Ajker Patrika

এক স্থানের জনপ্রতিনিধি কীভাবে গোটা জাতির আইন প্রণয়ন করেন: সলিমুল্লাহ খান

 উত্তরা (ঢাকা) প্রতিনিধি 
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ০২
Thumbnail image
আজ মঙ্গলবার রাতে জাতীয় নাগরিক কমিটির ঢাকা মহানগর উত্তরের থানা প্রতিনিধি সভায় বক্তব্য দেন লেখক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। ছবি: আজকের পত্রিকা

লেখক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘আমাদের সংবিধান বাস্তবায়ন কমিটি যখন গঠন হল, তখন তারা সবাই গিয়ে ড. কামাল হোসেন সাহেবের সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে গেলেন। ড. কামাল হোসেন সংবিধানের কি বোঝেন? বাংলাদেশে সংবিধানে লেখা হয়েছিল, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সংসদে। এটা হল সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে মালিকানা। সমস্ত ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ। জনগণই ক্ষমতার কেন্দ্র। উৎস বলতে বোঝায়, আপনি (জনগণ) ক্ষমতা দিলেন, আরেকজন চালাবার জন্য। আপনি (জনগণ) মালিকানা দেন না, ম্যানেজারি করার ক্ষমতা দেন।’

রাজধানীর গুলশানের একটি কনভেনশন হলে আজ মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) রাতে জাতীয় নাগরিক কমিটির ঢাকা মহানগর উত্তরের থানা প্রতিনিধি সভায় অতিথি আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের এই অধ্যাপক বলেন, ‘রাষ্ট্রে যারা সংসদে নির্বাচিত হন, তাঁরা হচ্ছেন বড়জোর ম্যানেজার। মালিকেরা তাঁদের নিয়োগ দেন। তাঁরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করেন, মালিকের অধিকার আছে, তাঁকে চাকরিচ্যুত করার, বরখাস্ত করার। বাংলাদেশের সংবিধানের নিয়ম হচ্ছে পাঁচ বছর। যদি সে পাঁচ বছরের মধ্যেই দায়িত্ব থেকে অবহেলা করে, বেইমানি করে তাঁকে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা জনগণ রাখে। এটাই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব।’

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব হচ্ছে অবিভক্ত অখণ্ড। বাংলাদেশের ১৮ কোটি লোক মিলে সার্বভৌমত্ব। একজনের ওপর, দুজনের ওপর সার্বভৌমত্ব হয় না। কিন্তু আমরা কার্যত এক ব্যক্তির হাতে, এক পরিবারের হাতে ন্যস্ত করেছিলাম। এটা হচ্ছে আমাদের ঐতিহাসিক ভুল অথবা ব্যর্থতা। সার্বভৌমত্ব জিনিসটা যেমন বিক্রয় করা যায় না, কারও হাতে তুলেও দেওয়া যায় না। সেই জন্যে সংসদ নির্বাচন করা হয় বিশেষ কিছু কাজ দেওয়ার জন্য, মালিক হওয়ার জন্য নয়। যেটা দেওয়া হয়, নির্দিষ্টকালীন শাসনের ভার।’

গণ বুদ্ধিজীবি সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘যেটা না হলে বাংলাদেশ গঠিত হয় না। ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল ১৯৭১ সালে। সংবিধান লিখে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধান লেখার দায়িত্ব বা ক্ষমতা এসেছিল। সেটার আমরা অপব্যবহার করেছি। উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, ১৯৭২ সালে যে সংবিধান লেখা হয়েছিল, বর্তমানে তা অজ্ঞান অবস্থায় আছে। ওই সংবিধানের মূল সমস্যা হল তিন ভাগ। জনগণের অধিকার (প্রস্তাবনা আকারে আছে), রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি ও মৌলিক অধিকার। সংবিধানের বাকি পাঁচ ভাগের প্রথমেই আছে আমলাতন্ত্রের শাসন। যেটার প্রথমে আছে নির্বাহী বিভাগ। প্রধান আমলা প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের গোড়াতেই আছে, আমলাতন্ত্রের অপ্রতিহত ক্ষমতা। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা তারপরে দেওয়া হয়েছে। যার নাম হচ্ছে সংসদ বা আইন আইনসভা। তৃতীয় ভাগে রয়েছে বিচার বিভাগ। বাকিগুলো সংবিধানে না থাকলেও চলতো, অন্য আইনে হলেও হতো।’

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচিত সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাব হচ্ছে, বিচার বিভাগকে স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু তার আগে তো আইনসভাকে কর্তৃত্ব দিতে হবে। তাঁর প্রতিনিধি স্থাপন করতে হবে সরকার, শাসন বিভাগ ও আমলাতন্ত্রকে। কিন্তু যদি বলেন, সার্বক্ষণিক কাউন্সিল তৈরি করবেন, সেটা হচ্ছে মূল সমস্যা বুঝতে না পারার ক্ষমতা। আপনি বুঝতে পারছেন না, সেটাই ক্ষমতা আকারে প্রকাশ করছেন। যা সরকার না থাকলেও রাষ্ট্রকে সার্বক্ষণিক পাহারা দেবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে জনগণ সার্বভৌমত্বের মালিক, তাঁরা যদি সর্বক্ষণ ক্ষমতায় থাকে, তাহলে তাঁদের ভোটেই যারা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা হচ্ছেন আইনসভা। রাষ্ট্র হচ্ছে সকলের। আর সরকার হচ্ছে নির্দিষ্ট মেয়াদে জনগণ কর্তৃক নিয়োজিত। ঢাকা-১, ঢাকা-২, কুষ্টিয়া-১, কুষ্টিয়া-২ আসন এভাবে করেন কেন? একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক লোকেরা একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, সারা দেশে যদি ৩০০ হয়, তাঁরা মিলে সংসদ গঠন করেন। তাহলে এক স্থানের জনপ্রতিনিধি কীভাবে গোটা জাতির আইন প্রণয়ন করেন?’

লেখক ও চিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ বলেন, ‘এদিকে যারা একবার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা সেটাকে বাড়িয়ে দশ বছর করেন, দশ বছরকে বাড়িয়ে পঞ্চাশ বছর করে, পঞ্চাশ বছরকে বাড়ানোর চেষ্টায় তাঁদের হঠাৎ পতন হয়। টানতে টানতে একসময় ছিঁড়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব যত দিন আছে, তত দিন তাঁর মালিক জনগণ। আমরা মাঝে মাঝে সরকার নিয়োগ করব। সরকার যদি আইন ভঙ্গ করে অথবা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তাঁকে আমরা সরিয়ে ফেলব। সংবিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে জনগণের প্রতিনিধিদের কাজ। প্রধান সমস্যা হচ্ছে জনগণের ইচ্ছে অনুযায়ী সংবিধান হবে কি-না? ছাত্র-জনতা যেভাবে চাইবে সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে।’

অধ্যাপক বলেন, ‘একটি দেশ যদি রাজনীতির ওপরে চলে, তাহলে রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাজনৈতিক দল ছাড়া চলে না। এখন যেগুলো বিদ্যমান রাজনৈতিক দল আছে, তাঁদের মধ্যে একটু সংশয় দেখা দিয়েছে, যে তরুণ ছাত্ররা যদি তাদের নীতিতে দল গঠন করে, তাহলে আমাদের কি অবস্থা হবে?’

তিনি বলেন, ‘আমি তাদের উদ্দেশেই বলতে চাই, যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে অনেক রাজনৈতিক দল লাগবে। একটি রাজনৈতিক দল ঠিকমতো দেশ চালাচ্ছে কি না, সেটি পাহারা দেওয়ার জন্যও আরেকটি রাজনৈতিক দল দরকার। যারাই ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা যদি জনগণের কাছে জবাবদিহির বাধ্য না হোন, তাহলে তারা বিপথগামী হবে, যেটা প্রায় ৯০ ভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ ইতিহাস সাক্ষী আছে। আমরা কোনো ধরনের রাষ্ট্র গঠন করব, আমাদের রাজনৈতিক দলকে সেই রকম হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের মাঝে মানুষের কোনো বৈষম্য থাকবে না, অপমান, শোষণ ও নির্যাতন করা হয়েছিল, সেটার অবসান হবে। সেই কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন করা হয়েছিল। কিন্তু যে অঙ্গীকার ছিল, সেটা আমরা গত ৫৩-৫৪ বছরে পালন করতে পারি নাই। সমাজে যখন ন্যায়বিচারের অভাব দেখা দেয়, তখন গণতন্ত্র-সাম্য অবরুদ্ধ হয়, আর বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।’

সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশের বৈষম্য বেড়েছে, মানবিক মর্যাদার জায়গায় অপমান, নির্যাতন, ঘুম এবং অপহরণ, নরহত্যা সবই পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো আমরা ৫৩ বছরে পাই নাই। এবার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের আন্দোলনে। সেই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব কিনা, তার পরীক্ষার মুখে আমরা।’

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাইনুল আহসান খান বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের কথায় যদি যুদ্ধ হতো, তাহলে দেশ স্বাধীন হতো না। আবার বুদ্ধিজীবীদের কথায় যদি আন্দোলন হতো তাহলে বিপ্লব হতো না। আইন হচ্ছে যত অন্যায় অবিচার রয়েছে, তা প্রতিহতের জন্য। আর আমাদের দেশের আইন হলো, যত অন্যায়-অবিচার রয়েছে তা রক্ষা করার জন্য। লক্ষ্য করবেন, যাদের কোনো উপায় নেই, আইন সব সময় তাদেরই নিপীড়ন করে, শোষণ করে।’

অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত