Ajker Patrika

দাম্পত্য সম্পর্কে ঘৃণার অনুপ্রবেশ হলে নতুন পথ খুঁজবেন যেভাবে

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৪৩
রোমান্টিক দাম্পত্য সম্পর্কে ঘৃণার উৎপত্তি হয় বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলে। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি
রোমান্টিক দাম্পত্য সম্পর্কে ঘৃণার উৎপত্তি হয় বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলে। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি

রোমান্টিক দাম্পত্য সম্পর্কে ঘৃণার উৎপত্তি হয় বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলে। রোমান্টিক এই সম্পর্কে ঘৃণা ও ঈর্ষার অনুপ্রবেশ ঘটলে তার বহিঃপ্রকাশ হয় রাগ ও ভয়ের অনুভূতির মধ্য দিয়ে। একটু খোলাসা করে বলা যাক, দম্পতিদের মধ্য়ে যখন রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন দুজনের মধ্যকার মিলগুলো সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। আদর্শগত মিল, নৈতিকতার মিল এবং একই ধরনের জিনিস পছন্দ হলে রোমান্টিক সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি হয়; বিশেষ করে আদর্শগত মিল আচরণে প্রকাশিত হলে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়ে। অন্যদিকে দাম্পত্য সম্পর্কে যদি একে অপরের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়, তাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়।

ব্যক্তির স্বাস্থ্যে ঘৃণার প্রভাব

শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক—স্বাস্থ্যের চারটি ভাগ রয়েছে। ঘৃণা নামের আবেগটি স্বাস্থ্যের এই চারটি ভাগের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গবেষণা বলে, ঘৃণা করা মানে আপনার মস্তিষ্কের ভেতরে বিনা ভাড়ায় দীর্ঘমেয়াদি ভাড়াটে থাকতে দেওয়া।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চর্চা করুন। ছবি: পেক্সেলস
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চর্চা করুন। ছবি: পেক্সেলস

শারীরিক প্রভাব

অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া আঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট ঘৃণা আমাদের মনে বিশ্বাসহীনতার জন্ম দেয়। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে শারীরিকভাবে। এতে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদি ঘৃণার অনুভূতি ওজন বৃদ্ধি, নিদ্রাহীনতা, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতাসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের জন্ম দিতে পারে।

গবেষণা বলছে, দাম্পত্য দ্বন্দ্বে স্ত্রীরা স্বামীদের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এবং অধিকতর শারীরবৃত্তীয় প্রভাবের ভেতর দিয়ে যান; বিশেষ করে যেসব নারী দীর্ঘদিন ধরে তিক্ত দাম্পত্যের মধ্যে জীবন যাপন করেছেন, দেখা গেছে তাঁদের কর্টিসল ও অ্যাড্রেনোকোর্টিকোট্রপিক হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন স্বামীদের তুলনায় ভিন্ন। যদিও স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার ওপর দাম্পত্য কলহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শুধু তা-ই নয়, দেখা গেছে, দৈহিক ক্ষত নিরাময়ের গতিও দাম্পত্য বিবাদের কারণে শ্লথ হয়ে যায়। অন্যদিকে তৃপ্তিকর দাম্পত্যজীবনের সঙ্গে সুস্থ রক্তচাপের সুসম্পর্ক আছে। কাজেই অন্যের জন্য নয়, ব্যক্তির নিজের প্রয়োজনে নিজের দাম্পত্য সম্পর্ক স্বাস্থ্যকর রাখা প্রয়োজন। আর একান্তই যদি দাম্পত্য দ্বন্দ্ব নিরসন করতে পারা না যায়, প্রয়োজনে দাম্পত্য বিচ্ছেদ হতে পারে। কিন্তু বিষাক্ত সম্পর্ক নিয়ে এক ছাদের নিচে না থাকা ভালো।

মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব

কাউকে তীব্র ঘৃণার ফলে ব্যক্তির মধ্যে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে বারবার একই চিন্তা ঘুরেফিরে আসে। তখন বিভ্রান্তিতে ভোগেন আক্রান্ত ব্যক্তি। একে প্যারানয়া বলা যায়। অর্থাৎ এটা থেকে ব্যক্তিত্বের ব্যাধি বা অসুখ পর্যন্ত হতে পারে। পেশাজীবী নারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঘরে-বাইরে দ্বিমুখী চাপ সামলাতে গিয়ে, যাঁদের সন্তান আছে, তাঁদের শরীরে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি হয়ে যায়, যা মানসিক চাপের নিয়ামক।

সামাজিক স্বাস্থ্যে প্রভাব

ইতিমধ্যে ঘৃণার কারণে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য আহত হলে ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগগুলোও কমে আসতে থাকে। ফলে অদৃশ্য চাপ তৈরি হয়। গবেষণা বলছে, যাদের তীব্র ঘৃণার অনুভূতি থাকে, তাদের মৃত্যুহার বেশি। দাম্পত্যে সুসম্পর্ক সামাজিক স্বাস্থ্যকে অবচেতনভাবে প্রভাবিত করে।

আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যে প্রভাব

আধ্যাত্মিকতা আর ধর্ম এক জিনিস নয়। আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক তিনটি জায়গায়। ব্যক্তির নিজের সঙ্গে নিজের কী সম্পর্ক? নিজের সঙ্গে অন্যদের কী সম্পর্ক? নিজের সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা পরিস্থিতির কী সম্পর্ক? ঘৃণা যদি কোথাও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে, সেটা আমাদের আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যে।

ঘৃণা যখন স্বাস্থ্যের সব কটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে, বৈবাহিক সম্পর্ক ঘৃণার কারণে সব দিক থেকে নেতিবাচক আগুনে পুড়ে যায়, স্বাভাবিক সম্পর্ক তখন টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।

আনন্দ পান এমন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।
আনন্দ পান এমন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।

কেন ঘৃণার কারণে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন

যেকোনো আন্তসম্পর্ক শূন্যতার ওপর ভর দিয়ে চলতে পারে না। দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিনিয়ত বৃহত্তর পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এখান থেকে প্রচুর নেতিবাচক উপাদান সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। এককথায় বলা যায়, দাম্পত্যে যদি একজন অন্যজনের মাধ্যমে অবহেলিত অনুভব করে, তবে যে অবহেলিত অনুভব করছে, তার মধ্যে ঘৃণার জন্ম হবে।

মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা থেকে ঘৃণাকে সাত ভাগ করা হয়েছে—গ্রহণযোগ্য ঘৃণা, উত্তপ্ত ঘৃণা, শীতল ঘৃণা, টগবগিয়ে ফুটন্ত/জ্বলন্ত ঘৃণা, সর্বগ্রাসী ঘৃণা, ক্ষিপ্ত ঘৃণা, তিল তিল করে পুঞ্জীভূত ঘৃণা। দাম্পত্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করে রোমান্টিক ঘৃণা। যেটা রাগ ও ভয়ের সঙ্গে অবচেতন মনে সংযুক্ত হয়। ভালোবাসা আর ঘৃণা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গবেষণায় উঠে এসেছে, ভালোবাসা যত গভীর, তার ব্যত্যয় ঘটলে তত তীব্র ঘৃণা মানুষের মনে তৈরি হয়।

ঘৃণা থেকে বের হতে করণীয়

ঘটনাটা কিন্তু ঘটে গেছে। ঘটনাকে মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যে অনুভূতি হয়েছে, তা বিবেচনা করে যদি ক্ষমা করতে চাই, সে জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। জানতে হবে, ক্ষমা করতে পারাটা একটা দক্ষতা এবং এটা একটা প্রক্রিয়া।

ঘটনা পর্যালোচনা করে, তার প্রভাব জেনে-বুঝে গ্রহণ করা, কী কারণে কী করছি—এ যুক্তিগুলো যেন নিজের কাছে পরিষ্কার থাকে। ঘৃণা নিয়ে একটি চমৎকার উদ্ধৃতি আছে, ‘আপনি যেদিন আর কাউকে ঘৃণা করবেন না, সেদিন নিজেকে ভালোবাসতে শিখবেন।’ ঘৃণামুক্ত হওয়া প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে শিখতে হয়। কাজেই নিজেকে ভালো রাখার জন্য ঘৃণা থেকে বের হতে হবে।

যে অভ্যাসগুলো নিয়মিত চর্চা করা জরুরি

মার্টিন লুথার কিং একবার বলেছিলেন, ‘ঘৃণা বোঝা হিসেবে এতই বড় যে তা বহন করা যায় না।’ কারণ, আমরা জানি তখন বিয়ে, অন্তরঙ্গতা, বন্ধুত্ব—কিছুই কাজ করে না। সোজা সম্পর্কটা গড়িয়ে নিচে হারিয়ে যায়। ঘৃণার এই বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু অভ্যাস চর্চা করতে হবে—

  • নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন? কেন এই ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটল? এ ঘটনা ঘটার পেছনে আমার অবদান কী ছিল?
  • আনন্দ পান এমন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। সেটা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন থেকে যোগব্যায়াম ক্লাস পর্যন্ত—যেকোনো কিছুই হতে পারে।
  • কখনো কখনো রাগ আমাদের দৃষ্টি ঘোলা করে দেয়। কাজেই নিজের মনোভাব বদলাতে কী করতে পারেন, ঠান্ডা মাথায় সেটা ভেবে দেখুন।
  • প্রতিটি জিনিসেরই কিছু ইতিবাচক এবং কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। যে ঘটনাটি ঘৃণা উৎপাদন করছে, সেটির ইতিবাচক প্রবাহ কী হতে পারে, খুঁজতে থাকুন।
  • মন না চাইলেও কখনো কখনো আনন্দ খুঁজুন এবং নিজেকে তৃপ্তি দেওয়ার চেষ্টা করুন। এভাবে কোনো না কোনো সময় মন সত্যি আনন্দ খুঁজে নেবে।
  • জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চর্চা করুন।
  • মনের ভাব চিঠিতে লিখে প্রকাশ করুন। যদি প্রয়োজন মনে করেন, তবে চিঠি পাঠাবেন। না হলে গোপন রাখবেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার মনের ভাব মৌখিক না হলেও অন্তত লিখে প্রকাশ করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তি পাবেন না।
  • ক্ষমা করতে শিখুন। ক্ষমা করতে শেখা প্রয়োজন অন্যের জন্য নয়, বরং নিজের জন্য।

লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বিডি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘সাকিবের পোস্টার স্টেডিয়ামে ঢুকবে কি না, বিসিবির ডিসিপ্লিনারি কমিটি দেখবে’

আন্তর্জাতিক সালিসের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ-আদানি

দলীয় মনোনয়ন পছন্দ না হওয়ায় বিশৃঙ্খলা, বিএনপির ৪ নেতা বহিষ্কার

‘তোমার জন্যই খুন করেছি’, স্ত্রীকে হত্যার পর প্রেমিকাকে সার্জনের বার্তা

জোটেই ভোট করবে জামায়াত, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা শিগগির

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ