোগান ঠিক করেন ‘পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র-জিন্দাবাদ’; এবং পরের বছর, যুদ্ধের মাঝখানে তাঁদের সংগঠনের নামটি দাঁড়ায় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। বাংলাদেশ বলেননি, পূর্ব বাংলাই বলেছেন। পূর্ব পাকিস্তান তো নয়ই।

আমরা জানি, উনসত্তরের অভ্যুত্থানের পেছনে দুই অর্থনীতির তত্ত্বের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বেশ আগেই, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের পরস্পর-বিচ্ছিন্ন দুই অংশের ভেতরে শ্রম ও পুঁজির চলাচল সম্ভব হবে না; বিশেষ করে এই বিবেচনায় পাকিস্তানে দুই অর্থনীতির ব্যবস্থা চালু করতে হবে–এ ধারণাটি কারও কারও চিন্তায় ধরা পড়েছিল। এটিকে স্পষ্টভাবে প্রথম ব্যক্ত করেন অর্থনীতিবিদ ড. আবদুস সাদেক। ধারণাটিকে তুলে ধরে তিনি একটি পুস্তিকা রচনা করেন ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকেই। পরবর্তী সময়ে, ষাটের দশকে বাঙালি অর্থনীতিবিদদের কয়েকজন তাঁদের অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়ন থেকে এই ধারণাকে আরও জোরালো ও যুক্তিসংগতভাবে প্রবন্ধ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্যে পাকিস্তানের দুই অংশের ভেতর ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বঞ্চনার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন তাঁদের বক্তব্য দ্বারা সমর্থিত হয়ে বিশেষ রকমের শক্তি লাভ করেছে। অর্থনীতিবিদেরা কিন্তু তাই বলে এটা মনে করেননি, অন্তত বলেননি যে পাকিস্তান আসলে এক জাতির দেশ নয়; তাঁদের প্রকাশিত বক্তব্যে বরং এটাই বলা হচ্ছিল যে, অখণ্ড পাকিস্তানের উন্নতির জন্যই দ্বৈত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মেনে নেওয়া এবং দুই অঞ্চলের ভেতরকার বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। যেমন ১৯৬১ সালে লাহোরে জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার (বিএনআর) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে অধ্যাপক রেহমান সোবহান যে প্রবন্ধটি পাঠ করে বড় রকমের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন, তার শিরোনাম ছিল, ‘How to build Pakistan as a well-knit nation’। পাকিস্তানি জাতিকে সুগঠিত করার এই চিন্তার অন্য অর্থনীতিবিদদেরও সায় ছিল। তাঁরা রাষ্ট্রের নয়, জাতির কথাই ভাবছিলেন। পাকিস্তান প্রস্তাবের রাজনৈতিক দর্শনও কিন্তু ছিল ওইটিই; ভারতবর্ষের মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি, তাই তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি চাই, যার নাম হবে পাকিস্তান, কিন্তু যার ভৌগোলিক গঠনটা সেদিন নেতারা বলতে পারেননি। তবে পাঞ্জাব যে থাকবে একেবারে প্রথমে, তাতে তাঁদের কোনো সন্দেহই ছিল না। বাঙালি এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদীরা এবং সমাজতন্ত্রীরা, উভয়েই বিলক্ষণ এগিয়ে গিয়েছিলেন। (সমাপ্ত)

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঘর আলো করেছে ৫ নবজাতক, চোখে অন্ধকার দেখছেন মুদিদোকানি সোহেল

বেতন–ভাতা বাড়িয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার না করলে টেসলা ছাড়তে পারেন মাস্ক

আজকের রাশিফল: ভুল ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠিয়ে বিপত্তি বাধাবেন না

ঘনীভূত হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’, আঘাত হানবে সন্ধ্যার পর

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বহুজাতিক কোম্পানির খপ্পরে কৃষি

আবু তাহের খান 
জিএমও বীজ কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। ছবি: সংগৃহীত
জিএমও বীজ কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।

কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।

১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।

একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।

যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।

মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?

বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।

উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।

প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।

অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।

দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঘর আলো করেছে ৫ নবজাতক, চোখে অন্ধকার দেখছেন মুদিদোকানি সোহেল

বেতন–ভাতা বাড়িয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার না করলে টেসলা ছাড়তে পারেন মাস্ক

আজকের রাশিফল: ভুল ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠিয়ে বিপত্তি বাধাবেন না

ঘনীভূত হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’, আঘাত হানবে সন্ধ্যার পর

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ক্রিনের আড়ালে নিঃসঙ্গতা

মাহফুজা খাতুন
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।

একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?

গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।

যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।

মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।

ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।

তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।

আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঘর আলো করেছে ৫ নবজাতক, চোখে অন্ধকার দেখছেন মুদিদোকানি সোহেল

বেতন–ভাতা বাড়িয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার না করলে টেসলা ছাড়তে পারেন মাস্ক

আজকের রাশিফল: ভুল ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠিয়ে বিপত্তি বাধাবেন না

ঘনীভূত হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’, আঘাত হানবে সন্ধ্যার পর

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নেদারল্যান্ডসের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির অনুশীলন

শাইখ সিরাজ
তরুণ উদ্যোক্তা ইয়নের সঙ্গে ক্যাপসিকাম খামারে লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
তরুণ উদ্যোক্তা ইয়নের সঙ্গে ক্যাপসিকাম খামারে লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।

এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।

পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।

প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।

একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।

তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?

পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।

অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’

ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।

ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’

তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।

সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!

এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।

আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঘর আলো করেছে ৫ নবজাতক, চোখে অন্ধকার দেখছেন মুদিদোকানি সোহেল

বেতন–ভাতা বাড়িয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার না করলে টেসলা ছাড়তে পারেন মাস্ক

আজকের রাশিফল: ভুল ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠিয়ে বিপত্তি বাধাবেন না

ঘনীভূত হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’, আঘাত হানবে সন্ধ্যার পর

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই

সম্পাদকীয়
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।

কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।

কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?

ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।

মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঘর আলো করেছে ৫ নবজাতক, চোখে অন্ধকার দেখছেন মুদিদোকানি সোহেল

বেতন–ভাতা বাড়িয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার না করলে টেসলা ছাড়তে পারেন মাস্ক

আজকের রাশিফল: ভুল ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠিয়ে বিপত্তি বাধাবেন না

ঘনীভূত হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’, আঘাত হানবে সন্ধ্যার পর

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত