বিধান রিবেরু
আমরা যেন এক কদম সামনে বাড়লে পিছিয়ে পড়ি আরও দশ কদম। তখন সেই এক কদম এগিয়ে যাওয়াকে বড্ড ম্লান মনে হয়। গত প্রায় এক দশক ধরেই ঢাকার বায়ু ও পরিবেশ দূষণের শিকার। এখনো আমরা শীর্ষ বা এর আশপাশে অবস্থান করছি। এত সংস্কার কমিটি হলো, শুনেছি পরিবেশ উন্নয়নের জন্যও নাকি কমিটি গঠিত হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে কোনোটিরই কি কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা আমরা শুনেছি? এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা দিয়ে জল কম গড়ায়নি। একনায়কতন্ত্রী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী প্রমুখ শাসককে বিদায় করে দিয়ে এখন মৌলবাদী সমাজের উত্থান দেখছি। এসব দেখতে দেখতে এবং রাজনীতির মারপ্যাঁচ খেতে খেতে নগরবাসীর মাথা স্ক্রুর মতো রূপ ধারণ করেছে। বলতে গেলে তারা জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে। কী করবে, কাদের ওপর আস্থা রাখবে, কে তাদের আকাঙ্ক্ষিত জীবন উপহার দেবে, কে তাদের ভরসা দেবে, কোথায় গেলে তারা শান্তি পাবে, ভবিষ্যতে আদৌ কোনো সুখবর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কি না, আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র গঠন করা হবে কি না, কিছুই তাদের জানা নেই। একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা ও পরিস্থিতি সবাইকে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সারা ঢাকা শহরে বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে জুলাই অভ্যুত্থান উদ্যাপিত হয়। সরকারি ছুটি থাকায় লোকজন যানজট অতটা টের পায়নি। কিন্তু পরদিন ৬ আগস্টও রাজনৈতিক কর্মসূচি ও শিক্ষার্থীদের জমায়েত রাজধানীর স্বাভাবিক যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এদিন গুগল ম্যাপের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে কেউ হয়তো সুস্থ-সবল মানুষের রক্তনালি চেপে ধরেছে, তাই রক্ত জমাট বেঁধে গেছে সব শিরা-উপশিরায়। এদিন বিকেলের দিকে শহরের আরেকটি জায়গায় শিক্ষার্থীদের জমায়েত দেখে এক রিকশাচালক তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘এই সব পোলাপানের পড়ালেখা শেষ। খালি রাস্তা আটকায় আর চান্দাবাজি করে। মানুষের হয়রানি।’
ঢাকা শহরকে আমরা কায়মনোবাক্যে খতম করে দিয়েছি বহু আগেই। হতশ্রী এই ঢাকার না আছে মন, না আছে আত্মা, এক মৃত নগরীর আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে। নগরকে দুই পিতার হাতে তুলে দিয়েও তার মৃত্যু রোধ করা যায়নি, বরং উল্টো পিতৃত্ব দাবি করা লোককেই আমরা নগরীর টুঁটি টিপে ধরতে দেখেছি। আর নগরবাসীও হইহই করতে করতে সেসব সমর্থন করেছে। বাকিরা ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এখন তো কথায় কথায় রাস্তা আটকে দিয়ে আন্দোলন করা এক নতুন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে ভুয়া জুলাই যোদ্ধারা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। ঢাকার শিক্ষার্থীরাও যেন রাজপথকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করছে। শিক্ষকেরা অসহায়। শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবেন আর কী পড়াবেন না, সেই সংশয় কাটছে না। এই বুঝি শিক্ষার্থীদের ‘মব’ তাদের অপমান-অপদস্থ করে!
শহরের রাস্তায় হুটহাট বসে পড়া যে জমায়েত, সেটাও একধরনের মব। আমি বলব নৈরাজ্য। যে সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব, আলোচনা করলেই মিটে যায়, সেটার জন্যও তারা নগরবাসীকে ৮-৯ ঘণ্টার তীব্র যানজট উপহার দিচ্ছে। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ রাস্তায় কাটিয়েও দিচ্ছে বিনা প্রতিবাদে। অথচ এই যে রাস্তা আটকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, এটা যে বড় ধরনের ফ্যাসিবাদী আচরণ, সেটি কারও নজরে পড়ছে না। জনসাধারণের তো এখন মূল বক্তব্য হওয়া প্রয়োজন: যে আটকাবে রাস্তা, সে হারাবে আস্থা। অর্থাৎ, ভোট হোক আর সমর্থন হোক, সে জনগণের আস্থাভাজন হবে না। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সবাই ধরে নিচ্ছেন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি, সে জন্য জনসমর্থন দেখানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। আদৌ কি জনসমর্থন পাচ্ছে তারা? ভর কর্মদিবসে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে? তা-ও প্রতিনিয়ত?
একটি নগরকে সচল রাখা এবং একে নগরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যকর করে তোলা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু যেখানে আমাদের রাজনীতিটাই অসুস্থ, সেখানে নগরের অধঃপতন না হয়ে কি পারে? আমরা তো জিম্মি করার রাজনীতি শিখেছি, আর শিখেছি রাজনীতি মানে লুটপাটের এক অবারিত সুযোগের নাম। এই অসুস্থতার মধ্যে আমরা কৌশলে শিক্ষার্থীদের শামিল করতে পেরেছি বা তাদের করা হয়েছে। তারাও অসুস্থ রাজনীতির পূতিগন্ধময় নদীতে ‘সেনান’ করতে নেমেছেন। ষাটের দশকে যে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করতেন বা যে রাজনীতি করতেন, তার সঙ্গে আজকের শিক্ষার্থী ও রাজনীতির বিস্তর ব্যবধান। একসময় ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল মেধা ও মননের চর্চা। এখন চলছে মেধা চর্চার নামে বিপথগামিতা আর বৈষম্যহীনতা তথা কোটা বিরোধিতার নামে কোটারি স্বার্থ সংরক্ষণের বিপজ্জনক খেলা। কে কার হয়ে এত দিন মাঠে খেলাধুলা করেছে, তা মোটামুটি এখন পরিষ্কার। কে কার স্বার্থ সংরক্ষণ করছে, সেটাও হলফ করে বলে দেওয়া যাচ্ছে।
আপনি যখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলেন, তখনই বোঝা যায়, আপনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীনতাকে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন এবং নির্দিষ্ট কারণে সেই স্বাধীনতা আপনার পছন্দ নয়, ঐতিহাসিকভাবে সেই স্বাধীনতা অর্জনে আপনার ভূমিকা তো ছিলই না, উপরন্তু আপনি সেটার বিরোধিতা করেছেন এবং সেই বিরোধিতা করতে গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এখন সময় ও সুযোগ বুঝে আপনি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে যে অর্জন, সেই অর্জনকে ছোট করার পাশাপাশি চাইছেন আপনার ভয়ংকর অপরাধকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতে। একবার বলছেন জাতীয় সংগীত পাল্টে ফেলা হবে, আবার বলছেন সংবিধান ছুড়ে ফেলা হবে। শুধু বলাতেই তো থেমে নেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখলাম ৫ আগস্ট চিহ্নিত ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ছবি বড় বড় করে ছাপিয়ে টাঙানো হলো। যেন এরাই ‘নতুন বাংলাদেশের’ নতুন ‘নায়ক’। একবারও কি এদের লজ্জা লাগল না? যে বাংলাদেশের পতাকা মাথায় বেঁধে এরা যুদ্ধাপরাধীদের হিরো বানিয়ে দিচ্ছে, সেই বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে এরা। এরা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বহাল রাখতে। অথচ আজ জোড়াতালি দেওয়া ইতিহাস উপহার দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষের স্মৃতি কখনো কখনো গোল্ডফিশের মগজের মতো আচরণ করে ঠিক, তবে এতটা আত্মবিশ্বাসী হওয়া ভালো নয় যে এই ভূখণ্ডের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মতো তীব্র ও গভীর ব্যঞ্জনাময় ঘটনা ভুলে যাবে। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, তাঁদের সন্তানেরাও আছেন। ভালোবাসা জানাই তাঁদের, যাঁরা প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মুখাবয়ব সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছেন।
তার পরও আমি বলতে চাই, এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই বাহিনীর দোসরদের ছবি শ্রদ্ধা নিবেদনের নিমিত্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই টাঙাল সে দেশেরই কিছু তরুণ—এর চেয়ে করুণ আর কী হতে পারে! একটি দেশের অধোগতির চিত্র কি আর অন্য কোথাও খোঁজার প্রয়োজন পড়ে? একাত্তর সাল আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জন্ম দিয়েছে। এখন আপনারা কি একাত্তরের আগে ফিরে গিয়ে এই রাষ্ট্রকে তার মাতৃজঠরে ফেরত পাঠাতে চান? এটা কি সম্ভব?
সব সম্ভবের দেশ মনে হয় বাংলাদেশ। এখানে প্রকৃত শিক্ষার আলো না থাকায় একটি কুচক্রী মহল সর্বদাই জনগণকে বিভ্রান্ত করতে উদ্গ্রীব থাকে। কয়েকজন রয়েছেন জ্ঞানপাপী। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক, মুখে মধু। তারা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে মানুষের সামনে বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করছেন, কখনো বা একেবারেই মিথ্যা ও বানোয়াট বয়ান হাজির করছেন। এ রকম আত্মঘাতী জাতি বিরলই বটে।
যে জাতি সুযোগ পেলেই নিজের ইতিহাসকে বিকৃত করে, ঐতিহাসিক সাক্ষ্যকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, ঐতিহ্য পাঠ করতে পারে না বলে বিনষ্ট করে, নিজের দেশের কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবইতে অযথা কাটাছেঁড়া করে, শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগের পর যুগ কয়েকটি ধারায় বিভক্ত করে রাখে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা না ভেবে বিদেশিদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে, তাদের অধোগতির জন্য তো বহিঃশত্রুর প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেদের পতনের জন্য নিজেরাই যথেষ্ট।
লেখক:– প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
আমরা যেন এক কদম সামনে বাড়লে পিছিয়ে পড়ি আরও দশ কদম। তখন সেই এক কদম এগিয়ে যাওয়াকে বড্ড ম্লান মনে হয়। গত প্রায় এক দশক ধরেই ঢাকার বায়ু ও পরিবেশ দূষণের শিকার। এখনো আমরা শীর্ষ বা এর আশপাশে অবস্থান করছি। এত সংস্কার কমিটি হলো, শুনেছি পরিবেশ উন্নয়নের জন্যও নাকি কমিটি গঠিত হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে কোনোটিরই কি কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা আমরা শুনেছি? এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা দিয়ে জল কম গড়ায়নি। একনায়কতন্ত্রী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী প্রমুখ শাসককে বিদায় করে দিয়ে এখন মৌলবাদী সমাজের উত্থান দেখছি। এসব দেখতে দেখতে এবং রাজনীতির মারপ্যাঁচ খেতে খেতে নগরবাসীর মাথা স্ক্রুর মতো রূপ ধারণ করেছে। বলতে গেলে তারা জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে। কী করবে, কাদের ওপর আস্থা রাখবে, কে তাদের আকাঙ্ক্ষিত জীবন উপহার দেবে, কে তাদের ভরসা দেবে, কোথায় গেলে তারা শান্তি পাবে, ভবিষ্যতে আদৌ কোনো সুখবর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কি না, আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র গঠন করা হবে কি না, কিছুই তাদের জানা নেই। একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা ও পরিস্থিতি সবাইকে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সারা ঢাকা শহরে বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে জুলাই অভ্যুত্থান উদ্যাপিত হয়। সরকারি ছুটি থাকায় লোকজন যানজট অতটা টের পায়নি। কিন্তু পরদিন ৬ আগস্টও রাজনৈতিক কর্মসূচি ও শিক্ষার্থীদের জমায়েত রাজধানীর স্বাভাবিক যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এদিন গুগল ম্যাপের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে কেউ হয়তো সুস্থ-সবল মানুষের রক্তনালি চেপে ধরেছে, তাই রক্ত জমাট বেঁধে গেছে সব শিরা-উপশিরায়। এদিন বিকেলের দিকে শহরের আরেকটি জায়গায় শিক্ষার্থীদের জমায়েত দেখে এক রিকশাচালক তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘এই সব পোলাপানের পড়ালেখা শেষ। খালি রাস্তা আটকায় আর চান্দাবাজি করে। মানুষের হয়রানি।’
ঢাকা শহরকে আমরা কায়মনোবাক্যে খতম করে দিয়েছি বহু আগেই। হতশ্রী এই ঢাকার না আছে মন, না আছে আত্মা, এক মৃত নগরীর আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে। নগরকে দুই পিতার হাতে তুলে দিয়েও তার মৃত্যু রোধ করা যায়নি, বরং উল্টো পিতৃত্ব দাবি করা লোককেই আমরা নগরীর টুঁটি টিপে ধরতে দেখেছি। আর নগরবাসীও হইহই করতে করতে সেসব সমর্থন করেছে। বাকিরা ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এখন তো কথায় কথায় রাস্তা আটকে দিয়ে আন্দোলন করা এক নতুন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে ভুয়া জুলাই যোদ্ধারা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। ঢাকার শিক্ষার্থীরাও যেন রাজপথকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করছে। শিক্ষকেরা অসহায়। শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবেন আর কী পড়াবেন না, সেই সংশয় কাটছে না। এই বুঝি শিক্ষার্থীদের ‘মব’ তাদের অপমান-অপদস্থ করে!
শহরের রাস্তায় হুটহাট বসে পড়া যে জমায়েত, সেটাও একধরনের মব। আমি বলব নৈরাজ্য। যে সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব, আলোচনা করলেই মিটে যায়, সেটার জন্যও তারা নগরবাসীকে ৮-৯ ঘণ্টার তীব্র যানজট উপহার দিচ্ছে। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ রাস্তায় কাটিয়েও দিচ্ছে বিনা প্রতিবাদে। অথচ এই যে রাস্তা আটকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, এটা যে বড় ধরনের ফ্যাসিবাদী আচরণ, সেটি কারও নজরে পড়ছে না। জনসাধারণের তো এখন মূল বক্তব্য হওয়া প্রয়োজন: যে আটকাবে রাস্তা, সে হারাবে আস্থা। অর্থাৎ, ভোট হোক আর সমর্থন হোক, সে জনগণের আস্থাভাজন হবে না। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সবাই ধরে নিচ্ছেন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি, সে জন্য জনসমর্থন দেখানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। আদৌ কি জনসমর্থন পাচ্ছে তারা? ভর কর্মদিবসে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে? তা-ও প্রতিনিয়ত?
একটি নগরকে সচল রাখা এবং একে নগরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যকর করে তোলা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু যেখানে আমাদের রাজনীতিটাই অসুস্থ, সেখানে নগরের অধঃপতন না হয়ে কি পারে? আমরা তো জিম্মি করার রাজনীতি শিখেছি, আর শিখেছি রাজনীতি মানে লুটপাটের এক অবারিত সুযোগের নাম। এই অসুস্থতার মধ্যে আমরা কৌশলে শিক্ষার্থীদের শামিল করতে পেরেছি বা তাদের করা হয়েছে। তারাও অসুস্থ রাজনীতির পূতিগন্ধময় নদীতে ‘সেনান’ করতে নেমেছেন। ষাটের দশকে যে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করতেন বা যে রাজনীতি করতেন, তার সঙ্গে আজকের শিক্ষার্থী ও রাজনীতির বিস্তর ব্যবধান। একসময় ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল মেধা ও মননের চর্চা। এখন চলছে মেধা চর্চার নামে বিপথগামিতা আর বৈষম্যহীনতা তথা কোটা বিরোধিতার নামে কোটারি স্বার্থ সংরক্ষণের বিপজ্জনক খেলা। কে কার হয়ে এত দিন মাঠে খেলাধুলা করেছে, তা মোটামুটি এখন পরিষ্কার। কে কার স্বার্থ সংরক্ষণ করছে, সেটাও হলফ করে বলে দেওয়া যাচ্ছে।
আপনি যখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলেন, তখনই বোঝা যায়, আপনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীনতাকে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন এবং নির্দিষ্ট কারণে সেই স্বাধীনতা আপনার পছন্দ নয়, ঐতিহাসিকভাবে সেই স্বাধীনতা অর্জনে আপনার ভূমিকা তো ছিলই না, উপরন্তু আপনি সেটার বিরোধিতা করেছেন এবং সেই বিরোধিতা করতে গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এখন সময় ও সুযোগ বুঝে আপনি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে যে অর্জন, সেই অর্জনকে ছোট করার পাশাপাশি চাইছেন আপনার ভয়ংকর অপরাধকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতে। একবার বলছেন জাতীয় সংগীত পাল্টে ফেলা হবে, আবার বলছেন সংবিধান ছুড়ে ফেলা হবে। শুধু বলাতেই তো থেমে নেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখলাম ৫ আগস্ট চিহ্নিত ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ছবি বড় বড় করে ছাপিয়ে টাঙানো হলো। যেন এরাই ‘নতুন বাংলাদেশের’ নতুন ‘নায়ক’। একবারও কি এদের লজ্জা লাগল না? যে বাংলাদেশের পতাকা মাথায় বেঁধে এরা যুদ্ধাপরাধীদের হিরো বানিয়ে দিচ্ছে, সেই বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে এরা। এরা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বহাল রাখতে। অথচ আজ জোড়াতালি দেওয়া ইতিহাস উপহার দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষের স্মৃতি কখনো কখনো গোল্ডফিশের মগজের মতো আচরণ করে ঠিক, তবে এতটা আত্মবিশ্বাসী হওয়া ভালো নয় যে এই ভূখণ্ডের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মতো তীব্র ও গভীর ব্যঞ্জনাময় ঘটনা ভুলে যাবে। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, তাঁদের সন্তানেরাও আছেন। ভালোবাসা জানাই তাঁদের, যাঁরা প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মুখাবয়ব সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছেন।
তার পরও আমি বলতে চাই, এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই বাহিনীর দোসরদের ছবি শ্রদ্ধা নিবেদনের নিমিত্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই টাঙাল সে দেশেরই কিছু তরুণ—এর চেয়ে করুণ আর কী হতে পারে! একটি দেশের অধোগতির চিত্র কি আর অন্য কোথাও খোঁজার প্রয়োজন পড়ে? একাত্তর সাল আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জন্ম দিয়েছে। এখন আপনারা কি একাত্তরের আগে ফিরে গিয়ে এই রাষ্ট্রকে তার মাতৃজঠরে ফেরত পাঠাতে চান? এটা কি সম্ভব?
সব সম্ভবের দেশ মনে হয় বাংলাদেশ। এখানে প্রকৃত শিক্ষার আলো না থাকায় একটি কুচক্রী মহল সর্বদাই জনগণকে বিভ্রান্ত করতে উদ্গ্রীব থাকে। কয়েকজন রয়েছেন জ্ঞানপাপী। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক, মুখে মধু। তারা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে মানুষের সামনে বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করছেন, কখনো বা একেবারেই মিথ্যা ও বানোয়াট বয়ান হাজির করছেন। এ রকম আত্মঘাতী জাতি বিরলই বটে।
যে জাতি সুযোগ পেলেই নিজের ইতিহাসকে বিকৃত করে, ঐতিহাসিক সাক্ষ্যকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, ঐতিহ্য পাঠ করতে পারে না বলে বিনষ্ট করে, নিজের দেশের কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবইতে অযথা কাটাছেঁড়া করে, শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগের পর যুগ কয়েকটি ধারায় বিভক্ত করে রাখে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা না ভেবে বিদেশিদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে, তাদের অধোগতির জন্য তো বহিঃশত্রুর প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেদের পতনের জন্য নিজেরাই যথেষ্ট।
লেখক:– প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। তাদের শাসন আমলে একটি নতুন অর্থবছরেরও সূচনা হয়েছে। আজ বছর পেরিয়ে অনেকেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন—অর্জন কতটুকু, ব্যর্থতা কোথায় এবং অন্তরায় কী কী? এমন একটি হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় দিকনির্দেশনা দি
৫ ঘণ্টা আগেবাসটা ধাক্কা দিয়েছে এক শিক্ষার্থীকে, শিক্ষার্থী করেছে তার প্রতিবাদ। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসের চালক, চালকের সহকারী ও অন্য কর্মীরা শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়েছে বাসে। ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়েছে। বাসের যাত্রীরা প্রশ্ন করেছে, কিন্তু ‘চোর’কে পেটানো হচ্ছে বলা হলে তারা নির্বিকার বসে থেকেছে আসনে। চোর হলেও যে তাকে পু
৫ ঘণ্টা আগেযে রকম পরিস্থিতিতে দেশ চলছে, তাতে দেশের জনগণের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় সেই অস্বস্তি থেকে বের হয়ে আসার আপাতত একটা পথের দিশা পাওয়া গেল। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা এই ভাষণ দেওয়ার আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে...
১ দিন আগে১৯৭৮ সালে আর্থার সি ক্লার্ক দ্য মাইন্ড মেশিনস-এ একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে কিংবদন্তি এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী বক্তব্য তুলে ধরেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ এবং যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ৫০ বছর পরে তাঁর পূর্বাভাস আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে।
১ দিন আগে