Ajker Patrika

শিক্ষার্থীদের ‘কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে’ সপরিবার পালিয়েছেন বিএসবির বাশার

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ০৬ মে ২০২৫, ২৩: ৫১
বিএসবির কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার ও তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন। ছবি: ফেসবুক
বিএসবির কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার ও তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন। ছবি: ফেসবুক

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে শত শত শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাজধানীর একটি শিক্ষা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। চটকদার বিজ্ঞাপন, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তির দাবি, আর একঝাঁক ‘ভালো খবরের’ গল্প—সব মিলিয়ে ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’ নামের প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিল বিশ্বাসের এমন এক আবরণ, যার আড়ালে চলত সুপরিকল্পিত প্রতারণা। আর এর নেপথ্যে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার। তিনি এখন সপরিবার উধাও।

১৪১ জনের কাছ থেকে ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ এবং পাচার করার অভিযোগে বাশার, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের বিরুদ্ধে ৪ মে ডিএমপির গুলশান থানায় অর্থ পাচার মামলা করেছে সিআইডি। বাশারের এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে গত ডিসেম্বরেই অর্থ পাচারের প্রমাণ পায় সিআইডি। এরপর মামলা হয়। এ ছাড়া ৭০০ ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে সিআইডির কাছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। বিদেশে পাঠানোর কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ৮৫০ জন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছ থেকে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক উচ্চশিক্ষা, বৃত্তিসহ দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানোর বিজ্ঞাপন দিত। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে সেখানে যেত। সবার কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিত। এরপর মাসের পর মাস ঘোরাত। বিদেশও পাঠাতে পারত না, টাকাও ফেরত দিত না। এ রকম প্রায় সাড়ে ৮০০ শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভাবকেরা সিআইডির কাছে অভিযোগ করেন। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪১ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা পায় সিআইডি। তাঁদের কাছ থেকে ১৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বাশার ও তাঁর প্রতিষ্ঠান। তবে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। সব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এমনকি তাঁকেও দেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তদন্তে উঠে এসেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার, তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন এবং ছেলে আরশ ইবনে বাশার দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। পরে সেই অর্থ হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে পাচার করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের এসআই উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন মামলায় অভিযোগ করেছেন, বাশার ও তাঁর প্রতিষ্ঠানটি নানা প্রলোভনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ছয় লাখ থেকে শুরু করে ৩০ লাখ টাকার বেশি পর্যন্ত অর্থ নিয়েছেন। তদন্তে অন্তত ৭৮ জন ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। কারও কারও দাবি অনুযায়ী, তাঁরা শেষ পর্যন্ত কোনো ভিসাই পাননি, আবার কেউ কেউ টাকা দিয়েও বিদেশে যেতে পারেননি।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাহমুদুল করিম নামের এক ব্যক্তি দিয়েছেন ৯৪ লাখ, লিমা আক্তার ১৫ লাখ, তামান্না আক্তার ২২ লাখ, রাসেল আমান্ডা মণ্ডল ১৭ লাখ ২৭ হাজার, সাদমান সাইফ ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ও এম এ কাশেম ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা দেন।

তাঁদের অভিযোগ, টাকা নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ঘোরাতে থাকে। কখনো বলে, ‘আপনার ফাইল হাইকমিশনে পাঠানো হয়েছে’, কখনো বলে ‘ভিসার প্রক্রিয়া চলছে’। একপর্যায়ে অনেকে বুঝতে পারেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। কেউ টাকা ফেরত চাইলে হুমকি দেওয়া হয়, এমনকি আইনি জটিলতায় ফেলার ভয়ও দেখানো হয়।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

তদন্তে আরও জানা গেছে, ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’ নামের প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয়। পরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় পুনরায় লাইসেন্স নবায়ন করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খায়রুল বাশার বাহার ‘বুশরা-সেলিমা-বাশার ফাউন্ডেশন’ নামের একটি অলাভজনক সংস্থারও সভাপতি। সহসভাপতির দায়িত্বে আছেন তাঁর স্ত্রী সেলিমা রওশন।

সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক লেনদেনের জন্য একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে। বেশির ভাগ চেক ইস্যু করা হয়েছে ব্যক্তিগত নামে, যাতে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা থেকে যায়। এরপর সেই অর্থ নানা পথে স্থানান্তর করা হয়েছে।

মামলায় খায়রুল বাশার বাহার, তাঁর ছেলে আরশ ইবনে বাশার এবং স্ত্রী খন্দকার সেলিনা রওশন ছাড়াও অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে সিআইডি জানিয়েছে, আসামিরা কেউ দেশে নেই। তাঁরা দেশ থেকে গোপনে পালিয়েছেন। তাঁদের অন্য দেশের পাসপোর্ট ছিল। তাঁরা সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে গোপনে দেশ ছেড়েছেন।

এ বিষয়ে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিএসবির কর্ণধারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে ১৪১ জন ভুক্তভোগীর বিষয়টি মামলায় এসেছে। বাকি ৭০০ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির অভিযোগের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত