Ajker Patrika

অনিশ্চয়তায় ঢাকা বিআরটি কোম্পানি

  • প্রকল্প অসমাপ্ত রেখে শেষ হচ্ছে, কাজ থাকছে না বিআরটি কোম্পানির
  • প্রকল্পের তহবিল থেকে চলে কোম্পানির ব্যয়, অর্থ নিয়েও অনিশ্চয়তা
  • অন্য কাজে যুক্ত হতে চায় কোম্পানিটি, ডিটিসিএর একাধিক প্রস্তাব
তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ফাইল ছবি
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ফাইল ছবি

বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ করার সরকারের সিদ্ধান্তে বিআরটি পরিচালনার জন্য গঠিত ঢাকা বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির (পিএলসি) ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রকল্পটি চালু না হলে কার্যত এই কোম্পানির কোনো কাজ থাকছে না। প্রকল্পের তহবিল থেকে কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও পরিচালন ব্যয় মেটানো হয় বলে এ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

সূত্র বলেছে, প্রকল্প বন্ধ হলে বিআরটি কোম্পানিকে অন্য কোনো কাজে যুক্ত করার বিষয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সড়ক পরিবহন ও সেতুবিষয়ক বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন বলেছেন, বিআরটি কোম্পানির ক্ষেত্রে আপাতত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। যদি কোম্পানি নিজেরা অন্য কোনো কাজে অংশ নিতে চায়, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।

রাজধানীর যানজট নিরসন ও যাত্রীদের জন্য দ্রুতগতির গণপরিবহন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বিশেষ বাস চলাচলের জন্য এই করিডরের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার। প্রকল্পটির নির্মাণকাজের জন্য প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা ও যাত্রীদের এক যুগ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। কাজ শেষ না হলেও এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিশেষ বাস চলাচলের করিডরের ধারণা বাতিল হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চার লেনের সড়ক সাধারণ যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা বিআরটি কোম্পানি (পিএলসি) গঠিত হয়েছিল বিআরটি রুট পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। কিন্তু প্রকল্প চালু না হলে কোম্পানির কাজও কার্যত শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এই কোম্পানির মূল দায়িত্বের মধ্যে ছিল বাস কেনা, বিআরটি পরিচালনার জন্য আইটিএস সরঞ্জাম কেনা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র ও সিগন্যাল সিস্টেম স্থাপন, বিদ্যমান বাস অপারেটরদের সঙ্গে সমন্বয় এবং বিআরটি বাস অপারেটর নির্বাচন। কিন্তু গত ১২ বছরে এসব কাজের কোনোটিই সম্পন্ন করতে পারেনি কোম্পানিটি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করলেও এখনো একটি বাসও কেনা যায়নি। বর্তমানে ঢাকা বিআরটি কোম্পানিতে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদা) নেতৃত্বে ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. নূরুল আমিন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্প এগোবে কি না, সেটি আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানি না। যদি প্রকল্প স্থগিত হয়, তাহলে সরকার আমাদের অন্য কোনো দায়িত্ব দিতে পারে। তবে প্রকল্পের অর্থ থেকেই আমাদের বেতন ও পরিচালন ব্যয় মেটানো হতো। প্রকল্প বন্ধ হলে এই খাত থেকে অর্থ পাওয়া যাবে না, তখন কোম্পানির কার্যক্রম কীভাবে চলবে, সেটি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।’

প্রকল্প না এগোনোর সিদ্ধান্তের পর ঢাকা বিআরটি কোম্পানি বিআরটি প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা ডিটিসিএর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ডিটিসিএ সূত্র জানায়, প্রকল্প বন্ধ হলে কোম্পানিকে অন্য কোনো কাজে যুক্ত করার বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডিটিসিএর ‘ক্লিয়ারিং হাউস’ প্রকল্পে কোম্পানিকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাবও আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়েছে।

বিআরটি প্রকল্প নিয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে প্রধান উপদেষ্টার সড়ক পরিবহন ও সেতুবিষয়ক বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন গত রোববার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পে আমরা কোনো বাস কিনছি না এবং টিকিট কাউন্টারগুলোও চালু করছি না। প্রকল্পের রাস্তাটি এখন চার লেনের একটি সাধারণ সড়ক হিসেবে খুলে দেওয়া হবে, যাতে অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে পারে। তবে প্রকল্পের অবকাঠামো যেমন আছে, তেমনই থাকবে, কোনো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। ঢাকা বিআরটি কোম্পানির ক্ষেত্রেও আপাতত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তারা যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। যদি কোম্পানি নিজেরা অন্য কোনো কাজে অংশ নিতে চায়, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।’ তিনি বলেন, ভবিষ্যতে নতুন সরকার চাইলে বিআরটি সেবা চালু করতে পারবে। তাদের শুধু বাস কিনতে হবে ও টিকিট কাউন্টারগুলো চালু করতে হবে। তখন ঢাকা বিআরটি কোম্পানিকেই ব্যবহার করা যেতে পারে।

বৃহৎ কাঠামোর অসমাপ্ত পরিসমাপ্তি

অসমাপ্ত এই প্রকল্পের আওতায় ২০ দশমিক ২০ কিলোমিটার করিডর নির্মাণ করা হয়েছে। এর ১৫ দশমিক ০৭ কিলোমিটার ভূমিতে এবং ৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার উড়ালসড়ক (এলিভেটেড) অংশ। রয়েছে ২৫টি স্টেশন, একটি বাস ডিপো (গাজীপুরে), দুটি টার্মিনাল (বিমানবন্দর ও গাজীপুরে), ছয়টি ফ্লাইওভার (বিমানবন্দর, জসীমউদ্দীন, কুনিয়া, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ভোগরা ও জয়দেবপুর চৌরাস্তা এলাকায়), টঙ্গী সেতু ১০ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আটটি অ্যাকসেস রোড, প্রায় ৫৬ কিলোমিটার নর্দমা ও ২৪ কিলোমিটার ফুটপাত করা হয়েছে।

শেখ মইনউদ্দিন বলেন, বিআরটি প্রকল্প শেষ করতে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়েছিল। সেটি অনুমোদন পায়নি। ফলে প্রকল্পটি এভাবেই শেষ করতে হচ্ছে। এখন ঠিকাদারের কিছু পাওনা ও অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়ে ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল পরিকল্পনা, সমন্বয়ের অভাব, ঠিকাদারি বিলম্ব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব—এসব কারণে বিআরটি প্রকল্প সফল হয়নি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বিআরটি প্রকল্প একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবহনব্যবস্থার ধারণা ছিল। সেটি বাতিল হলে পুরো পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে যায়। এত বড় বিনিয়োগের পরও যদি প্রকল্পটি সেবা দিতে না পারে, তাহলে এটি হবে একধরনের ‘স্ট্রাকচারাল ওয়েস্ট’। এখন জরুরি হলো ঢাকা বিআরটি কোম্পানির মানবসম্পদ ও সক্ষমতাকে অন্য পরিবহন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজে লাগানো, যেন রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ পুরোপুরি ব্যর্থ না হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি আমলের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মিলনকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিল ইমিগ্রেশন পুলিশ

বিদ্যুতের লাইন ঠিক করার কথা বলে ঘরে ঢুকে কিশোরীকে ধর্ষণ, যুবক গ্রেপ্তার

প্রতারণার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে এই সরকার: মান্না

শেখ মুজিবের ছবি টাঙানোর বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব নেই জুলাই সনদে, ক্ষোভ বিএনপির

বদলি-পদায়ন নিয়ে জটিলতার পর জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ