Ajker Patrika

বিআরটি প্রকল্প: সাধারণ সড়কের জন্যই এত ভোগান্তি

  • প্রকল্পে ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে ৪ হাজার কোটি টাকা
  • ৯৭% কাজ শেষ হলেও এখনো চলাচলযোগ্য নয়
  • খরচ ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে
  • এই নির্মাণকাজের জন্য এক যুগ ধরে ভোগান্তিতে মানুষ
তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা 
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ০৭
বিআরটি প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চার লেনের সড়কটি সাধারণ যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিআরটি প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চার লেনের সড়কটি সাধারণ যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

দীর্ঘ ১২ বছর চরম দুর্ভোগ দেওয়া বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প আপাতত অসমাপ্তই থাকছে। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিশেষ বাস চলাচলের জন্য নির্মাণ করা বিশেষ এই করিডর হয়ে যাচ্ছে সাধারণ যানবাহনের জন্য চার লেনের সড়ক। অথচ ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে সড়ক, উড়ালসড়ক, স্টেশনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে খরচ হয়ে গেছে ৪ হাজার কোটি টাকা। সঙ্গে মানুষকে পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

প্রকল্প দপ্তর সূত্র বলছে, বিআরটি প্রকল্প সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর ও মেয়াদ আরও চার বছর বাড়িয়ে ২০২৯ সাল পর্যন্ত করার প্রস্তাব ফেরত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার বিআরটি করিডরে বিশেষ ইলেকট্রিক (বিদ্যুৎ-চালিত) বাস চলাচলের ধারণা বাতিল করে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চার লেনের সড়কটি সাধারণ যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। সেই প্রস্তুতিই চলছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিআরটি প্রকল্প চালু হলেও যানজট নিরসন সম্ভব নয়। বিশেষায়িত লেনে শুধু বিআরটি বাস চললে অন্য লেনে যানজট আরও বাড়বে। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবহন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার সড়ক পরিবহন ও সেতুবিষয়ক বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এখন যে পরিকল্পনা নিচ্ছি, সেটি হয়তো বিআরটি আকারে আর খোলা হবে না। গাজীপুর অংশে যে কাজ বাকি আছে, তা শেষ করে স্বাভাবিক চার লেনের সড়ক হিসেবে খুলে দেওয়া হবে। এতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে।’ তিনি বলেন, এ মুহূর্তে নতুন করে আড়াই-তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করা যৌক্তিক হবে না। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৯ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাবে পরিকল্পনা কমিশন রাজি হয়নি। ফলে বিআরটি হিসেবে প্রকল্পটি শেষ করা যাচ্ছে না। বাকি কাজগুলো শেষ করে সড়কটি চলাচলযোগ্য করা হবে।

জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বিআরটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য দ্রুত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা পরবর্তী সময়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নতুন প্রস্তাবে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হলে পরিকল্পনা কমিশন ফেরত পাঠায়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ)।

প্রকল্প সূত্র বলছে, ৯৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হলেও প্রকল্প এলাকা পুরোপুরি চলাচলযোগ্য নয়। স্টেশনগুলোর ফিনিশিং কাজ, গাজীপুর অংশে ময়মনসিংহ রোডের অসম্পূর্ণ অংশ, ফুটপাত ও এসকেলেটর স্থাপনসহ কিছু কাজ এখনো বাকি। এ ছাড়া ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিভিন্ন স্টেশনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশও মেরামত করতে হবে।

চার লেনের সড়ক হিসেবে চালু হলেও প্রকল্পে ব্যয় বাড়বে কি না—এমন প্রশ্নে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, এখনো ঠিকাদারের কিছু দাবি আছে। সেগুলো মেটাতে গিয়ে বোঝা যাবে খরচ বাড়বে কি না। টাকা বাড়বে না, বাড়লেও খুব সামান্য।

প্রকল্পের আওতায় মোট ২০ দশমিক ২০ কিলোমিটার বিআরটি করিডর নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৫ দশমিক শূন্য ৭ কিলোমিটার ভূমিতে এবং ৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এলিভেটেড অংশ। নির্মাণ করা হচ্ছে ২৫টি স্টেশন, একটি বাস ডিপো (গাজীপুরে) এবং দুটি টার্মিনাল (একটি বিমানবন্দরে ও অন্যটি গাজীপুরে)। এ ছাড়া ছয়টি উড়ালসড়ক (ফ্লাইওভার) নির্মাণ হচ্ছে বিমানবন্দর, জসীমউদদীন, কুনিয়া, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ভোগরা এবং জয়দেবপুর চৌরাস্তা এলাকায়। টঙ্গী ব্রিজকে ১০ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। রয়েছে আটটি অ্যাকসেস রোড, ১১৩টি (প্রায় ৫৬ কিলোমিটার) নর্দমা এবং উভয় পাশে মোট ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ফুটপাত।

বিআরটি করিডরের পরিবর্তে সাধারণ সড়ক চালুর প্রস্তুতির কারণে বিশেষ বাস লেনের ধারণাটি আপাতত বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন বলেন, ‘পরের নতুন সরকার যদি মনে করে বিআরটি হিসেবে চালু করবে, তাহলে সেটি করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু কিছু বাস কেনা ও কাউন্টারগুলো চালু করা।’

এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য বিমানবন্দর-গাজীপুর রুটে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মানুষ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। বিশেষায়িত লেন না থাকায় সাধারণ সড়কে যানজট বেড়ে গেছে, পথচারীর চলাচল ও পারাপারে অসুবিধা হচ্ছে এবং ধুলা ও শব্দদূষণও বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। ৬ অক্টোবর গাজীপুরে ‘গাজীপুরের সর্বস্তরের জনগণ’-এর ব্যানারে মানববন্ধনও হয়েছে। ওই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রকল্পের কাজ চলায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। তাঁরা দ্রুত কাজ শেষ করা, পথচারী পারাপারের নিরাপদ ব্যবস্থা, ফুটওভার ব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ ৯ দফা দাবি জানান।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘১২ বছর পর এসে করিডর ধারণা বাতিল করা বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও নীতিগত ব্যর্থতা। এ প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ও জনসম্পদ ব্যয় হয়েছে। সাধারণ যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করা অস্থায়ীভাবে স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে নগর পরিবহনব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত