Ajker Patrika

প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারে সৌন্দর্য নাকি ক্ষতি

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র
প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারে সৌন্দর্য নাকি ক্ষতি

পৃথিবীতে প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারের সংস্কৃতি অনেক দিনের। অনেকের মতে, এর ব্যবহার পৃথিবীতে প্রথম শুরু হয়েছে ৬ হাজার বছর আগে। পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি সমাজেই এর ব্যবহার দেখা গেছে। মেসোপটেমিয়া ও প্রাচীন মিসরে এর ব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে। প্রাচীন মিসরে কাজল ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তারা পাথরের ওপর বিভিন্ন উপাদান চূর্ণ করে প্রসাধনসামগ্রী তৈরি করত। মিসরের পুরুষ ও নারী উভয়েই এসব সামগ্রীর ব্যবহার জানত। তারা তাদের চেহারা উন্নত করার জন্য মেকআপ ব্যবহার করত। মিসরে ধারণা করা হয়, প্রায় ৫ হাজার বছর আগে প্রথম প্রসাধনীর ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

তারা ত্বকের যত্নে ধূপের তেল ব্যবহার করত। এটি ত্বকের কোমলতা রক্ষা ও গন্ধসামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া এখানে একসময় আইলাইনার ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল। মিসরের নারীরা সূর্যের আলো থেকে বাঁচতে মুখে সাদা রং ব্যবহার করত। এই অঞ্চলে একধরনের লিপস্টিকের ব্যবহার প্রচলিত ছিল, যা দেখতে অনেক ঝলমলে। এই ঝলমলে লিপস্টিক তৈরির জন্য তারা মাছের আঁশ থেকে একধরনের মুক্তার মতো পদার্থ ব্যবহার করত। প্রাচীনকাল থেকে ইরান ও পারস্য অঞ্চলে আইলাইনার ব্যবহারের প্রচলন ছিল। মেসোপটেমিয়ায় উচ্চবিত্তরা রত্নপাথর গুঁড়ো করে প্রসাধনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করত। প্রাচীন রোমেও এটি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারের একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অন্যান্য ইতিহাসের মতো এই ইতিহাসেরও একটি চড়াই-উতরাই রয়েছে। খ্রিষ্টীয় যুগের শুরুতে রোমান সাম্রাজ্যে প্রসাধনীর ব্যাপক ব্যবহার ছিল। তারা কাজল ব্যবহার করত অনেক। তারা গাল লাল করত আর গায়ের রং সাদা করার জন্য ব্যবহার করত পাউডার। গোসলের সময় তেল ব্যবহার করত। রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর ইউরোপের অধিকাংশ জায়গায় প্রসাধনীর ব্যবহার কমে যায়। ইউরোপীয় রেঁনেসার সময় এর ব্যবহার আবার বাড়তে থাকে। ১৫ ও ১৬ শতাব্দীতে ইটালি আর ১৭ শতাব্দীতে প্রসাধনী উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে ফ্রান্স। ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এর ব্যবহার অভিজাতদের মধ্যেই ছিল। ১৮ শতাব্দীতে এটি প্রায় সবাই ব্যবহার করা শুরু করে। ১৯ শতকের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে প্রসাধনসামগ্রীর প্রকাশ্য ব্যবহার খারাপ দৃষ্টিতে দেখত। তবে সে সময় ফ্রান্সের নারীদের মেকআপ ব্যবহারের চল ছিল। এই সময়টায় ফ্রান্স প্রসাধনী উৎপাদনে এগিয়ে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমস্ত কুসংস্কার বাদ দিয়ে নতুন করে প্রসাধনীর ব্যবহার শুরু হয়। আধুনিক যুগে এসে প্রসাধনসামগ্রী একটি বৃহৎ শিল্পে পরিণত হয়েছে। আগে প্রসাধনসামগ্রীতে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহৃত হলেও এখন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হয়। ফলে এসব পণ্যে ক্ষতিকর উপাদান থেকে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে।

প্রসাধনসামগ্রী বলতে ত্বক, চুল ও শরীরের সৌন্দর্যের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীকে বোঝায়। আমরা নানা উদ্দেশ্যে নানা রকম প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করে থাকি। যেমন মেকআপের জন্য ব্যবহার করি মাসকারা, আইশ্যাডো, আইলাইনার, কনসিলার প্রভৃতি। আবার ত্বকের জন্য ব্যবহার করি ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন, ফেসিয়াল মাস্ক, টোনার ইত্যাদি। চুলের যত্নে ব্যবহার করি শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, হেয়ার স্প্রে, হেয়ার কালার ইত্যাদি। এ ছাড়া সাবান, পারফিউম, লিপস্টিক আরও নানা ধরনের প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবহার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে ২৬টি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম নিয়ে পরীক্ষা করে পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)। তাদের পরীক্ষায় ২৬টি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের মধ্যে ২২টিতে পারদের মাত্রা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিরাপত্তা সীমা-১ পার্ট পার মিলিয়ন (পিপিএম) থেকে অনেক গুণ বেশি পেয়েছে। তারা গবেষণায় সরাসরি শপিং মল, বাজার, দোকান ও অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এই গবেষণা করে। এতে তারা এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স মেশিন ব্যবহার করে নমুনা পণ্যগুলোতে উচ্চমাত্রার মার্কারি বা পারদ পায়। সবচেয়ে বেশি পারদ পাওয়া গেছে ডিউ বিউটি ক্রিম ও গোল্ডেন পার্ল বিউটি ক্রিমে। পারদ আমাদের শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী পারদ স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। জিরো মার্কারি ওয়ার্কিং গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী পারদ চোখ, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। শিশু, নবজাতক ও গর্ভস্থ ভ্রূণের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রসাধনসামগ্রীতে পারদের ব্যবহার এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। ফিলিপাইনের মতো দেশে পারদ পাওয়া গেছে এমন ১০০টির মতো রং ফর্সাকারী ক্রিম নিষিদ্ধ করার পরও এগুলো অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রসাধনসামগ্রীতে পারদ আরও ব্যাপক ও মারাত্মকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার আগেই এসব ব্যাপারে এখন প্রশাসনের দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে পারদের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পারদযুক্ত ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিরুদ্ধে চলমান বৈশ্বিক আন্দোলনের সঙ্গে সবাইকে যুক্ত হতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার পর বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাকে ফেরত নেওয়ার অনুরোধ কাতারের

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি জানাবে ইউজিসি

বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করল যুক্তরাষ্ট্র

শেখ হাসিনার ‘ফেরার পরিকল্পনা’ ঘিরে গোপন বৈঠক, গ্রেপ্তার ২২ নেতা-কর্মী কারাগারে

পর্যটকদের জন্য দ্বার খুলে দিচ্ছে বিশ্বের অন্যতম নিঃসঙ্গ একটি দেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত