Ajker Patrika

এ শহর মসজিদের, মাদ্রাসার

ফাতিমা জাহান
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮: ২৫
এ শহর মসজিদের, মাদ্রাসার

লেবি হাউজ নামে যে জায়গায় আমি চলে এসেছি, তাকে আমার রূপকথার রাজ্যের চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। একটি বিশাল পুকুর বা পুল বা জলাধারের তিন ধারে প্রাচীন মাদ্রাসা, পুকুরটি চার কোনা, বাঁধানো ঘাট। ঘাটের দুই ধারে বিশাল খোলা রেস্তোরাঁ আর বাকি দুপাশে ভ্রমণকারীদের হাওয়া খাওয়ার জায়গা। চারপাশে গাছপালা ঘন হয়ে এসেছে। লেবি হাউজের এক পাড়ে রেস্তোরাঁর পাতা একটি খাটিয়ায় বসে চল্লিশ থেকে সত্তর বছর বয়স্ক ব্যক্তিরা তাস খেলছেন। আশপাশের পর্যটকদের আনাগোনা তাঁদের ধ্যান একবিন্দুও ভঙ্গ করতে পারেনি। কী প্রগাঢ় প্রশান্তি ছেয়ে আছে তাঁদের চোখে-মুখে!

লেবি হাউজের একদম মুখোমুখি মাদ্রাসার নাম নাদির দিভানবেগী মাদ্রাসা। ৭১ কক্ষবিশিষ্ট মাদ্রাসাটি ১৬২২ সালে নির্মিত হয়েছিল সরাইখানা হিসেবে। পরে এটি মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হয়।

সবুজ টলটলে পানি লেবি হাউজের আর ঠিক অপর পাশে নাদির দিভানবেগী খানকা। এ ভবন তদানীন্তন মন্ত্রী নাদির দিভানবেগী নির্মাণ করেছিলেন। একই নামের মাদ্রাসা নির্মাণও তাঁর অবদান। খানকা এমন এক জায়গা, যেখানে অনেকে মিলে একসঙ্গে ইবাদত বন্দেগি করা যায়। খানকার ভেতরের মিহরাবের সূক্ষ্ম চিত্রকর্ম মনোমুগ্ধকর। এই খানকা এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সতেরো শতকের অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে কিছু বিরল চিত্র এখানে ঠাঁই পেয়েছে।

মীর–ই–আরব মাদ্রাসালেবি হাউজের আরেক পাশে কুকালদশ মাদ্রাসা। ১৫৬৮ সালে নির্মিত এই মাদ্রাসা মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় আবাসিক মাদ্রাসা ছিল তখনকার আমলে। প্রবেশ তোরণে নীল টাইলসে ফুল, লতাপাতার কারুকাজ। ভেতরের ছাদে পাথরে খোদাই করা ফুল, লতাপাতার খোদাই। মাদ্রাসার কয়েকটি কক্ষ জাদুঘর হিসেবে রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। মেঝেতে কার্পেট পেতে, রেহেলে কিতাব রেখে যেভাবে ছাত্ররা পড়াশোনা করত, সেভাবে সাজিয়ে রাখা আছে দোতলা মাদ্রাসার কয়েকটি কক্ষ। বাকি কক্ষগুলো খালি। খালি কক্ষের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পাথরের ওপর ফুল, লতাপাতার খোদাই করা নকশা।

মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ লেবি হাউজ ঘিরে থাকা নাদির দিভানবেগী খানকা আর কুকালদশ মাদ্রাসার মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে নাম মাগোক-ই-আত্তারি মসজিদ। উজবেকিস্তানে ইসলাম প্রচারের আগে এ মসজিদ ছিল অগ্নি উপাসকদের মন্দির। নবম শতকে মন্দিরটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়। সোনালি-বাদামি রঙের ইট-পাথরের তৈরি ভবনটি আমাদের দেশের সাধারণ একতলা দুই গম্বুজ মসজিদের মতো দেখতে। দেয়ালে একসময় সোনালি পাথরে খোদাই করা কারুকাজ ছিল, যার অনেকটাই এখন বিলীন হয়ে গেছে। মসজিদ নির্মাণের অনেক পরে সদর দরজার তোরণ স্থাপিত হয়। তোরণে অন্যান্য মাদ্রাসা বা মসজিদের মতোই নীল টাইলসের ওপর কারুকাজ করা।

মাগোক-ই-আত্তারি মসজিদ আর নাদির দিভানবেগী খানকার পেছনের যে লম্বা একতলা ভবন অনেকগুলো গম্বুজ মাথায় নিয়ে ১৫৩৪ সাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম তোক্বি সাররোফোন। সেই ষোলো শতক থেকে আজ পর্যন্ত এটি একটি বাজার বা শপিং সেন্টার হিসেবে পরিচিত। তোক্বি সাররোফোন ফারসি শব্দ, যার অর্থ মুদ্রা বিনিময়ের গম্বুজ। প্রখর রোদে মসজিদ-মাদ্রাসায় ঘুরে এই বাজার হতে পারে ছায়া এবং নিজের পকেট খালি করার অজুহাত। এই বিশাল বাজারে কার্পেট, পোশাক, হস্তশিল্প, সূচিশিল্প, স্যুভেনির, রুপা বা বিভিন্ন পাথরের গয়না, উজবেকিস্তানের বিখ্যাত সিরামিক, কাঠ বা পিতলের পণ্য, উজবেক পুতুল ইত্যাদি পাওয়া যায়। তোক্বি সাররোফোনের আশপাশে অনেক মসজিদ ও মাদ্রাসা রয়েছে।

কালোন মসজিদবোখারার বিখ্যাত মসজিদ হলো কালোন। ১১২১ সালে তৈরি এই মসজিদকে আয়তনে মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ বলে গণ্য করা হয়। এর সঙ্গে লাগোয়া কালোন মিনার হলো উজবেকিস্তানের সবচেয়ে উঁচু মিনার। তেরো শতকে চেঙ্গিস খান যখন বোখারা দখল করতে এসেছিলেন, তখন কালোন মিনার বাদে বাকি সব মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস করেছিলেন। তেরো শতকের আগের কোনো স্থাপনা আসলে আগের রূপে নেই। পরে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তোরণের পর বিশাল প্রাঙ্গণ পেরিয়ে মূল মসজিদ। মসজিদের উল্টো পাশে মীর-ই-আরব মাদ্রাসাও কালোন মসজিদের সমসাময়িক। কালোন মসজিদে আমি কয়েকজন পর্যটক দেখলাম। এ ছাড়া অন্যান্য মাদ্রাসা ও মসজিদ একেবারে ফাঁকা।

এই কমপ্লেক্স এবং এর আশপাশে আরও কয়েকটি মাদ্রাসা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উলুগ বেগ মাদ্রাসা, কোশ মাদ্রাসা, আব্দুল আজিজ খান মাদ্রাসা, আব্দুল্লাহ খান মাদ্রাসা, মওলানা আসরি মাদ্রাসা, মোদারি খান মাদ্রাসা।

আর্ক অব বুখারাআর্ক অব বোখারা বা বোখারা দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল পঞ্চম শতাব্দীতে। তখন থেকে সোভিয়েত শাসনামল পর্যন্ত সেটি দুর্গ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯২০ সালে এই স্থাপনার সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীরঘেরা এই বিশাল দুর্গ লেবি হাউজ থেকে বেশি দূরে নয়। কালোন মসজিদের একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো। মজবুত ও অক্ষত এই দুর্গের ভেতরে এখনো মিলনায়তন, অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন কক্ষ, হাতি-ঘোড়ার আস্তাবল ইত্যাদি রয়েছে। কয়েকটি কক্ষ এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেখানে বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা, নথিপত্র, অস্ত্র, রাজা-রানির পোশাক, তৈজসপত্র ইত্যাদি সংরক্ষণ করে রাখা আছে।

আর্ক অব বোখারা ছাড়িয়ে শান্ত মহল্লা আর এর সামনে খোশগল্প করতে থাকা বাসিন্দাদের চেহারায় আনন্দ দেখতে দেখতে আরও বেশ সামনে গেলে পড়বে ইসমাইল সামানি সমাধিসৌধ। দশম শতকে শাসন করা সামানিদ রাজবংশের তিনজন শাসকের সমাধি আছে এখানে। চার কোনা, এক গম্বুজবিশিষ্ট সোনালি-বাদামি রঙের এই সমাধিসৌধ অষ্টম-নবম শতাব্দীর ইসলামি স্থাপত্যকলার উদাহরণ।

কুকালদশ মাদ্রাসার ভেতরের অংশআমার দেখা ও বোখারার সবচেয়ে ছোট মাদ্রাসার নাম চার মিনার। ১৮০৭ সালে নির্মিত মাদ্রাসাটি একটি ছোট কক্ষ ও এর সঙ্গে লাগোয়া চার মিনারের জন্য বিখ্যাত। সোনালি-বাদামি রঙের ইট-পাথরের গড়ন আর চার মিনারের উপরিভাগে ফিরোজা টাইলসের আবরণ একে অনন্য করে তুলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত