আজকের পত্রিকা ডেস্ক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, লেখক, গবেষক এবং বাম ধারার বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর ৯৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। আজ রোববার সকালে ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে দেশের প্রগতিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জন্ম ও শিক্ষা
বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবুল হাশিম ও মাতার নাম মাহমুদা আখতার মেহেরবানু বেগম। পিতা আবুল হাশিম একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। উমর ১৯৪৮ সালে বর্ধমান টাউন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। দর্শন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৬১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (পিপিই) ডিগ্রি লাভ করেন।
অক্সফোর্ডে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি ও লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ।
শিক্ষক থেকে বুদ্ধিজীবী
বদরুদ্দীন উমর তাঁর পেশাজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন, যা তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক অবদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ছিল ব্যাপক। তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে আমৃত্যু সেটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি
বদরুদ্দীন উমরের সর্বজনস্বীকৃত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতি হচ্ছে তিনটি বিশাল খণ্ডে রচিত ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে একটি সুসংহত সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন। রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাঙালির মননজগতে বদরুদ্দীন উমরের স্থান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং স্বীকৃত। সাহিত্যিক শংকর তাঁকে ‘ভাষা আন্দোলনের কাশীরাম দাশ’ হিসেবে অভিহিত করে তাঁর এ অবদানের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। আবুল কাসেম ফজলুল হক তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, বদরুদ্দীন উমর সম্ভবত সেই সৃষ্টিশীল ধারার পথিকৃৎ, যা বিগত কয়েক দশক ধরে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছিল।
এই গ্রন্থ রচনার পটভূমি ছিল ব্যাপক ও গবেষণামূলক। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ ইতিহাস রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহ শুরু করলেও পরে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এই কাজ সম্পন্ন করতে তাঁকে প্রায় কুড়ি বছর (১৯৬৩-৮২) ব্যয় করতে হয়েছে এবং তিন সহস্রাধিক তথ্য-উৎস ব্যবহার করতে হয়েছে। প্রায় ২০০ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনাটিও ছিল ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে, যা ছিল তাঁর বাবা আবুল হাশিমের অনুরোধে লেখা ‘আমাদের ভাষার লড়াই’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা।
গবেষণার নেপথ্যে: চ্যালেঞ্জ ও অধ্যবসায়
বদরুদ্দীন উমরের গবেষণামূলক কাজ ছিল অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। ভাষা আন্দোলনের মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়ে ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল লিখিত তথ্যসূত্রের অভাব এবং স্মৃতিচারণের বিভ্রান্তি। অনেক সময় দেখা গেছে, প্রত্যক্ষদর্শীরাও দুর্বল স্মৃতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে ভুল তথ্য দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি যাচাই করতে গিয়ে তিনি দেখেন, আতাউর রহমান খান নিজেকে ওই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত বলে দাবি করলেও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এসব সমস্যা সত্ত্বেও তিনি অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তিনি সংবাদপত্র, বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কিত পুস্তক-পুস্তিকা, পার্টি দলিলপত্র, ইশতেহার এবং তৎকালীন রাজনীতিবিদ ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ব্যাপক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সরকারি কোনো তথ্য উৎস থেকে খুব বেশি সাহায্য তিনি পাননি। তাঁর এই নিরলস পরিশ্রমের ফসল হিসেবেই বাংলা ভাষা আন্দোলন একটি সুসংবদ্ধ ঐতিহাসিক রূপ লাভ করে। তার গ্রন্থত্রয় সম্মিলিতভাবে একটি বিরাট জন-অঞ্চলের সামাজিক জীবনের গভীরতম দলিল, যা পূর্ব বাংলার উজ্জ্বল জীবন-নাট্যকে তুলে ধরে।
রাজনৈতিক দর্শন
বদরুদ্দীন উমর কেবল একজন ইতিহাসবিদ ছিলেন না, তাঁর রচনায় সমাজ, রাজনীতি এবং পার্টির অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর লেখালেখির মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের সার্বিক শোষণমুক্তির উদ্দেশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলা। বিশ্লেষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তীক্ষ্ণ। তাঁর প্রতিটি গ্রন্থ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের জন্য একটি মূল্যবান দলিল।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে তিনি কেবল ভাষার আন্দোলন হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশের সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল, যা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলে। তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনই পাকিস্তানি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ব্যাপক জাতীয় প্রতিরোধ। ভাষা আন্দোলনের ফলে বুর্জোয়া রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতা ধর্মনিরপেক্ষতা লাভ করে এবং তা সামনে উঠে আসে।
তবে তিনি ভাষা আন্দোলনের কিছু দুর্বলতার দিকও তুলে ধরেছেন। যেমন, ভাষা আন্দোলনকে সমগ্র পাকিস্তানের সমস্যা হিসেবে দেখতে না পারা এবং এর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রের অভাব। তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়গুলোতে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, কোনো শক্তিশালী সাহিত্যের জন্ম হয় না এবং এর ফসলকে শাসক-শোষকরাই ভোগ করে।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর সহজ, অনাড়ম্বর এবং ধারালো গদ্যশৈলীর জন্য পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শক্তিশালী গদ্যশিল্পী। তাঁর লেখালেখি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর আপোসহীন সংগ্রাম তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে।
জীবনে কখনো পুরস্কার নেননি
বদরুদ্দীন উমরকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি। সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করলেও সেটিও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
চলতি বছরের মার্চে স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় নাম ঘোষণা করলে এক বিবৃতিতে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’
এর আগে ১৯৭২ সালে বদরুদ্দীন উমরকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়, তবে তিনি তা তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ইতিহাস পরিষদের পুরস্কার পান এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন।
[১৯৮১ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন অবলম্বনে]
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, লেখক, গবেষক এবং বাম ধারার বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর ৯৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। আজ রোববার সকালে ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে দেশের প্রগতিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জন্ম ও শিক্ষা
বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবুল হাশিম ও মাতার নাম মাহমুদা আখতার মেহেরবানু বেগম। পিতা আবুল হাশিম একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। উমর ১৯৪৮ সালে বর্ধমান টাউন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। দর্শন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৬১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (পিপিই) ডিগ্রি লাভ করেন।
অক্সফোর্ডে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি ও লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ।
শিক্ষক থেকে বুদ্ধিজীবী
বদরুদ্দীন উমর তাঁর পেশাজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন, যা তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক অবদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ছিল ব্যাপক। তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে আমৃত্যু সেটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি
বদরুদ্দীন উমরের সর্বজনস্বীকৃত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতি হচ্ছে তিনটি বিশাল খণ্ডে রচিত ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে একটি সুসংহত সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন। রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাঙালির মননজগতে বদরুদ্দীন উমরের স্থান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং স্বীকৃত। সাহিত্যিক শংকর তাঁকে ‘ভাষা আন্দোলনের কাশীরাম দাশ’ হিসেবে অভিহিত করে তাঁর এ অবদানের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। আবুল কাসেম ফজলুল হক তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, বদরুদ্দীন উমর সম্ভবত সেই সৃষ্টিশীল ধারার পথিকৃৎ, যা বিগত কয়েক দশক ধরে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছিল।
এই গ্রন্থ রচনার পটভূমি ছিল ব্যাপক ও গবেষণামূলক। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ ইতিহাস রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহ শুরু করলেও পরে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এই কাজ সম্পন্ন করতে তাঁকে প্রায় কুড়ি বছর (১৯৬৩-৮২) ব্যয় করতে হয়েছে এবং তিন সহস্রাধিক তথ্য-উৎস ব্যবহার করতে হয়েছে। প্রায় ২০০ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনাটিও ছিল ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে, যা ছিল তাঁর বাবা আবুল হাশিমের অনুরোধে লেখা ‘আমাদের ভাষার লড়াই’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা।
গবেষণার নেপথ্যে: চ্যালেঞ্জ ও অধ্যবসায়
বদরুদ্দীন উমরের গবেষণামূলক কাজ ছিল অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। ভাষা আন্দোলনের মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়ে ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল লিখিত তথ্যসূত্রের অভাব এবং স্মৃতিচারণের বিভ্রান্তি। অনেক সময় দেখা গেছে, প্রত্যক্ষদর্শীরাও দুর্বল স্মৃতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে ভুল তথ্য দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি যাচাই করতে গিয়ে তিনি দেখেন, আতাউর রহমান খান নিজেকে ওই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত বলে দাবি করলেও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এসব সমস্যা সত্ত্বেও তিনি অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তিনি সংবাদপত্র, বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কিত পুস্তক-পুস্তিকা, পার্টি দলিলপত্র, ইশতেহার এবং তৎকালীন রাজনীতিবিদ ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ব্যাপক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সরকারি কোনো তথ্য উৎস থেকে খুব বেশি সাহায্য তিনি পাননি। তাঁর এই নিরলস পরিশ্রমের ফসল হিসেবেই বাংলা ভাষা আন্দোলন একটি সুসংবদ্ধ ঐতিহাসিক রূপ লাভ করে। তার গ্রন্থত্রয় সম্মিলিতভাবে একটি বিরাট জন-অঞ্চলের সামাজিক জীবনের গভীরতম দলিল, যা পূর্ব বাংলার উজ্জ্বল জীবন-নাট্যকে তুলে ধরে।
রাজনৈতিক দর্শন
বদরুদ্দীন উমর কেবল একজন ইতিহাসবিদ ছিলেন না, তাঁর রচনায় সমাজ, রাজনীতি এবং পার্টির অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর লেখালেখির মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের সার্বিক শোষণমুক্তির উদ্দেশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলা। বিশ্লেষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তীক্ষ্ণ। তাঁর প্রতিটি গ্রন্থ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের জন্য একটি মূল্যবান দলিল।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে তিনি কেবল ভাষার আন্দোলন হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশের সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল, যা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলে। তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনই পাকিস্তানি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ব্যাপক জাতীয় প্রতিরোধ। ভাষা আন্দোলনের ফলে বুর্জোয়া রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতা ধর্মনিরপেক্ষতা লাভ করে এবং তা সামনে উঠে আসে।
তবে তিনি ভাষা আন্দোলনের কিছু দুর্বলতার দিকও তুলে ধরেছেন। যেমন, ভাষা আন্দোলনকে সমগ্র পাকিস্তানের সমস্যা হিসেবে দেখতে না পারা এবং এর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রের অভাব। তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়গুলোতে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, কোনো শক্তিশালী সাহিত্যের জন্ম হয় না এবং এর ফসলকে শাসক-শোষকরাই ভোগ করে।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর সহজ, অনাড়ম্বর এবং ধারালো গদ্যশৈলীর জন্য পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শক্তিশালী গদ্যশিল্পী। তাঁর লেখালেখি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর আপোসহীন সংগ্রাম তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে।
জীবনে কখনো পুরস্কার নেননি
বদরুদ্দীন উমরকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি। সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করলেও সেটিও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
চলতি বছরের মার্চে স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় নাম ঘোষণা করলে এক বিবৃতিতে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’
এর আগে ১৯৭২ সালে বদরুদ্দীন উমরকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়, তবে তিনি তা তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ইতিহাস পরিষদের পুরস্কার পান এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন।
[১৯৮১ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন অবলম্বনে]
গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভনে কিরগিজস্তানে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন ১৮০ জন বাংলাদেশি নাগরিক। আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁদের নিয়ে একটি বিমান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।
৮ মিনিট আগেনেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় রুটের বিমান চলাচল স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিমানের কাঠমান্ডুগামী একটি ফ্লাইট ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কাছাকাছি গিয়েও ফির
২০ মিনিট আগেআখতার আহমেদ বলেন, বিভিন্ন কাজে এনআইডির দরকার পড়ে। এটি বিবেচনায় নিয়ে ১৬ বছর বয়সীদের এনআইডি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বছরের যেকোনো সময় ১৬ বছর পূর্ণ হলেই এনআইডির জন্য নিবন্ধনের আবেদন করা যাবে।
১ ঘণ্টা আগেডাকসু নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের একটি মডেল হিসেবে অভিহিত করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আজ মঙ্গলবার দুপুরে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
৩ ঘণ্টা আগে