ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে।
মাসুদ রানা
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে কেন যুক্ত হয়েছিলেন?
২০১৮ সালে প্রথম যে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হয়, তাতেও যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তো আমরা দেখেছি যে, একটা দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ যে আন্দোলন চলছিল, ছাত্রলীগ-পুলিশ সেখানে হামলা করছে। আন্দোলনকারীরা আহত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, জেল খাটছে। আমরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর এসব জুলুম দেখে বসে থাকতে পারি না। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছি। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে নানান কর্মসূচি পালন করেছি–বিবৃতি, পদযাত্রা, প্রতিবাদ সমাবেশ ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে আমাদের ওপরও নানারূপী আক্রমণ এসেছে। আমাকে একবার প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ ও শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের গুন্ডারা হেনস্তা করেছে। আমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন আমারই এক সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আমাদের প্রমোশন ও ন্যায্য সুবিধাদির ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা বিবেচনা করে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের যে দাবি, তা ন্যায্য ছিল। তিন প্রজন্ম পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থাকার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরির মোট ৫৬ শতাংশ কোটায় যাবে, তা মানা যায় না। তাই ২০১৮ সালে ওই আন্দোলনে আমরা সমর্থন দিয়েছি। ২০২৪ সালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে ২০২৪-এর আন্দোলনের জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করা যায়। ২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কারের, কমিয়ে ১০ শতাংশের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা পুরো কোটা প্রথাই উঠিয়ে দেন। পরে মামলা হলে কোটার বিষয়টি আবার ফিরে আসে ২০২৪ সালে।
বিদেশে অবস্থান করেও এ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। এক বছর পর জুলাই আন্দোলনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডিজিটাল যুগে পরিসরের ধারণা আর আগের মতো নেই। বিদেশে থেকে বহু মানুষই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দেশে মতপ্রকাশের পরিস্থিতি সংকুচিত থাকায় অনেক সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট বিদেশে থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বন্ধ করে দিয়ে ভালো ইমপ্যাক্ট ফেলেছিলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সৌন্দর্য ছিল, পুরো জাতি এক স্বৈরাচারী সরকার ও মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীদেরও অনেকে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড সইতে না পেরে, বিলম্বে হলেও আন্দোলনে যোগ দেন। তাই একে ‘পুরো জাতির ঐক্য’ বলাই যায়। কিন্তু স্বৈরাচারের পলায়নের পর সেই ঐক্য এক দিনও অটুট থাকেনি, সেটা হলো এক হতাশাজনক বাস্তবতা। যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো, দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের অঙ্গীকার পূরণে অনেকখানি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয়ের কোনোটিই এক বছরে আংশিকভাবেও অর্জিত হয়নি। এক বছরে বোঝা গিয়েছে, রাতারাতি বদলে যাবে না বাংলাদেশ। বরং পরিবর্তনের পথটি দীর্ঘ ও ধীরগতির।
অনেক বিষয়ে কমিশন হলো, শিক্ষা বিষয়ে হলো না। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের কোন ধরনের পরিবর্তন দরকার?
বোঝা যায় শিক্ষা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ কম। অথচ শিক্ষা একটি মৌলিক চাহিদার বিষয়, অন্ন-বস্ত্রের পরেই শিক্ষার গুরুত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ২২ বছর ধরে সর্বনিম্ন, অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেটা না বাড়িয়ে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
প্রথমত, তহবিলের জোগান দরকার। ইউনেসকোর সুপারিশ হলো, জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দ করা। সেটা বাংলাদেশ কখনোই করে না। মোটামুটি ২ শতাংশের নিচেই থাকে। শিক্ষায় বিনিয়োগ না করলে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। সম্প্রতি যেসব দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হয়েছে, তারা সবাই (যেমন দক্ষিণ কোরিয়া) শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এটা হলো প্রথম ও প্রধান কাজ। এটা না হলে, বাকি আলাপে ঢুকে কোনো লাভ নেই। তাই সেই আলাপে আমি যাচ্ছি না।
শিক্ষার্থীদের সরকারে নেওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের সরকারে যোগদান করাটাকে কি ঠিক মনে করেছেন?
জুলাইয়ে কোনো বিপ্লব হয়নি, হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান। বিপ্লব হলে শিক্ষার্থীরাই পুরো সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু বিপ্লবের পূর্বশর্ত একটি রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন চর্চার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়। দেশব্যাপী তাদের জনসম্পৃক্ততা থাকবে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে এসে গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
তারা সম্ভবত একটা জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে ৪ আগস্টেই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখায় বলেছিলাম, শিক্ষার্থীদের ছায়া সরকার গঠন করতে। তাই তাদের উচিত ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রেখে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সমাজে সক্রিয় হওয়া এবং ছায়া সরকারের মতো করে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বার্তা দেওয়া যে, তারা কী চায়? সরকারে যুক্ত থাকাটা তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি।
শেখ হাসিনা যে করাপ্ট সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, তিনি চলে গেলেও কাঠামো রেখে গেছেন। সেই কাঠামো, সরকারে যুক্ত থাকার সূত্রে তো বটেই, নতুন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের নানান প্রলোভন দেখিয়েছে এবং তাদের অনেকেই তাতে সাড়া দিয়েছে। সরকারে না থাকলেও, ব্যাপারটা ঘটতে পারত, তবে মাত্রাগত অনেক পার্থক্য থাকত। আমরা যাঁরা তাদের সামনে রেখে, চিন্তায় বা লেখায়, সমাজ পরিবর্তনের বাজি ধরেছিলাম, তাঁদের জন্য এ এক অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক পরিস্থিতি।
আপনি কি মনে করেন জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে? যদি মনে হয়ে থাকে, তাহলে কেন হয়েছে বলে মনে করেন?
অনেক কারণ। জুলাই আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একই উদ্দেশ্যে। প্রথমত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে, দ্বিতীয়ত অত্যাচারী শাসকদের পতনের জন্য। বেশ দ্রুতই ব্যাপারটা ঘটে। ফলে হাসিনামুক্ত বাংলাদেশকে কেমন হতে হবে, এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের বোঝাপড়ার সুযোগ হয়নি। কারও চাওয়া ছিল, হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী প্রথার বিলোপ হতে হবে। কারও ছিল, ইসলামি শরিয়াহ কায়েমের পথে এগিয়ে যাওয়া। কেউ ভাবছে, কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরাই যথেষ্ট। যখন আন্দোলনের পরপর একদল ভাবছে, কী করে দ্রুত একটা সরকার গঠন করা যায়, তখন আরেক দল মূর্তি ভাঙা ও মাজার ভাঙায় ব্যস্ত হয়ে গেল। তাদের কাছে কেবল মুজিবের মূর্তি নয়, যেকোনো মূর্তিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। মেয়েরা আন্দোলনে এত বড় ভূমিকা রাখল, অথচ কেউ কেউ ভাবছে, মেয়েদের ঘরে অন্তরীণ করে ফেলতে হবে।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তিনটি রাজনৈতিক পক্ষ—বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি পরস্পর বিবাদ ও বিষোদ্গারে ব্যস্ত এখন। আন্দোলন একসঙ্গে করলেও, একজন অন্য জনের চাওয়ার কথা ভাবেনি, সব পক্ষই নিজেদের ভাবনাতেই মশগুল থাকছে। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে যখন অনেক ভাঙচুর হচ্ছে, একপক্ষ আরেকপক্ষকে আক্রমণ করছে, পিটিয়ে মেরে ফেলছে—এসব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার যারা বেশি পেশি প্রদর্শন করেছে, তাদের দাবিই মেনেছে, সে দাবি অগণতান্ত্রিক ও আইনবিরোধী হলেও ফলেছে। সে হিসেবে গত এক বছরে ডানপন্থীদের কথাই বেশি শুনেছে সরকার। গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসেনি, বরং সরকার তার কাজের মাধ্যমে ডানপন্থীদের জয়যাত্রায় সায় দিয়েছে।
এই আন্দোলনে শিক্ষকেরা সক্রিয় ছিলেন, এখন তাঁরা নতুন সময়ে কী ধরনের অবদান রাখতে পারেন? তাঁদের কি সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে?
গোলমেলে পরিস্থিতিতে, নির্লজ্জভাবে নিজেদের কথা বলার প্রয়োজন তৈরি হয়। হাসিনা সরকারের পুরোটা সময়ে শিক্ষকদের একটি পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতায় যুক্ত ছিল, তা হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসের হাজারো অনিয়মের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখেননি। বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা কিন্তু রাজধানীতে ও গ্রামগঞ্জে নানান অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন, অনেক
জুলুম সয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষকেরা তেমন কিছুই করেননি। এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সাদা দলের ছিল তিন-চার শ শিক্ষক। তাঁরা সাদা প্যানেলে নিয়মিত নির্বাচন করা ছাড়া, কোনো একটা প্রতিবাদ সমাবেশও করেননি। শিক্ষক নেটওয়ার্ক মাঝে মাঝে ‘নিপীড়নবিরোধী’ ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করলে, সাদা দলের শিক্ষকেরা পেছনে এসে দাঁড়াতেন। এমনকি জুলাইয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে তাঁরা নিজেদের ব্যানার খুলে দাঁড়ানোর সাহস করেছেন।
কিন্তু আন্দোলন শেষ হলে, আগের সব ভিসি-প্রোভিসি পদত্যাগ করলে, তাঁরা শূন্য আসনগুলো পূরণে তৎপর হয়ে ওঠেন, ধীরে ধীরে সব দখলও করেন। আর রুদ্ধ সময়ের সক্রিয় পক্ষটিকে, নতুন সময়ে সম্মান দেখানো হয়নি। দু-চারজনকে অল্প কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব অর্পণ করে আবার প্রত্যাহারও করা হয়েছে। দেশের বাঁধনছাড়া ডানপন্থী অংশটি তাঁদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’, ‘নারীবাদী’, ‘শাহবাগি’, ‘বাকশালি’, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ইত্যাদি বলে গেছে। শিক্ষার্থীদের নেতারা, যাঁরা নানান সময়ে এসব শিক্ষকের কাছ থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন, তাঁরাও এসব শিক্ষককে অসম্মান থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
এখন দলীয় যেসব শিক্ষক দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারেন। নেটওয়ার্কের সদস্যরা আবার পুরোনো অ্যাকটিভিজমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা সেটা চালিয়ে যেতে পারেন। সব দল-মতের শিক্ষকেরা তাঁদের (পাঠদান ও গবেষণার) পেশাগত দায়িত্বটি ঠিকমতো পালন করবেন, শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখবেন, আর জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখবেন—এই হলো আমার প্রত্যাশা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে কেন যুক্ত হয়েছিলেন?
২০১৮ সালে প্রথম যে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হয়, তাতেও যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তো আমরা দেখেছি যে, একটা দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ যে আন্দোলন চলছিল, ছাত্রলীগ-পুলিশ সেখানে হামলা করছে। আন্দোলনকারীরা আহত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, জেল খাটছে। আমরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর এসব জুলুম দেখে বসে থাকতে পারি না। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছি। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে নানান কর্মসূচি পালন করেছি–বিবৃতি, পদযাত্রা, প্রতিবাদ সমাবেশ ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে আমাদের ওপরও নানারূপী আক্রমণ এসেছে। আমাকে একবার প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ ও শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের গুন্ডারা হেনস্তা করেছে। আমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন আমারই এক সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আমাদের প্রমোশন ও ন্যায্য সুবিধাদির ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা বিবেচনা করে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের যে দাবি, তা ন্যায্য ছিল। তিন প্রজন্ম পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থাকার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরির মোট ৫৬ শতাংশ কোটায় যাবে, তা মানা যায় না। তাই ২০১৮ সালে ওই আন্দোলনে আমরা সমর্থন দিয়েছি। ২০২৪ সালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে ২০২৪-এর আন্দোলনের জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করা যায়। ২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কারের, কমিয়ে ১০ শতাংশের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা পুরো কোটা প্রথাই উঠিয়ে দেন। পরে মামলা হলে কোটার বিষয়টি আবার ফিরে আসে ২০২৪ সালে।
বিদেশে অবস্থান করেও এ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। এক বছর পর জুলাই আন্দোলনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডিজিটাল যুগে পরিসরের ধারণা আর আগের মতো নেই। বিদেশে থেকে বহু মানুষই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দেশে মতপ্রকাশের পরিস্থিতি সংকুচিত থাকায় অনেক সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট বিদেশে থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বন্ধ করে দিয়ে ভালো ইমপ্যাক্ট ফেলেছিলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সৌন্দর্য ছিল, পুরো জাতি এক স্বৈরাচারী সরকার ও মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীদেরও অনেকে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড সইতে না পেরে, বিলম্বে হলেও আন্দোলনে যোগ দেন। তাই একে ‘পুরো জাতির ঐক্য’ বলাই যায়। কিন্তু স্বৈরাচারের পলায়নের পর সেই ঐক্য এক দিনও অটুট থাকেনি, সেটা হলো এক হতাশাজনক বাস্তবতা। যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো, দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের অঙ্গীকার পূরণে অনেকখানি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয়ের কোনোটিই এক বছরে আংশিকভাবেও অর্জিত হয়নি। এক বছরে বোঝা গিয়েছে, রাতারাতি বদলে যাবে না বাংলাদেশ। বরং পরিবর্তনের পথটি দীর্ঘ ও ধীরগতির।
অনেক বিষয়ে কমিশন হলো, শিক্ষা বিষয়ে হলো না। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের কোন ধরনের পরিবর্তন দরকার?
বোঝা যায় শিক্ষা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ কম। অথচ শিক্ষা একটি মৌলিক চাহিদার বিষয়, অন্ন-বস্ত্রের পরেই শিক্ষার গুরুত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ২২ বছর ধরে সর্বনিম্ন, অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেটা না বাড়িয়ে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
প্রথমত, তহবিলের জোগান দরকার। ইউনেসকোর সুপারিশ হলো, জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দ করা। সেটা বাংলাদেশ কখনোই করে না। মোটামুটি ২ শতাংশের নিচেই থাকে। শিক্ষায় বিনিয়োগ না করলে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। সম্প্রতি যেসব দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হয়েছে, তারা সবাই (যেমন দক্ষিণ কোরিয়া) শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এটা হলো প্রথম ও প্রধান কাজ। এটা না হলে, বাকি আলাপে ঢুকে কোনো লাভ নেই। তাই সেই আলাপে আমি যাচ্ছি না।
শিক্ষার্থীদের সরকারে নেওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের সরকারে যোগদান করাটাকে কি ঠিক মনে করেছেন?
জুলাইয়ে কোনো বিপ্লব হয়নি, হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান। বিপ্লব হলে শিক্ষার্থীরাই পুরো সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু বিপ্লবের পূর্বশর্ত একটি রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন চর্চার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়। দেশব্যাপী তাদের জনসম্পৃক্ততা থাকবে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে এসে গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
তারা সম্ভবত একটা জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে ৪ আগস্টেই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখায় বলেছিলাম, শিক্ষার্থীদের ছায়া সরকার গঠন করতে। তাই তাদের উচিত ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রেখে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সমাজে সক্রিয় হওয়া এবং ছায়া সরকারের মতো করে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বার্তা দেওয়া যে, তারা কী চায়? সরকারে যুক্ত থাকাটা তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি।
শেখ হাসিনা যে করাপ্ট সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, তিনি চলে গেলেও কাঠামো রেখে গেছেন। সেই কাঠামো, সরকারে যুক্ত থাকার সূত্রে তো বটেই, নতুন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের নানান প্রলোভন দেখিয়েছে এবং তাদের অনেকেই তাতে সাড়া দিয়েছে। সরকারে না থাকলেও, ব্যাপারটা ঘটতে পারত, তবে মাত্রাগত অনেক পার্থক্য থাকত। আমরা যাঁরা তাদের সামনে রেখে, চিন্তায় বা লেখায়, সমাজ পরিবর্তনের বাজি ধরেছিলাম, তাঁদের জন্য এ এক অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক পরিস্থিতি।
আপনি কি মনে করেন জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে? যদি মনে হয়ে থাকে, তাহলে কেন হয়েছে বলে মনে করেন?
অনেক কারণ। জুলাই আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একই উদ্দেশ্যে। প্রথমত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে, দ্বিতীয়ত অত্যাচারী শাসকদের পতনের জন্য। বেশ দ্রুতই ব্যাপারটা ঘটে। ফলে হাসিনামুক্ত বাংলাদেশকে কেমন হতে হবে, এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের বোঝাপড়ার সুযোগ হয়নি। কারও চাওয়া ছিল, হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী প্রথার বিলোপ হতে হবে। কারও ছিল, ইসলামি শরিয়াহ কায়েমের পথে এগিয়ে যাওয়া। কেউ ভাবছে, কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরাই যথেষ্ট। যখন আন্দোলনের পরপর একদল ভাবছে, কী করে দ্রুত একটা সরকার গঠন করা যায়, তখন আরেক দল মূর্তি ভাঙা ও মাজার ভাঙায় ব্যস্ত হয়ে গেল। তাদের কাছে কেবল মুজিবের মূর্তি নয়, যেকোনো মূর্তিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। মেয়েরা আন্দোলনে এত বড় ভূমিকা রাখল, অথচ কেউ কেউ ভাবছে, মেয়েদের ঘরে অন্তরীণ করে ফেলতে হবে।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তিনটি রাজনৈতিক পক্ষ—বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি পরস্পর বিবাদ ও বিষোদ্গারে ব্যস্ত এখন। আন্দোলন একসঙ্গে করলেও, একজন অন্য জনের চাওয়ার কথা ভাবেনি, সব পক্ষই নিজেদের ভাবনাতেই মশগুল থাকছে। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে যখন অনেক ভাঙচুর হচ্ছে, একপক্ষ আরেকপক্ষকে আক্রমণ করছে, পিটিয়ে মেরে ফেলছে—এসব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার যারা বেশি পেশি প্রদর্শন করেছে, তাদের দাবিই মেনেছে, সে দাবি অগণতান্ত্রিক ও আইনবিরোধী হলেও ফলেছে। সে হিসেবে গত এক বছরে ডানপন্থীদের কথাই বেশি শুনেছে সরকার। গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসেনি, বরং সরকার তার কাজের মাধ্যমে ডানপন্থীদের জয়যাত্রায় সায় দিয়েছে।
এই আন্দোলনে শিক্ষকেরা সক্রিয় ছিলেন, এখন তাঁরা নতুন সময়ে কী ধরনের অবদান রাখতে পারেন? তাঁদের কি সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে?
গোলমেলে পরিস্থিতিতে, নির্লজ্জভাবে নিজেদের কথা বলার প্রয়োজন তৈরি হয়। হাসিনা সরকারের পুরোটা সময়ে শিক্ষকদের একটি পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতায় যুক্ত ছিল, তা হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসের হাজারো অনিয়মের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখেননি। বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা কিন্তু রাজধানীতে ও গ্রামগঞ্জে নানান অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন, অনেক
জুলুম সয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষকেরা তেমন কিছুই করেননি। এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সাদা দলের ছিল তিন-চার শ শিক্ষক। তাঁরা সাদা প্যানেলে নিয়মিত নির্বাচন করা ছাড়া, কোনো একটা প্রতিবাদ সমাবেশও করেননি। শিক্ষক নেটওয়ার্ক মাঝে মাঝে ‘নিপীড়নবিরোধী’ ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করলে, সাদা দলের শিক্ষকেরা পেছনে এসে দাঁড়াতেন। এমনকি জুলাইয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে তাঁরা নিজেদের ব্যানার খুলে দাঁড়ানোর সাহস করেছেন।
কিন্তু আন্দোলন শেষ হলে, আগের সব ভিসি-প্রোভিসি পদত্যাগ করলে, তাঁরা শূন্য আসনগুলো পূরণে তৎপর হয়ে ওঠেন, ধীরে ধীরে সব দখলও করেন। আর রুদ্ধ সময়ের সক্রিয় পক্ষটিকে, নতুন সময়ে সম্মান দেখানো হয়নি। দু-চারজনকে অল্প কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব অর্পণ করে আবার প্রত্যাহারও করা হয়েছে। দেশের বাঁধনছাড়া ডানপন্থী অংশটি তাঁদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’, ‘নারীবাদী’, ‘শাহবাগি’, ‘বাকশালি’, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ইত্যাদি বলে গেছে। শিক্ষার্থীদের নেতারা, যাঁরা নানান সময়ে এসব শিক্ষকের কাছ থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন, তাঁরাও এসব শিক্ষককে অসম্মান থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
এখন দলীয় যেসব শিক্ষক দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারেন। নেটওয়ার্কের সদস্যরা আবার পুরোনো অ্যাকটিভিজমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা সেটা চালিয়ে যেতে পারেন। সব দল-মতের শিক্ষকেরা তাঁদের (পাঠদান ও গবেষণার) পেশাগত দায়িত্বটি ঠিকমতো পালন করবেন, শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখবেন, আর জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখবেন—এই হলো আমার প্রত্যাশা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে।
মাসুদ রানা
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে কেন যুক্ত হয়েছিলেন?
২০১৮ সালে প্রথম যে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হয়, তাতেও যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তো আমরা দেখেছি যে, একটা দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ যে আন্দোলন চলছিল, ছাত্রলীগ-পুলিশ সেখানে হামলা করছে। আন্দোলনকারীরা আহত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, জেল খাটছে। আমরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর এসব জুলুম দেখে বসে থাকতে পারি না। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছি। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে নানান কর্মসূচি পালন করেছি–বিবৃতি, পদযাত্রা, প্রতিবাদ সমাবেশ ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে আমাদের ওপরও নানারূপী আক্রমণ এসেছে। আমাকে একবার প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ ও শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের গুন্ডারা হেনস্তা করেছে। আমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন আমারই এক সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আমাদের প্রমোশন ও ন্যায্য সুবিধাদির ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা বিবেচনা করে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের যে দাবি, তা ন্যায্য ছিল। তিন প্রজন্ম পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থাকার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরির মোট ৫৬ শতাংশ কোটায় যাবে, তা মানা যায় না। তাই ২০১৮ সালে ওই আন্দোলনে আমরা সমর্থন দিয়েছি। ২০২৪ সালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে ২০২৪-এর আন্দোলনের জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করা যায়। ২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কারের, কমিয়ে ১০ শতাংশের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা পুরো কোটা প্রথাই উঠিয়ে দেন। পরে মামলা হলে কোটার বিষয়টি আবার ফিরে আসে ২০২৪ সালে।
বিদেশে অবস্থান করেও এ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। এক বছর পর জুলাই আন্দোলনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডিজিটাল যুগে পরিসরের ধারণা আর আগের মতো নেই। বিদেশে থেকে বহু মানুষই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দেশে মতপ্রকাশের পরিস্থিতি সংকুচিত থাকায় অনেক সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট বিদেশে থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বন্ধ করে দিয়ে ভালো ইমপ্যাক্ট ফেলেছিলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সৌন্দর্য ছিল, পুরো জাতি এক স্বৈরাচারী সরকার ও মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীদেরও অনেকে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড সইতে না পেরে, বিলম্বে হলেও আন্দোলনে যোগ দেন। তাই একে ‘পুরো জাতির ঐক্য’ বলাই যায়। কিন্তু স্বৈরাচারের পলায়নের পর সেই ঐক্য এক দিনও অটুট থাকেনি, সেটা হলো এক হতাশাজনক বাস্তবতা। যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো, দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের অঙ্গীকার পূরণে অনেকখানি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয়ের কোনোটিই এক বছরে আংশিকভাবেও অর্জিত হয়নি। এক বছরে বোঝা গিয়েছে, রাতারাতি বদলে যাবে না বাংলাদেশ। বরং পরিবর্তনের পথটি দীর্ঘ ও ধীরগতির।
অনেক বিষয়ে কমিশন হলো, শিক্ষা বিষয়ে হলো না। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের কোন ধরনের পরিবর্তন দরকার?
বোঝা যায় শিক্ষা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ কম। অথচ শিক্ষা একটি মৌলিক চাহিদার বিষয়, অন্ন-বস্ত্রের পরেই শিক্ষার গুরুত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ২২ বছর ধরে সর্বনিম্ন, অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেটা না বাড়িয়ে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
প্রথমত, তহবিলের জোগান দরকার। ইউনেসকোর সুপারিশ হলো, জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দ করা। সেটা বাংলাদেশ কখনোই করে না। মোটামুটি ২ শতাংশের নিচেই থাকে। শিক্ষায় বিনিয়োগ না করলে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। সম্প্রতি যেসব দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হয়েছে, তারা সবাই (যেমন দক্ষিণ কোরিয়া) শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এটা হলো প্রথম ও প্রধান কাজ। এটা না হলে, বাকি আলাপে ঢুকে কোনো লাভ নেই। তাই সেই আলাপে আমি যাচ্ছি না।
শিক্ষার্থীদের সরকারে নেওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের সরকারে যোগদান করাটাকে কি ঠিক মনে করেছেন?
জুলাইয়ে কোনো বিপ্লব হয়নি, হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান। বিপ্লব হলে শিক্ষার্থীরাই পুরো সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু বিপ্লবের পূর্বশর্ত একটি রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন চর্চার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়। দেশব্যাপী তাদের জনসম্পৃক্ততা থাকবে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে এসে গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
তারা সম্ভবত একটা জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে ৪ আগস্টেই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখায় বলেছিলাম, শিক্ষার্থীদের ছায়া সরকার গঠন করতে। তাই তাদের উচিত ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রেখে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সমাজে সক্রিয় হওয়া এবং ছায়া সরকারের মতো করে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বার্তা দেওয়া যে, তারা কী চায়? সরকারে যুক্ত থাকাটা তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি।
শেখ হাসিনা যে করাপ্ট সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, তিনি চলে গেলেও কাঠামো রেখে গেছেন। সেই কাঠামো, সরকারে যুক্ত থাকার সূত্রে তো বটেই, নতুন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের নানান প্রলোভন দেখিয়েছে এবং তাদের অনেকেই তাতে সাড়া দিয়েছে। সরকারে না থাকলেও, ব্যাপারটা ঘটতে পারত, তবে মাত্রাগত অনেক পার্থক্য থাকত। আমরা যাঁরা তাদের সামনে রেখে, চিন্তায় বা লেখায়, সমাজ পরিবর্তনের বাজি ধরেছিলাম, তাঁদের জন্য এ এক অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক পরিস্থিতি।
আপনি কি মনে করেন জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে? যদি মনে হয়ে থাকে, তাহলে কেন হয়েছে বলে মনে করেন?
অনেক কারণ। জুলাই আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একই উদ্দেশ্যে। প্রথমত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে, দ্বিতীয়ত অত্যাচারী শাসকদের পতনের জন্য। বেশ দ্রুতই ব্যাপারটা ঘটে। ফলে হাসিনামুক্ত বাংলাদেশকে কেমন হতে হবে, এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের বোঝাপড়ার সুযোগ হয়নি। কারও চাওয়া ছিল, হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী প্রথার বিলোপ হতে হবে। কারও ছিল, ইসলামি শরিয়াহ কায়েমের পথে এগিয়ে যাওয়া। কেউ ভাবছে, কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরাই যথেষ্ট। যখন আন্দোলনের পরপর একদল ভাবছে, কী করে দ্রুত একটা সরকার গঠন করা যায়, তখন আরেক দল মূর্তি ভাঙা ও মাজার ভাঙায় ব্যস্ত হয়ে গেল। তাদের কাছে কেবল মুজিবের মূর্তি নয়, যেকোনো মূর্তিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। মেয়েরা আন্দোলনে এত বড় ভূমিকা রাখল, অথচ কেউ কেউ ভাবছে, মেয়েদের ঘরে অন্তরীণ করে ফেলতে হবে।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তিনটি রাজনৈতিক পক্ষ—বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি পরস্পর বিবাদ ও বিষোদ্গারে ব্যস্ত এখন। আন্দোলন একসঙ্গে করলেও, একজন অন্য জনের চাওয়ার কথা ভাবেনি, সব পক্ষই নিজেদের ভাবনাতেই মশগুল থাকছে। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে যখন অনেক ভাঙচুর হচ্ছে, একপক্ষ আরেকপক্ষকে আক্রমণ করছে, পিটিয়ে মেরে ফেলছে—এসব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার যারা বেশি পেশি প্রদর্শন করেছে, তাদের দাবিই মেনেছে, সে দাবি অগণতান্ত্রিক ও আইনবিরোধী হলেও ফলেছে। সে হিসেবে গত এক বছরে ডানপন্থীদের কথাই বেশি শুনেছে সরকার। গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসেনি, বরং সরকার তার কাজের মাধ্যমে ডানপন্থীদের জয়যাত্রায় সায় দিয়েছে।
এই আন্দোলনে শিক্ষকেরা সক্রিয় ছিলেন, এখন তাঁরা নতুন সময়ে কী ধরনের অবদান রাখতে পারেন? তাঁদের কি সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে?
গোলমেলে পরিস্থিতিতে, নির্লজ্জভাবে নিজেদের কথা বলার প্রয়োজন তৈরি হয়। হাসিনা সরকারের পুরোটা সময়ে শিক্ষকদের একটি পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতায় যুক্ত ছিল, তা হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসের হাজারো অনিয়মের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখেননি। বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা কিন্তু রাজধানীতে ও গ্রামগঞ্জে নানান অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন, অনেক
জুলুম সয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষকেরা তেমন কিছুই করেননি। এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সাদা দলের ছিল তিন-চার শ শিক্ষক। তাঁরা সাদা প্যানেলে নিয়মিত নির্বাচন করা ছাড়া, কোনো একটা প্রতিবাদ সমাবেশও করেননি। শিক্ষক নেটওয়ার্ক মাঝে মাঝে ‘নিপীড়নবিরোধী’ ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করলে, সাদা দলের শিক্ষকেরা পেছনে এসে দাঁড়াতেন। এমনকি জুলাইয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে তাঁরা নিজেদের ব্যানার খুলে দাঁড়ানোর সাহস করেছেন।
কিন্তু আন্দোলন শেষ হলে, আগের সব ভিসি-প্রোভিসি পদত্যাগ করলে, তাঁরা শূন্য আসনগুলো পূরণে তৎপর হয়ে ওঠেন, ধীরে ধীরে সব দখলও করেন। আর রুদ্ধ সময়ের সক্রিয় পক্ষটিকে, নতুন সময়ে সম্মান দেখানো হয়নি। দু-চারজনকে অল্প কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব অর্পণ করে আবার প্রত্যাহারও করা হয়েছে। দেশের বাঁধনছাড়া ডানপন্থী অংশটি তাঁদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’, ‘নারীবাদী’, ‘শাহবাগি’, ‘বাকশালি’, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ইত্যাদি বলে গেছে। শিক্ষার্থীদের নেতারা, যাঁরা নানান সময়ে এসব শিক্ষকের কাছ থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন, তাঁরাও এসব শিক্ষককে অসম্মান থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
এখন দলীয় যেসব শিক্ষক দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারেন। নেটওয়ার্কের সদস্যরা আবার পুরোনো অ্যাকটিভিজমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা সেটা চালিয়ে যেতে পারেন। সব দল-মতের শিক্ষকেরা তাঁদের (পাঠদান ও গবেষণার) পেশাগত দায়িত্বটি ঠিকমতো পালন করবেন, শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখবেন, আর জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখবেন—এই হলো আমার প্রত্যাশা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে কেন যুক্ত হয়েছিলেন?
২০১৮ সালে প্রথম যে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হয়, তাতেও যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তো আমরা দেখেছি যে, একটা দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ যে আন্দোলন চলছিল, ছাত্রলীগ-পুলিশ সেখানে হামলা করছে। আন্দোলনকারীরা আহত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, জেল খাটছে। আমরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর এসব জুলুম দেখে বসে থাকতে পারি না। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছি। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে নানান কর্মসূচি পালন করেছি–বিবৃতি, পদযাত্রা, প্রতিবাদ সমাবেশ ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে আমাদের ওপরও নানারূপী আক্রমণ এসেছে। আমাকে একবার প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ ও শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের গুন্ডারা হেনস্তা করেছে। আমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন আমারই এক সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আমাদের প্রমোশন ও ন্যায্য সুবিধাদির ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা বিবেচনা করে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের যে দাবি, তা ন্যায্য ছিল। তিন প্রজন্ম পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থাকার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরির মোট ৫৬ শতাংশ কোটায় যাবে, তা মানা যায় না। তাই ২০১৮ সালে ওই আন্দোলনে আমরা সমর্থন দিয়েছি। ২০২৪ সালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে ২০২৪-এর আন্দোলনের জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করা যায়। ২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কারের, কমিয়ে ১০ শতাংশের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা পুরো কোটা প্রথাই উঠিয়ে দেন। পরে মামলা হলে কোটার বিষয়টি আবার ফিরে আসে ২০২৪ সালে।
বিদেশে অবস্থান করেও এ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। এক বছর পর জুলাই আন্দোলনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডিজিটাল যুগে পরিসরের ধারণা আর আগের মতো নেই। বিদেশে থেকে বহু মানুষই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দেশে মতপ্রকাশের পরিস্থিতি সংকুচিত থাকায় অনেক সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট বিদেশে থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বন্ধ করে দিয়ে ভালো ইমপ্যাক্ট ফেলেছিলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সৌন্দর্য ছিল, পুরো জাতি এক স্বৈরাচারী সরকার ও মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীদেরও অনেকে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড সইতে না পেরে, বিলম্বে হলেও আন্দোলনে যোগ দেন। তাই একে ‘পুরো জাতির ঐক্য’ বলাই যায়। কিন্তু স্বৈরাচারের পলায়নের পর সেই ঐক্য এক দিনও অটুট থাকেনি, সেটা হলো এক হতাশাজনক বাস্তবতা। যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো, দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের অঙ্গীকার পূরণে অনেকখানি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয়ের কোনোটিই এক বছরে আংশিকভাবেও অর্জিত হয়নি। এক বছরে বোঝা গিয়েছে, রাতারাতি বদলে যাবে না বাংলাদেশ। বরং পরিবর্তনের পথটি দীর্ঘ ও ধীরগতির।
অনেক বিষয়ে কমিশন হলো, শিক্ষা বিষয়ে হলো না। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের কোন ধরনের পরিবর্তন দরকার?
বোঝা যায় শিক্ষা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ কম। অথচ শিক্ষা একটি মৌলিক চাহিদার বিষয়, অন্ন-বস্ত্রের পরেই শিক্ষার গুরুত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ২২ বছর ধরে সর্বনিম্ন, অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেটা না বাড়িয়ে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
প্রথমত, তহবিলের জোগান দরকার। ইউনেসকোর সুপারিশ হলো, জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দ করা। সেটা বাংলাদেশ কখনোই করে না। মোটামুটি ২ শতাংশের নিচেই থাকে। শিক্ষায় বিনিয়োগ না করলে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। সম্প্রতি যেসব দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হয়েছে, তারা সবাই (যেমন দক্ষিণ কোরিয়া) শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এটা হলো প্রথম ও প্রধান কাজ। এটা না হলে, বাকি আলাপে ঢুকে কোনো লাভ নেই। তাই সেই আলাপে আমি যাচ্ছি না।
শিক্ষার্থীদের সরকারে নেওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের সরকারে যোগদান করাটাকে কি ঠিক মনে করেছেন?
জুলাইয়ে কোনো বিপ্লব হয়নি, হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান। বিপ্লব হলে শিক্ষার্থীরাই পুরো সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু বিপ্লবের পূর্বশর্ত একটি রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন চর্চার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়। দেশব্যাপী তাদের জনসম্পৃক্ততা থাকবে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে এসে গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
তারা সম্ভবত একটা জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে ৪ আগস্টেই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখায় বলেছিলাম, শিক্ষার্থীদের ছায়া সরকার গঠন করতে। তাই তাদের উচিত ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রেখে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সমাজে সক্রিয় হওয়া এবং ছায়া সরকারের মতো করে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বার্তা দেওয়া যে, তারা কী চায়? সরকারে যুক্ত থাকাটা তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি।
শেখ হাসিনা যে করাপ্ট সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, তিনি চলে গেলেও কাঠামো রেখে গেছেন। সেই কাঠামো, সরকারে যুক্ত থাকার সূত্রে তো বটেই, নতুন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের নানান প্রলোভন দেখিয়েছে এবং তাদের অনেকেই তাতে সাড়া দিয়েছে। সরকারে না থাকলেও, ব্যাপারটা ঘটতে পারত, তবে মাত্রাগত অনেক পার্থক্য থাকত। আমরা যাঁরা তাদের সামনে রেখে, চিন্তায় বা লেখায়, সমাজ পরিবর্তনের বাজি ধরেছিলাম, তাঁদের জন্য এ এক অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক পরিস্থিতি।
আপনি কি মনে করেন জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে? যদি মনে হয়ে থাকে, তাহলে কেন হয়েছে বলে মনে করেন?
অনেক কারণ। জুলাই আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একই উদ্দেশ্যে। প্রথমত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে, দ্বিতীয়ত অত্যাচারী শাসকদের পতনের জন্য। বেশ দ্রুতই ব্যাপারটা ঘটে। ফলে হাসিনামুক্ত বাংলাদেশকে কেমন হতে হবে, এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের বোঝাপড়ার সুযোগ হয়নি। কারও চাওয়া ছিল, হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী প্রথার বিলোপ হতে হবে। কারও ছিল, ইসলামি শরিয়াহ কায়েমের পথে এগিয়ে যাওয়া। কেউ ভাবছে, কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরাই যথেষ্ট। যখন আন্দোলনের পরপর একদল ভাবছে, কী করে দ্রুত একটা সরকার গঠন করা যায়, তখন আরেক দল মূর্তি ভাঙা ও মাজার ভাঙায় ব্যস্ত হয়ে গেল। তাদের কাছে কেবল মুজিবের মূর্তি নয়, যেকোনো মূর্তিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। মেয়েরা আন্দোলনে এত বড় ভূমিকা রাখল, অথচ কেউ কেউ ভাবছে, মেয়েদের ঘরে অন্তরীণ করে ফেলতে হবে।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তিনটি রাজনৈতিক পক্ষ—বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি পরস্পর বিবাদ ও বিষোদ্গারে ব্যস্ত এখন। আন্দোলন একসঙ্গে করলেও, একজন অন্য জনের চাওয়ার কথা ভাবেনি, সব পক্ষই নিজেদের ভাবনাতেই মশগুল থাকছে। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে যখন অনেক ভাঙচুর হচ্ছে, একপক্ষ আরেকপক্ষকে আক্রমণ করছে, পিটিয়ে মেরে ফেলছে—এসব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার যারা বেশি পেশি প্রদর্শন করেছে, তাদের দাবিই মেনেছে, সে দাবি অগণতান্ত্রিক ও আইনবিরোধী হলেও ফলেছে। সে হিসেবে গত এক বছরে ডানপন্থীদের কথাই বেশি শুনেছে সরকার। গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসেনি, বরং সরকার তার কাজের মাধ্যমে ডানপন্থীদের জয়যাত্রায় সায় দিয়েছে।
এই আন্দোলনে শিক্ষকেরা সক্রিয় ছিলেন, এখন তাঁরা নতুন সময়ে কী ধরনের অবদান রাখতে পারেন? তাঁদের কি সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে?
গোলমেলে পরিস্থিতিতে, নির্লজ্জভাবে নিজেদের কথা বলার প্রয়োজন তৈরি হয়। হাসিনা সরকারের পুরোটা সময়ে শিক্ষকদের একটি পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতায় যুক্ত ছিল, তা হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসের হাজারো অনিয়মের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখেননি। বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা কিন্তু রাজধানীতে ও গ্রামগঞ্জে নানান অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন, অনেক
জুলুম সয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষকেরা তেমন কিছুই করেননি। এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সাদা দলের ছিল তিন-চার শ শিক্ষক। তাঁরা সাদা প্যানেলে নিয়মিত নির্বাচন করা ছাড়া, কোনো একটা প্রতিবাদ সমাবেশও করেননি। শিক্ষক নেটওয়ার্ক মাঝে মাঝে ‘নিপীড়নবিরোধী’ ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করলে, সাদা দলের শিক্ষকেরা পেছনে এসে দাঁড়াতেন। এমনকি জুলাইয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে তাঁরা নিজেদের ব্যানার খুলে দাঁড়ানোর সাহস করেছেন।
কিন্তু আন্দোলন শেষ হলে, আগের সব ভিসি-প্রোভিসি পদত্যাগ করলে, তাঁরা শূন্য আসনগুলো পূরণে তৎপর হয়ে ওঠেন, ধীরে ধীরে সব দখলও করেন। আর রুদ্ধ সময়ের সক্রিয় পক্ষটিকে, নতুন সময়ে সম্মান দেখানো হয়নি। দু-চারজনকে অল্প কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব অর্পণ করে আবার প্রত্যাহারও করা হয়েছে। দেশের বাঁধনছাড়া ডানপন্থী অংশটি তাঁদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’, ‘নারীবাদী’, ‘শাহবাগি’, ‘বাকশালি’, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ইত্যাদি বলে গেছে। শিক্ষার্থীদের নেতারা, যাঁরা নানান সময়ে এসব শিক্ষকের কাছ থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন, তাঁরাও এসব শিক্ষককে অসম্মান থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
এখন দলীয় যেসব শিক্ষক দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারেন। নেটওয়ার্কের সদস্যরা আবার পুরোনো অ্যাকটিভিজমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা সেটা চালিয়ে যেতে পারেন। সব দল-মতের শিক্ষকেরা তাঁদের (পাঠদান ও গবেষণার) পেশাগত দায়িত্বটি ঠিকমতো পালন করবেন, শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখবেন, আর জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখবেন—এই হলো আমার প্রত্যাশা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
৪ ঘণ্টা আগেমধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
৪ ঘণ্টা আগে‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো।
৪ ঘণ্টা আগেদক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।
৪ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়
গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!
গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!
ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা..
২৪ আগস্ট ২০২৫মধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
৪ ঘণ্টা আগে‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো।
৪ ঘণ্টা আগেদক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।
৪ ঘণ্টা আগেরাজিউল হাসান
মধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধে দেশটির ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া। প্রথমে সামরিক শক্তির জোরে উপদ্বীপটি দখল করা হয়েছে, তারপর গণভোট দিয়ে সেই দখলকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এবার ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল মোটামুটি দখলে চলে গেছে রাশিয়ার কাছে। এখন যুদ্ধ থামাতে এই অঞ্চলকে রাশিয়ার কাছে সমর্পণের শর্ত হাজির করা হয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে। ক্রিমিয়া দখলের সময় রাশিয়ার পাশে কেউ ছিল না। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রও কড়া অবস্থান নিয়েছিল মস্কোর বিরুদ্ধে। তারপরও ঠেকানো যায়নি। এবার অবস্থা ভিন্ন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন ইউক্রেনের বিষয়ে খানিকটা বৈরী মনোভাবাপন্ন। তাঁর তরফ থেকেই দনবাস সমর্পণের প্রস্তাব গেছে ইউক্রেনের কাছে। ফলে এবারও যে রাশিয়া দনবাস দখল করে নেবে, সে ব্যাপারে আপাতত কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জেলেনস্কির জন্য এই যুদ্ধ যেমন বড় চাপ, একইভাবে দনবাস সমর্পণ হবে তাঁর জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যা।
রাশিয়া-ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে কিছুটা পেছন ফিরে তাকাতে হবে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর ইউক্রেনের স্বাধীন দেশ হিসেবে পথচলা শুরু হয়। কিন্তু ‘পৃথিবীর রুটির ঝুড়ি’খ্যাত দেশটির বড় দুর্ভাগ্য, তারা এক পরাশক্তির প্রতিবেশী। প্রতিবেশী শক্তিশালী ও ভালো হলে কিছু সুবিধা অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিবেশী যদি বৈরী হয়, তাহলে যেকোনো দেশের জন্যই একসময় তা বড় ধরনের হুমকি হয়ে ওঠে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আবার পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন বরাবরই প্রতিবেশীদের জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করছে। তার ওপর ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশটির বেশির ভাগ রাজনীতিকেরই মনোযোগ রাশিয়ার মতো পরাক্রমশালী প্রতিবেশীকে নিজের পক্ষে রাখা নয়, যেকোনো মূল্যে তাকে ঠেকানো। বিশেষ করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দেশের প্রতিরক্ষার কথা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাঁর এই প্রত্যাশা আরও চড়িয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু রাশিয়া তো তার দোরগোড়ায় ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন মানবে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। জেলেনস্কির তৎপরতার ছুতোয় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ফের ইউক্রেনে তথাকথিত রুশ অভিযান শুরু হয়, যা এখনো চলছে।
বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, গত প্রায় চার বছরে রাশিয়া ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। দনবাস অঞ্চলের সিংহভাগ এখন রুশ নিয়ন্ত্রণে। ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক এবং কৃষ্ণসাগর-তীরবর্তী মারিউপোল বন্দর নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে গেলে ক্রিমিয়ার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। এ কারণেই রাশিয়ার জন্য এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু জেলেনস্কি এই অঞ্চল সমর্পণ করতে নারাজ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রতি কিছুটা হলেও নমনীয়। যুদ্ধ থামাতে তিনি রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানা হুমকি দিয়েছেন, রুশ তেল না কিনতে ইউরোপীয় মিত্র এবং ভারত ও চীনকে বারবার সতর্ক করে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত মস্কোর বিরুদ্ধে বড় কোনো পদক্ষেপ তিনি নেননি। বরং তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা দেশগুলোর ওপর চাপিয়েছেন বাড়তি শুল্ক। তাঁর উদ্দেশ্য রুশ তেলের বিপণন কমিয়ে দেশটির আর্থিক শক্তি কমিয়ে আনা। তবে কূটনৈতিকভাবে তিনি এখনো পুতিনের প্রতি নমনীয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র পেতে জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন। সেই ক্ষেপণাস্ত্র তো তিনি পানইনি, বরং এবারও ‘অপমানিত’ হয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। ট্রাম্প এ সময় তাঁকে উল্টো যুদ্ধ থামাতে দনবাস সমর্পণ করতে বলেছেন। এর আগেও ট্রাম্প এমন কথা বলেছেন জেলেনস্কিকে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হোয়াইট হাউসে একবার অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। সেবার প্রকাশ্যে অপমান করলেও এবার তেমনটা ঘটেনি। তবে সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এবারও জেলেনস্কিকে ‘ধমক’ দিয়েছেন ট্রাম্প।
জেলেনস্কির এবারের হোয়াইট হাউস সফরের এক দিন আগেই পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। সেই আলোচনার পর ফের সরাসরি সাক্ষাতের ঘোষণা আসে তাঁদের তরফ থেকে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে এবার আর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নয়, ট্রাম্প-পুতিন দেখা হবে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। কিন্তু এটিও জেলেনস্কির জন্য বড় দুঃসংবাদ। কারণ, হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবান পুতিনের বড় সমর্থক। কাজেই এই আলোচনায়ও যে ইউক্রেনের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না, তা আগেভাগেই অনুমান করা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও জেলেনস্কি ওই বৈঠকে থাকতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁকে যদি আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে তিনি বৈঠকে থাকতে চান।
তবে যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা, জেলেনস্কির কূটনৈতিক তৎপরতার ফলাফল যদি দনবাস সমর্পণ হয়, তাহলে তা হবে ইউক্রেন ও তার জনগণের জন্য বড় ক্ষতি। পাশাপাশি সারা বিশ্বের জন্যও অশনিসংকেত হবে সেটি। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের পর এরই মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে লাখো ইউক্রেনীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ফলে জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ বেড়েছে। তার ওপর ইউক্রেনকে লাগাতার নানাভাবে সহায়তা দিতে গিয়ে ইউরোপের দেশগুলোকে পড়তে হয়েছে আর্থিক চাপে। এমন ক্ষতি স্বীকার করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনকে যদি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল সমর্পণ করতে হয়, তাহলে গোটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য তা হবে বড় এক পরাজয়।
এদিকে রাশিয়ার এভাবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া যদি বৈধতা পেয়ে যায়, তখন বাকি বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও ‘নিপীড়ক’ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নানা ঝক্কি সামলাতে হয়। তার ওপর ভূখণ্ড দখলের উদাহরণ সৃষ্টি হলে হুমকিতে পড়বে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা। ফলে বিশ্বজুড়ে বাড়বে অবিশ্বাস, তৈরি হবে অস্থিরতা। তার সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের ওপর। বেড়ে যাবে সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ। কিন্তু আধুনিক যুগে এমনটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধে দেশটির ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া। প্রথমে সামরিক শক্তির জোরে উপদ্বীপটি দখল করা হয়েছে, তারপর গণভোট দিয়ে সেই দখলকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এবার ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল মোটামুটি দখলে চলে গেছে রাশিয়ার কাছে। এখন যুদ্ধ থামাতে এই অঞ্চলকে রাশিয়ার কাছে সমর্পণের শর্ত হাজির করা হয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে। ক্রিমিয়া দখলের সময় রাশিয়ার পাশে কেউ ছিল না। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রও কড়া অবস্থান নিয়েছিল মস্কোর বিরুদ্ধে। তারপরও ঠেকানো যায়নি। এবার অবস্থা ভিন্ন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন ইউক্রেনের বিষয়ে খানিকটা বৈরী মনোভাবাপন্ন। তাঁর তরফ থেকেই দনবাস সমর্পণের প্রস্তাব গেছে ইউক্রেনের কাছে। ফলে এবারও যে রাশিয়া দনবাস দখল করে নেবে, সে ব্যাপারে আপাতত কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জেলেনস্কির জন্য এই যুদ্ধ যেমন বড় চাপ, একইভাবে দনবাস সমর্পণ হবে তাঁর জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যা।
রাশিয়া-ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে কিছুটা পেছন ফিরে তাকাতে হবে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর ইউক্রেনের স্বাধীন দেশ হিসেবে পথচলা শুরু হয়। কিন্তু ‘পৃথিবীর রুটির ঝুড়ি’খ্যাত দেশটির বড় দুর্ভাগ্য, তারা এক পরাশক্তির প্রতিবেশী। প্রতিবেশী শক্তিশালী ও ভালো হলে কিছু সুবিধা অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিবেশী যদি বৈরী হয়, তাহলে যেকোনো দেশের জন্যই একসময় তা বড় ধরনের হুমকি হয়ে ওঠে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আবার পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন বরাবরই প্রতিবেশীদের জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করছে। তার ওপর ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশটির বেশির ভাগ রাজনীতিকেরই মনোযোগ রাশিয়ার মতো পরাক্রমশালী প্রতিবেশীকে নিজের পক্ষে রাখা নয়, যেকোনো মূল্যে তাকে ঠেকানো। বিশেষ করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দেশের প্রতিরক্ষার কথা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাঁর এই প্রত্যাশা আরও চড়িয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু রাশিয়া তো তার দোরগোড়ায় ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন মানবে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। জেলেনস্কির তৎপরতার ছুতোয় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ফের ইউক্রেনে তথাকথিত রুশ অভিযান শুরু হয়, যা এখনো চলছে।
বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, গত প্রায় চার বছরে রাশিয়া ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। দনবাস অঞ্চলের সিংহভাগ এখন রুশ নিয়ন্ত্রণে। ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক এবং কৃষ্ণসাগর-তীরবর্তী মারিউপোল বন্দর নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে গেলে ক্রিমিয়ার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। এ কারণেই রাশিয়ার জন্য এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু জেলেনস্কি এই অঞ্চল সমর্পণ করতে নারাজ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রতি কিছুটা হলেও নমনীয়। যুদ্ধ থামাতে তিনি রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানা হুমকি দিয়েছেন, রুশ তেল না কিনতে ইউরোপীয় মিত্র এবং ভারত ও চীনকে বারবার সতর্ক করে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত মস্কোর বিরুদ্ধে বড় কোনো পদক্ষেপ তিনি নেননি। বরং তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা দেশগুলোর ওপর চাপিয়েছেন বাড়তি শুল্ক। তাঁর উদ্দেশ্য রুশ তেলের বিপণন কমিয়ে দেশটির আর্থিক শক্তি কমিয়ে আনা। তবে কূটনৈতিকভাবে তিনি এখনো পুতিনের প্রতি নমনীয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র পেতে জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন। সেই ক্ষেপণাস্ত্র তো তিনি পানইনি, বরং এবারও ‘অপমানিত’ হয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। ট্রাম্প এ সময় তাঁকে উল্টো যুদ্ধ থামাতে দনবাস সমর্পণ করতে বলেছেন। এর আগেও ট্রাম্প এমন কথা বলেছেন জেলেনস্কিকে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হোয়াইট হাউসে একবার অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। সেবার প্রকাশ্যে অপমান করলেও এবার তেমনটা ঘটেনি। তবে সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এবারও জেলেনস্কিকে ‘ধমক’ দিয়েছেন ট্রাম্প।
জেলেনস্কির এবারের হোয়াইট হাউস সফরের এক দিন আগেই পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। সেই আলোচনার পর ফের সরাসরি সাক্ষাতের ঘোষণা আসে তাঁদের তরফ থেকে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে এবার আর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নয়, ট্রাম্প-পুতিন দেখা হবে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। কিন্তু এটিও জেলেনস্কির জন্য বড় দুঃসংবাদ। কারণ, হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবান পুতিনের বড় সমর্থক। কাজেই এই আলোচনায়ও যে ইউক্রেনের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না, তা আগেভাগেই অনুমান করা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও জেলেনস্কি ওই বৈঠকে থাকতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁকে যদি আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে তিনি বৈঠকে থাকতে চান।
তবে যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা, জেলেনস্কির কূটনৈতিক তৎপরতার ফলাফল যদি দনবাস সমর্পণ হয়, তাহলে তা হবে ইউক্রেন ও তার জনগণের জন্য বড় ক্ষতি। পাশাপাশি সারা বিশ্বের জন্যও অশনিসংকেত হবে সেটি। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের পর এরই মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে লাখো ইউক্রেনীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ফলে জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ বেড়েছে। তার ওপর ইউক্রেনকে লাগাতার নানাভাবে সহায়তা দিতে গিয়ে ইউরোপের দেশগুলোকে পড়তে হয়েছে আর্থিক চাপে। এমন ক্ষতি স্বীকার করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনকে যদি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল সমর্পণ করতে হয়, তাহলে গোটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য তা হবে বড় এক পরাজয়।
এদিকে রাশিয়ার এভাবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া যদি বৈধতা পেয়ে যায়, তখন বাকি বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও ‘নিপীড়ক’ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নানা ঝক্কি সামলাতে হয়। তার ওপর ভূখণ্ড দখলের উদাহরণ সৃষ্টি হলে হুমকিতে পড়বে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা। ফলে বিশ্বজুড়ে বাড়বে অবিশ্বাস, তৈরি হবে অস্থিরতা। তার সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের ওপর। বেড়ে যাবে সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ। কিন্তু আধুনিক যুগে এমনটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা..
২৪ আগস্ট ২০২৫হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
৪ ঘণ্টা আগে‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো।
৪ ঘণ্টা আগেদক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।
৪ ঘণ্টা আগেআব্দুর রহমান
‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো। যেগুলোর নাম অধিকাংশ মানুষই শোনেনি, যা বিশ্বের প্রযুক্তি, সামরিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
রেয়ার আর্থ মিনারেলস বা বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো বলতে সাধারণত নিওডিমিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, টার্বিয়ামের মতো ১৭টি ধাতব পদার্থকে বোঝায়। এগুলো রকেট, যুদ্ধবিমান, স্মার্টফোন, ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর, উইন্ড টারবাইন, সোলার প্যানেল, স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থা, এমনকি মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমসহ নানা যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। একুশ শতকের শিল্প ও সামরিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে এই খনিজগুলো পুরোপুরি নির্ভরশীল।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিরল খনিজকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ তীব্র হয়েছে। তিনি চীনকে প্রতিরোধের নতুন সূত্র হিসেবে এই খনিজের জোগান ও নিয়ন্ত্রণের ওপর মনোযোগ দিচ্ছেন। এরই মধ্যে চীনের মিত্র পাকিস্তান ও খনিজসমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়াশিংটন সম্পর্ক জোরদার করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা মিয়ানমারের বিরল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখছেন, বিনিয়োগ ও সরবরাহ চুক্তির সম্ভাবনা খুঁজছেন। এমনকি দেশটির জান্তা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভের জন্য এই বিরল খনিজকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন তৎপরতা নিছক অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
চীনও থেমে নেই। দেশটি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল ভবিষ্যতের যুদ্ধের রণক্ষেত্র হবে ভূগর্ভ। ১৯৯২ সালে তৎকালীন নেতা দেং জিয়াওপিং বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের তেল আছে, আর চীনের আছে বিরল খনিজ।’ সেই কথার অর্থ আজ পরিষ্কার হচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিরল খনিজের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, আর পরিশোধনের ৯০ শতাংশ সম্পূর্ণ তাদের হাতে। এর মানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা জাপান কোথাও খনিজ আবিষ্কার করলেও সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায়ই চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ, খনিজকে বাজারযোগ্য অবস্থায় আনতে যে প্রযুক্তি, শ্রম ও পরিবেশগত অবকাঠামো দরকার, তা চীনের বাইরে তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে যুদ্ধবিমান, রকেট থেকে ব্যাটারি, প্রতিটি উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রে এই খনিজ অপরিহার্য। তাই চীন চাইলে বৈশ্বিক শিল্পপ্রবাহের শিরা বন্ধ করে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে প্রযুক্তিগতভাবে অচল করে দিতে পারে।
চীন প্রথমে খনিজকে অস্ত্রে পরিণত করতে না চাইলেও ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনকে সেই পথে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের রপ্তানিতে শতভাগের বেশি শুল্ক বসানোর পর বেইজিংও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। মার্কিন প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে চীন ঘোষণা করে, চীনা বা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি চীনের বিরল খনিজ বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামরিক উদ্দেশ্যে কিছু তৈরি করতে চায়, তবে বেইজিংয়ের অনুমতি লাগবে। আর এই ঘোষণার পেছনে আছে ক্ষমতার প্রশ্ন। চীন জানে, বিশ্ব এখন তাদের খনিজের ওপর নির্ভরশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখন নাজুক। তাদের সামরিক প্রযুক্তি, যেমন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, রাডারব্যবস্থা কিংবা মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেম বা ক্ষেপণাস্ত্র নির্দেশক প্রযুক্তি—সবই বিরল খনিজের ওপর নির্ভরশীল। একেকটি এফ-৩৫ বিমান তৈরিতে লাগে প্রায় ৪০০ কেজি বিরল মৃত্তিকা খনিজ, যার অধিকাংশই আসে চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সফটওয়্যার কোম্পানি গোভিনির গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১,৯০৮টি অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৮০ হাজার উপাদান সরাসরি চীনা খনিজের ওপর নির্ভরশীল। এই পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্পের ভঙ্গুর বাস্তবতাকে প্রকাশ করে।
ইউরোপও একই সংকটে আছে। জার্মানির গাড়িশিল্প, ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন—সবই চীনের সরবরাহের কাছে বাঁধা। অথচ বিকল্প জোগান গড়ে তোলার মতো প্রযুক্তি, অর্থ বা সময় তাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন মরিয়া হয়ে আফ্রিকার দেশগুলো যেমন অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, তানজানিয়া ও মোজাম্বিকে নতুন খনিজ উৎস খুঁজছে। এমনকি লাতিন আমেরিকাতেও তাদের নজর আছে। সেখানে পশ্চিমা জোটের অর্থায়নে গড়ে তোলা হচ্ছে সড়ক, রেল ও বন্দর, যাতে ভবিষ্যতে চীনের বিকল্প সরবরাহ পথ তৈরি করা যায়।
বিরল খনিজকে কেন্দ্র করে চীনের কৌশলগত বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসনও পাল্টা খেলায় নেমেছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফাচ্ছন্ন ভূমি থেকে শুরু করে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত খনিজ অঞ্চল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নজর দিচ্ছে নতুন খনিজ খাত দখলে। অস্ট্রেলিয়ায় বিনিয়োগ চুক্তি, পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে অনুসন্ধান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কূটনৈতিক দর-কষাকষি—সবই একই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।
এরই অংশ হিসেবে ‘ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট’-এর আওতায় ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র রেয়ার আর্থ খাতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। দেশটি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নতুন খনি প্রকল্প সন্ধানে নেমেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ‘ক্রিটিক্যাল র ম্যাটেরিয়ালস অ্যাক্ট’ পাস করে চীনের বিকল্প সরবরাহশৃঙ্খল তৈরির চেষ্টা করছে।
এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের অস্ত্র পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়, বরং মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, ডিসপোরিয়াম আর ইট্রিয়ামের মতো ধাতু। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে থাকবে এই ধাতুগুলোর ওপর। চীন এখন বুঝে গেছে, যুদ্ধ না করেও আধিপত্য কায়েম করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রও তা বুঝে গেছে, কিন্তু তাদের হাতে সময় কম।
পৃথিবী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ‘সবুজ জ্বালানির’ দিকে ঝুঁকছে, তখন এই খনিজগুলোর চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। একেকটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে প্রায় ১০ কেজি রেয়ার আর্থ মিনারেলস লাগে, একটি উইন্ড টারবাইনে প্রয়োজন ৬০০ কেজিরও বেশি। ফলে ‘সবুজবিপ্লব’ যত দ্রুত এগোচ্ছে, ততই রেয়ার আর্থের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।
এই নির্ভরতা নতুন উপনিবেশবাদের রূপ নিচ্ছে। আফ্রিকার কঙ্গো, জাম্বিয়া, নামিবিয়া, লাতিন আমেরিকার চিলি ও বলিভিয়া—সবখানে এখন খনিজের নামে বিদেশি বিনিয়োগের হিড়িক। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ—সবাই একে অপরকে টপকে খনি, রপ্তানি অধিকার ও অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। স্থানীয় জনগণ পাচ্ছে দূষণ, স্থানচ্যুতি আর ঋণচক্রের শৃঙ্খল।
ভবিষ্যতের যুদ্ধ মিসাইল দিয়ে নয়, সরবরাহ চেইনের দখল দিয়ে হবে। যে রাষ্ট্রের হাতে থাকবে রেয়ার আর্থ মিনারেলসের প্রবাহ, সেই দেশই নির্ধারণ করবে কারা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে, কারা জ্বালানি উৎপাদন করবে, এমনকি কারা যুদ্ধ করবে।
চীন এখন এই সরবরাহ-শৃঙ্খলের প্রভু। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধে মরিয়া। ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের অবস্থান খুঁজছে—কেউ চীনের সঙ্গে সমঝোতায়, কেউ আমেরিকার সঙ্গে জোটে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—এ প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত মানবতার উপকারে আসবে, নাকি নতুন এক খনিজ সাম্রাজ্যের জন্ম দেবে? তবে সবুজ শক্তির নামে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা যদি পরিবেশবিধ্বংস, দারিদ্র্য আর বৈষম্যই বাড়ায়, তবে এই রেয়ার আর্থ আসলে আধুনিক সভ্যতার নতুন শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়াবে। ইতিহাস ইঙ্গিত দেয়, এই প্রতিযোগিতা দ্রুত শেষ হবে না।
‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো। যেগুলোর নাম অধিকাংশ মানুষই শোনেনি, যা বিশ্বের প্রযুক্তি, সামরিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
রেয়ার আর্থ মিনারেলস বা বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো বলতে সাধারণত নিওডিমিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, টার্বিয়ামের মতো ১৭টি ধাতব পদার্থকে বোঝায়। এগুলো রকেট, যুদ্ধবিমান, স্মার্টফোন, ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর, উইন্ড টারবাইন, সোলার প্যানেল, স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থা, এমনকি মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমসহ নানা যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। একুশ শতকের শিল্প ও সামরিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে এই খনিজগুলো পুরোপুরি নির্ভরশীল।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিরল খনিজকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ তীব্র হয়েছে। তিনি চীনকে প্রতিরোধের নতুন সূত্র হিসেবে এই খনিজের জোগান ও নিয়ন্ত্রণের ওপর মনোযোগ দিচ্ছেন। এরই মধ্যে চীনের মিত্র পাকিস্তান ও খনিজসমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়াশিংটন সম্পর্ক জোরদার করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা মিয়ানমারের বিরল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখছেন, বিনিয়োগ ও সরবরাহ চুক্তির সম্ভাবনা খুঁজছেন। এমনকি দেশটির জান্তা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভের জন্য এই বিরল খনিজকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন তৎপরতা নিছক অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
চীনও থেমে নেই। দেশটি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল ভবিষ্যতের যুদ্ধের রণক্ষেত্র হবে ভূগর্ভ। ১৯৯২ সালে তৎকালীন নেতা দেং জিয়াওপিং বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের তেল আছে, আর চীনের আছে বিরল খনিজ।’ সেই কথার অর্থ আজ পরিষ্কার হচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিরল খনিজের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, আর পরিশোধনের ৯০ শতাংশ সম্পূর্ণ তাদের হাতে। এর মানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা জাপান কোথাও খনিজ আবিষ্কার করলেও সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায়ই চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ, খনিজকে বাজারযোগ্য অবস্থায় আনতে যে প্রযুক্তি, শ্রম ও পরিবেশগত অবকাঠামো দরকার, তা চীনের বাইরে তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে যুদ্ধবিমান, রকেট থেকে ব্যাটারি, প্রতিটি উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রে এই খনিজ অপরিহার্য। তাই চীন চাইলে বৈশ্বিক শিল্পপ্রবাহের শিরা বন্ধ করে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে প্রযুক্তিগতভাবে অচল করে দিতে পারে।
চীন প্রথমে খনিজকে অস্ত্রে পরিণত করতে না চাইলেও ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনকে সেই পথে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের রপ্তানিতে শতভাগের বেশি শুল্ক বসানোর পর বেইজিংও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। মার্কিন প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে চীন ঘোষণা করে, চীনা বা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি চীনের বিরল খনিজ বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামরিক উদ্দেশ্যে কিছু তৈরি করতে চায়, তবে বেইজিংয়ের অনুমতি লাগবে। আর এই ঘোষণার পেছনে আছে ক্ষমতার প্রশ্ন। চীন জানে, বিশ্ব এখন তাদের খনিজের ওপর নির্ভরশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখন নাজুক। তাদের সামরিক প্রযুক্তি, যেমন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, রাডারব্যবস্থা কিংবা মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেম বা ক্ষেপণাস্ত্র নির্দেশক প্রযুক্তি—সবই বিরল খনিজের ওপর নির্ভরশীল। একেকটি এফ-৩৫ বিমান তৈরিতে লাগে প্রায় ৪০০ কেজি বিরল মৃত্তিকা খনিজ, যার অধিকাংশই আসে চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সফটওয়্যার কোম্পানি গোভিনির গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১,৯০৮টি অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৮০ হাজার উপাদান সরাসরি চীনা খনিজের ওপর নির্ভরশীল। এই পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্পের ভঙ্গুর বাস্তবতাকে প্রকাশ করে।
ইউরোপও একই সংকটে আছে। জার্মানির গাড়িশিল্প, ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন—সবই চীনের সরবরাহের কাছে বাঁধা। অথচ বিকল্প জোগান গড়ে তোলার মতো প্রযুক্তি, অর্থ বা সময় তাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন মরিয়া হয়ে আফ্রিকার দেশগুলো যেমন অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, তানজানিয়া ও মোজাম্বিকে নতুন খনিজ উৎস খুঁজছে। এমনকি লাতিন আমেরিকাতেও তাদের নজর আছে। সেখানে পশ্চিমা জোটের অর্থায়নে গড়ে তোলা হচ্ছে সড়ক, রেল ও বন্দর, যাতে ভবিষ্যতে চীনের বিকল্প সরবরাহ পথ তৈরি করা যায়।
বিরল খনিজকে কেন্দ্র করে চীনের কৌশলগত বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসনও পাল্টা খেলায় নেমেছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফাচ্ছন্ন ভূমি থেকে শুরু করে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত খনিজ অঞ্চল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নজর দিচ্ছে নতুন খনিজ খাত দখলে। অস্ট্রেলিয়ায় বিনিয়োগ চুক্তি, পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে অনুসন্ধান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কূটনৈতিক দর-কষাকষি—সবই একই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।
এরই অংশ হিসেবে ‘ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট’-এর আওতায় ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র রেয়ার আর্থ খাতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। দেশটি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নতুন খনি প্রকল্প সন্ধানে নেমেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ‘ক্রিটিক্যাল র ম্যাটেরিয়ালস অ্যাক্ট’ পাস করে চীনের বিকল্প সরবরাহশৃঙ্খল তৈরির চেষ্টা করছে।
এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের অস্ত্র পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়, বরং মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, ডিসপোরিয়াম আর ইট্রিয়ামের মতো ধাতু। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে থাকবে এই ধাতুগুলোর ওপর। চীন এখন বুঝে গেছে, যুদ্ধ না করেও আধিপত্য কায়েম করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রও তা বুঝে গেছে, কিন্তু তাদের হাতে সময় কম।
পৃথিবী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ‘সবুজ জ্বালানির’ দিকে ঝুঁকছে, তখন এই খনিজগুলোর চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। একেকটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে প্রায় ১০ কেজি রেয়ার আর্থ মিনারেলস লাগে, একটি উইন্ড টারবাইনে প্রয়োজন ৬০০ কেজিরও বেশি। ফলে ‘সবুজবিপ্লব’ যত দ্রুত এগোচ্ছে, ততই রেয়ার আর্থের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।
এই নির্ভরতা নতুন উপনিবেশবাদের রূপ নিচ্ছে। আফ্রিকার কঙ্গো, জাম্বিয়া, নামিবিয়া, লাতিন আমেরিকার চিলি ও বলিভিয়া—সবখানে এখন খনিজের নামে বিদেশি বিনিয়োগের হিড়িক। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ—সবাই একে অপরকে টপকে খনি, রপ্তানি অধিকার ও অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। স্থানীয় জনগণ পাচ্ছে দূষণ, স্থানচ্যুতি আর ঋণচক্রের শৃঙ্খল।
ভবিষ্যতের যুদ্ধ মিসাইল দিয়ে নয়, সরবরাহ চেইনের দখল দিয়ে হবে। যে রাষ্ট্রের হাতে থাকবে রেয়ার আর্থ মিনারেলসের প্রবাহ, সেই দেশই নির্ধারণ করবে কারা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে, কারা জ্বালানি উৎপাদন করবে, এমনকি কারা যুদ্ধ করবে।
চীন এখন এই সরবরাহ-শৃঙ্খলের প্রভু। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধে মরিয়া। ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের অবস্থান খুঁজছে—কেউ চীনের সঙ্গে সমঝোতায়, কেউ আমেরিকার সঙ্গে জোটে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—এ প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত মানবতার উপকারে আসবে, নাকি নতুন এক খনিজ সাম্রাজ্যের জন্ম দেবে? তবে সবুজ শক্তির নামে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা যদি পরিবেশবিধ্বংস, দারিদ্র্য আর বৈষম্যই বাড়ায়, তবে এই রেয়ার আর্থ আসলে আধুনিক সভ্যতার নতুন শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়াবে। ইতিহাস ইঙ্গিত দেয়, এই প্রতিযোগিতা দ্রুত শেষ হবে না।
ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা..
২৪ আগস্ট ২০২৫হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
৪ ঘণ্টা আগেমধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
৪ ঘণ্টা আগেদক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।
৪ ঘণ্টা আগেনতুন অস্থিরতা
এস এম হাসানুজ্জামান
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। সাম্প্রতিক সংঘাতের মাধ্যমে তা আবারও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সীমান্তের এই অস্থিরতা কেবল দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, মানবিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর কাবুলের আবদুল হাক্ক স্কয়ারে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো শহরকে আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন করে। এই বিস্ফোরণকে পাকিস্তান সরকার তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়। যদিও মেহসুদ নিজে একটি অডিও বার্তায় বেঁচে থাকার ঘোষণা দেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১১ অক্টোবর রাতে আফগান বাহিনী পাকিস্তানি সীমান্তচৌকিগুলোতে পাল্টা হামলা চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তান তার ২৩ সেনা সদস্যকে হারায়। তবে পাল্টা হামলায় তারা দাবি করে, ২০০ তালেবান এবং তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। আফগান বাহিনী ঘোষণা করে, তারা সীমান্তে ২৫টি পাকিস্তানি চৌকি দখল করেছে। এর পরপরই তোরখাম, চামান এবং অন্যান্য প্রধান সীমান্তচৌকিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্য, পরিবহন এবং সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।
সীমান্ত সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা রয়েছে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, আফগান সরকার তাদের ভূখণ্ডে টিটিপি সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। আফগান প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্ককে ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর, আফগান ভূখণ্ডে টিটিপির কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। ইসলামাবাদ এই কার্যক্রমকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা সীমান্ত অস্থিরতাকে আরও তীব্র করছে।
সীমান্ত সংঘাতের সামরিক দিকও অত্যন্ত জটিল। এ ক্ষেত্রে সংঘাত প্রায়ই গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে পরিচালিত হয়। তালেবান বাহিনী হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত আক্রমণ, দ্রুতগতি, স্থানীয় সমর্থন এবং ট্যাকটিক্যাল অপ্রচলিত কৌশল ব্যবহার করে পাকিস্তানি সীমান্তপ্রহরীদের তুলনায় অধিক কার্যকরভাবে। পাকিস্তানি বাহিনী তুলনামূলকভাবে বড়, আধুনিক ও স্থায়ী। তাদের কাছে প্রচলিত যুদ্ধের প্রযুক্তি রয়েছে—যেমন ট্যাংক, বিমান, পর্যবেক্ষণব্যবস্থা এবং আধুনিক অস্ত্র। তবু গেরিলা কৌশলের কারণে সীমান্তচৌকিগুলো হারাতে পারে। তালেবান বাহিনী স্বল্পসংখ্যক হলেও দ্রুতগতি ও চমকপ্রদ কৌশল ব্যবহার করে কার্যকর আক্রমণ চালায়।
টিটিপি, তালেবান এবং ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্সের কর্মকাণ্ড সীমান্ত সংঘাতকে আরও জটিল করেছে। টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং অন্যান্য সহিংস কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। আফগান ভূখণ্ডে তারা নিরাপদ আশ্রয় পায়। আফগানিস্তান তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রতিরোধের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এখনকার দুই দেশের মধ্যে সংঘাতে সীমান্তচৌকিগুলো বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী সাধারণ জনগণ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতা, আফগান শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়া এবং অর্থনৈতিক দুর্ভোগ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। সীমান্ত অস্থিরতার কারণে স্থানীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মানবিক সহায়তার জন্য এই সংকট প্রশমিত করা প্রয়োজন।
এই সংঘাতে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিরও গুরুত্ব আছে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাকিস্তান সন্দেহের চোখে দেখছে। ভারতের কূটনৈতিক নীতির প্রভাব এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা চিন্তা—সবকিছু মিলিত হয়ে সংকটকে আরও জটিল করেছে। সৌদি আরব, কাতার, ইরান, চীন এবং রাশিয়া উভয় পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সফরে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। পাকিস্তানও সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। তবে উভয় পক্ষই বড় ধরনের সংঘাতে জড়াতে চায় না, কারণ তারা ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যায় জর্জরিত। পাকিস্তান টিটিপির হামলা মোকাবিলায় লড়ছে এবং আফগানিস্তানও তাদের ভূখণ্ডে তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত সংঘাত কেবল সামরিক উত্তেজনার বিষয় নয়। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মানবিক নিরাপত্তার জন্য বহুমাত্রিক সংকট। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং উভয় দেশের আন্তরিকতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, উভয় দেশকে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। সাম্প্রতিক সংঘাতের মাধ্যমে তা আবারও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সীমান্তের এই অস্থিরতা কেবল দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, মানবিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর কাবুলের আবদুল হাক্ক স্কয়ারে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো শহরকে আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন করে। এই বিস্ফোরণকে পাকিস্তান সরকার তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়। যদিও মেহসুদ নিজে একটি অডিও বার্তায় বেঁচে থাকার ঘোষণা দেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১১ অক্টোবর রাতে আফগান বাহিনী পাকিস্তানি সীমান্তচৌকিগুলোতে পাল্টা হামলা চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তান তার ২৩ সেনা সদস্যকে হারায়। তবে পাল্টা হামলায় তারা দাবি করে, ২০০ তালেবান এবং তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। আফগান বাহিনী ঘোষণা করে, তারা সীমান্তে ২৫টি পাকিস্তানি চৌকি দখল করেছে। এর পরপরই তোরখাম, চামান এবং অন্যান্য প্রধান সীমান্তচৌকিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্য, পরিবহন এবং সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।
সীমান্ত সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা রয়েছে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, আফগান সরকার তাদের ভূখণ্ডে টিটিপি সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। আফগান প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্ককে ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর, আফগান ভূখণ্ডে টিটিপির কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। ইসলামাবাদ এই কার্যক্রমকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা সীমান্ত অস্থিরতাকে আরও তীব্র করছে।
সীমান্ত সংঘাতের সামরিক দিকও অত্যন্ত জটিল। এ ক্ষেত্রে সংঘাত প্রায়ই গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে পরিচালিত হয়। তালেবান বাহিনী হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত আক্রমণ, দ্রুতগতি, স্থানীয় সমর্থন এবং ট্যাকটিক্যাল অপ্রচলিত কৌশল ব্যবহার করে পাকিস্তানি সীমান্তপ্রহরীদের তুলনায় অধিক কার্যকরভাবে। পাকিস্তানি বাহিনী তুলনামূলকভাবে বড়, আধুনিক ও স্থায়ী। তাদের কাছে প্রচলিত যুদ্ধের প্রযুক্তি রয়েছে—যেমন ট্যাংক, বিমান, পর্যবেক্ষণব্যবস্থা এবং আধুনিক অস্ত্র। তবু গেরিলা কৌশলের কারণে সীমান্তচৌকিগুলো হারাতে পারে। তালেবান বাহিনী স্বল্পসংখ্যক হলেও দ্রুতগতি ও চমকপ্রদ কৌশল ব্যবহার করে কার্যকর আক্রমণ চালায়।
টিটিপি, তালেবান এবং ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্সের কর্মকাণ্ড সীমান্ত সংঘাতকে আরও জটিল করেছে। টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং অন্যান্য সহিংস কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। আফগান ভূখণ্ডে তারা নিরাপদ আশ্রয় পায়। আফগানিস্তান তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রতিরোধের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এখনকার দুই দেশের মধ্যে সংঘাতে সীমান্তচৌকিগুলো বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী সাধারণ জনগণ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতা, আফগান শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়া এবং অর্থনৈতিক দুর্ভোগ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। সীমান্ত অস্থিরতার কারণে স্থানীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মানবিক সহায়তার জন্য এই সংকট প্রশমিত করা প্রয়োজন।
এই সংঘাতে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিরও গুরুত্ব আছে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাকিস্তান সন্দেহের চোখে দেখছে। ভারতের কূটনৈতিক নীতির প্রভাব এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা চিন্তা—সবকিছু মিলিত হয়ে সংকটকে আরও জটিল করেছে। সৌদি আরব, কাতার, ইরান, চীন এবং রাশিয়া উভয় পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সফরে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। পাকিস্তানও সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। তবে উভয় পক্ষই বড় ধরনের সংঘাতে জড়াতে চায় না, কারণ তারা ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যায় জর্জরিত। পাকিস্তান টিটিপির হামলা মোকাবিলায় লড়ছে এবং আফগানিস্তানও তাদের ভূখণ্ডে তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত সংঘাত কেবল সামরিক উত্তেজনার বিষয় নয়। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মানবিক নিরাপত্তার জন্য বহুমাত্রিক সংকট। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং উভয় দেশের আন্তরিকতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, উভয় দেশকে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা..
২৪ আগস্ট ২০২৫হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
৪ ঘণ্টা আগেমধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
৪ ঘণ্টা আগে‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো।
৪ ঘণ্টা আগে