Ajker Patrika

আমাদের নাগরিক দায়টা কী?

মামুনুর রশীদ
আমাদের নাগরিক দায়টা কী?

ঢাকার অদূরে একটা শুটিংয়ের কাজে কয়েক দিন যাতায়াত করতে হচ্ছে। জায়গাটির নাম রয়না, কালীগঞ্জ উপজেলায়। ওখানে যেতে তিনটি পথ আছে।

একটি পূর্বাচলের মধ্য দিয়ে কাঞ্চন ব্রিজ হয়ে টাঙ্গাইলের হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া যায় উলুখোলা হয়ে। দ্বিতীয়টি আবদুল্লাহপুর হয়ে ময়নারটেক-উত্তরখান হয়ে উলুখোলা দিয়ে। তৃতীয় পথটি গেছে টঙ্গী পার হয়ে পূর্বাচলের পথ ধরে, টাঙ্গাইল হাইওয়ে দিয়ে, উলুখোলা হয়ে নাগরির কাছ দিয়ে সরু পথ ধরে। পূর্বাচলের রাস্তাটিতে এখন চলছে নানা ভাঙচুর, রাস্তা বেহাল। টঙ্গী পার হয়ে ডান দিকের যে রাস্তা সে বহুদূর এবং যানজটে বিপর্যস্ত। অগত্যা যাওয়ার পথ একটি তা হলো, উত্তরখান-ময়নারটেক হয়ে উলুখোলা। রাস্তা কোথাও প্রশস্ত, বিশেষ করে উত্তরা সিটি করপোরেশনের সীমানা পর্যন্ত।

এরপরই পথটি আঁকাবাঁকা। কোথাও সংকীর্ণ, এতই সংকীর্ণ যে দুটি গাড়ি চলাচলের উপায় নেই। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর, বাজার, দোকানপাট। মনে হয় যার যার খেয়ালখুশিমতো গড়ে তুলেছে এসব দালান, টিনের ঘর এবং মানুষের চলাচলের পথ। রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য দোকানপাট।

কোথাও রেস্টুরেন্ট, কোথাও দরজির দোকান, মাছের আড়ত, সবজির দোকান, লন্ড্রি এসব। একটা বিশাল জনপদ গড়ে উঠেছে অপরিসর রাস্তার দুই পাশে।

বেশ কিছু ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে দুই ধারে। কিন্তু বইয়ের দোকান কোথায়, মনে পড়ছে না। রাস্তাটি সদা ব্যস্ত ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশা দিয়ে।

এগুলোকে সংখ্যার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে প্রচুর পরিমাণে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়ি। এগুলোরই রাজত্ব এখানে। এসব কথা বলার অর্থ হচ্ছে, ওখানে ঢুকেই বিশাল এক জনপদের চিন্তাহীনতা, ভবিষ্যৎ ভাবনাহীনতা চোখে পড়ে। কী নির্ভাবনায়, কী শান্তিতে বসবাস করছে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড হলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না, অসুস্থ রোগীদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স যেতে পারবে না, এসব মোটাদাগের চিন্তাও করার ক্ষমতা নেই এই নাগরিকদের। কেউ জায়গা ছাড়তে রাজি নয়।

যেখানে রাজউক বা সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ আছে, সেখানে একধরনের শৃঙ্খলার কথা ভাবা যায় হয়তো। কিন্তু স্থানীয় সরকারের যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আসলে এসব জায়গা যে একসময় জলাশয় ছিল, তার প্রমাণ মেলে একটু এগিয়ে গেলেই। একটা বড় ব্রিজ হয়েছে, দুদিকে জলাশয় চোখে পড়ে। এই ব্রিজে আবার পুলিশি পাহারা বসানো আছে। এখান থেকে উলুখোলা পর্যন্ত পথটা আঁকাবাঁকা। একমাত্র ব্যাটারিচালিত তিন চাকা ছাড়া আর তেমন কোনো অত্যাচার নেই। এসব জায়গাও স্থানীয় সরকারের আওতাধীন। প্রশ্ন হচ্ছে ময়নারটেক পর্যন্ত যে বিশৃঙ্খলা, তা ওই ব্রিজে গিয়ে শেষ হলো কী করে? ঢাকা শহরেও একদা বড় বড় জলাশয় ছিল, বাগান, শতবর্ষী গাছ এসব ছিল। ঢাকা শহরের চারপাশে, বিশেষ করে তুরাগ যেভাবে গিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়েছিল, তাতে একটা বড় জলাশয়ের নদীর প্রমাণ মেলে। এখন একটা ক্ষীণকায় নদীর প্রমাণ মেলে বটে, কিন্তু আশুলিয়া-বিরুলিয়ার সেই বিশাল জলাশয়গুলো কোথায় গেল?

একটা দেশের মালিকানা সেই দেশের জনগণের। বাংলাদেশের সংবিধানেও সে কথা লেখা আছে। তাহলে জনগণ এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখে অথবা রাখার কোনো উপায় নেই? স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে কোথাও এ কথা লেখা নেই যে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের এবং জনগণের ইচ্ছাই এখানে মুখ্য। আসলে যাঁরা জনপ্রতিনিধি হন, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছাই জনগণের নাম করে চালিয়ে দেন এবং ক্ষমতার একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেন। আমার ধারণা, আবদুল্লাহপুর থেকে ময়নারটেকের যে বিশৃঙ্খল জায়গাটি তা ক্ষমতাবান কোনো সিন্ডিকেটের ফলেই হয়েছে, যারা কোনো অবস্থাতেই জনগণের সুযোগ-সুবিধা দেখতে চায় না। ঢাকা শহরটা যেহেতু রাজধানী শহর, তাই লোকদেখানো হলেও কিছু কাজ করতেই হয়। যেকোনো বড় শহরে অথবা ছোট শহরের পরিবহন নিয়ে একটা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যেমন রেলস্টেশন। ব্রিটিশরা যখন রেল প্রতিষ্ঠা করে, তখন এগুলো নিয়ে ভেবেছিল। জীবনের অসংখ্য মধুর মুহূর্তের সঙ্গে রেলস্টেশন জড়িয়ে ছিল। কত প্রেম, বিচ্ছেদ, আশা-নিরাশার পটভূমি রেলস্টেশন। এখানে সুপেয় পানি, বিশ্রামাগার, প্রসাধন—সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। সেই রেলকে ধ্বংস করে বাস। বাস স্টেশনগুলোকে মনে হয় সন্ত্রাসীদের আড্ডা। বাসমালিক আর শ্রমিক মিলে একটা অন্ধকারের জগৎ সৃষ্টি করে রেখেছে এখানে।

 মানুষের জীবনে কত কিছু প্রয়োজন। একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই তার চলে না। প্রয়োজন হয় নির্মল বাতাস, চলাচলের পথ, স্বাস্থ্যকর্মী, সুপেয় পানি, শিশুদের জন্য স্কুল, স্কুলে যাওয়ার সুন্দর পথ, মাঠসহ একটা স্কুল, আবার লাইব্রেরি। এসব তো যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসছে। কিন্তু একটা রাক্ষস এসবকে গ্রাস করে মানুষকে একটা প্রাণীতে পরিণত করেছে। যারা স্কুল চালায় তাদের প্রয়োজন অর্থ। যারা রাজনীতি করে, তাদের প্রয়োজন অঢেল অর্থ, সে যেভাবেই হোক। যারা ব্যবসা করে, তাদের তো অর্থের প্রয়োজনই; কিন্তু নকল খাবার দিয়ে শিশু হত্যা করেও কি টাকা উপার্জন করতে হবে?

আর সর্বত্র গড়ে উঠেছে বেসরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিক। বিপুল অর্থের ছড়াছড়ি। স্বাস্থ্য এখন নিরেট বাণিজ্য। সঙ্গে শিক্ষা। কোচিং সেন্টারের ছড়াছড়ি। কোচিংয়ে মুখস্থবিদ্যা শিখিয়ে পঙ্গু মানসিকতার মানুষ জন্ম দেওয়ার এক মহোৎসব। মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য, পরিবেশ এসবের প্রয়োজনীয়তা ভুলে শুধু ছুটছেই।

দেশের প্রতিটি শহরে গড়ে উঠেছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য হাজার হাজার মেসবাড়ি, হোস্টেল। কী যে তার মালিকদের অমানুষিক আচরণ–কল্পনা করা যাবে না! এই হোস্টেলে থাকার পর ছেলেমেয়েরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে, লেখাপড়া করে একটা যন্ত্র হয়ে বের হয়।

 বর্তমানে লেখাপড়ায় নাকি চাপ কমানোর চেষ্টা চলছে। দেখা যাক, কতটা চাপ কমে। সরকার কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে পারছে না। নোটবইয়ের অবাধ ছড়াছড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তারপর কী হবে, কে জানে! নাগরিকেরা শুধু সরকারের ওপর দোষারোপ করে নিজেকে মুক্ত মনে করে। কিন্তু সরকার যে সব সময়ই সঠিক নির্দেশনা দেয় না, তা তো একেবারেই জানা কথা। তাহলে সমাজের প্রতি নাগরিক দায়টি তো আমাদের।

 চে গুয়েভারাকে মৃত্যুর সময় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কোন দেশের নাগরিক?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর সব দেশের নাগরিক এবং সব দেশের প্রতি আমার নাগরিক দায় সমান।’ বিষয়টি কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে, কিন্তু আমরা কি ভাবব নাগরিক দায়টা কী?

লেখক: মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হোলি আর্টিজানের ঘটনায় ‘জঙ্গি সন্দেহে’ আটক ছিলেন অনিন্দ্য, রাজশাহীর সাবেক মেয়র লিটনের চাচাতো ভাই তিনি

‘তেলের ক্রেতা’ হিসেবে ভারতকে আর পাবে না রাশিয়া, জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

রাবির অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নিয়ম ভঙ্গের জন্য ট্রান্স নারী শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার, জানতে চান ১৬২ নাগরিক

টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি পেছাল, পাবে ৫ কোটি শিশু-কিশোর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত