Ajker Patrika

সৌন্দর্যচর্চা হোক নিজের সিদ্ধান্তে

শোভন সাহা 
আপডেট : ২৩ জুন ২০২৫, ১২: ৪৫
মডেল: শিরীন শিলা, ছবি: মঞ্জু আলম
মডেল: শিরীন শিলা, ছবি: মঞ্জু আলম

ইতস্তত করে হলেও স্বীকার করতেই হয়, এখনো অনেকের কাছে সৌন্দর্য মানে হলো ফরসা আর নিখুঁত ত্বক। প্রযুক্তির ঘনঘটা আর নারী স্বাধীনতার এ সময়ে এসেও পাত্রপক্ষ কনের ফরসা রঙেই বেশি মজে। ফলে নারীদের মধ্য়েও ছোটবেলা থেকে গায়ের রং উজ্জ্বল করে তোলার কসরত চলতে থাকে। ইদানীং খেয়াল করলে দেখবেন, বিভিন্ন ফেসবুক পেজেও রং ফরসা করার ক্রিম ও সাবান বিক্রি হচ্ছে। সেসব পোস্ট ও রিলসেও হাজার হাজার রিঅ্যাকশন। কিন্তু একজন মানুষের সৌন্দর্যের অর্থ কি শুধু নিখুঁত ত্বক আর চুলের অধিকারী হওয়া? নিশ্চয়ই নয়; বরং একজন মানুষ আমিত্বকে কীভাবে গ্রহণ করে বয়ে নিয়ে চলেছেন, সেখানেই আসল সৌন্দর্য নিহিত।

বিউটি স্ট্যান্ডার্ড বলে আদৌ কিছু নেই

পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় এক তারকা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একজন নারী কত দিন এবং কোন বয়সে দেখতে সুন্দর লাগবে বা খারাপ লাগবে—এই সিদ্ধান্তটা আসলে কে নেবে?’ চল্লিশ বছরের পর চড়া রঙের লিপস্টিক দেওয়া যাবে না, জমকালো শাড়ি না পরলেই ভালো; এসব মন্তব্য়ের বিপক্ষে এই কথা বলেছিলেন তিনি।

আমাদের সমাজে অবাস্তব বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের যেসব কথা প্রচলিত আছে, সেটাই যে ধ্রুব, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? একজন মানুষ তাঁর জীবনে নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করতে চান, সেটাই

তো মুখ্য হওয়ার কথা। বাহ্যিক পরিচর্যায় নিজেকে উপস্থাপনযোগ্য করে তোলা নিশ্চয় সম্ভব কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তা জরুরিও বটে। কিন্তু পুরোপুরি নিজেকে বদলে ফেলা কখনোই সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। আর সেই কারণে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া অবাস্তব বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে নিজের মতো সুন্দর রাখাতে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

নিজেকে জয় করা

সৌন্দর্যপণ্য়ের রমরমার সময় চলছে এখন। বেশির ভাগ মানুষ অন্যকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রসাধনসামগ্রী কেনেন এবং ব্যবহার করেন। এর ফল ভালো হয় না। ত্বক মেরামতের জন্য ১০-১২ পর্যায়ে যত্ন নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আপনার ত্বকের ধরন, সময় ও সাধ্য় বুঝে যত্ন নিন। নিজের নিয়ন্ত্রণে যতটুকু রয়েছে, তা-ই করুন। হয়তো শ্বেতী বা গভীর ক্ষতের দাগ রয়েছে শরীরে। এগুলোর স্থায়ী প্রতিকার সহজ নয় ঠিকই, তবে নিজেকে এর আড়ালে গুটিয়ে নেওয়াও কোনো সমাধান নয়। ধরে নিন, ওটাই আপনার পরিচয়, যা আপনাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে। প্রতিনিয়ত যদি সমাজ আপনার তথাকথিত খুঁতগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকে, সে ক্ষেত্রে নিজেকে নিজের সৌন্দর্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। খুব ছোট বয়সে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আত্মবিশ্বাসেও বড়সড় আঘাত লাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে আপনার দিকে ধেয়ে আসা বিদ্রূপ বা ব্যঙ্গকে মোটিভেশন হিসেবে দেখতে চেষ্টা করুন।

মডেল: শিরীন শিলা, ছবি: মঞ্জু আলম
মডেল: শিরীন শিলা, ছবি: মঞ্জু আলম

আজকাল লেজার, বডি শেপিং, কসমেটিক সার্জারি এবং অন্যান্য অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্টের বরাতে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হচ্ছে। তবে শরীরের কোনো অংশ বা ত্বকের যেকোনো চিহ্ন যদি সমস্যা তৈরি না করে, তাহলে সেটাকে নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারলে জয়টা আপনারই হবে।

রূপচর্চায় নিজের শর্ত মেনে চলা

আপনার ত্বকের রং ও ধরন যা-ই হোক না কেন, দিনের একটা ভাগে নিজের যত্ন নিন। সপ্তাহে বা মাসে এক দিন যদি পারলারে গিয়ে চুলে হট অয়েল ম্যাসাজ, পেডিকিউর, মেনিকিউর ও ফেসিয়াল করে আসতে হয়, ক্ষতি নেই তো। উপার্জন বা সঞ্চয়ের ছোট্ট অংশ নিজের জন্য খরচ করাতে অপরাধবোধের কিছু নেই। মাঝেমধ্যে বডি স্পাতে গিয়ে রিল্যাক্সিং ম্যাসাজ নেওয়া কিংবা হেয়ার কালার বা হেয়ারস্টাইল বদলানোর মতো সাধারণ কোনো মেকওভার নিলেও দেখবেন, মন ভালো লাগছে। তবে মূল যত্নটা করতে হবে বাড়িতে এবং নিয়মিত। ত্বকের উপযোগী ক্লিনজার দিয়ে দিনে দুবার মুখ ধোয়া, পেডিকিউর-মেনিকিউর, স্ক্র‍্যাবিং, হারবাল ফেস ও হেয়ারপ্যাক বাড়িতে বানিয়ে ব্যবহার করুন। হঠাৎ একদিন দিনরাত এক করে যত্ন নিলে হয়তো সাময়িকভাবে মন ভালো হবে। তবে যদি বাহ্যিক পরিবর্তন দেখতে চান, সে ক্ষেত্রে নিয়মিত যত্নের কোনো বিকল্প নেই।

বেসিক ইজ দ্য বেস্ট

হালের ট্রেন্ড অনুসরণ করে দেড়-দুই ঘণ্টা ধরে ত্বকের যত্ন নেওয়ার কিছু নেই; বরং বেসিক ক্লিনজিং, টোনিং, ময়শ্চারাইজিং এবং চুলের জন্য অয়েল ম্যাসাজ, সপ্তাহান্তে ডিম, কলা, পাতিলেবুর মতো উপকারী প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে বানানো কোনো নারিশিং প্যাক এবং নিয়মিত শ্যাম্পু, কন্ডিশনার ও সেরাম ব্যবহার করুন। নিয়মিত চিরুনি, মেকআপ ব্রাশ, পাফ ইত্যাদি পরিষ্কার করুন। বাইরে থেকে ফিরে শ্যাম্পু অথবা বডিওয়াশ মেখে পামিস স্টোনে পা ঘষে ধুয়ে ফেলুন। এরপর অলিভ অয়েল মালিশ করে নিন। পা এমনিতেই নরম ও পেলব থাকবে।

ত্বকের খুব বেশি সমস্যা না থাকলে কিংবা ত্বক বিশেষজ্ঞ মনে না করলে, সকালে বিকেলে আলাদা ময়শ্চারাইজার ব্যবহারের কোনো দরকার নেই। অ্যালোভেরা, কাঁচা হলুদ, মসুর ডাল, চন্দনবাটা, লেবুর রস, জবা ফুল, মুলতানি মাটি, শসার রস, মৌসুমি ফল ও সবজির রস ত্বকে ব্যবহার করলে ধীরে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল পাবেন।

নিজেকে নিজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখুন। এটা বাইরে থেকে কেউ শিখিয়ে দেবে না। নিজের কোঁকড়া চুল, শ্যামলা রং, ঘাড়ের পেছনের অতিরিক্ত মাংসল অংশ—সবটা মিলেই আপনি। এই পুরো ‘আপনি’র প্রতি যত্নশীল হোন, তাকে নিয়ে গর্ব করুন। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় যে নিখুঁত মুখগুলো দেখে হীনম্মন্যতায় ভোগেন, সেগুলো প্রায় সবই বিউটি ক্যামেরায় তোলা ছবি। মেকি সৌন্দর্যের মোহে না পড়ে, বরং নিজের স্বকীয়তা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করুন। সুন্দর থাকুন নিজের শর্তে।

শোভন সাহা, কসমেটোলজিস্ট ও শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত