শাইখ সিরাজ
কৃষিকে ঘিরেই নেদারল্যান্ডসের যত কাজকারবার। কৃষি গবেষণা, কৃষি প্রযুক্তির বিকাশ থেকে শুরু করে কৃষি কর্মকাণ্ড ও কৃষি-বাণিজ্যের এক সূতিকাগার নেদারল্যান্ডস। কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার নেদারল্যান্ডস যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। বছর দুই আগেও দেখে এসেছি কৃষি নিয়ে তাদের বহুমুখী কর্মকাণ্ড। কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রসার আর কৃষি নিয়ে নানামুখী কর্মকাণ্ডে বহুদূর এগিয়ে গেছে দেশটি। আমাদের অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক ও গ্রিনহাউস জোন দেখানোর দায়িত্বে ছিলেন পিটার স্মিটস। তিনি ওয়েগিনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
দ্য হেগ শহরের এডে সেন্ট্রাল স্টেশন এলাকায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন পিটার স্মিটস। পায়ে চামড়ার বুট, পরনে জিনস আর গায়ে সবুজাভ লেদারের হ্যারিংটন জ্যাকেট। শুভ্র সাদা চুল, নীল চোখের ষাটোর্ধ্ব পিটারকে দেখে মনে হচ্ছিল তারুণ্য এখনো যেন তাঁর চলনেবলনে। পিটারের সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষ হলে আবার গাড়ি চলতে শুরু করল। পিটার জানিয়ে দিলেন, ‘আপনাদের সবকিছু প্রায় গাড়ি থেকেই দেখতে হবে। জানেন তো নেদারল্যান্ডস খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে জৈবনিরাপত্তা শতভাগ মেনে চলে। ফলে খাদ্য প্রসেসিং সেন্টার বা উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে আপনাদের নিয়ে যেতে পারব না।’ পিটারের কথা শুনে আমরা সবাই হতাশ হলাম। যদি প্রসেসিং সেন্টার বা গ্রিনহাউসের ভেতরে যেতে না পারি, তাহলে ক্যামেরায় কী ধারণ করব! গাড়ির ভেতর থেকে ক্যামেরা ধরে তো আর প্রতিবেদন তৈরি করা যায় না। কিন্তু করার কিছু নেই। এই ব্যাপারে তাঁরা ভীষণ কঠোর।
প্রথমেই গেলাম ভেনলো এলাকার অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্কে। আমাদের দেশে যেমন এক্সপোর্ট জোন কিংবা শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে, ভেনলোর ‘ফ্রেশ পার্ক’ও ঠিক সে রকমই। পিটার জানালেন, নেদারল্যান্ডসে আরও ছয়টি অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক রয়েছে। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সর্টিং ও প্যাকেজিংয়ের জন্য চলে আসে প্রসেসিং পার্কে। একদিকে অনলাইনে চলে কেনাবেচা, অন্যদিকে বিক্রি হয়ে যাওয়া কৃষিপণ্য প্যাকেজিং শেষে বড় বড় সব লরিতে করে চলে যায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাজারে।
সেসব খামারে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ফলে গাড়িতে বসেই ঘুরে দেখতে হচ্ছে সব। চলতে চলতেই অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক ও নেদারল্যান্ডসের কৃষি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নানান তথ্য দিচ্ছিলেন ড. পিটার স্মিটস। তিনি বলে যেতে থাকলেন এভাবে—‘এই ভেনলো ফ্রেশ পার্ক আসলে অন্য রকম একটি অ্যাগ্রো পার্ক। প্রথমে সারা দেশ থেকে কৃষিপণ্য এখানে জমা করা হয়। তারপর এখান থেকে কৃষিপণ্যগুলো সারা দেশের বাজারে এবং বিদেশে পাঠানো হয়। বড় লরিগুলো দেখছেন, ওগুলো তাজা সবজি নিয়ে চলে যাচ্ছে এক্সপোর্ট জোনে আর ছোট লরিগুলো যাচ্ছে সুপার শপে। ছোট লরিগুলোতে বিভিন্ন রকম সবজি ও ফল আছে। হয়তো ১-২ ক্যারেট টমেটো, ক্যাপসিকাম, কমলা, শসা কিংবা অন্য কোনো ফল-ফসল, যার যেমন চাহিদা। সবজি ও ফলমূল সতেজ রাখতে নিয়ন্ত্রিত আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা এখানে আছে। মূলত ডিস্ট্রিবিউশনের কাজটা এখান থেকেই হয়।’
কথায় বলে ‘কথায় চিড়ে ভিজে না’, পিটারের কথায় আমাদের মন ভরছিল না। বললাম, ভেতরে ঢুকি না, কোথাও অন্তত দাঁড়িয়ে দেখি তারা কী করছে!’ পিটার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন। আমরা গাড়ি রাখার নির্ধারিত একটা জায়গায় থামলাম। পিটার নির্ধারণ করে দিলেন পাঁচ মিনিটের বেশি সময় এখানে দাঁড়ানো যাবে না। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম প্রসেসিং সেন্টার থেকে প্যাকেটজাত ও ক্যারেটজাত সবজি-ফল ছোট-বড় লরিগুলোতে সাজানো হচ্ছে। কাচের ভবনের বাইরে থেকে ভেতরে যতটুকু দেখা যায়, তা দেখার চেষ্টা করলাম। লোকজন খুবই কম। যন্ত্রই সবকিছু করছে, অর্থাৎ রোবটই সব কাজকর্ম করছে।
মিনিট পাঁচ পরেই পিটার তাড়া দিলেন। যেতে হবে। আবার গাড়িতে উঠলাম। পিটার আমাদের নিয়ে গেলেন বারেনড্রেখ্ট এলাকায়। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টর জমির কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে দেশটি পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। এর কোনো মানে হয়? পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারি, তবে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গিয়ে লাভ কী হবে?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। এরপর তিনি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
গাড়ি পুনরায় চলতে থাকল। পিটার বলে চললেন, ‘এখানে যে গ্রিনহাউসগুলো দেখছেন কোনোটিই কিন্তু ৫ হেক্টর জমির নিচে নয়। সবচেয়ে বড়টি ১২৫ হেক্টর জমির ওপর। সেচের জন্য ব্যবহার হচ্ছে বৃষ্টির পানি। ওই যে নালাগুলো দেখছেন, ওগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা আছে। ওখানকার পানিতে মাছ চাষও হচ্ছে। আর সোলার প্যানেলে উৎপাদন হচ্ছে বিদ্যুৎ। এখানে গ্রিনহাউসগুলো শুধু খাদ্যই উৎপাদন করছে না, বলা যায় একেকটা গ্রিনহাউস একেকটা পাওয়ার হাউস।
এখানে যত গ্রিনহাউস দেখছেন, তারা তাদের বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ নিজেরাই উৎপাদন করে। বাকি ১০ ভাগ পূরণ হয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। এখানকার গ্রিনহাউস উদ্যোক্তারা খুব খুশি, কারণ বিদ্যুতের জন্য তাঁদের খরচ করতে হয় না। এখানে বিদ্যুতের অনেক দাম। আপনি জানেন, তরুণেরা আগে কৃষির প্রতি অত আগ্রহী ছিল না, কিন্তু প্রযুক্তির কৃষি তরুণদের দারুণ আগ্রহী করে তুলেছে। এখন কৃষিতেই ভবিষ্যৎ দেখছে তারা। আর একটা বিষয়, বলুন তো মানুষ কেন গ্রামে থাকতে চায় না? কারণ স্কুল-কলেজ-হাসপাতালসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক। এ কারণে তরুণেরা সব শহরের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। আবার এ তরুণদের হাতে কৃষিও হয়ে উঠছে অনেকটা নগরকেন্দ্রিক।’
আমরা এসে পৌঁছালাম বেমোলে অবস্থিত ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের গ্রিনহাউসে। এই গ্রিনহাউসে প্রবেশের অনুমতি আমরা পেয়েছি। আমরা গ্রিনহাউসে প্রবেশ করলাম। একটু এগিয়ে যেতেই দেখা হলো এক তরুণের সঙ্গে। বয়স ৩৫-৪০ বছরের কাছাকাছি। বেশ প্রাণোচ্ছল তরুণ। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তরুণের নাম ইয়ন ফান ডের অলেখ। তিনিই এই গ্রিনহাউসটির স্বত্বাধিকারী। বেশ আন্তরিক। জানালেন, ৮ দশমিক ৬ হেক্টর জমির গ্রিনহাউসটাতে প্রায় দুই লাখ ক্যাপসিকামের গাছ আছে। গ্রিনহাউসের দুই পাশে ক্যাপসিকামের চাষ। মাঝখানটায় চলছে বাছাই আর প্যাকেজিং। গাছ থেকে তোলা ক্যাপসিকাম নিয়ে আসছে রোবট। রোবট প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে চলছে। একটার পর একটা ঢেলে দিচ্ছে সর্টিং প্যানেলে। কোনোটাই কোনোটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে না। একটি রোবট চলে যাচ্ছে বাগানের দিকে ফসল তুলে আনতে, হয়তো আর একটি রোবট ফসল তুলে নিয়ে ফিরছে। দুটি রোবট ক্রস করার সময় একটা থেমে যাচ্ছে। একটা রোবট চলে যাওয়ার পর অন্যটি যাচ্ছে। যেন প্রতিটিই নিয়ম মেনে চলছে।
গ্রিনহাউসের সবকিছুই চলছে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে। ইন্টারনেট অব থিংস ও এআই অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইয়নের এই ফার্ম। কোনো কিছুরই অপচয় নেই এই গ্রিনহাউসে। সবই রিসাইকেল হয়। সেচের পানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড সবকিছুরই রয়েছে পুনর্ব্যবহার কিংবা ব্যয় হচ্ছে শক্তি উৎপাদনে। বায়োপেস্ট কনট্রোল রয়েছে গ্রিনহাউসে। ইনসেক্টররাই ইনসেক্টদের মেরে ফেলে। ফলে কোনো রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। এখানকার প্রতিটি ক্যাপসিকামই নিরাপদ খাদ্য।
এবার ফেরার পালা। বিকেল নেমে গেছে। গাড়িতে করে ফেরার পথে চোখে পড়ল বিকেলের সোনালি রোদ সারি সারি গ্রিনহাউসের কাচে পড়ে চিকচিক করছে। যেন অন্য রকম এক সোনালি সমৃদ্ধির বারতা দিচ্ছে। আমি ভাবছিলাম, আমাদের দেশও নেদারল্যান্ডসের মতোই একটি বদ্বীপ। ওরা কৃষি-বাণিজ্যে কতদূর এগিয়ে গেছে! কৃষিশিল্পে ওদের সমৃদ্ধি আজ বিশ্বজুড়ে! কবে আমাদের দেশে এমন বাণিজ্যিক কৃষির ক্ষেত্র তৈরি হবে? আগামীর খাদ্য অর্থনীতির গতি-প্রবাহ সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায় নেদারল্যান্ডসের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি অনুশীলন দেখে, যা আমাদের আগামী কৃষির চর্চার জন্য অবশ্যই অনুসরণীয়।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
কৃষিকে ঘিরেই নেদারল্যান্ডসের যত কাজকারবার। কৃষি গবেষণা, কৃষি প্রযুক্তির বিকাশ থেকে শুরু করে কৃষি কর্মকাণ্ড ও কৃষি-বাণিজ্যের এক সূতিকাগার নেদারল্যান্ডস। কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার নেদারল্যান্ডস যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। বছর দুই আগেও দেখে এসেছি কৃষি নিয়ে তাদের বহুমুখী কর্মকাণ্ড। কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রসার আর কৃষি নিয়ে নানামুখী কর্মকাণ্ডে বহুদূর এগিয়ে গেছে দেশটি। আমাদের অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক ও গ্রিনহাউস জোন দেখানোর দায়িত্বে ছিলেন পিটার স্মিটস। তিনি ওয়েগিনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
দ্য হেগ শহরের এডে সেন্ট্রাল স্টেশন এলাকায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন পিটার স্মিটস। পায়ে চামড়ার বুট, পরনে জিনস আর গায়ে সবুজাভ লেদারের হ্যারিংটন জ্যাকেট। শুভ্র সাদা চুল, নীল চোখের ষাটোর্ধ্ব পিটারকে দেখে মনে হচ্ছিল তারুণ্য এখনো যেন তাঁর চলনেবলনে। পিটারের সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষ হলে আবার গাড়ি চলতে শুরু করল। পিটার জানিয়ে দিলেন, ‘আপনাদের সবকিছু প্রায় গাড়ি থেকেই দেখতে হবে। জানেন তো নেদারল্যান্ডস খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে জৈবনিরাপত্তা শতভাগ মেনে চলে। ফলে খাদ্য প্রসেসিং সেন্টার বা উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে আপনাদের নিয়ে যেতে পারব না।’ পিটারের কথা শুনে আমরা সবাই হতাশ হলাম। যদি প্রসেসিং সেন্টার বা গ্রিনহাউসের ভেতরে যেতে না পারি, তাহলে ক্যামেরায় কী ধারণ করব! গাড়ির ভেতর থেকে ক্যামেরা ধরে তো আর প্রতিবেদন তৈরি করা যায় না। কিন্তু করার কিছু নেই। এই ব্যাপারে তাঁরা ভীষণ কঠোর।
প্রথমেই গেলাম ভেনলো এলাকার অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্কে। আমাদের দেশে যেমন এক্সপোর্ট জোন কিংবা শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে, ভেনলোর ‘ফ্রেশ পার্ক’ও ঠিক সে রকমই। পিটার জানালেন, নেদারল্যান্ডসে আরও ছয়টি অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক রয়েছে। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সর্টিং ও প্যাকেজিংয়ের জন্য চলে আসে প্রসেসিং পার্কে। একদিকে অনলাইনে চলে কেনাবেচা, অন্যদিকে বিক্রি হয়ে যাওয়া কৃষিপণ্য প্যাকেজিং শেষে বড় বড় সব লরিতে করে চলে যায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাজারে।
সেসব খামারে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ফলে গাড়িতে বসেই ঘুরে দেখতে হচ্ছে সব। চলতে চলতেই অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক ও নেদারল্যান্ডসের কৃষি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নানান তথ্য দিচ্ছিলেন ড. পিটার স্মিটস। তিনি বলে যেতে থাকলেন এভাবে—‘এই ভেনলো ফ্রেশ পার্ক আসলে অন্য রকম একটি অ্যাগ্রো পার্ক। প্রথমে সারা দেশ থেকে কৃষিপণ্য এখানে জমা করা হয়। তারপর এখান থেকে কৃষিপণ্যগুলো সারা দেশের বাজারে এবং বিদেশে পাঠানো হয়। বড় লরিগুলো দেখছেন, ওগুলো তাজা সবজি নিয়ে চলে যাচ্ছে এক্সপোর্ট জোনে আর ছোট লরিগুলো যাচ্ছে সুপার শপে। ছোট লরিগুলোতে বিভিন্ন রকম সবজি ও ফল আছে। হয়তো ১-২ ক্যারেট টমেটো, ক্যাপসিকাম, কমলা, শসা কিংবা অন্য কোনো ফল-ফসল, যার যেমন চাহিদা। সবজি ও ফলমূল সতেজ রাখতে নিয়ন্ত্রিত আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা এখানে আছে। মূলত ডিস্ট্রিবিউশনের কাজটা এখান থেকেই হয়।’
কথায় বলে ‘কথায় চিড়ে ভিজে না’, পিটারের কথায় আমাদের মন ভরছিল না। বললাম, ভেতরে ঢুকি না, কোথাও অন্তত দাঁড়িয়ে দেখি তারা কী করছে!’ পিটার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন। আমরা গাড়ি রাখার নির্ধারিত একটা জায়গায় থামলাম। পিটার নির্ধারণ করে দিলেন পাঁচ মিনিটের বেশি সময় এখানে দাঁড়ানো যাবে না। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম প্রসেসিং সেন্টার থেকে প্যাকেটজাত ও ক্যারেটজাত সবজি-ফল ছোট-বড় লরিগুলোতে সাজানো হচ্ছে। কাচের ভবনের বাইরে থেকে ভেতরে যতটুকু দেখা যায়, তা দেখার চেষ্টা করলাম। লোকজন খুবই কম। যন্ত্রই সবকিছু করছে, অর্থাৎ রোবটই সব কাজকর্ম করছে।
মিনিট পাঁচ পরেই পিটার তাড়া দিলেন। যেতে হবে। আবার গাড়িতে উঠলাম। পিটার আমাদের নিয়ে গেলেন বারেনড্রেখ্ট এলাকায়। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টর জমির কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে দেশটি পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। এর কোনো মানে হয়? পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারি, তবে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গিয়ে লাভ কী হবে?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। এরপর তিনি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
গাড়ি পুনরায় চলতে থাকল। পিটার বলে চললেন, ‘এখানে যে গ্রিনহাউসগুলো দেখছেন কোনোটিই কিন্তু ৫ হেক্টর জমির নিচে নয়। সবচেয়ে বড়টি ১২৫ হেক্টর জমির ওপর। সেচের জন্য ব্যবহার হচ্ছে বৃষ্টির পানি। ওই যে নালাগুলো দেখছেন, ওগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা আছে। ওখানকার পানিতে মাছ চাষও হচ্ছে। আর সোলার প্যানেলে উৎপাদন হচ্ছে বিদ্যুৎ। এখানে গ্রিনহাউসগুলো শুধু খাদ্যই উৎপাদন করছে না, বলা যায় একেকটা গ্রিনহাউস একেকটা পাওয়ার হাউস।
এখানে যত গ্রিনহাউস দেখছেন, তারা তাদের বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ নিজেরাই উৎপাদন করে। বাকি ১০ ভাগ পূরণ হয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। এখানকার গ্রিনহাউস উদ্যোক্তারা খুব খুশি, কারণ বিদ্যুতের জন্য তাঁদের খরচ করতে হয় না। এখানে বিদ্যুতের অনেক দাম। আপনি জানেন, তরুণেরা আগে কৃষির প্রতি অত আগ্রহী ছিল না, কিন্তু প্রযুক্তির কৃষি তরুণদের দারুণ আগ্রহী করে তুলেছে। এখন কৃষিতেই ভবিষ্যৎ দেখছে তারা। আর একটা বিষয়, বলুন তো মানুষ কেন গ্রামে থাকতে চায় না? কারণ স্কুল-কলেজ-হাসপাতালসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক। এ কারণে তরুণেরা সব শহরের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। আবার এ তরুণদের হাতে কৃষিও হয়ে উঠছে অনেকটা নগরকেন্দ্রিক।’
আমরা এসে পৌঁছালাম বেমোলে অবস্থিত ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের গ্রিনহাউসে। এই গ্রিনহাউসে প্রবেশের অনুমতি আমরা পেয়েছি। আমরা গ্রিনহাউসে প্রবেশ করলাম। একটু এগিয়ে যেতেই দেখা হলো এক তরুণের সঙ্গে। বয়স ৩৫-৪০ বছরের কাছাকাছি। বেশ প্রাণোচ্ছল তরুণ। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তরুণের নাম ইয়ন ফান ডের অলেখ। তিনিই এই গ্রিনহাউসটির স্বত্বাধিকারী। বেশ আন্তরিক। জানালেন, ৮ দশমিক ৬ হেক্টর জমির গ্রিনহাউসটাতে প্রায় দুই লাখ ক্যাপসিকামের গাছ আছে। গ্রিনহাউসের দুই পাশে ক্যাপসিকামের চাষ। মাঝখানটায় চলছে বাছাই আর প্যাকেজিং। গাছ থেকে তোলা ক্যাপসিকাম নিয়ে আসছে রোবট। রোবট প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে চলছে। একটার পর একটা ঢেলে দিচ্ছে সর্টিং প্যানেলে। কোনোটাই কোনোটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে না। একটি রোবট চলে যাচ্ছে বাগানের দিকে ফসল তুলে আনতে, হয়তো আর একটি রোবট ফসল তুলে নিয়ে ফিরছে। দুটি রোবট ক্রস করার সময় একটা থেমে যাচ্ছে। একটা রোবট চলে যাওয়ার পর অন্যটি যাচ্ছে। যেন প্রতিটিই নিয়ম মেনে চলছে।
গ্রিনহাউসের সবকিছুই চলছে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে। ইন্টারনেট অব থিংস ও এআই অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইয়নের এই ফার্ম। কোনো কিছুরই অপচয় নেই এই গ্রিনহাউসে। সবই রিসাইকেল হয়। সেচের পানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড সবকিছুরই রয়েছে পুনর্ব্যবহার কিংবা ব্যয় হচ্ছে শক্তি উৎপাদনে। বায়োপেস্ট কনট্রোল রয়েছে গ্রিনহাউসে। ইনসেক্টররাই ইনসেক্টদের মেরে ফেলে। ফলে কোনো রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। এখানকার প্রতিটি ক্যাপসিকামই নিরাপদ খাদ্য।
এবার ফেরার পালা। বিকেল নেমে গেছে। গাড়িতে করে ফেরার পথে চোখে পড়ল বিকেলের সোনালি রোদ সারি সারি গ্রিনহাউসের কাচে পড়ে চিকচিক করছে। যেন অন্য রকম এক সোনালি সমৃদ্ধির বারতা দিচ্ছে। আমি ভাবছিলাম, আমাদের দেশও নেদারল্যান্ডসের মতোই একটি বদ্বীপ। ওরা কৃষি-বাণিজ্যে কতদূর এগিয়ে গেছে! কৃষিশিল্পে ওদের সমৃদ্ধি আজ বিশ্বজুড়ে! কবে আমাদের দেশে এমন বাণিজ্যিক কৃষির ক্ষেত্র তৈরি হবে? আগামীর খাদ্য অর্থনীতির গতি-প্রবাহ সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায় নেদারল্যান্ডসের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি অনুশীলন দেখে, যা আমাদের আগামী কৃষির চর্চার জন্য অবশ্যই অনুসরণীয়।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
-গল্পটা এমন—লেনিনকে ঈশ্বরের মুখোমুখি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, তিনি স্বর্গে যাবেন না নরকে যাবেন, তা নির্ধারণ করা। ঈশ্বরের দূত খুব জোর গলায় বলছিলেন, লেনিন একজন পাপী। তাঁর মতে, লেনিন সারা জীবন ঈশ্বরের বদনাম করেছেন।
২০ ঘণ্টা আগেনীলোৎপল সাধ্যের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ১৭ মার্চ। তিনি তাঁর সংগীতজীবনের মধ্য গগনে খসে পড়েছিলেন শিল্পচর্চা ও শিল্পসাধনায় ব্রতী অনুগামী অনুজ পরম্পরা তৈরির কর্মযজ্ঞ পালন থেকে। হালে শিল্পপ্রসারে প্রযুক্তি অনেক সুযোগ ও সংযোগ তৈরি করেছে, সে কারণে শিল্পে স্নাত হওয়ার অনেক দরজা খুলে গেছে...
২০ ঘণ্টা আগেবরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ১৬ মার্চ আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই।
২১ ঘণ্টা আগেআমার এই লেখা যেদিন ছাপা হবে, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
২ দিন আগে