Ajker Patrika

৮ বছর পর ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্ত আযমী ও আরমান, বাকিদের বিষয়ে জানা যাবে কাল

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৪, ১১: ০৪
৮ বছর পর ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্ত আযমী ও আরমান, বাকিদের বিষয়ে জানা যাবে কাল

দীর্ঘ আট বছর পর গোয়েন্দা সংস্থার ‘গোপন বন্দীশালা’ থেকে মুক্ত হয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। গতকাল সোমবার মধ্যরাতে তাঁদের রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আজ মঙ্গলবার ভোরে তাঁরা পরিবারের কাছে ফিরেছেন বলে জানা গেছে।

বেশ কিছু দিন আগে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে গুমের শিকার রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদরদপ্তরের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত সেই কুঠুরিতে বছরের পর বছর মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর সেই আয়নাঘরের সামনে আজ মঙ্গলবার সকালে বিক্ষোভ করেছেন গুম হওয়াদের স্বজনেরা। স্বজনদের বিষয়ে আগামীকাল বুধবার বিস্তারিত জানাবে ডিজিএফআই।

আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া একজন জানিয়েছেন, এখনো অনেক মানুষ আয়নাঘরে আটক রয়েছেন। আজ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেতে ডিজিএফআই সদর দপ্তরের সামনে ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে অন্তত ২৩ গুম হওয়া ব্যক্তির অর্ধশত স্বজন মানববন্ধন করেন। এ সময় তাদের হাতে গুম হওয়া মানুষের ছবি ছিল। তাঁরা ডিজিএফআই সদরদপ্তরে প্রবেশ করে স্বজনদের দেখতে চান, তবে তাঁদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

এ সময় ‘মায়ের ডাক’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস, বিশিষ্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং নারী অধিকার নেত্রী শিরিন হক ছিলেন। পরে তাঁরা ভেতরে গিয়ে ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

ডিজিএফআই তাঁদের জানিয়েছেন, এখানে আর কোনো আটক নেই, নিখোঁজেরা কোথায় রয়েছেন, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আগামীকাল বুধবার জানানো হবে।

এ বিষয়ে সানজিদা ইসলাম তুলি আজকের পত্রিকাকে বলেন, `আমরা ডিজিএফআইয়ের কাছে জানতে চেয়েছি, আর কে কে ভেতরে আছে? তবে তাঁরা জানিয়েছেন কেউ নেই। কিন্তু আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, সেখানে এখনো অনেক মানুষ আটক আছেন, আমরা এরপর ভেতরে গিয়ে দেখতে চাইলে তাঁরা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি।'

তিনি বলেন, ‘আমাদের ডিজিএফআই আগামীকাল এ বিষয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাবেন। না জানালে আমরা ফের সেখানে যাব। কারণ আমরা জানতে পেরেছি, অনেক আটক এখনো সেখানে রয়েছেন। সব গুম হওয়া মানুষের বিষয়ে হিসাব নেওয়া হবে।’

সানজিদা ইসলাম তুলির ভাই বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। তিনি মায়ের ডাক-এর ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে গুম হওয়া মানুষকে ফেরত পেতে লড়াই করছেন।

শেখ হাসিনার পতনের পর গতকাল সোমবার রাতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী এবং ব্যারিস্টার মীর আহমদ আরমান বিন কাসেমকে দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁদের পরিবার উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়। আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির, মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম আযমের (মৃত) ছেলে। আর ব্যারিস্টার আরমান জামায়াতে ইসলামীর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে।

পরিবারের পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও আহমাদ বিন কাসেমের মুক্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে।

২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুরের বাসা থেকে ব্যারিস্টার আরমানকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

গতকাল সোমবার রাতে কর্নেল (অব.) সামসের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা রাজধানীর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকায় অবস্থান নিয়ে সবার মুক্তি চান। রাতেই ওই দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আরমান মুক্তির পর জানিয়েছেন, আয়নাঘর খ্যাত বন্দিশালায় আরও অনেকেই রয়েছেন।

এরপরই গুম হওয়া মানুষের স্বজনেরা আজ সকাল থেকে আয়নাঘরের সামনে জড়ো হতে থাকেন। মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে অংশ নেন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে হরিশ্চর এলাকা থেকে তাঁকে র‍্যাব পরিচয়ে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর খোঁজ মেলেনি।

সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম কোথাও নেই, ডিজিএফআই সেটাও বলেনি, আবার আছে তাও বলেনি। তাঁরা আগামীকাল বুধবার আমাদের বিস্তারিত জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আমি বিশ্বাস করি এবং যে দুজন ফিরে এসেছেন তাঁদের কাছেও শুনেছি, আয়নাঘরে অনেক লোক আছেন, তার মধ্যে আমার স্বামীও রয়েছেন।’

বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস, বিশিষ্ট ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলম ও নারী অধিকার নেত্রী শিরিন হক ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এক ব্যক্তির নামে অনুমোদিত সিমের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এক ব্যক্তির নামে অনুমোদিত সিমকার্ডের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। আজ রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘একজনের সিমকার্ড ব্যবহার করে অন্যজন অপরাধ করে। এতে করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তি অনেক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এ জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশন করা সিমকার্ড কমিয়ে আনা হবে। কোনো ঘটনা ঘটার পর দেখা যায় সিমটি সেই ব্যক্তির নয়। নির্বাচনের আগে সিমকার্ড কমিয়ে আনা হবে। আমরা চেষ্টা করছি জাতীয় নির্বাচনের আগে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ সাতটি সিমকার্ড নিজের এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন।’

ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ও মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ।

গত মে মাসে বিটিআরসি জানায়, একজন গ্রাহক এখন থেকে নিজের নামে সর্বোচ্চ ১০টি সিম নিতে পারবেন। এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্মনিবন্ধন সনদ ও পাসপোর্ট দিয়ে সব অপারেটর মিলিয়ে ১৫টি সিম নেওয়া যেত।

২০১৭ সালে বিটিআরসি একজন গ্রাহকের নামে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম নিবন্ধন করা যাবে বলে নির্দেশনা দেয়। এরপর ২০২২ সালের অক্টোবরে বিটিআরসি আরেক নির্দেশনায় জানিয়েছিল, একজন গ্রাহক জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্মনিবন্ধন সনদ ও পাসপোর্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম নিবন্ধন করতে পারবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাতীয় নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে বসছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জাতীয় নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে বসছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

সন্ন জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে সার্বিক প্রস্তুতি, সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অভিযান পরিচালনা এবং সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে বৈঠকে বসছে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি।

আজ রোববার সকাল ১১টায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১৫তম বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বৈঠকের আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—

১. দেশব্যাপী চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের কর্মকাণ্ড রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

২. জুলাই হত্যাকাণ্ডের শহীদদের মামলার রেকর্ড, তদন্ত ও অগ্রগতি বিষয়ক আলোচনা, দেশে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী উসকানিমূলক সাইবার প্রচারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

৩. নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনগত ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

৪. মাদকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কিত আলোচনা।

৫. শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন পরবর্তী সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও প্রতিরোধ, নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনসমূহের অপতৎপরতা রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

৬. গার্মেন্টস বা শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিশ্চিত করা।

৭. গার্মেন্টস কারখানা, ঔষধ শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির তৎপরতা বিষয়ে আলোচনা।

৮. অস্ত্র জমা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত আলোচনা।

৯. সীমান্ত ও পার্বত্যাঞ্চল পরিস্থিতি বিষয়ক আলোচনা।

১০. রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ক আলোচনা।

১১. মা ইলিশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আলোচনা।

জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিল্প-ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, খাদ্য ও ভূমি বিষয়ক উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্ট আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কমিশন-বিশেষজ্ঞ বৈঠক: বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা নিয়ে জট কাটেনি

  • বৈঠকে সময়সীমা নিশ্চিত করার উপায় মেলেনি
  • কয়েকটি মত এলেও বাস্তবসম্মত মনে করেননি কেউ
  • ঝুলন্ত পার্লামেন্টের সম্ভাবনাসহ নানা প্রশ্নের জবাব নেই
  • আজ সকালে আবার বসছে কমিশন
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭: ৪৯
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আগামী জাতীয় সংসদ নিয়মিত সংসদের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের (৯ মাস) মধ্যে জুলাই সনদের সংবিধানসংক্রান্ত বিষয়গুলো সংবিধানে যুক্ত করবে বলে মতৈক্য হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত হবে, গতকাল শনিবার পর্যন্ত তার কিনারা করতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৃহস্পতিবারের পর ঐকমত্য কমিশন গতকালও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করলেও কোনো সমাধান মেলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে আজ রোববার কমিশন আবার নিজেরা বৈঠক করবে এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবার বসবে।

ঐকমত্য কমিশনের জাতীয় সংসদ ভবনের কার্যালয়ে গতকাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকটি বেলা দেড়টার পর শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টার পরে শেষ হয়। প্রায় চার ঘণ্টার বৈঠকেও সংবিধান নিয়ে সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করার উপায় বের হয়নি।

সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সিদ্ধান্ত হলো, গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে প্রথমে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করা হবে। তার অধীনে জারি হবে গণভোট-বিষয়ক একটি অধ্যাদেশ। এর ভিত্তিতেই হবে গণভোট। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (২৭০ দিন বা প্রথম ৯ মাস) আগামী সংসদ কাজ করবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে। এ সময়ের মধ্যেই সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংসদে অনুমোদন করা হবে। প্রসঙ্গত, একই সময় এ পরিষদ নিয়মিত সংসদ হিসেবেও কাজ করবে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়ই সংবিধান সংস্কার হবে।

গতকালের আলোচনা বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন না করলে সনদে থাকা বিষয়গুলো কী হবে—সেখানেই আটকে যাচ্ছে আলোচনা। কারণ আমরা তেমন সমাধান দিতে পারছি না। দেশে অতীতে এ-সংক্রান্ত কোনো উদাহরণ নেই। দেশের বাইরেও এ ধরনের উদাহরণ পাইনি।’

কোনো দল আগামী নির্বাচনে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সংবিধান সংস্কার কীভাবে হবে, এ প্রশ্নও আছে। বিষয়টি তখন মূলত নির্ভর করবে বেশি আসন পাওয়া কয়েকটি দলের সদিচ্ছার ওপর। কিন্তু কমিশন চাইছে এ অনিশ্চয়তার অবকাশ না রেখে এমন কোনো বিধান করা, যা সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেবে।

গতকালের বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা একাধিক মত দিয়ে বলেছেন, সেগুলো আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না তাঁ। একটি মত হলো,নির্ধারিত সময়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করা না হলে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটি আইনগতভাবে ঠিক হলেও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সংসদ এভাবে বিলুপ্ত হলে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

আরও যে কয়েকটি মত গতকাল এসেছে তার মধ্যে রয়েছে, প্রথমত, পরিষদে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, আগে সংবিধান সংস্কার পরিষদ বৈঠকে বসে সনদের সংযুক্তি বাস্তবায়ন করবে এবং তারপর সংসদ বসবে। কিন্তু এগুলোও কার্যকর বা বাস্তবসম্মত মনে করেননি বিশেষজ্ঞদের সবাই।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, সময়সীমার মধ্যে না সম্পন্ন করলে আপনা থেকেই সংবিধানে বিষয়গুলো যুক্ত হওয়ার ধারণা বাস্তবসম্মত না। কারণ বিলগুলোর খসড়া তৈরি করা নেই। এটা করা বিশেষজ্ঞদের কাজ না। সংসদে আলোচনা করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এ সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বলেন, সনদের একটি বিধান হচ্ছে, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ করা হবে। কিন্তু কোন মৌলিক অধিকারটি সম্প্রসারণ করা হবে, তা বলা নেই। সংসদ সদস্যদের আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এসব কারণে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারিনি। কমিশন জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা বৈঠক করবেন, প্রয়োজনে আমাদের সহযোগিতা নেবেন।’

গতকালের বৈঠকে আগে সংবিধান সংস্কার পরিষদ বসে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার যে প্রস্তাব আসে তার পক্ষে বলা হয়, এতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দ্রুত সনদ বাস্তবায়নে কাজ করবেন। কারণ তাঁরা বিলম্ব না করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে চাইবেন। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হলেও বেশির ভাগের মত, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ জনপ্রতিনিধিদের শপথের মাধ্যমে সংসদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্বে থেকে যেতে হবে। এটা প্রধান উপদেষ্টাই মানবেন না।

এ অবস্থায় সমাধান কী হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা আদৌ কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি করে দিতে পারব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ এমন আইনি ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য সমাধান পাইনি। তাই বিষয়টি আমাদের সুপারিশে না-ও থাকতে পারে।’

সনদ-বিষয়ক আদেশের খুঁটিনাটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। গণভোটের দিনক্ষণ সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কমিশন সূত্র জানায়, আজ সকালে নিজেরা বৈঠক করার পর প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও আবার বৈঠক করা হবে। ৩১ অক্টোবরের মেয়াদের মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন।

এনসিপির সঙ্গে বৈঠক

গতকাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসার আগে কমিশনের সদস্যরা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেন। ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদের স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হলেও দলটি সই করেনি। এনসিপি বলেছিল, বাস্তবায়নের আদেশের চূড়ান্ত খসড়া না দেখে তারা স্বাক্ষর করবে না।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, গতকালের বৈঠকে এনসিপির প্রতিনিধিরা ‘স্পষ্টভাবে’ জানিয়েছেন যে তাঁরা স্বাক্ষর করতে চান। তাঁরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন, যা কমিশন আইনি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে। এনসিপির প্রস্তাবে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে। সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করে কমিশন এগোচ্ছে। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, যেন সবাই স্বাক্ষরের দিকে আসে।

বিশেষজ্ঞ হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূইয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন।

আলোচনায় কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সংশোধিত আরপিও নিয়ে বিতর্ক, এল যেসব পরিবর্তন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন, ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার সংশোধিত আরপিও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যুক্ত করা হয়েছে নতুন বিধান, আবার কিছু কিছু বিধান আরপিও থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইভিএম ব্যবহার বাতিল, ‘না ভোট’ পুনর্বহাল, প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয় ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের বাধ্যবাধকতা এবং পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।

সংশোধিত আরপিওর গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:

আদালত কর্তৃক ফেরারি বা পলাতক আসামি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে তাঁকে না ভোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। নির্বাচনে না ভোট বেশি হলে সেখানে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন হবে। তবে দ্বিতীয়বারও একক প্রার্থী হলে সেই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হলে তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।

ভোট গণনার সময় সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকার বিধানটিও যুক্ত করা হয়েছে। তবে ভোট গণনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেলাভিত্তিক নির্বাচন অফিসগুলোতে দায়িত্ব পালন করবেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। প্রার্থীদের দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে আয় ও সম্পত্তির বিবরণ হলফনামায় দিতে হবে, যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে উন্মুক্তভাবে প্রকাশ করা হবে।

আগে দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে জোটের যেকোনো দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারত। সেটি সংশোধন করা হয়েছে। জোটভুক্ত হলেও প্রার্থীকে নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ভোটের সময় অনেকে জোটভুক্ত হলে জনপ্রিয় বা বড় দলের মার্কায় ভোট করতেন। এখন আর সে সুযোগ থাকছে না।

প্রবাসী বাংলাদেশি, নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিধানটি আরপিওতে যুক্ত করা হয়েছে। এবার আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং চালু করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের পাশাপাশি আইনি হেফাজতে থাকা, সরকারি কর্মকর্তা, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা ভোট দিতে পারবেন।

প্রার্থীর জামানত বাড়ানো হয়েছে। আগে ২০ হাজার টাকা ছিল, তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো রাজনৈতিক দলকে ৫০ হাজার টাকার বেশি অনুদান দিতে চাইলে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। যিনি অনুদান দেবেন, তাঁর ট্যাক্স রিটার্নও দিতে হবে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন পুরো আসনের ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা কমিয়েছিল। সংশোধিত আরপিওতে শুধু ভোটকেন্দ্র নয়, অনিয়ম হলে ইসি পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে, সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রার্থীর হলফনামায় আগে শুধু দেশের সম্পদের হিসাব দেওয়া হতো। সংশোধিত আরপিওতে শুধু দেশের নয়, বিদেশের আয়ের উৎস, সম্পত্তির বিবরণ দিতে হবে।

এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-সংক্রান্ত বিধানটি সংশোধিত আরপিও থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত