
দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবকে বিএনপি ‘হাস্যকর’ বলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক...
৬ ঘণ্টা আগে
ডাল খেতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে খাদ্যতালিকায় মুগ ডাল রাখেন। মানুষের এই পছন্দের ডাল নিয়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রতারণা। বাজারে মুগ ডালের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ ‘মথবীজ’। বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
৬ ঘণ্টা আগে
উড়োজাহাজ সংকটে ইতিমধ্যে একটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর ওপর লিজে (ভাড়ায়) আনা দুটি বোয়িং আগামী ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। ফলে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বর্তমান স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে প্রার্থীকে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারায় সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হলে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
৬ ঘণ্টা আগেতানিম আহমেদ, ঢাকা

জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবকে বিএনপি ‘হাস্যকর’ বলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সুপারিশের আলোকে আদেশ জারি করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দিয়েছে। সুপারিশে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণভোটের আগে সরকার জাতীয় সনদের ভিত্তিতে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করবে, যা গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। ফল ইতিবাচক হলে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা একযোগে এমপি ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা প্রথম অধিবেশন থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবেন; নির্ধারিত সময় পার হলে বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বিলের কথা বলা নেই। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়া হলেও প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার শেষ করবে এবং এরপর পরিষদের কার্যক্রম শেষ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি ধারাগুলো একই আছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, কমিশন মতামত দিয়েছে, এখন কাজ সরকারের। কমিশনের যেকোনো মতামত, পরামর্শ সরকার গ্রহণ করতে পারে, বর্জন করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন সিদ্ধান্ত সরকার কী করবে? সেটা সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে।
একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রথম প্রস্তাবটি আইনগতভাবে দুর্বল হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে কমিশন সেটি দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলগুলোর মধ্যে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে। অনেকে মনে করেন, বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা না হলে সংস্কার পরিষদে সনদের সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে না। এ প্রস্তাবের পক্ষে রয়েছে জামায়াত ও এনসিপি।
অবশ্য প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সংবিধানে কোনো কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তাই ২৭০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সরকার না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে—এটা সঠিক নয়, এটি ভ্রান্ত ধারণা। সংবিধানে কোনো কিছু অন্তর্ভুক্ত করতে হলে অবশ্যই সংসদে পাস হতে হবে।
কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত করার প্রস্তাবটি অস্বাভাবিক। সেটা না করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন না হলে সংসদ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া ভালো ছিল। এ রকম উদাহরণ তিউনিসিয়া, ভেনেজুয়েলায় হয়েছে। তাঁদের একজন বলেন, তাঁর মনে হয়, সরকার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে। কারণ, প্রথমটি করতে হলে ৪৮টি প্রস্তাবের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি করতে হবে, যা তৈরি করতে দুই মাস লাগতে পারে। দ্বিতীয়টির বিষয়ে সরকার চাইলে কালকেই আদেশ জারি করতে পারে।
দুটি প্রস্তাবের কারণে বিএনপির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এতে সরকারের আলোচনা করার পথ তৈরি হয়েছে। সেদিক থেকে দুটি প্রস্তাবের উপযোগিতা আছে। দ্বিতীয় প্রস্তাব মানলে বিএনপিরও লাভ হবে। তাঁদের মতে, সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস না করলে তো বাস্তবায়ন হবে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপির আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) প্রয়োগ করা যাবে।
২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাবের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হবে—এটি একটি হাস্যকর ব্যাপার। অটোপাসের মতো কোনো বিষয় সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল আমি জানি না।’
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম প্রস্তাবকে সামনে রেখে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ জারি করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে জামায়াত ও এনসিপি। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমরা কমিশনের সুপারিশ করা প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী নভেম্বরে গণভোট করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সুপারিশ করা প্রথম প্রস্তাবে ভাষাগত অস্পষ্টতা আছে, সেটার আরও উন্নতি করা সম্ভব। তবে সেখানে বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়ে স্পষ্ট করা আছে। তাই তাঁরা এটির পক্ষে। দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী সংস্কারপ্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। কারণ, সেখানে বাস্তবায়ন পদ্ধতি উল্লেখ নেই।
১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর হলেও সেদিন স্বাক্ষর করেনি এনসিপি। তখন দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না পেলে তারা স্বাক্ষর করবে না। কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার পরও স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি।
সরোয়ার তুষার বলেন, ‘সরকার যদি বিকল্প-১ প্রস্তাব অনুযায়ী আদেশ জারির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা স্বাক্ষর করব।’
একাধিক সূত্র জানায়, আদেশ জারির বিষয়ে সরকার গতকাল পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবকে বিএনপি ‘হাস্যকর’ বলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সুপারিশের আলোকে আদেশ জারি করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দিয়েছে। সুপারিশে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণভোটের আগে সরকার জাতীয় সনদের ভিত্তিতে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করবে, যা গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। ফল ইতিবাচক হলে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা একযোগে এমপি ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা প্রথম অধিবেশন থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবেন; নির্ধারিত সময় পার হলে বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বিলের কথা বলা নেই। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়া হলেও প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার শেষ করবে এবং এরপর পরিষদের কার্যক্রম শেষ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি ধারাগুলো একই আছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, কমিশন মতামত দিয়েছে, এখন কাজ সরকারের। কমিশনের যেকোনো মতামত, পরামর্শ সরকার গ্রহণ করতে পারে, বর্জন করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন সিদ্ধান্ত সরকার কী করবে? সেটা সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে।
একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রথম প্রস্তাবটি আইনগতভাবে দুর্বল হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে কমিশন সেটি দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলগুলোর মধ্যে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে। অনেকে মনে করেন, বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা না হলে সংস্কার পরিষদে সনদের সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে না। এ প্রস্তাবের পক্ষে রয়েছে জামায়াত ও এনসিপি।
অবশ্য প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সংবিধানে কোনো কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তাই ২৭০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সরকার না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে—এটা সঠিক নয়, এটি ভ্রান্ত ধারণা। সংবিধানে কোনো কিছু অন্তর্ভুক্ত করতে হলে অবশ্যই সংসদে পাস হতে হবে।
কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত করার প্রস্তাবটি অস্বাভাবিক। সেটা না করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন না হলে সংসদ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া ভালো ছিল। এ রকম উদাহরণ তিউনিসিয়া, ভেনেজুয়েলায় হয়েছে। তাঁদের একজন বলেন, তাঁর মনে হয়, সরকার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে। কারণ, প্রথমটি করতে হলে ৪৮টি প্রস্তাবের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি করতে হবে, যা তৈরি করতে দুই মাস লাগতে পারে। দ্বিতীয়টির বিষয়ে সরকার চাইলে কালকেই আদেশ জারি করতে পারে।
দুটি প্রস্তাবের কারণে বিএনপির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এতে সরকারের আলোচনা করার পথ তৈরি হয়েছে। সেদিক থেকে দুটি প্রস্তাবের উপযোগিতা আছে। দ্বিতীয় প্রস্তাব মানলে বিএনপিরও লাভ হবে। তাঁদের মতে, সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস না করলে তো বাস্তবায়ন হবে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপির আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) প্রয়োগ করা যাবে।
২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাবের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হবে—এটি একটি হাস্যকর ব্যাপার। অটোপাসের মতো কোনো বিষয় সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল আমি জানি না।’
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম প্রস্তাবকে সামনে রেখে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ জারি করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে জামায়াত ও এনসিপি। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমরা কমিশনের সুপারিশ করা প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী নভেম্বরে গণভোট করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সুপারিশ করা প্রথম প্রস্তাবে ভাষাগত অস্পষ্টতা আছে, সেটার আরও উন্নতি করা সম্ভব। তবে সেখানে বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়ে স্পষ্ট করা আছে। তাই তাঁরা এটির পক্ষে। দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী সংস্কারপ্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। কারণ, সেখানে বাস্তবায়ন পদ্ধতি উল্লেখ নেই।
১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর হলেও সেদিন স্বাক্ষর করেনি এনসিপি। তখন দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না পেলে তারা স্বাক্ষর করবে না। কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার পরও স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি।
সরোয়ার তুষার বলেন, ‘সরকার যদি বিকল্প-১ প্রস্তাব অনুযায়ী আদেশ জারির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা স্বাক্ষর করব।’
একাধিক সূত্র জানায়, আদেশ জারির বিষয়ে সরকার গতকাল পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ডাল খেতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে খাদ্যতালিকায় মুগ ডাল রাখেন। মানুষের এই পছন্দের ডাল নিয়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রতারণা। বাজারে মুগ ডালের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ ‘মথবীজ’। বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
৬ ঘণ্টা আগে
উড়োজাহাজ সংকটে ইতিমধ্যে একটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর ওপর লিজে (ভাড়ায়) আনা দুটি বোয়িং আগামী ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। ফলে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বর্তমান স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে প্রার্থীকে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারায় সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হলে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
৬ ঘণ্টা আগেআয়নাল হোসেন, ঢাকা

ডাল খেতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে খাদ্যতালিকায় মুগ ডাল রাখেন। মানুষের এই পছন্দের ডাল নিয়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রতারণা। বাজারে মুগ ডালের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ ‘মথবীজ’। বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় বাজারে মুগ ডাল নামে বিক্রি করা হচ্ছে, এ ধরনের ৩৩টি ডালের নমুনা সম্প্রতি দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগ্রহ করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক পরীক্ষায় এসব নমুনা ডালের ১৮টির মধ্যে হলুদ রঙের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। রংমিশ্রিত ডালের একটি নমুনা বিএসটিআইয়ের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হলে সেখানে টারট্রাজিন রং পাওয়া যায়। টারট্রাজিন নামক এই রঙের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ। এ কারণে রং মেশানো মথবীজ কেনার বিষয়ে সতর্ক করে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক বিল্লাল হোসেন বলেন, টারট্রাজিন বা হালকা হলুদ রং বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে ২০০ পিপিএম পর্যন্ত। কিন্তু এসব রং কাঁচা পণ্যে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসব রং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ক্যানসার, লিভার ও কিডনির জটিল রোগ হতে পারে।
সেই সঙ্গে মুগ ডাল ও মথবীজ আমদানির ক্ষেত্রে রং পরীক্ষা নিশ্চিত- করণ এবং রংমিশ্রিত ডাল আমদানি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, রং মেশানো মথ বীজ আমদানি বন্ধ চেয়ে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এসব আমদানি করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে প্রকৃত মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫০-১৬০ টাকা দরে।
অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানি করা দেখতে অনেকটাই মুগ ডালের মতো ‘মথ বীজ’ হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, বিচক্ষণ ব্যক্তিরাও এসব ডালের পার্থক্য বুঝতে পারেন না। এ সুযোগ নিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। মুগ ডাল নামে মথ বীজ বিক্রি করে আসছেন তাঁরা।
পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ ডালপট্টির মেসার্স এস আলম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলী আজগর জানান, বাজারে ভারত থেকে আমদানি করা মুগ ডালসদৃশ এসব ডাল প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকা দরে পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বিকাশ চন্দ্র সাহা বলেন, ভারতের ব্যবসায়ীরা এই দেশের কৃষককে শেষ করে ফেলছে। অসাধু কিছু ব্যবসায়ী মথ বীজ আমদানি করে তাতে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন।
বাজারে কী পরিমাণ ভেজাল মুগ ডাল আছে, সে সম্পর্কে ধারণা পেতে বাংলাদেশে ডাল আমদানির বিষয়ে অ্যাসাইকুডা অনলাইন ডেটা পর্যালোচনা করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছরে এইচএস কোড-০৭১৩৯৯০, ০৭১৩৩৯১০, ০৭১৩৩১৯০ এবং ০৭১৩৯০৯০-এর আওতায় মুগ ডাল আমদানির পরিমাণ ছিল অনুমান ১০ হাজার ৯৬১ টন। অন্যদিকে এইচএস কোড-০৭১৩৯০৯০-এর আওতায় মথ বীজ আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৮৯১ টন। মুগ ডালের তুলনায় মথ বীজ আমদানির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হলেও ৩৩টি নমুনা সংগ্রহের সময় বাজারে মথ নামে ডাল পায়নি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শিবির বিচিত্র বড়ুয়া বলেন, ডালের নামে ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য আমদানির বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডাল খেতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে খাদ্যতালিকায় মুগ ডাল রাখেন। মানুষের এই পছন্দের ডাল নিয়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রতারণা। বাজারে মুগ ডালের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ ‘মথবীজ’। বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় বাজারে মুগ ডাল নামে বিক্রি করা হচ্ছে, এ ধরনের ৩৩টি ডালের নমুনা সম্প্রতি দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগ্রহ করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক পরীক্ষায় এসব নমুনা ডালের ১৮টির মধ্যে হলুদ রঙের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। রংমিশ্রিত ডালের একটি নমুনা বিএসটিআইয়ের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হলে সেখানে টারট্রাজিন রং পাওয়া যায়। টারট্রাজিন নামক এই রঙের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ। এ কারণে রং মেশানো মথবীজ কেনার বিষয়ে সতর্ক করে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক বিল্লাল হোসেন বলেন, টারট্রাজিন বা হালকা হলুদ রং বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে ২০০ পিপিএম পর্যন্ত। কিন্তু এসব রং কাঁচা পণ্যে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসব রং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ক্যানসার, লিভার ও কিডনির জটিল রোগ হতে পারে।
সেই সঙ্গে মুগ ডাল ও মথবীজ আমদানির ক্ষেত্রে রং পরীক্ষা নিশ্চিত- করণ এবং রংমিশ্রিত ডাল আমদানি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, রং মেশানো মথ বীজ আমদানি বন্ধ চেয়ে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এসব আমদানি করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে প্রকৃত মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫০-১৬০ টাকা দরে।
অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানি করা দেখতে অনেকটাই মুগ ডালের মতো ‘মথ বীজ’ হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, বিচক্ষণ ব্যক্তিরাও এসব ডালের পার্থক্য বুঝতে পারেন না। এ সুযোগ নিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। মুগ ডাল নামে মথ বীজ বিক্রি করে আসছেন তাঁরা।
পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ ডালপট্টির মেসার্স এস আলম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলী আজগর জানান, বাজারে ভারত থেকে আমদানি করা মুগ ডালসদৃশ এসব ডাল প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকা দরে পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বিকাশ চন্দ্র সাহা বলেন, ভারতের ব্যবসায়ীরা এই দেশের কৃষককে শেষ করে ফেলছে। অসাধু কিছু ব্যবসায়ী মথ বীজ আমদানি করে তাতে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন।
বাজারে কী পরিমাণ ভেজাল মুগ ডাল আছে, সে সম্পর্কে ধারণা পেতে বাংলাদেশে ডাল আমদানির বিষয়ে অ্যাসাইকুডা অনলাইন ডেটা পর্যালোচনা করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছরে এইচএস কোড-০৭১৩৯৯০, ০৭১৩৩৯১০, ০৭১৩৩১৯০ এবং ০৭১৩৯০৯০-এর আওতায় মুগ ডাল আমদানির পরিমাণ ছিল অনুমান ১০ হাজার ৯৬১ টন। অন্যদিকে এইচএস কোড-০৭১৩৯০৯০-এর আওতায় মথ বীজ আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৮৯১ টন। মুগ ডালের তুলনায় মথ বীজ আমদানির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হলেও ৩৩টি নমুনা সংগ্রহের সময় বাজারে মথ নামে ডাল পায়নি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শিবির বিচিত্র বড়ুয়া বলেন, ডালের নামে ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য আমদানির বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবকে বিএনপি ‘হাস্যকর’ বলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক...
৬ ঘণ্টা আগে
উড়োজাহাজ সংকটে ইতিমধ্যে একটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর ওপর লিজে (ভাড়ায়) আনা দুটি বোয়িং আগামী ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। ফলে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বর্তমান স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে প্রার্থীকে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারায় সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হলে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
৬ ঘণ্টা আগেমনজুরুল ইসলাম, ঢাকা

উড়োজাহাজ সংকটে ইতিমধ্যে একটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর ওপর লিজে (ভাড়ায়) আনা দুটি বোয়িং আগামী ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। ফলে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বর্তমান স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় সংকট কাটাতে বিমানকে ভাড়ায় উড়োজাহাজ আনার ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশ সূত্র বলেছে, সংকট এড়াতে বড় আকারের (৩২০-এর বেশি আসনের) চারটি উড়োজাহাজ লিজে আনতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে দুটি বোয়িং লিজ নিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চার দফা দরপত্র আহ্বান করেও সাড়া পায়নি বিমান। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিজ নিতে বিমানের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এবারও তেমন আশঙ্কা রয়েছে।
বিমান বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সংস্থাটির বহরে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭ ও পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। এগুলো দিয়ে বিমান ২৩টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ভাড়ার মেয়াদ শেষে বহরের দুটি বোয়িং ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। এ দুটি ফেরত গেলে বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা হবে ১৯টি। এ সময়ের মধ্যে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে ফ্লাইট পরিচালনায় জটিলতার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। তাই চারটি বড় আকারের উড়োজাহাজ ভাড়ায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, যাত্রীর চাহিদা বাড়ছে, ফলে বহর ছোট হয়ে গেলে ফ্লাইট পরিচালনায় সমস্যা হবে। তাই ঘাটতি সামাল দিতে অন্তত কিছু উড়োজাহাজ লিজে আনার চেষ্টা চলছে।
বিমান সূত্র জানায়, চারটি উড়োজাহাজ লিজ নিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হবে ওয়েট লিজে। মূলত সামনের হজ মৌসুমের চাপ সামাল দিতে এ দুটি উড়োজাহাজ আগামী বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ভাড়া নিতে চায় বিমান।
প্রসঙ্গত, ওয়েট লিজের চুক্তিতে একটি এয়ারলাইনস (ইজারা দেওয়া) অন্য এয়ারলাইনসকে (ইজারা গ্রহীতা) উড়োজাহাজ, তার সম্পূর্ণ ক্রু, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিমা সরবরাহ করে। এই ব্যবস্থা সাধারণত স্বল্পমেয়াদি ব্যবহারের জন্য করা হয়।
সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরে বহর সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে বিমান বাংলাদেশ। নতুন উড়োজাহাজ কিনতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের এয়ারবাস ও যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর ঢাকা সফরকালে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল এয়ারবাস। প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল প্রায় ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই চুক্তি স্থগিত হয়। পরে বোয়িংও নতুন প্রস্তাব পাঠায়। গত জুলাইয়ে বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার কথা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, নতুন উড়োজাহাজ কেনার লক্ষ্যে এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্রুত চুক্তি হলেও তাদের কেউই ২০৩২ সালের আগে উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে পারবে না। সে হিসেবে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে লাগবে প্রায় সাত বছর। এর আগেই পবিত্র হজসহ ব্যস্ত মৌসুমে যাত্রী পরিবহনে ঘাটতি দেখা দেবে। তাই আপাতত চারটি উড়োজাহাজ লিজে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী এক দশকে দেশের আকাশপথে যাত্রীসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বছরে গড়ে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। ২০৩৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখে। কিন্তু এই সম্ভাবনার বিপরীতে উড়োজাহাজ সংকটে পড়েছে বিমান। স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা-টরন্টো, ঢাকা-নারিতা ও ঢাকা-রোম রুটে ফ্লাইট চালুর পর থেকে সংকটের শুরু।
জানা গেছে, গত হজ মৌসুমে পরিস্থিতি জটিল হলে জরুরি ভিত্তিতে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮ উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করে বিমান। সিদ্ধান্ত ছিল, ছয় বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া হবে। এর একটি গত ১ ফেব্রুয়ারি এবং অন্যটি ১ এপ্রিলের মধ্যে বহরে যুক্ত করার কথা ছিল। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চার দফায় দরপত্র দিলেও কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে চাহিদা অনুযায়ী সাড়া পায়নি বিমান। ফলে গত হজ মৌসুমে বিদ্যমান উড়োজাহাজ দিয়েই ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়েছে। এতে নারিতা রুট বন্ধসহ বেশ কিছু রুটের ফ্লাইট কমাতে হয়। এদিকে লোকসানে থাকা ঢাকা-নারিতা রুট উড়োজাহাজ সংকটে গত ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় বিমান।
এদিকে চাহিদা অনুযায়ী চারটি উড়োজাহাজ ভাড়া পেলে নতুন আন্তর্জাতিক রুট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষের। বিমান সূত্র জানায়, মালদ্বীপের মালে, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি রুটে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে বাজার যাচাই-বাছাই চলছে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, উড়োজাহাজ লিজ নিতে বিমান কর্তৃপক্ষ যে প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহ্বান করে, তাতে কখনই সফল হবে না। কারণ, বিমানের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ, সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। কোনো এয়ারলাইনসই তার উড়োজাহাজ বিমানের জন্য একদিনও বসিয়ে রাখবে না। এ কারণে গত বছরও দফায় দফায় দরপত্র দিয়েও উড়োজাহাজ লিজ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারও সে পথেই হাঁটছে বিমান।

উড়োজাহাজ সংকটে ইতিমধ্যে একটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর ওপর লিজে (ভাড়ায়) আনা দুটি বোয়িং আগামী ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। ফলে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বর্তমান স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় সংকট কাটাতে বিমানকে ভাড়ায় উড়োজাহাজ আনার ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশ সূত্র বলেছে, সংকট এড়াতে বড় আকারের (৩২০-এর বেশি আসনের) চারটি উড়োজাহাজ লিজে আনতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে দুটি বোয়িং লিজ নিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চার দফা দরপত্র আহ্বান করেও সাড়া পায়নি বিমান। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিজ নিতে বিমানের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এবারও তেমন আশঙ্কা রয়েছে।
বিমান বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সংস্থাটির বহরে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭ ও পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। এগুলো দিয়ে বিমান ২৩টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ভাড়ার মেয়াদ শেষে বহরের দুটি বোয়িং ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। এ দুটি ফেরত গেলে বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা হবে ১৯টি। এ সময়ের মধ্যে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে ফ্লাইট পরিচালনায় জটিলতার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। তাই চারটি বড় আকারের উড়োজাহাজ ভাড়ায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, যাত্রীর চাহিদা বাড়ছে, ফলে বহর ছোট হয়ে গেলে ফ্লাইট পরিচালনায় সমস্যা হবে। তাই ঘাটতি সামাল দিতে অন্তত কিছু উড়োজাহাজ লিজে আনার চেষ্টা চলছে।
বিমান সূত্র জানায়, চারটি উড়োজাহাজ লিজ নিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হবে ওয়েট লিজে। মূলত সামনের হজ মৌসুমের চাপ সামাল দিতে এ দুটি উড়োজাহাজ আগামী বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ভাড়া নিতে চায় বিমান।
প্রসঙ্গত, ওয়েট লিজের চুক্তিতে একটি এয়ারলাইনস (ইজারা দেওয়া) অন্য এয়ারলাইনসকে (ইজারা গ্রহীতা) উড়োজাহাজ, তার সম্পূর্ণ ক্রু, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিমা সরবরাহ করে। এই ব্যবস্থা সাধারণত স্বল্পমেয়াদি ব্যবহারের জন্য করা হয়।
সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরে বহর সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে বিমান বাংলাদেশ। নতুন উড়োজাহাজ কিনতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের এয়ারবাস ও যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর ঢাকা সফরকালে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল এয়ারবাস। প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল প্রায় ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই চুক্তি স্থগিত হয়। পরে বোয়িংও নতুন প্রস্তাব পাঠায়। গত জুলাইয়ে বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার কথা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, নতুন উড়োজাহাজ কেনার লক্ষ্যে এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্রুত চুক্তি হলেও তাদের কেউই ২০৩২ সালের আগে উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে পারবে না। সে হিসেবে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে লাগবে প্রায় সাত বছর। এর আগেই পবিত্র হজসহ ব্যস্ত মৌসুমে যাত্রী পরিবহনে ঘাটতি দেখা দেবে। তাই আপাতত চারটি উড়োজাহাজ লিজে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী এক দশকে দেশের আকাশপথে যাত্রীসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বছরে গড়ে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। ২০৩৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখে। কিন্তু এই সম্ভাবনার বিপরীতে উড়োজাহাজ সংকটে পড়েছে বিমান। স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা-টরন্টো, ঢাকা-নারিতা ও ঢাকা-রোম রুটে ফ্লাইট চালুর পর থেকে সংকটের শুরু।
জানা গেছে, গত হজ মৌসুমে পরিস্থিতি জটিল হলে জরুরি ভিত্তিতে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮ উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করে বিমান। সিদ্ধান্ত ছিল, ছয় বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া হবে। এর একটি গত ১ ফেব্রুয়ারি এবং অন্যটি ১ এপ্রিলের মধ্যে বহরে যুক্ত করার কথা ছিল। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চার দফায় দরপত্র দিলেও কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে চাহিদা অনুযায়ী সাড়া পায়নি বিমান। ফলে গত হজ মৌসুমে বিদ্যমান উড়োজাহাজ দিয়েই ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়েছে। এতে নারিতা রুট বন্ধসহ বেশ কিছু রুটের ফ্লাইট কমাতে হয়। এদিকে লোকসানে থাকা ঢাকা-নারিতা রুট উড়োজাহাজ সংকটে গত ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় বিমান।
এদিকে চাহিদা অনুযায়ী চারটি উড়োজাহাজ ভাড়া পেলে নতুন আন্তর্জাতিক রুট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষের। বিমান সূত্র জানায়, মালদ্বীপের মালে, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি রুটে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে বাজার যাচাই-বাছাই চলছে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, উড়োজাহাজ লিজ নিতে বিমান কর্তৃপক্ষ যে প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহ্বান করে, তাতে কখনই সফল হবে না। কারণ, বিমানের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ, সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। কোনো এয়ারলাইনসই তার উড়োজাহাজ বিমানের জন্য একদিনও বসিয়ে রাখবে না। এ কারণে গত বছরও দফায় দফায় দরপত্র দিয়েও উড়োজাহাজ লিজ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারও সে পথেই হাঁটছে বিমান।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবকে বিএনপি ‘হাস্যকর’ বলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক...
৬ ঘণ্টা আগে
ডাল খেতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে খাদ্যতালিকায় মুগ ডাল রাখেন। মানুষের এই পছন্দের ডাল নিয়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রতারণা। বাজারে মুগ ডালের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ ‘মথবীজ’। বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
৬ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে প্রার্থীকে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারায় সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হলে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
৬ ঘণ্টা আগেজোটের ভোটে নির্বাচনী প্রতীক
মো. হুমায়ূন কবীর, ঢাকা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে প্রার্থীকে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারায় সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হলে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটি চায়, আগের মতোই অন্য দলের প্রতীকে ভোট করার সুযোগ পাক জোটের প্রার্থী। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থীর নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধানের পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে ইসি এখন কী করবে—সবাই তাকিয়ে সেদিকেই।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, ‘আমরা তো আমাদের কাজ করে দিয়েছি।’
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, জোটের ভোটে প্রতীকের বিষয়টি এখন আর ইসির হাতে নেই; এটি ইতিমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হয়ে গেছে। তাই বিষয়টি এখন সরকারের হাতে চলে গেছে।
গত রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বিএনপির দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল বৈঠক করে আরপিওর ২০ ধারায় আনা সংশোধনী পরিবর্তন করে আগের মতো দলগুলোর ইচ্ছেমতো প্রতীকে ভোট করার দাবি জানান। একই দিন জোটের ভোটে দলগুলোর ইচ্ছেমতো প্রতীক ব্যবহারের পক্ষে একই দাবি জানিয়ে ইসিতে চিঠি দেয় ববি হাজ্জাজের দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। তবে গত মঙ্গলবার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে জোটের ভোটে নিজ নিজ দলের পক্ষে ভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইসিতে ১৮ দফা সুপারিশের মধ্যে তারা উল্লেখ করে, উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত সর্বশেষ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদের সর্বশেষ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। এ বিধান বহাল রাখতে হবে।
এ ছাড়া গতকাল বুধবার ইসির সঙ্গে বৈঠকে গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) নুরুল হক নুর বলেন, জোটের ভোটে দলগুলোর নিজ নিজ প্রতীকের ভোটে তাদের সম্মতি রয়েছে। তিনি বলেন, জোটভুক্ত হলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান। তবে কালোটাকা ও পেশিশক্তি মুক্ত, ভয়ভীতিমুক্ত নির্বাচন আয়োজন, ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভির ব্যবহার, কেন্দ্রে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা রাখার দাবি জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ।
সংশোধিত আরপিওর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো—আদালত কর্তৃক ফেরারি বা পলাতক আসামি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে; কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে তাঁকে না ভোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে; নির্বাচনে না ভোট বেশি হলে সেখানে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন হবে, তবে দ্বিতীয়বারও একক প্রার্থী হলে সেই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হলে তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হবে; ভোট গণনার সময় সাংবাদিকদের উপস্থিতি থাকার বিধানটিও যুক্ত করা হয়েছে, তবে ভোট গণনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; প্রবাসী বাংলাদেশি, নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে; এবার আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং চালু করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের পাশাপাশি আইনি হেফাজতে থাকা, সরকারি কর্মকর্তা, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা ভোট দিতে পারবেন; প্রার্থীর জামানত বাড়ানো হয়েছে, আগে ২০ হাজার টাকা ছিল, এটি বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে; কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন পুরো আসনের ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা কমিয়েছিল, সংশোধিত আরপিওতে শুধু ভোটকেন্দ্র নয়, অনিয়ম হলে ইসির পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে, সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে; প্রার্থীর হলফনামায় আগে শুধু দেশের সম্পদের হিসাব দেওয়া হতো, সংশোধিত আরপিওতে শুধু দেশের নয়, বিদেশের আয়ের উৎস, সম্পত্তির বিবরণ দিতে হবে; কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো রাজনৈতিক দলকে ৫০ হাজার টাকার বেশি অনুদান দিতে চাইলে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে; যিনি অনুদান দেবেন, তাঁর ট্যাক্স রিটার্নও দিতে হবে; এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংক্রান্ত বিধানটি সংশোধিত আরপিও থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে প্রভৃতি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, আগেও ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁরা যদি মনে করতেন, ভোট গ্রহণ চালানোর মতো পরিস্থিতি নেই, তাহলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সেই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারতেন। তবে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন সেই ক্ষমতা কিছুটা কমিয়েছিল। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এক দিনের জন্য যতই শক্তিশালী করা হোক না কেন, তা তেমন কাজে আসবে না। এক দিন ক্ষমতা দেখিয়ে পরে তাঁরা বরং স্থানীয়ভাবে ঝামেলায় পড়তে পারেন। কারণ, অতীতে অনেকে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তাই নির্বাচনেরও পরেও মাসখানেক প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের আইনি সহায়তার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তাহলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে প্রার্থীকে—এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারায় সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হলে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটি চায়, আগের মতোই অন্য দলের প্রতীকে ভোট করার সুযোগ পাক জোটের প্রার্থী। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থীর নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধানের পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে ইসি এখন কী করবে—সবাই তাকিয়ে সেদিকেই।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, ‘আমরা তো আমাদের কাজ করে দিয়েছি।’
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, জোটের ভোটে প্রতীকের বিষয়টি এখন আর ইসির হাতে নেই; এটি ইতিমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হয়ে গেছে। তাই বিষয়টি এখন সরকারের হাতে চলে গেছে।
গত রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বিএনপির দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল বৈঠক করে আরপিওর ২০ ধারায় আনা সংশোধনী পরিবর্তন করে আগের মতো দলগুলোর ইচ্ছেমতো প্রতীকে ভোট করার দাবি জানান। একই দিন জোটের ভোটে দলগুলোর ইচ্ছেমতো প্রতীক ব্যবহারের পক্ষে একই দাবি জানিয়ে ইসিতে চিঠি দেয় ববি হাজ্জাজের দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। তবে গত মঙ্গলবার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে জোটের ভোটে নিজ নিজ দলের পক্ষে ভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইসিতে ১৮ দফা সুপারিশের মধ্যে তারা উল্লেখ করে, উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত সর্বশেষ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদের সর্বশেষ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। এ বিধান বহাল রাখতে হবে।
এ ছাড়া গতকাল বুধবার ইসির সঙ্গে বৈঠকে গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) নুরুল হক নুর বলেন, জোটের ভোটে দলগুলোর নিজ নিজ প্রতীকের ভোটে তাদের সম্মতি রয়েছে। তিনি বলেন, জোটভুক্ত হলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান। তবে কালোটাকা ও পেশিশক্তি মুক্ত, ভয়ভীতিমুক্ত নির্বাচন আয়োজন, ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভির ব্যবহার, কেন্দ্রে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা রাখার দাবি জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ।
সংশোধিত আরপিওর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো—আদালত কর্তৃক ফেরারি বা পলাতক আসামি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে; কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে তাঁকে না ভোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে; নির্বাচনে না ভোট বেশি হলে সেখানে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন হবে, তবে দ্বিতীয়বারও একক প্রার্থী হলে সেই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হলে তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হবে; ভোট গণনার সময় সাংবাদিকদের উপস্থিতি থাকার বিধানটিও যুক্ত করা হয়েছে, তবে ভোট গণনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; প্রবাসী বাংলাদেশি, নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে; এবার আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং চালু করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের পাশাপাশি আইনি হেফাজতে থাকা, সরকারি কর্মকর্তা, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা ভোট দিতে পারবেন; প্রার্থীর জামানত বাড়ানো হয়েছে, আগে ২০ হাজার টাকা ছিল, এটি বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে; কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন পুরো আসনের ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা কমিয়েছিল, সংশোধিত আরপিওতে শুধু ভোটকেন্দ্র নয়, অনিয়ম হলে ইসির পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে, সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে; প্রার্থীর হলফনামায় আগে শুধু দেশের সম্পদের হিসাব দেওয়া হতো, সংশোধিত আরপিওতে শুধু দেশের নয়, বিদেশের আয়ের উৎস, সম্পত্তির বিবরণ দিতে হবে; কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো রাজনৈতিক দলকে ৫০ হাজার টাকার বেশি অনুদান দিতে চাইলে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে; যিনি অনুদান দেবেন, তাঁর ট্যাক্স রিটার্নও দিতে হবে; এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংক্রান্ত বিধানটি সংশোধিত আরপিও থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে প্রভৃতি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, আগেও ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁরা যদি মনে করতেন, ভোট গ্রহণ চালানোর মতো পরিস্থিতি নেই, তাহলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সেই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারতেন। তবে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন সেই ক্ষমতা কিছুটা কমিয়েছিল। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এক দিনের জন্য যতই শক্তিশালী করা হোক না কেন, তা তেমন কাজে আসবে না। এক দিন ক্ষমতা দেখিয়ে পরে তাঁরা বরং স্থানীয়ভাবে ঝামেলায় পড়তে পারেন। কারণ, অতীতে অনেকে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তাই নির্বাচনেরও পরেও মাসখানেক প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের আইনি সহায়তার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তাহলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবকে বিএনপি ‘হাস্যকর’ বলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক...
৬ ঘণ্টা আগে
ডাল খেতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে খাদ্যতালিকায় মুগ ডাল রাখেন। মানুষের এই পছন্দের ডাল নিয়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর প্রতারণা। বাজারে মুগ ডালের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ ‘মথবীজ’। বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
৬ ঘণ্টা আগে
উড়োজাহাজ সংকটে ইতিমধ্যে একটি রুট বন্ধ করে দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর ওপর লিজে (ভাড়ায়) আনা দুটি বোয়িং আগামী ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। ফলে বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত না হলে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বর্তমান স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগে