Ajker Patrika

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ও মহাযুদ্ধের আশঙ্কা

চিররঞ্জন সরকার
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি আঞ্চলিক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিতে পারে। ছবি: এএফপি
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি আঞ্চলিক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিতে পারে। ছবি: এএফপি

১৩ জুন, মধ্যরাতে ইসরায়েল যখন ২০০টি যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ইরানের ভেতরকার একাধিক স্থাপনায় আঘাত হানে, তখন এই আক্রমণের পেছনে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি আর কৌশলগত পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট ছিল। এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, বরং ইসরায়েলের ‘শেষ আঘাত’ হিসেবে বিবেচিত।

ইসরায়েলের হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। বিশেষ করে নাটাঞ্জের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা গত কয়েক বছরে একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ইসরায়েল মনে করে, যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো সুরক্ষিত থাকবে না। তাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, ‘এখন না হলে কখনোই নয়।’

এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল কেবল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো নয়, বরং তাদের সামরিক নেতৃত্ব, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে চায়। এককথায় বলা যায়, তারা ইরানকে সামরিকভাবে ‘অক্ষম’ করে দিতে চায়। এই যুদ্ধ কেবল অস্ত্র নির্মূলকরণের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতে ইরান যেন আর হুমকি হয়ে উঠতে না পারে, তার নিশ্চয়তা চায়।

ইসরায়েলের জন্য আসল বাধা ছিল হিজবুল্লাহ। লেবাননের এই শক্তিশালী মিলিশিয়া গোষ্ঠী অনেকটাই ইরানের প্রজেক্টাইল প্রতিরক্ষা। ২০২৪ সালের শেষ দিকে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের অস্ত্রাগারকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। গোপনে মোসাদের সাজানো বিস্ফোরণে কমান্ডারদের মৃত্যু, সিগন্যাল ডিভাইসে ফাঁদ—সব মিলিয়ে এক মাসে হিজবুল্লাহ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। হিজবুল্লাহ দুর্বল হওয়ার পরই ইসরায়েল ইরানের দিকে নজর ঘোরায়। তারা প্রথমে হামাসের নেতাকে তেহরানে হত্যা করে, এরপর ইরানের সামরিক কমান্ডারদের লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এসব হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হন। একাধিক পারমাণবিক বিজ্ঞানীও এই অভিযানে প্রাণ হারান।

ইরান প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে, শতাধিক ড্রোন ও মিসাইল ছোড়ে। কিন্তু আগের মতো এবারও ইসরায়েল, আমেরিকা, ইউরোপ এবং আরব প্রতিবেশীদের যৌথ প্রতিরক্ষাবলয় তা প্রতিহত করে। এই হামলা আরও একটি কাজ করে—ইসরায়েলকে পাল্টা আক্রমণের বৈধতা দেয়।

উল্লেখ্য, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার এই দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনার মূলে রয়েছে বেশ কিছু জটিল কারণ। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ধর্ম ও আদর্শগত বিরোধ। ইসরায়েল নিজেকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে দেখে, যেখানে ইরান একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে তার শিয়া বিপ্লবী আদর্শকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চায়। ইরানের সংবিধানে ইসরায়েলকে একটি অবৈধ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইসরায়েলও ইরানকে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে।

ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও এই বিরোধের একটি মূল কারণ। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তার জন্য অস্তিত্বের সংকট হিসেবে দেখে। ইসরায়েলের আশঙ্কা, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে তা আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। ইরান অবশ্য সব সময়ই তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে।

উভয় দেশই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন করে, যা ইসরায়েলের জন্য সরাসরি হুমকি। অন্যদিকে, ইসরায়েলও ইরানের প্রভাব কমাতে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে।

এই বিরোধে ঘি ঢালছে ফিলিস্তিন ইস্যু। ইরান ফিলিস্তিনিদের অধিকারের সোচ্চার সমর্থক এবং ইসরায়েলের ফিলিস্তিন নীতির কঠোর সমালোচক। এটিও তাদের মধ্যে উত্তেজনার একটি বড় কারণ।

সিরিয়া সংঘাতও দুই দেশের শত্রুতাকে উসকে দিচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরান বাশার আল-আসাদের সরকারকে সমর্থন করে, যেখানে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইসরায়েল নিয়মিতভাবে সিরিয়ায় ইরানের সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে আসছে।

তবে এই দুই দেশ যত গর্জনই করুক না কেন, বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল-ইরান উভয়ই বর্তমানে ভালো অবস্থানে নেই। ইসরায়েল তার নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছে, যেখানে লাখ লাখ ইসরায়েলি নাগরিককে আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটাতে হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ঠিকই ইসরায়েলে আঘাত হানছে। এটি ইসরায়েলের দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সৈন্যসংকটে ভুগছে এবং তাদের অর্থনীতিও চাপের মুখে। ইসরায়েলের অর্থনীতি ভালো নয় এবং ইরান প্রতি মাসে তিন হাজার ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর সক্ষমতা রাখে। ফলে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলমান থাকলে ইসরায়েল তিন মাসের মাথায় বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে।

অন্যদিকে, ইরানের সামরিক সক্ষমতাও সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে তাদের সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু করায়। এই আঘাত থেকে ইরানের সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি সচল হতে সময় লাগবে। ইসরায়েল বা মোসাদ গত এক বছরে ইরানের ভেতরে অস্ত্র পাচার করে একটি ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করেছিল তেহরানের কাছে। এর ফলে আলী খামেনির প্রধান সহযোগীদের টার্গেট করে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েল। ইরানের এই ব্যর্থতা যতটা চোখে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা তার চেয়েও কঠিন।

মনে রাখা দরকার যে, ইসরায়েল কখনোই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না। ইসরায়েলের নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা তাৎক্ষণিক কোনো বড় অর্জন এনে দেয়নি। এই দুটি সাইট ইরান হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই মেরামত করে নিতে পারবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা মাটির প্রায় ৮০০ মিটার নিচে অবস্থিত এবং সুরক্ষিত, যা বোমা হামলা করে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে হামলা চালানো ইসরায়েলের জন্য একটি অবাস্তব লক্ষ্য।

এই সংঘাত এমন এক জটিল মুহূর্তে এসেছে যখন সামগ্রিক পরিস্থিতি ইরানের পক্ষে নেই। লেবাননে হিজবুল্লাহ তাদের পূর্বের শক্তিশালী অবস্থানে নেই, সেখানে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ আগের মতো ইরানের পাশে নেই। ইয়েমেনে হুতিরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বোমা হামলায় বিপর্যস্ত। উপরন্তু, তুরস্কের ন্যাটো-স্থাপিত রাডার থেকে প্রাপ্ত তথ্য ইসরায়েলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হচ্ছে বলে জোরালোভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এইসব কারণ মিলিয়ে, সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি ইরানের জন্য অনুকূল নয়।

অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কূটনৈতিক বৈঠকের নামে ইরানকে ধোঁকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এবং তিনি এই হামলার বিষয়ে পুরোপুরি অবগত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এর অর্থ হলো, যদি ইরান পুরোপুরি সংঘাতে জড়ায়, তবে তাকে মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকান ঘাঁটিগুলোতেও হামলা চালাতে হবে, যা একটি মহাযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসরায়েল ঠেকাতে পারবে না, এটি সত্য। একই সঙ্গে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের অর্থনীতি আরও শতগুণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে, এটিও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল ইরানের পক্ষে যাবে না। একটি মহাযুদ্ধ ছাড়া ইরানের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান সংঘাতের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে পারবে না। তারা সর্বোচ্চ যা করতে পারবে তা হলো হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া। তবে তেল সরবরাহ ব্যাহত হলে ইরানকেও নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল কি তাহলে হামলা থামাবে? এর উত্তর সম্ভবত কারোরই জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে থেমে গিয়ে ইসরায়েল আংশিক বিজয় দাবি করে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এতে ইসরায়েল আপাতত রক্ষা পাবে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, এই পর্যায়ে সংঘাত চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

ইসরায়েল যুদ্ধ চেয়েছিল, আর তারা প্রস্তুতও ছিল। তারা হয়তো কৌশলগতভাবে জিতছে, কিন্তু মানবিকভাবে এই যুদ্ধ ভয়ংকর। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, গৃহহীনতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়—সবই একসঙ্গে চলছে।

শেষ পর্যন্ত, যুদ্ধ হয়তো একটি সমস্যা মেটায়, কিন্তু নতুন আরও দশটি সমস্যা তৈরি করে। তাই যুদ্ধের শেষ ধাপে পৌঁছানোর আগে বিশ্ব সম্প্রদায়, জাতিসংঘ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর উচিত দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানের পথে ফিরে যাওয়া।

বর্তমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাত কেবল দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ নয়; এটি একটি আঞ্চলিক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিতে পারে। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন—সবখানেই ইতিমধ্যে ছায়াযুদ্ধ চলছে, যা যেকোনো সময় সরাসরি সংঘাতে রূপ নিতে পারে। এই যুদ্ধ যদি ‘একজনের পরাজয়’ দিয়ে শেষ হয়, তাহলে সেই বিজয়ও ক্ষণস্থায়ী হবে, কারণ ততক্ষণে গোটা অঞ্চল অস্থিরতায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন মানবতা, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে—নাহলে সবাই হেরে যাবে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নেতানিয়াহু বাংকারে লুকিয়ে, ট্রাম্পের একটি ফোনকলই যথেষ্ট: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মেয়াদের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পরিকল্পনা সরকারের

ঐকমত্য কমিশনের মঙ্গলবারের সংলাপ ‘বয়কট’ করল জামায়াত

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধে আইন পরিবর্তন করায় জাতিসংঘের উদ্বেগ

ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব নয়, স্বীকার করল ইসরায়েল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত