Ajker Patrika

সংস্কার হবে অধ্যাদেশে, পরে সংবিধান সংশোধন

  • মন্ত্রণালয়-বিভাগ পর্যায়ে ১২১টি সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত।
  • সংবিধান সংশোধন করে বাস্তবায়নযোগ্য দুই প্রস্তাবও অধ্যাদেশ দিয়ে বাস্তবায়ন।
  • এভাবে অধ্যাদেশ জারির বিষয়টি ভবিষ্যতে প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
শহীদুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ১০: ৪৮
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

পাঁচটি সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে ১২১টি প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে দুটি বিষয় রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু সরকার এ দুটি বিষয়ও অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর একটি নিয়ে ইতিমধ্যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন করে ওই বিষয়গুলো নতুন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজন করা হবে বলে জানা গেছে।

সংবিধান সংশোধন করে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়ে অধ্যাদেশ জারির বিষয়টি ভবিষ্যতে প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের নিজেরই সাংবিধানিক বৈধতা নেই। এখন সংবিধান সংশোধন করতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুত সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ করা ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর বাইরে সংলাপ ছাড়াই ১২১টি প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংসদ কার্যকর না থাকায় অধ্যাদেশ জারি করে ওই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সরকারি দপ্তরকে কমিশনের এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে, তা নির্ধারণ করে সেগুলো বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দিয়ে ১৯ মার্চ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের দুটি প্রস্তাব সংবিধান সংশোধন করে বাস্তবায়ন করার কথা। এই দুটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে পরে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যান্য বিচারক নিয়োগের জন্য স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এই সুপারিশ আশু বাস্তবায়নের তালিকায় রেখে আইন ও বিচার বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংসদ এবং অর্থ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে করণীয় হিসেবে নতুন অধ্যাদেশ জারি ও কমিশন গঠন এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার।

তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী সরকারি দপ্তরগুলোকে এ বিষয়ে সংবিধানের ৯৫(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে বলা আছে।

অন্যদিকে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগে অস্থায়ী ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি স্থায়ী জাতীয় অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত আশু বাস্তবায়নের তালিকায় রাখা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আইন ও বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগকে। এসব সরকারি দপ্তরের করণীয়তে বলা হয়েছে, অ্যাটর্নি সার্ভিস-সংক্রান্ত সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ ৬৪(ক) সংযোজন, জাতীয় অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠাকরণের উদ্দেশ্যে অধ্যাদেশ প্রণয়ন, অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন, সংশোধিত সংবিধান অনুসারে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন, দ্য বাংলাদেশ ল অফিসার্স অর্ডার, ১৯৭২ রহিতকরণ...।

উল্লেখ্য, সংবিধানের ৬৪ অনুচ্ছেদে অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। একটি স্থায়ী জাতীয় অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার এই অনুচ্ছেদের সঙ্গে নতুন করে ৬৪(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করতে হবে।

সংবিধান সংশোধন করে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলে তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এগুলোর লিগ্যালিটি নিয়ে পরে প্রশ্ন উঠবে। অধ্যাদেশ জারির ক্ষেত্রে যে যুক্তিগুলো আসছে, সবকিছুই তো ডকট্রিন অব নেসেসিটিকে ধরে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকেই হচ্ছে। তখন হয়তো সংবিধানের সংশোধনীকে অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে করাকেও জাস্টিফাই করার চেষ্টা করবে। এগুলো ভবিষ্যতে আসলে কতটুকু টিকবে বা টিকবে না, তা এখনই একবাক্যে বলে দেওয়া মুশকিল।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সরকারেরই তো বৈধতা নেই, সেটিকে তো রেকটিফাই করার প্রয়োজনীয়তা আছে। এই সরকারের কর্মকাণ্ড বৈধ কি অবৈধ, তা তুলতে গেলে ওই মৌলিক প্রশ্নও আসে। আমরা তো এ সরকারকে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে মেনে নিয়েছি। তাহলে তাঁদের অধ্যাদেশ কেন মেনে নেব না? বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল সার্ভিস তৈরি করার কথা বলছে, সেটা আমি সমর্থন করি। কিন্তু বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে আইন পাস করেছে, সেটি আসলে খুবই প্রবলেম্যাটিক। এটা বিচার বিভাগকে ভবিষ্যতে নানা ধরনের প্রশ্নের মধ্যে ফেলবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে এগুলো সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।

সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজন মনে হলে তিনি অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন। তবে ওই অধ্যাদেশের কারণে সংবিধানের কোনো বিধানের পরিবর্তন বা রহিত হয় এমন অধ্যাদেশ জারি করা যাবে না—এমনটিই বলা আছে সংবিধানে।

তবে ১০ মার্চ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন সম্ভব।

আশু বাস্তবায়ন হচ্ছে যেসব সংস্কার প্রস্তাব

আশু বাস্তবায়নযোগ্য ১২১টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৩টি সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, দুদক আইন সংশোধন করে কমিশনারের সংখ্যা পাঁচজনে উন্নীতকরণ, দুদক কমিশনারের মেয়াদ পাঁচ বছর করা, আয়কর আইনের একটি ধারা সংশোধন করে দুদককে কোনো তথ্য বা দলিল দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ।

এ ছাড়া দুদকের নিজস্ব বেতন কাঠামো, যেসব জেলায় দুদকের কার্যালয় রয়েছে, সেখানে বিশেষ জজ আদালত প্রতিষ্ঠা, বেসরকারি খাতের ঘুষ লেনদেনকে শাস্তির আওতায় আনা, দুদক আইনের ৩২ক ধারা বাতিল, উচ্চমাত্রার দুর্নীতি তদন্তে বিভিন্ন এজেন্সির সমন্বয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন, পর্যায়ক্রমে সব জেলায় দুদকের জেলা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৩৮টি প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নের তালিকায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়ন, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য আচরণ বিধিমালা জারি, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা, আইনজীবীর বিরুদ্ধে করা মামলায় অন্য পক্ষে অন্য আইনজীবী নিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সার্কুলার জারি করা হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি সুপারিশের মধ্যে স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, তথ্য অধিকার আইন সংশোধন, পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট দেওয়া, পুলিশের হাতে থাকা ফৌজদারি মামলার আসামিদের তালিকা অনলাইনে সহজলভ্য রাখা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ পুনর্গঠন, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো কর্মচারী পদোন্নতির সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যাওয়ার পর ইনক্রিমেন্ট না পেলে তিনি যদি বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ডে দণ্ডিত না হন, তবে তাকে দুই বছর পর পরবর্তী বেতন স্কেলে দেওয়া, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের বাইরে ৫ শতাংশ পদে পার্শ্ব নিয়োগ এবং অতীতে যেসব সরকারি কর্মকর্তা ভোট জালিয়াতি, অর্থ পাচার, দুর্নীতি এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ আশু বাস্তবায়নের তালিকায় রয়েছে।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের ১৩টি প্রস্তাবের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগে পুলিশের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, পুলিশ কমিশন ও পুলিশের জন্য পরিপূর্ণ মেডিকেল সার্ভিস গঠন; রাতে কারও বাসায় তল্লাশির সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ; এফআইআরবহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার না করা, ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষার জন্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনিপ্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

আশু বাস্তবায়নের তালিকায় থাকা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ৯টি সুপারিশ হলো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন সংশোধন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা সংশোধন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধন, হলফনামার খসড়া, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং পোস্টাল ব্যালট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত