Ajker Patrika

জুলাই সনদ: আদেশ জারি, গণভোট নিয়ে অনৈক্যে বেকায়দায় সরকার

  • সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির এখতিয়ার সরকারের নেই: বিএনপি
  • দ্রুত বাস্তবায়ন আদেশ জারি চায় জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি
  • নভেম্বরে গণভোট দাবি জামায়াতের। বিএনপি বলেছে, ‘অযৌক্তিক’
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে আদেশ জারি ও গণভোট নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন সংকট। গণভোটের সময় এবং আদেশ জারির এখতিয়ার প্রশ্নে আবারও বিভক্ত হয়ে গেছে রাজনৈতিক দলগুলো। দলগুলোর এমন অনৈক্য অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন কীভাবে বিষয়গুলো সামাল দিয়ে দ্রুত সনদের আদেশ জারি করা যায়, তা নিয়ে বেকায়দায় সরকার।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গতকাল বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের মধ্যে যে অনৈক্যের সুর দেখছি, এটা হতাশাব্যঞ্জক। এই তীব্র বিরোধের মধ্যে কীভাবে সমঝোতার দলিল পাস হবে, এটা খুব দুরূহ একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে।’

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গত মঙ্গলবার সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারির কথা বলা হয়। পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে দুটো বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণভোটের আগে সরকার জাতীয় সনদের ভিত্তিতে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করবে, যা গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। ফলাফল ইতিবাচক হলে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা একযোগে এমপি ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা প্রথম অধিবেশন থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবেন। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বিলের কথা বলা নেই। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়া হলেও প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার শেষ করার কথা বলা হয়।

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ দ্রুত জারির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের মতো সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত আদেশ জারির পক্ষে জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। দলটির দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসই এই আদেশে স্বাক্ষর করবেন, রাষ্ট্রপতি নন।

তবে বিএনপি বলেছে, সরকারের এমন আদেশ জারির এখতিয়ার নেই। এ ছাড়া গণভোট নিয়েও দলগুলোর মধ্য মতভেদ তীব্র হয়েছে। বিএনপি সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের পক্ষে। একই মত গণঅধিকার পরিষদেরও। তবে জামায়াতে ইসলামীর দাবি, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে।

সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যেসব বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আসেনি, তা রাখা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সময়স্বল্পতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে ‘একপেশে’ও ‘জবরদস্তিমূলক’ বলে মনে করছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশমালাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশকে বিএনপি ‘একপেশে’ ও ‘চাপিয়ে দেওয়া’ বললেও এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করছে দলটি। সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি নিয়ে এক মুহূর্ত দেরি করার পক্ষে নন জামায়াত নেতারা। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের উদ্দেশে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘কোনো সময় ক্ষেপণ না করে আজই (বৃহস্পতিবার) ঘোষণা করুন। রাতের বেলায়ও অনেক আদেশ জারি করা যায়। না হলে আপনার সরকারের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। আর যদি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে জাতীয় নির্বাচন করা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

আদেশ জারিতে বিলম্ব হলে জামায়াত কী করবে জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘আমরা আন্দোলনের মধ্যেই আছি। আজকের (বৃহস্পতিবার) রাতের মধ্যেই দেখি করবে কি না। কালও (শুক্রবার) সময় আছে। বাকিটা কাল দেখা যাবে।’

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সবাই এক রকম কথা বলছে, শুধু বিএনপি ভিন্ন কথা বলছে। তবে জাতীয় স্বার্থে সবার এক হওয়া উচিত। ঐকমত্য কমিশন যেহেতু জাতীয় স্বার্থে একটা সনদ করেছে, সেটি বাস্তবায়নে এখন সবার সহযোগিতা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।’

জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মো. তাহেরও বলছেন, ‘জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে, এর ফলে রাজনীতিতে কিছুটা বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে চরম পর্যায়ে না গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে এ বিষয়ে ঐকমত্যে আসা দরকার এবং সেটা খুব শিগগিরই।’

জামায়াতের মতো সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত আদেশ জারির পক্ষে এনসিপিও। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা মনে করি, সুপারিশকৃত সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করতে হবে সরকারকে। এতে সই করার একমাত্র এখতিয়ার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ অনৈক্য তৈরি করেছে বলে বিএনপির মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন এনসিপির নেতারা। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর বিএনপির এই অবস্থান দ্বিচারিতা বলে মনে করেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে নাসীরুদ্দীন বলেন, ‘তাঁদের এখন আর “না” বলার সুযোগ নেই। তাঁরা বিবাহে রাজি হয়েছেন, কাবিননামায় সই করেছেন। তাই “না” বলার কোনো সুযোগ নেই। তাঁদের ভেবেচিন্তে জুলাই সনদে সই করা উচিত ছিল।’

বাস্তবায়ন আদেশ জারিতে জামায়াতে ইসলামী সরকারকে আলটিমেটাম দিলেও এনসিপি আপাতত কোনো আলটিমেটাম দেবে না। দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘এখনই আমরা আলটিমেটাম দিতে চাই না, তবে আমরা চাই, অবিলম্বে এই আদেশ জারি হোক।’

বিএনপির সঙ্গে একমত পোষণ করে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোটের পক্ষে অবস্থান গণঅধিকার পরিষদের। দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘নির্বাচন আর গণভোট একই দিনে এইটা আমাদের প্রস্তাব ছিল না। এইটা কমিশনেরই প্রস্তাব ছিল। আমরা তাতে রাজি হয়েছি। রাজি হওয়ার পরেও সরকার এখন জামায়াত ও এনসিপির চাওয়া অনুযায়ী গণভোট আগে করতে চাচ্ছে। নোট অব ডিসেন্ট বাদ রেখেই সনদ দিয়েছে।’

গণভোটের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত চলছে বলেও অভিযোগ করেন রাশেদ। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, দিল্লি-হাসিনার পরামর্শে, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি মহল চক্রান্ত করছে। সেই মহল মনে করছে, গণভোটের নামে রাষ্ট্র অস্থিতিশীল করে দিয়ে জাতীয় নির্বাচন বানচাল করে আরেকটি এক-এগারো সৃষ্টির চক্রান্ত শুরু হয়েছে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফি রতন বলেন, ‘বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে জামায়াত ও এনসিপিকে খুশি করার যে চেষ্টা, তা বিপজ্জনক। গণভোটের বিষয়টা আমরা অপ্রয়োজনীয় মনে করি। আমরা মনে করি, নির্বাচনের দিনে একই দিনে হওয়া উচিত।’

দলগুলোর এমন মতবিরোধ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘উনাদের (রাজনৈতিক দল) তো আসলে ঐকমত্য হয় নাই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে এর আগে আমরা জেনেছিলাম কনটেন্ট নিয়ে বিরোধ ছিল, যে সংস্কার হবে সেই বিষয়বস্তু নিয়ে বিরোধ ছিল। এখন আবার দেখলাম আরও দুই ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছে; একটা হচ্ছে জুলাই সনদ কী পদ্ধতিতে পাস করা হবে, আরেকটা হচ্ছে গণভোট কবে হবে।’

এই বিরোধকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে জাতির অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সরকার তো প্রত্যেকটা জায়গায় রীতিমতো জাতিকে হতাশ করল। শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদে মন-কষাকষি হয়। সেখানে একটা দলের প্রতি কিংবা দলের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে সাধারণ মানুষ তো টের পাচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা তো ভালো নয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি আমলের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মিলনকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিল ইমিগ্রেশন পুলিশ

বিদ্যুতের লাইন ঠিক করার কথা বলে ঘরে ঢুকে কিশোরীকে ধর্ষণ, যুবক গ্রেপ্তার

প্রতারণার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে এই সরকার: মান্না

শেখ মুজিবের ছবি টাঙানোর বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব নেই জুলাই সনদে, ক্ষোভ বিএনপির

বদলি-পদায়ন নিয়ে জটিলতার পর জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ