সুদীপ্ত সালাম

রূপসা নদী থেকে কখন পশুর নদীতে উঠলাম, বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের লঞ্চটি একটি ঘোলা পানির উত্তাল নদীর মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটিই পশুর নদী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘পশোর’ নদী। এই নদীতে পড়ে সুন্দরবনের আভাস পাওয়া যায়। পাড়গুলোতে সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ জন্মেছে। পার্থক্য, এখানে অতটা ঘন নয় এবং একটু দূরেই গ্রাম ও ফসলি জমিগুলো স্পষ্ট।
‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ বইয়ে বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘সামনে বিস্তৃত পশোর নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতাল ঝোপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।’ আর আমার ধারণা ছিল পশুর শুধু নামেই নদী, আদতে একটি খাল। বিশালদেহী নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমি লজ্জাই পেলাম।
এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। পেশাগত কাজে আগে খুলনা ও বাগেরহাট আসা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এসেছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা পর্যন্ত। সুন্দরবনে এখনই হয়তো আসা হতো না যদি ‘ফেমাস ট্যুরস বিডি’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজির হোসেন রুবেল জোর আমন্ত্রণ না করতেন। যে লঞ্চের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘এমভি দ্য ভেসপার’। সকালে (১৪ জানুয়ারি, ২০২২) রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে ভেড়ানো ছিল। আমি ট্রেন থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখান থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। ঘাট থেকে একটি ট্রলার আমাকেসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে নিয়ে আসে লঞ্চটির কাছে। তিনতলা লঞ্চটির একদম নিচতলায় ইঞ্জিন, জেনারেটর ও রান্নাঘর। দ্বিতীয় তলায় অতিথিদের রুম এবং তৃতীয় তলায় হলরুম; এখানকার লোকজন বলে ‘লাউঞ্জ’। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমার রুমটি দ্বিতীয়তলার সামনের দিকে। সেখান থেকে বাইরের দৃশ্য দারুণ দেখায়। আমাদের দুই রাত, তিন দিনের সফর। এই কয়েকটা দিন এই লঞ্চে করেই জলে ভেসে বেড়াব আমরা।

লঞ্চের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ, নদী কাটার ঝিরঝির শব্দ ও হিমেল বাতাস, মনটা আনমনে করে দেয়। কী এক স্বর্গীয় ভালো লাগা ভর করে শরীরে। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় যত দূর চোখ যায়। কোথাও ইটপাথরের বড় বড় দালান নেই, যানজটের বালাই নেই, তীব্র হর্নের ডামাডোল নেই—নেই দম বন্ধ করা ধোঁয়া। বুঁদ হয়েছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। মন ভালো করা চলচ্চিত্রে হুট করেই ঢুকে পড়ল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পশুর নদীর পাড়েই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীর পাড়ে কি এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটছে—তা বুঝতে বিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ হতে হয় না। ওখানে গেলেই বোঝা যায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন—সুন্দরবনের কাছে একাধিক সিমেন্ট ও তরল গ্যাস তৈরির কারখানাও তো রয়েছে। যা হোক, বেলা দেড়টার দিকে আমাদের লঞ্চটি এসে থামল মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায়। আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, মুরগি, মাছ, পালং শাক, আলুর ভর্তা ও ডাল। খাবার সবই লঞ্চে রান্না হয়। খুবই সুস্বাদু, বাড়ির খাবারের মতো। বিশেষ করে কোরাল মাছের স্বাদ মুখে লেগে রইল অনেকক্ষণ। এই মাছ স্থানীয়দের কাছে ভেটকি বলে পরিচিত। মংলা এলাকায় নানা পণ্যের জাহাজ। এখানে রাতদিন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলে। জাহাজ আসছে, যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে হাতে এক কাপ চা নিয়ে লঞ্চের এদিক-ওদিক হাঁটছি। দেখলাম লঞ্চের পেছনের দিকে এক কোণে বসে এক নারী আমাদের নোংরা করা বাসনকোসন পরিষ্কার করছেন। তাঁকে দেখতে আমার মায়ের মতো। বয়সও একই, পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তাঁর গল্পটা শুনতে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নাম তাসলিমা বেগম। তিনি মূলত লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী। তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কাটা এবং থালা-বাসন ধোয়া তাঁর কাজ। তাসলিমা বেগমও আমাদের সঙ্গে এই লঞ্চে তিন দিন থাকবেন। শুনে অবাক হলাম, এই তিন দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পাবেন মাত্র ১ হাজার টাকা! ‘টাকা এত কম, কিছু বলেন না?’ জানতে চাইলাম। বললেন, লাভ নেই। বেশি দাবি করলে বাবুর্চি তাঁকে বাদ দিয়ে দেবেন। খুলনার তাসলিমা বেগমের একমাত্র ছেলের বাগেরহাটে একটি দোকান ছিল। তখন তাঁদের অবস্থা বেশ ভালোই। করোনাকালে লোকসান ও দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ছেলে এখন রিকশাভ্যান চালায়। আমি তাসলিমা বেগমকে কিছু টাকা দিলাম। টাকাটা পেয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। বললেন, ‘বাবা, আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’

বেলা ৪টার দিকে আমরা চলে এলাম হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম কেন্দ্রে। লঞ্চ থেকে আমরা উঠে পড়লাম লঞ্চের সঙ্গে থাকা ট্রলারটিতে। আমাদের নামতে দেখে দুজন নারী নৌকা বেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা ডাব বিক্রি করেন, আমরা যদি কিনি। সেই মোংলার একটি গ্রামে দুই বোন দিলারা ও হাজেরার বসবাস। প্রতিদিন সেখান থেকে ডাব এনে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করেন।
ছোট্ট নৌকাটির বইঠা বড় বোন দিলারার হাতে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। আর হাজেরার বয়স হবে চল্লিশের মতো। ডাবের দাম ঢাকা থেকেও বেশি। তবুও আমরা কয়েকজন ডাব কিনলাম। ট্রলারে করে ইকোপার্কের ঘাটে যেতে মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এটি বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য।
বনের এই অংশটিকে ঘিরে একটি কাঠের দীর্ঘ সেতু করা হয়েছে। সেই সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা চক্কর দেওয়া যায়। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। এখানে বাঘের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব; অর্থাৎ, এলাকাটি নিরাপদ। তবে একাধিক প্রজাতির বানর ও চিত্রা হরিণ অহরহ চোখে পড়বে। এই পার্কেই প্রথমবার বন্য হরিণের ছবি তুললাম। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমরা আবার ট্রলারে ফিরে এলাম। শীতকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, জাগেও অনেক বেলা করে। বিস্তীর্ণ সবুজ বন নিজেকে সঁপে দিল অন্ধকারের হাতে। সারা দিন যে বন দেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ—অন্ধকার নামলেই সেই বন থেকে সবাই পালাতে চায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের গতি ও শীতলতা। ভারী বাতাসের ছোঁয়ায় মনটাও কোনো কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়। ‘ভেসপার’ চলছে অন্ধকার ও শ্যালা নদী কেটে কেটে।
সাগর মোহনায় জোয়ার-ভাটা এবং নোনা ও মিষ্টি পানির প্রবাহ ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কারণ, পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় নদী যেখানে সাগরে মেশে, সাগর মোহনার যে অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে, সেখানেই ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন তেমনি একটি বন। এর বয়স তিন থেকে চার হাজার বছর। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সভায় দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। ঘোষণার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, অবদান ও পৃথিবীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি শর্ত বিবেচনা করা হয়। একই দিনে ইউনেসকো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ‘৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য’ এলাকা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত। এই তালিকাতেও আছে সুন্দরবনের নাম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই বিশেষ এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় একে ‘রামসার চুক্তি’ বলা হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কতটা কাজ করছি, তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।

আমাদের সঙ্গে আছেন ফরেস্ট গার্ড আলী হোসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত ১০-১২বার তিনি বাঘ দেখেছেন। একবার হয়েছেন মুখোমুখি। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তিনি মাত্র এসেছেন আন্ধারমানিক ক্যাম্পে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একে একে সবার অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে যায়, রইলেন শুধু তিনিই। পুরো ক্যাম্পে তিনি ও তাঁর বাবুর্চি। বনের মাঝখানে গা ছমছমে পরিবেশে তাঁদের ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি দু-তিনটি ঘর। ক্যাম্পের ভিতটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পের পাটাতনে নিরস্ত্র আলী হোসেন বসে আছেন। বাবুর্চিও নেই। তিনি শুনতে পেলেন পাটাতনের নিচে শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন বন্য শূকর। তিনি মুখে শব্দ করলেন, যাতে শূকরটি পালিয়ে যায়। একটু পর পাটাতনের নিচ থেকে বের হলো একটি পূর্ণবয়স্ক বেঙ্গল টাইগার!
বাঘটি ঘুরে আলী হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। আলী হোসেনের গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বাঘটি দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। সে বুঝে নিতে চাইছে তার শিকারটি অসহায় কিনা। আলী হোসেন বুঝলেন, এভাবে বসে থাকলে মরতে হবে। তিনি তাঁর সামনে থাকা টেবিলটি টেনে ঢালের মতো করে নিজের সামনে ধরলেন। বাঘটা গর্জন করে জানিয়ে দিল, কাজটি তার পছন্দ হয়নি। আলী হোসেনের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি শুনেছেন, বিকট শব্দে বাঘ ভয় পায়। তিনি সময় নষ্ট না করে টেবিলটিতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চাপড় মারতে লাগলেন। জোরে! আরও জোরে! এটাই বাঁচার শেষ চেষ্টা।
আলীর ভাগ্য ভালো; বাঘ সত্যিই ভয় পায়। ধীরে ধীরে বাঘটি ফিরে গেল। বাঘটি বনে মিলিয়ে যেতেই আলী হোসেন এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে আলী হোসেন জানিয়ে দিলেন, তিনি আর একা আন্ধারমানিক ক্যাম্পে থাকবেন না। তাঁকে রেঞ্জ অফিসেই রেখে দেওয়া হয়। গল্প শেষে আলী হোসেন বললেন, ‘ভাইজান, আমি এক মাস বাঘের ভয় থেইকা বাইর হইতে পারি নাই। একা বনে হাঁটলেই মনে হইতো আমার পিছনে বুঝি সেই বাঘটা আসতাছে।’ আরও বললেন, ‘খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক না। আমি জানি কারে কয় ছাড়া বাঘ।’
হাড়বাড়িয়া থেকে কটকা যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের লঞ্চ স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আছে সুন্দরবন। শ্যালা নদীর দুপাশে সুন্দরবন। বন যেন গার্ড অব অনার দিয়ে পর্যটক বোঝাই লঞ্চগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শীতের রাতে অদ্ভুত এক রূপে হাজির হয় সুন্দরবন। মাথার উপরে অবারিত ধূসর আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে থোকা থোকা মেঘ। যেন আকাশ ফেটে চৌচির। মেঘের আড়ালে চাঁদ। আড়ালে থেকেও আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে ওই আলোই তো ভরসা। বিভূতিভূষণের বর্ণনা, ‘ছোট খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই।’ আমিও দেখিনি।

জম্পেশ নৈশভোজ শেষে ঘুমাতে গেলাম। প্রথম রাতেই বুঝলাম এই মনোরম রুমটির একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন সমস্যাটা টের পাওয়া যায়। নোঙর ওঠানো-নামানোর যন্ত্রটা আমার রুমঘেঁষা। নোঙর নামানোর সময় ভয়ংকর দীর্ঘ শব্দ হয়, আর সে সময় যদি আপনি ঘুমে থাকেন, তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর একটিও নেই। ভোর তিনটায় আমি বিকট আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
লঞ্চ কটকা খালে নোঙর ফেলেছে। নোঙর ফেলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম সাড়ে ৫টার দিকে। তখনো ঘোর অন্ধকার। আকাশে মেঘ নেই। তবে চাঁদটি আকাশের শিরোমণি হয়ে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এখন গন্তব্য জামতলা সমুদ্রসৈকত। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ট্রলারে করে রওনা হলাম। কটকা থেকে আমাদের ট্রলার গিয়ে পড়ল জামতলা খালে। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো সুবিধা করতে পারছে না। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ঘাটে নামলাম। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। কখনো উন্মুক্ত প্রান্তর, কখনো ঘন বন। এদিকটায় অনেক বেশি টাইগার ফার্ন। বাংলাদেশে ২৫০ প্রজাতির ফার্ন হয়। এর বেশির ভাগই জন্মে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) বেশি দেখা যায়।
এই ফার্নের পাতার রঙের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। অনেক সময় শিকারের জন্য এই ফার্নের আড়ালে বাঘ ওত পেতে থাকে। আমার চোখ ঘুরেফিরে ওই ফার্নের ঝোপের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক চুপ করে বসে নেই তো! আমরা হেঁটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জামতলা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছালাম। সৈকতের এদিকটায় প্রচুর সুন্দরী গাছ। এখানে সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের চিহ্ন। একটি কথা বলে রাখি, আমরা এখন যেদিকেই যাচ্ছি চিত্রা হরিণ চোখে পড়ে। সুতরাং এই হরিণ ও বানর দেখা ডালভাত হয়ে গেছে।
আমরা যখন জামতলা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম, তখনো সূর্য কুয়াশার কবলে। সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়। এখানকার সমুদ্রের পানি নদীর পানির মতো ঘোলা। সমুদ্রে কেউ নামে না। তবু সমুদ্র তো সমুদ্রই, বড় বড় ঢেউ আছে—আছে গর্জনও। কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দূরে যেমন জাহাজ বা নৌকা দেখা যায়—এই সৈকত থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এখানকার বালিও ধূসর। এই সৈকতে আপনি যদি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, মনে হবে আপনিই প্রথম সৈকতটি আবিষ্কার করলেন। কারণ মানবসভ্যতার কোনো উপকরণ ত্রিসীমানায় নেই। এদিক থেকে এই সৈকতটি ভিন্ন। দুঃখজনক হলো, এখানে সেখানে বর্জ্য পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় খাবারের মোড়ক ও প্লাস্টিক বোতল ফেলে রেখে যায়। সমুদ্রও নানা বর্জ্য উগরে দেয় সৈকতে। এসব পরিষ্কার করার লোক আছে বলে মনে হয়নি।

একই দিন, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গেলাম টাইগার টিলায়। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। একটু পরপরই হরিণের পাল দেখা যায়। এই এলাকায় প্রচুর সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, ধুন্দুল, ওরা ও বাইন গাছ। এদের অনেকের শুলো হয়। এই শুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। মাটি ভেদ করে এই শুলোগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুলোর জন্য হাঁটা মুশকিল। এই এলাকার প্রায় পুরোটাই শুলো দিয়ে ছাওয়া। টিলা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ঢিবিও না। একটু উঁচু স্থান। এমন কয়েকটা তথাকথিত টিলা পেলাম। এই টিলাগুলোতে নাকি বাঘ বিশ্রাম নেয়। টিলাগুলোতে পুরোনো অবকাঠামোর চিহ্ন স্পষ্ট, আর টিলা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃৎপাত্রের অসংখ্য টুকরো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এগুলোকে সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতির নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। আমার কাছে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলোকে প্রাচীন মনে হয়নি। আরও কিছু দূর গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম আরেকটি ধ্বংসস্তূপের সামনে। এটি নাকি কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি লবণ কারখানার নিদর্শন। আমি এবারও সম্মত হতে পারলাম না। যা হোক, একাধিক হরিণের পাল, কথিত প্রত্নকেন্দ্র ও শুলোর গালিচা দেখা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কটকা নামে খাল হলেও অনেক নদীর চেয়েও বড়। সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের লঞ্চটি সেই কটকা থেকে ছিটা কটকা বা ছোট কটকা খাল ধরে চলা শুরু করল। সবার আশা, এবার কুমির দেখা যাবে। আমার এই পুরো ভ্রমণের এই অংশটুকু বিশিষ্ট।
খাল ধরে চলতে গিয়ে সুন্দরবনের এক অনন্য রূপ দেখা গেল। খালগুলোকে সুন্দরবনের ধমনি বলা যায়। গাঙ্গেয় মোহনায় কয়েক শ দ্বীপাঞ্চল নিয়ে সুন্দরবনের পরিবার। তার আয়তন এখন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে নদী-নালা ও খাল-বিলই দখল করে আছে ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুন্দরবনের অধিকাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ—৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আমরা এখন লঞ্চ নিয়ে যে খাল ধরে যাচ্ছি, তা স্বাভাবিকভাবেই ওই জলভাগের অংশ। এলাকাজুড়ে ভীষণ নীরবতা। কখনো কখনো সেই নীরবতাকে ভাঙে পাখির ডাক। খাল বলেই হয়তো আমাদের লঞ্চটিও খুব ধীর গতিতে চলছে, ফলে শব্দও কম। খালের ঘোলা পানিতে গাছের ছায়া পড়ায় পানির রং সবুজ বলে ভ্রম হয়। সরু খাল ধরে লঞ্চ কখনো ডানে, কখনো বাঁয় যাচ্ছে। অনেক সময় বড় গাছ ঘেঁষে চলতে হচ্ছে লঞ্চটিকে। এদিকটায় নানা প্রজাতির মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। ছিটা কটকা থেকে কচিখালী খালে ওঠার একটু আগে কুমিরের দেখা মিলল। একঝলক। খালপাড়ে বসে ছিল একটি কুমির ছানা। লম্বায় মাত্র দেড় হাত হবে। লঞ্চ কাছে আসতেই দ্রুত পানিতে নেমে উধাও হয়ে গেল। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ তা দেখার সুযোগ পেল না। যারা দেখতে পেল না—তাদের সে কী আফসোস! বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনে প্রধানত পাঁচটি প্রাণী দেখার আছে—বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও কুমির। আমার চারটি দেখা হয়ে গেছে। বাঘ দেখতে পাব সে আশা আমার নেই। বেলা দেড়টার দিকে আমাদের ‘ভেসপার’ কচিখালী খালে উঠল।
লঞ্চ ছুটছে কচিখালী অফিস পার্কের দিকে। সেখানে অনেক হাঁটতে হবে, আমরা দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম। কচিখালী অফিস পার্কে পৌঁছাতে বেলা ২টা ৪০ বেজে গেল। পার্কের নামে সরকারি যত স্থাপনা আছে, সেগুলো এই বনাঞ্চলে একেবারেই বেমানান। এখানেও যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ভবন—দেখতে বিকট।
একজনকে দেখলাম মসজিদের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন। তানজির হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে আমাদের দলটি এসব ফেলে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল। তবে এবার সব পর্যটক এই দলে নেই। অর্ধেকই আরাম করতে লঞ্চে রয়ে গেছে। যা হোক, যত দূর চোখ যায় আধমরা কোমরসমান ঘাস (ছন) আর ছোট ছোট বুনোফুলের গাছ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আতঙ্ক জাগানো টাইগার ফার্ন এবং দু-একট বড় গাছও রয়েছে। তবে এই খোলা প্রান্তরেরও সীমানা রয়েছে। এর সীমানা প্রাচীর ঘন বন। কিছু দূর হাঁটতেই বুঝলাম আমরা এখানে কেন এসেছি। অদূরেই অসংখ্য চিত্রা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। নীরবে দেখতে লাগলাম সোনার হরিণের পাল। আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গেলাম। ক্যামেরা নিয়ে পড়লে এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা হবে না। আমরা যেমন হরিণ দেখছি, হরিণও কিন্তু একদল মানুষ দেখছে। সুতরাং হরিণগুলো ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই পুরো এলাকা সাফারি পার্কের মতো—আফ্রিকায় যেমন দেখা যায়। হরিণ দেখা শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুলে আমরা লঞ্চের দিকে পা বাড়ালাম।
এবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদের লঞ্চ—যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। ফেরার পথে দেখা হবে ডিমের চর ও করমজল। এখানে বলে রাখি, এই পুরো দলে আমারই কোনো উপদল ছিল না। আমি ঢাকা থেকে একাই এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনই আমার একটি দল তৈরি হয়। আমার এই দলে আছে এক তরুণ, এক শিশু আর দুই কিশোর—মাসুম, প্রত্যয়, প্রান্ত ও মাহী। ওরা থাকাতে আমার ভ্রমণটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়েছে। এবার আসি ‘ডিমের চর’ প্রসঙ্গে। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ডিমের চরে পা রাখলাম। এই চরের এই অদ্ভুত নামের কারণ কী? জানলাম, চরটি ডিম্বাকৃতির। তবে এর আরেকটি নামও রয়েছে—‘চর বিচ্ছু’।
এই চরের দক্ষিণ দিকে পক্ষীর চর। পাড় থেকেই বোঝা যায় চরটি গোল। ডিমের চরের চতুর্দিকে অথই পানি। এটি আসলে নদী ও সমুদ্রে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাড় থেকে ওপরের দিকে উঠতেই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে নানা ধরনের আবর্জনা পড়ে আছে। সাগর ও নদীতে ভেসে আসা আবর্জনার শেষ গন্তব্য এই চর। আর আবর্জনার স্তূপ আরও উঁচু করতে অনেক অসচেতন পর্যটক তো আছেই। এটিকে আবর্জনার চর বললেও ভুল হতো না। আবর্জনার কথা বাদ দিলে চরটি চমৎকার।
বিভূতিভূষণের ভাষায় বলতে হয়, ‘পিছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল—যেন কোন নূতন দেশের নূতন জীবনের সন্ধান পাইলাম এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।’
সত্যিই তাই, মনে হবে এই নির্জন দ্বীপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত! বালির গায়ে বসে যাওয়া সর্পিল পথ ধরে চরের ভেতরের দিকে (পূর্বদিক) এগিয়ে যাই। কিছু দূর গিয়ে আমরা থমকে গেলাম। একটু দূরেই ছনের বনে অগণিত চিত্রা হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি তারা টের পেল; কিন্তু পালাল না। হয়তো সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায়—সাহসও বেশি। ছনবনের পরেই ঘন বন। আমাদের সুন্দরবনের ডাঙার ৭০ শতাংশ ঘন গাছপালায় ছাওয়া। বাকি ৩০ শতাংশ ঘাসে আবৃত, চর এলাকা, সমুদ্রসৈকত, বালি ও কাদাময় প্রান্তর।
আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে আমরা আবার পাড়ের দিকে চলে এলাম। এখানে যখন নেমেছিলাম, তখন পানিতে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হয়েছিল পানিতে আগুন জ্বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে পানি তরল সোনায় পরিণত হয়েছে। যেন কেউ কোথাও নেই, আছে শুধু সূর্য ও তার জাদুর প্রতিবিম্ব। অন্ধকার বাড়ছে সূর্যও লাল হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে কিনা জানি না—সূর্য কিন্তু ডুবল না। পানিতে গা ডোবানোর আগেই নীরবে ধূসর আকাশে মিলিয়ে গেল। ঝপ করে নামল অন্ধকার। সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, খেয়ালই করিনি আমার পেছনে দুটো বন্য শূকর! আমার ভাগ্য ভালো তারা খাবারের খোঁজে ব্যস্ত ছিল। আমি ট্রলারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কী নিপুণভাবে নদী ও খাল পাড়ি দিচ্ছে নির্বিঘ্ন। কখনো গতি বাড়ছে, কখনো কমছে। কী রাত কী দিন—ভেসপার ভেসে চলেছে। আসলে তা চলে না—একজন তাকে চালায়। আর যিনি অবিরাম এটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি হলেন আবদুর রাজ্জাক। তৃতীয় তলার সামনের অংশে তাঁর অবস্থান। বয়স ত্রিশ। এই তরুণের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। ভেসপার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে আমাকে বললেন, তাঁকে কেউ বলে সারেং, কেউ বলে সুকানি, কেউ মাস্টার বলে। অনেকে নাকি ক্যাপ্টেন ও পাইলটও বলে।
শেষের লাইনটি বলে নিজেই হেসে ফেললেন রাজ্জাক। জানলাম, তিনি এখানে আছেন চার বছর ধরে। তার আগে কার্গো বোট চালাতেন, ঘুরতে হতো এক জেলা থেকে আরেক জেলা। তবে খুলনা এসে তিনি খুশি। জানতে চাইলাম, সুন্দরবন ভালো লাগে এ জন্য কাজটা করেন কিনা। উত্তর দিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া কিছু জানি না, তাই এটাই করি।’ রাজ্জাকদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিনি একাই। লঞ্চেই থাকা-খাওয়া। পর্যটন স্পট বন্ধ থাকলে অথবা ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফরিদপুরে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে ফেরা হয় না—দিনের পর দিন।
সুন্দরবনে এটিই শেষ রাত। তাই রাতের খাবারের মেনুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। মাছ ও মুরগির বারবিকিউ। কয়েকজন গান করলেন, নাচলেন—অনেক মজা হলো। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দূর থেকে রাতের সুন্দরবন দেখা হলো। সুন্দরবন দেবীর ঘুম যেন ভেঙে না যায়, সে জন্যই কি রাজ্জাক যতটা সম্ভব নীরবতা বজায় রেখে লঞ্চ চালাচ্ছেন? সুন্দরবনের রাত দেখে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘আবার আকাশে নক্ষত্র উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিচে অনন্ত সমুদ্র—মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম!’ যদিও এখন কুয়াশার কারণে খুব বেশি তারা আকাশে নেই। রাতের বাতাস বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে, লাউঞ্জে কেউ একজন গান ধরেছেন, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/ তোমায় আমি হলেম অচেনা...’ এই অচীন-অবর্ণনীয় নীরবতা কি মানুষের ভেতরের নীরবতাকেও উসকে দেয়? আর তখন পশুর নদীর মতোই কি ছলকে ওঠে সেই নীরবতা? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত একটার দিকে চাঁদপাই এলাকায় নোঙর ফেলল ভেসপার।
খুলনার দক্ষিণে দুবলার চরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে রূপসা নদী—যার একটি শাখা সমুদ্রে নেমেছে। অন্য শাখাটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী মংলা খালের সঙ্গে যুক্ত। এর পর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শিবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পশুর নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পশুর ভীষণ গভীর ও খরস্রোতা। সেই নদীকে আমি দুর্বল ভেবেছিলাম! সে জন্যই কিনা জানি না—আজ নিজের সক্ষমতা দেখাচ্ছে পশুর। সমুদ্রের মতো তার গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ, তীব্র তার স্রোত। তার আজ পশুর মতো বল। আচ্ছা নামটি পশুর কেন হলো? পশুর নামের গাছ থেকে? সুন্দরবনে প্রচুর পশুর গাছ জন্মে। বিভূতিভূষণ ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ নামের কিশোর উপন্যাসে এই পশুরকেই কি ভুলে ‘পশোর’ বলেছেন? নাকি মূল নাম পশোরই? পশোরের অর্থই-বা কী? যা হোক, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রলারে উঠে পড়লাম, গন্তব্য—করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র।
টালমাটাল অবস্থায় ট্রলার ১০ মিনিটের মধ্যেই বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে পৌঁছে গেল। কুমির দেখার জন্য জায়গাটি আদর্শ। বিভিন্ন চৌবাচ্চায় ছোট-বড় কুমির রয়েছে। একটি পুকুরে ‘রোমিও-জুলিয়েট’ নামে দুটি কুমিরের বসবাস। কেন্দ্রের লোকজন নাম ধরে ডাকলে সাঁতার কেটে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হয় তারা। এটি একটি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি চৌবাচ্চায় কয়েকটি কচ্ছপকে সাঁতার কেটে বেড়াতে দেখলাম। এই কেন্দ্রে যে প্রাণীগুলো সুখে-শান্তিতে নেই, তা বোঝা যায়। গোটা কেন্দ্রটিই শ্রীহীন, চৌবাচ্চার দেয়াল এবং খাঁচার লোহার জালগুলো ভাঙাচোরা, আর মানুষের উৎপাত তো রয়েছেই। বেলা ১১টার দিকে আমরা ফিরে এলাম।
বাঘ যে দেখা হলো না, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি বাঘ দেখতে আসিনি—এসেছি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হতে। পরিচয় বললাম, কারণ সুন্দরবনকে জানতে, বুঝতে মাসের পর মাস ব্যয় করলেও কম পড়তে পারে। আমরা গত দু-তিন দিনে বনদেবীর এক শতাংশও দর্শন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে যে সুন্দরবনের গল্প শুনছি, যার ছবি দেখি—তাকে সরাসরি একবার দেখার সাধ অন্তত মিটল। আমার এবারের প্রত্যাশা তাই ছিল। সুন্দরবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না হয় আবার আসব। দুপুরের দিকে আমরা ফিরে এলাম খুলনা সদরে।

রূপসা নদী থেকে কখন পশুর নদীতে উঠলাম, বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের লঞ্চটি একটি ঘোলা পানির উত্তাল নদীর মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটিই পশুর নদী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘পশোর’ নদী। এই নদীতে পড়ে সুন্দরবনের আভাস পাওয়া যায়। পাড়গুলোতে সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ জন্মেছে। পার্থক্য, এখানে অতটা ঘন নয় এবং একটু দূরেই গ্রাম ও ফসলি জমিগুলো স্পষ্ট।
‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ বইয়ে বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘সামনে বিস্তৃত পশোর নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতাল ঝোপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।’ আর আমার ধারণা ছিল পশুর শুধু নামেই নদী, আদতে একটি খাল। বিশালদেহী নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমি লজ্জাই পেলাম।
এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। পেশাগত কাজে আগে খুলনা ও বাগেরহাট আসা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এসেছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা পর্যন্ত। সুন্দরবনে এখনই হয়তো আসা হতো না যদি ‘ফেমাস ট্যুরস বিডি’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজির হোসেন রুবেল জোর আমন্ত্রণ না করতেন। যে লঞ্চের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘এমভি দ্য ভেসপার’। সকালে (১৪ জানুয়ারি, ২০২২) রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে ভেড়ানো ছিল। আমি ট্রেন থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখান থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। ঘাট থেকে একটি ট্রলার আমাকেসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে নিয়ে আসে লঞ্চটির কাছে। তিনতলা লঞ্চটির একদম নিচতলায় ইঞ্জিন, জেনারেটর ও রান্নাঘর। দ্বিতীয় তলায় অতিথিদের রুম এবং তৃতীয় তলায় হলরুম; এখানকার লোকজন বলে ‘লাউঞ্জ’। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমার রুমটি দ্বিতীয়তলার সামনের দিকে। সেখান থেকে বাইরের দৃশ্য দারুণ দেখায়। আমাদের দুই রাত, তিন দিনের সফর। এই কয়েকটা দিন এই লঞ্চে করেই জলে ভেসে বেড়াব আমরা।

লঞ্চের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ, নদী কাটার ঝিরঝির শব্দ ও হিমেল বাতাস, মনটা আনমনে করে দেয়। কী এক স্বর্গীয় ভালো লাগা ভর করে শরীরে। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় যত দূর চোখ যায়। কোথাও ইটপাথরের বড় বড় দালান নেই, যানজটের বালাই নেই, তীব্র হর্নের ডামাডোল নেই—নেই দম বন্ধ করা ধোঁয়া। বুঁদ হয়েছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। মন ভালো করা চলচ্চিত্রে হুট করেই ঢুকে পড়ল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পশুর নদীর পাড়েই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীর পাড়ে কি এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটছে—তা বুঝতে বিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ হতে হয় না। ওখানে গেলেই বোঝা যায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন—সুন্দরবনের কাছে একাধিক সিমেন্ট ও তরল গ্যাস তৈরির কারখানাও তো রয়েছে। যা হোক, বেলা দেড়টার দিকে আমাদের লঞ্চটি এসে থামল মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায়। আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, মুরগি, মাছ, পালং শাক, আলুর ভর্তা ও ডাল। খাবার সবই লঞ্চে রান্না হয়। খুবই সুস্বাদু, বাড়ির খাবারের মতো। বিশেষ করে কোরাল মাছের স্বাদ মুখে লেগে রইল অনেকক্ষণ। এই মাছ স্থানীয়দের কাছে ভেটকি বলে পরিচিত। মংলা এলাকায় নানা পণ্যের জাহাজ। এখানে রাতদিন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলে। জাহাজ আসছে, যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে হাতে এক কাপ চা নিয়ে লঞ্চের এদিক-ওদিক হাঁটছি। দেখলাম লঞ্চের পেছনের দিকে এক কোণে বসে এক নারী আমাদের নোংরা করা বাসনকোসন পরিষ্কার করছেন। তাঁকে দেখতে আমার মায়ের মতো। বয়সও একই, পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তাঁর গল্পটা শুনতে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নাম তাসলিমা বেগম। তিনি মূলত লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী। তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কাটা এবং থালা-বাসন ধোয়া তাঁর কাজ। তাসলিমা বেগমও আমাদের সঙ্গে এই লঞ্চে তিন দিন থাকবেন। শুনে অবাক হলাম, এই তিন দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পাবেন মাত্র ১ হাজার টাকা! ‘টাকা এত কম, কিছু বলেন না?’ জানতে চাইলাম। বললেন, লাভ নেই। বেশি দাবি করলে বাবুর্চি তাঁকে বাদ দিয়ে দেবেন। খুলনার তাসলিমা বেগমের একমাত্র ছেলের বাগেরহাটে একটি দোকান ছিল। তখন তাঁদের অবস্থা বেশ ভালোই। করোনাকালে লোকসান ও দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ছেলে এখন রিকশাভ্যান চালায়। আমি তাসলিমা বেগমকে কিছু টাকা দিলাম। টাকাটা পেয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। বললেন, ‘বাবা, আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’

বেলা ৪টার দিকে আমরা চলে এলাম হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম কেন্দ্রে। লঞ্চ থেকে আমরা উঠে পড়লাম লঞ্চের সঙ্গে থাকা ট্রলারটিতে। আমাদের নামতে দেখে দুজন নারী নৌকা বেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা ডাব বিক্রি করেন, আমরা যদি কিনি। সেই মোংলার একটি গ্রামে দুই বোন দিলারা ও হাজেরার বসবাস। প্রতিদিন সেখান থেকে ডাব এনে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করেন।
ছোট্ট নৌকাটির বইঠা বড় বোন দিলারার হাতে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। আর হাজেরার বয়স হবে চল্লিশের মতো। ডাবের দাম ঢাকা থেকেও বেশি। তবুও আমরা কয়েকজন ডাব কিনলাম। ট্রলারে করে ইকোপার্কের ঘাটে যেতে মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এটি বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য।
বনের এই অংশটিকে ঘিরে একটি কাঠের দীর্ঘ সেতু করা হয়েছে। সেই সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা চক্কর দেওয়া যায়। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। এখানে বাঘের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব; অর্থাৎ, এলাকাটি নিরাপদ। তবে একাধিক প্রজাতির বানর ও চিত্রা হরিণ অহরহ চোখে পড়বে। এই পার্কেই প্রথমবার বন্য হরিণের ছবি তুললাম। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমরা আবার ট্রলারে ফিরে এলাম। শীতকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, জাগেও অনেক বেলা করে। বিস্তীর্ণ সবুজ বন নিজেকে সঁপে দিল অন্ধকারের হাতে। সারা দিন যে বন দেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ—অন্ধকার নামলেই সেই বন থেকে সবাই পালাতে চায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের গতি ও শীতলতা। ভারী বাতাসের ছোঁয়ায় মনটাও কোনো কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়। ‘ভেসপার’ চলছে অন্ধকার ও শ্যালা নদী কেটে কেটে।
সাগর মোহনায় জোয়ার-ভাটা এবং নোনা ও মিষ্টি পানির প্রবাহ ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কারণ, পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় নদী যেখানে সাগরে মেশে, সাগর মোহনার যে অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে, সেখানেই ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন তেমনি একটি বন। এর বয়স তিন থেকে চার হাজার বছর। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সভায় দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। ঘোষণার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, অবদান ও পৃথিবীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি শর্ত বিবেচনা করা হয়। একই দিনে ইউনেসকো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ‘৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য’ এলাকা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত। এই তালিকাতেও আছে সুন্দরবনের নাম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই বিশেষ এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় একে ‘রামসার চুক্তি’ বলা হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কতটা কাজ করছি, তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।

আমাদের সঙ্গে আছেন ফরেস্ট গার্ড আলী হোসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত ১০-১২বার তিনি বাঘ দেখেছেন। একবার হয়েছেন মুখোমুখি। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তিনি মাত্র এসেছেন আন্ধারমানিক ক্যাম্পে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একে একে সবার অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে যায়, রইলেন শুধু তিনিই। পুরো ক্যাম্পে তিনি ও তাঁর বাবুর্চি। বনের মাঝখানে গা ছমছমে পরিবেশে তাঁদের ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি দু-তিনটি ঘর। ক্যাম্পের ভিতটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পের পাটাতনে নিরস্ত্র আলী হোসেন বসে আছেন। বাবুর্চিও নেই। তিনি শুনতে পেলেন পাটাতনের নিচে শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন বন্য শূকর। তিনি মুখে শব্দ করলেন, যাতে শূকরটি পালিয়ে যায়। একটু পর পাটাতনের নিচ থেকে বের হলো একটি পূর্ণবয়স্ক বেঙ্গল টাইগার!
বাঘটি ঘুরে আলী হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। আলী হোসেনের গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বাঘটি দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। সে বুঝে নিতে চাইছে তার শিকারটি অসহায় কিনা। আলী হোসেন বুঝলেন, এভাবে বসে থাকলে মরতে হবে। তিনি তাঁর সামনে থাকা টেবিলটি টেনে ঢালের মতো করে নিজের সামনে ধরলেন। বাঘটা গর্জন করে জানিয়ে দিল, কাজটি তার পছন্দ হয়নি। আলী হোসেনের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি শুনেছেন, বিকট শব্দে বাঘ ভয় পায়। তিনি সময় নষ্ট না করে টেবিলটিতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চাপড় মারতে লাগলেন। জোরে! আরও জোরে! এটাই বাঁচার শেষ চেষ্টা।
আলীর ভাগ্য ভালো; বাঘ সত্যিই ভয় পায়। ধীরে ধীরে বাঘটি ফিরে গেল। বাঘটি বনে মিলিয়ে যেতেই আলী হোসেন এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে আলী হোসেন জানিয়ে দিলেন, তিনি আর একা আন্ধারমানিক ক্যাম্পে থাকবেন না। তাঁকে রেঞ্জ অফিসেই রেখে দেওয়া হয়। গল্প শেষে আলী হোসেন বললেন, ‘ভাইজান, আমি এক মাস বাঘের ভয় থেইকা বাইর হইতে পারি নাই। একা বনে হাঁটলেই মনে হইতো আমার পিছনে বুঝি সেই বাঘটা আসতাছে।’ আরও বললেন, ‘খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক না। আমি জানি কারে কয় ছাড়া বাঘ।’
হাড়বাড়িয়া থেকে কটকা যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের লঞ্চ স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আছে সুন্দরবন। শ্যালা নদীর দুপাশে সুন্দরবন। বন যেন গার্ড অব অনার দিয়ে পর্যটক বোঝাই লঞ্চগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শীতের রাতে অদ্ভুত এক রূপে হাজির হয় সুন্দরবন। মাথার উপরে অবারিত ধূসর আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে থোকা থোকা মেঘ। যেন আকাশ ফেটে চৌচির। মেঘের আড়ালে চাঁদ। আড়ালে থেকেও আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে ওই আলোই তো ভরসা। বিভূতিভূষণের বর্ণনা, ‘ছোট খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই।’ আমিও দেখিনি।

জম্পেশ নৈশভোজ শেষে ঘুমাতে গেলাম। প্রথম রাতেই বুঝলাম এই মনোরম রুমটির একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন সমস্যাটা টের পাওয়া যায়। নোঙর ওঠানো-নামানোর যন্ত্রটা আমার রুমঘেঁষা। নোঙর নামানোর সময় ভয়ংকর দীর্ঘ শব্দ হয়, আর সে সময় যদি আপনি ঘুমে থাকেন, তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর একটিও নেই। ভোর তিনটায় আমি বিকট আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
লঞ্চ কটকা খালে নোঙর ফেলেছে। নোঙর ফেলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম সাড়ে ৫টার দিকে। তখনো ঘোর অন্ধকার। আকাশে মেঘ নেই। তবে চাঁদটি আকাশের শিরোমণি হয়ে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এখন গন্তব্য জামতলা সমুদ্রসৈকত। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ট্রলারে করে রওনা হলাম। কটকা থেকে আমাদের ট্রলার গিয়ে পড়ল জামতলা খালে। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো সুবিধা করতে পারছে না। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ঘাটে নামলাম। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। কখনো উন্মুক্ত প্রান্তর, কখনো ঘন বন। এদিকটায় অনেক বেশি টাইগার ফার্ন। বাংলাদেশে ২৫০ প্রজাতির ফার্ন হয়। এর বেশির ভাগই জন্মে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) বেশি দেখা যায়।
এই ফার্নের পাতার রঙের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। অনেক সময় শিকারের জন্য এই ফার্নের আড়ালে বাঘ ওত পেতে থাকে। আমার চোখ ঘুরেফিরে ওই ফার্নের ঝোপের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক চুপ করে বসে নেই তো! আমরা হেঁটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জামতলা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছালাম। সৈকতের এদিকটায় প্রচুর সুন্দরী গাছ। এখানে সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের চিহ্ন। একটি কথা বলে রাখি, আমরা এখন যেদিকেই যাচ্ছি চিত্রা হরিণ চোখে পড়ে। সুতরাং এই হরিণ ও বানর দেখা ডালভাত হয়ে গেছে।
আমরা যখন জামতলা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম, তখনো সূর্য কুয়াশার কবলে। সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়। এখানকার সমুদ্রের পানি নদীর পানির মতো ঘোলা। সমুদ্রে কেউ নামে না। তবু সমুদ্র তো সমুদ্রই, বড় বড় ঢেউ আছে—আছে গর্জনও। কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দূরে যেমন জাহাজ বা নৌকা দেখা যায়—এই সৈকত থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এখানকার বালিও ধূসর। এই সৈকতে আপনি যদি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, মনে হবে আপনিই প্রথম সৈকতটি আবিষ্কার করলেন। কারণ মানবসভ্যতার কোনো উপকরণ ত্রিসীমানায় নেই। এদিক থেকে এই সৈকতটি ভিন্ন। দুঃখজনক হলো, এখানে সেখানে বর্জ্য পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় খাবারের মোড়ক ও প্লাস্টিক বোতল ফেলে রেখে যায়। সমুদ্রও নানা বর্জ্য উগরে দেয় সৈকতে। এসব পরিষ্কার করার লোক আছে বলে মনে হয়নি।

একই দিন, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গেলাম টাইগার টিলায়। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। একটু পরপরই হরিণের পাল দেখা যায়। এই এলাকায় প্রচুর সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, ধুন্দুল, ওরা ও বাইন গাছ। এদের অনেকের শুলো হয়। এই শুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। মাটি ভেদ করে এই শুলোগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুলোর জন্য হাঁটা মুশকিল। এই এলাকার প্রায় পুরোটাই শুলো দিয়ে ছাওয়া। টিলা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ঢিবিও না। একটু উঁচু স্থান। এমন কয়েকটা তথাকথিত টিলা পেলাম। এই টিলাগুলোতে নাকি বাঘ বিশ্রাম নেয়। টিলাগুলোতে পুরোনো অবকাঠামোর চিহ্ন স্পষ্ট, আর টিলা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃৎপাত্রের অসংখ্য টুকরো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এগুলোকে সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতির নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। আমার কাছে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলোকে প্রাচীন মনে হয়নি। আরও কিছু দূর গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম আরেকটি ধ্বংসস্তূপের সামনে। এটি নাকি কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি লবণ কারখানার নিদর্শন। আমি এবারও সম্মত হতে পারলাম না। যা হোক, একাধিক হরিণের পাল, কথিত প্রত্নকেন্দ্র ও শুলোর গালিচা দেখা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কটকা নামে খাল হলেও অনেক নদীর চেয়েও বড়। সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের লঞ্চটি সেই কটকা থেকে ছিটা কটকা বা ছোট কটকা খাল ধরে চলা শুরু করল। সবার আশা, এবার কুমির দেখা যাবে। আমার এই পুরো ভ্রমণের এই অংশটুকু বিশিষ্ট।
খাল ধরে চলতে গিয়ে সুন্দরবনের এক অনন্য রূপ দেখা গেল। খালগুলোকে সুন্দরবনের ধমনি বলা যায়। গাঙ্গেয় মোহনায় কয়েক শ দ্বীপাঞ্চল নিয়ে সুন্দরবনের পরিবার। তার আয়তন এখন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে নদী-নালা ও খাল-বিলই দখল করে আছে ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুন্দরবনের অধিকাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ—৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আমরা এখন লঞ্চ নিয়ে যে খাল ধরে যাচ্ছি, তা স্বাভাবিকভাবেই ওই জলভাগের অংশ। এলাকাজুড়ে ভীষণ নীরবতা। কখনো কখনো সেই নীরবতাকে ভাঙে পাখির ডাক। খাল বলেই হয়তো আমাদের লঞ্চটিও খুব ধীর গতিতে চলছে, ফলে শব্দও কম। খালের ঘোলা পানিতে গাছের ছায়া পড়ায় পানির রং সবুজ বলে ভ্রম হয়। সরু খাল ধরে লঞ্চ কখনো ডানে, কখনো বাঁয় যাচ্ছে। অনেক সময় বড় গাছ ঘেঁষে চলতে হচ্ছে লঞ্চটিকে। এদিকটায় নানা প্রজাতির মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। ছিটা কটকা থেকে কচিখালী খালে ওঠার একটু আগে কুমিরের দেখা মিলল। একঝলক। খালপাড়ে বসে ছিল একটি কুমির ছানা। লম্বায় মাত্র দেড় হাত হবে। লঞ্চ কাছে আসতেই দ্রুত পানিতে নেমে উধাও হয়ে গেল। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ তা দেখার সুযোগ পেল না। যারা দেখতে পেল না—তাদের সে কী আফসোস! বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনে প্রধানত পাঁচটি প্রাণী দেখার আছে—বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও কুমির। আমার চারটি দেখা হয়ে গেছে। বাঘ দেখতে পাব সে আশা আমার নেই। বেলা দেড়টার দিকে আমাদের ‘ভেসপার’ কচিখালী খালে উঠল।
লঞ্চ ছুটছে কচিখালী অফিস পার্কের দিকে। সেখানে অনেক হাঁটতে হবে, আমরা দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম। কচিখালী অফিস পার্কে পৌঁছাতে বেলা ২টা ৪০ বেজে গেল। পার্কের নামে সরকারি যত স্থাপনা আছে, সেগুলো এই বনাঞ্চলে একেবারেই বেমানান। এখানেও যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ভবন—দেখতে বিকট।
একজনকে দেখলাম মসজিদের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন। তানজির হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে আমাদের দলটি এসব ফেলে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল। তবে এবার সব পর্যটক এই দলে নেই। অর্ধেকই আরাম করতে লঞ্চে রয়ে গেছে। যা হোক, যত দূর চোখ যায় আধমরা কোমরসমান ঘাস (ছন) আর ছোট ছোট বুনোফুলের গাছ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আতঙ্ক জাগানো টাইগার ফার্ন এবং দু-একট বড় গাছও রয়েছে। তবে এই খোলা প্রান্তরেরও সীমানা রয়েছে। এর সীমানা প্রাচীর ঘন বন। কিছু দূর হাঁটতেই বুঝলাম আমরা এখানে কেন এসেছি। অদূরেই অসংখ্য চিত্রা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। নীরবে দেখতে লাগলাম সোনার হরিণের পাল। আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গেলাম। ক্যামেরা নিয়ে পড়লে এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা হবে না। আমরা যেমন হরিণ দেখছি, হরিণও কিন্তু একদল মানুষ দেখছে। সুতরাং হরিণগুলো ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই পুরো এলাকা সাফারি পার্কের মতো—আফ্রিকায় যেমন দেখা যায়। হরিণ দেখা শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুলে আমরা লঞ্চের দিকে পা বাড়ালাম।
এবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদের লঞ্চ—যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। ফেরার পথে দেখা হবে ডিমের চর ও করমজল। এখানে বলে রাখি, এই পুরো দলে আমারই কোনো উপদল ছিল না। আমি ঢাকা থেকে একাই এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনই আমার একটি দল তৈরি হয়। আমার এই দলে আছে এক তরুণ, এক শিশু আর দুই কিশোর—মাসুম, প্রত্যয়, প্রান্ত ও মাহী। ওরা থাকাতে আমার ভ্রমণটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়েছে। এবার আসি ‘ডিমের চর’ প্রসঙ্গে। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ডিমের চরে পা রাখলাম। এই চরের এই অদ্ভুত নামের কারণ কী? জানলাম, চরটি ডিম্বাকৃতির। তবে এর আরেকটি নামও রয়েছে—‘চর বিচ্ছু’।
এই চরের দক্ষিণ দিকে পক্ষীর চর। পাড় থেকেই বোঝা যায় চরটি গোল। ডিমের চরের চতুর্দিকে অথই পানি। এটি আসলে নদী ও সমুদ্রে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাড় থেকে ওপরের দিকে উঠতেই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে নানা ধরনের আবর্জনা পড়ে আছে। সাগর ও নদীতে ভেসে আসা আবর্জনার শেষ গন্তব্য এই চর। আর আবর্জনার স্তূপ আরও উঁচু করতে অনেক অসচেতন পর্যটক তো আছেই। এটিকে আবর্জনার চর বললেও ভুল হতো না। আবর্জনার কথা বাদ দিলে চরটি চমৎকার।
বিভূতিভূষণের ভাষায় বলতে হয়, ‘পিছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল—যেন কোন নূতন দেশের নূতন জীবনের সন্ধান পাইলাম এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।’
সত্যিই তাই, মনে হবে এই নির্জন দ্বীপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত! বালির গায়ে বসে যাওয়া সর্পিল পথ ধরে চরের ভেতরের দিকে (পূর্বদিক) এগিয়ে যাই। কিছু দূর গিয়ে আমরা থমকে গেলাম। একটু দূরেই ছনের বনে অগণিত চিত্রা হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি তারা টের পেল; কিন্তু পালাল না। হয়তো সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায়—সাহসও বেশি। ছনবনের পরেই ঘন বন। আমাদের সুন্দরবনের ডাঙার ৭০ শতাংশ ঘন গাছপালায় ছাওয়া। বাকি ৩০ শতাংশ ঘাসে আবৃত, চর এলাকা, সমুদ্রসৈকত, বালি ও কাদাময় প্রান্তর।
আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে আমরা আবার পাড়ের দিকে চলে এলাম। এখানে যখন নেমেছিলাম, তখন পানিতে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হয়েছিল পানিতে আগুন জ্বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে পানি তরল সোনায় পরিণত হয়েছে। যেন কেউ কোথাও নেই, আছে শুধু সূর্য ও তার জাদুর প্রতিবিম্ব। অন্ধকার বাড়ছে সূর্যও লাল হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে কিনা জানি না—সূর্য কিন্তু ডুবল না। পানিতে গা ডোবানোর আগেই নীরবে ধূসর আকাশে মিলিয়ে গেল। ঝপ করে নামল অন্ধকার। সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, খেয়ালই করিনি আমার পেছনে দুটো বন্য শূকর! আমার ভাগ্য ভালো তারা খাবারের খোঁজে ব্যস্ত ছিল। আমি ট্রলারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কী নিপুণভাবে নদী ও খাল পাড়ি দিচ্ছে নির্বিঘ্ন। কখনো গতি বাড়ছে, কখনো কমছে। কী রাত কী দিন—ভেসপার ভেসে চলেছে। আসলে তা চলে না—একজন তাকে চালায়। আর যিনি অবিরাম এটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি হলেন আবদুর রাজ্জাক। তৃতীয় তলার সামনের অংশে তাঁর অবস্থান। বয়স ত্রিশ। এই তরুণের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। ভেসপার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে আমাকে বললেন, তাঁকে কেউ বলে সারেং, কেউ বলে সুকানি, কেউ মাস্টার বলে। অনেকে নাকি ক্যাপ্টেন ও পাইলটও বলে।
শেষের লাইনটি বলে নিজেই হেসে ফেললেন রাজ্জাক। জানলাম, তিনি এখানে আছেন চার বছর ধরে। তার আগে কার্গো বোট চালাতেন, ঘুরতে হতো এক জেলা থেকে আরেক জেলা। তবে খুলনা এসে তিনি খুশি। জানতে চাইলাম, সুন্দরবন ভালো লাগে এ জন্য কাজটা করেন কিনা। উত্তর দিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া কিছু জানি না, তাই এটাই করি।’ রাজ্জাকদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিনি একাই। লঞ্চেই থাকা-খাওয়া। পর্যটন স্পট বন্ধ থাকলে অথবা ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফরিদপুরে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে ফেরা হয় না—দিনের পর দিন।
সুন্দরবনে এটিই শেষ রাত। তাই রাতের খাবারের মেনুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। মাছ ও মুরগির বারবিকিউ। কয়েকজন গান করলেন, নাচলেন—অনেক মজা হলো। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দূর থেকে রাতের সুন্দরবন দেখা হলো। সুন্দরবন দেবীর ঘুম যেন ভেঙে না যায়, সে জন্যই কি রাজ্জাক যতটা সম্ভব নীরবতা বজায় রেখে লঞ্চ চালাচ্ছেন? সুন্দরবনের রাত দেখে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘আবার আকাশে নক্ষত্র উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিচে অনন্ত সমুদ্র—মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম!’ যদিও এখন কুয়াশার কারণে খুব বেশি তারা আকাশে নেই। রাতের বাতাস বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে, লাউঞ্জে কেউ একজন গান ধরেছেন, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/ তোমায় আমি হলেম অচেনা...’ এই অচীন-অবর্ণনীয় নীরবতা কি মানুষের ভেতরের নীরবতাকেও উসকে দেয়? আর তখন পশুর নদীর মতোই কি ছলকে ওঠে সেই নীরবতা? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত একটার দিকে চাঁদপাই এলাকায় নোঙর ফেলল ভেসপার।
খুলনার দক্ষিণে দুবলার চরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে রূপসা নদী—যার একটি শাখা সমুদ্রে নেমেছে। অন্য শাখাটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী মংলা খালের সঙ্গে যুক্ত। এর পর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শিবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পশুর নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পশুর ভীষণ গভীর ও খরস্রোতা। সেই নদীকে আমি দুর্বল ভেবেছিলাম! সে জন্যই কিনা জানি না—আজ নিজের সক্ষমতা দেখাচ্ছে পশুর। সমুদ্রের মতো তার গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ, তীব্র তার স্রোত। তার আজ পশুর মতো বল। আচ্ছা নামটি পশুর কেন হলো? পশুর নামের গাছ থেকে? সুন্দরবনে প্রচুর পশুর গাছ জন্মে। বিভূতিভূষণ ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ নামের কিশোর উপন্যাসে এই পশুরকেই কি ভুলে ‘পশোর’ বলেছেন? নাকি মূল নাম পশোরই? পশোরের অর্থই-বা কী? যা হোক, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রলারে উঠে পড়লাম, গন্তব্য—করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র।
টালমাটাল অবস্থায় ট্রলার ১০ মিনিটের মধ্যেই বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে পৌঁছে গেল। কুমির দেখার জন্য জায়গাটি আদর্শ। বিভিন্ন চৌবাচ্চায় ছোট-বড় কুমির রয়েছে। একটি পুকুরে ‘রোমিও-জুলিয়েট’ নামে দুটি কুমিরের বসবাস। কেন্দ্রের লোকজন নাম ধরে ডাকলে সাঁতার কেটে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হয় তারা। এটি একটি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি চৌবাচ্চায় কয়েকটি কচ্ছপকে সাঁতার কেটে বেড়াতে দেখলাম। এই কেন্দ্রে যে প্রাণীগুলো সুখে-শান্তিতে নেই, তা বোঝা যায়। গোটা কেন্দ্রটিই শ্রীহীন, চৌবাচ্চার দেয়াল এবং খাঁচার লোহার জালগুলো ভাঙাচোরা, আর মানুষের উৎপাত তো রয়েছেই। বেলা ১১টার দিকে আমরা ফিরে এলাম।
বাঘ যে দেখা হলো না, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি বাঘ দেখতে আসিনি—এসেছি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হতে। পরিচয় বললাম, কারণ সুন্দরবনকে জানতে, বুঝতে মাসের পর মাস ব্যয় করলেও কম পড়তে পারে। আমরা গত দু-তিন দিনে বনদেবীর এক শতাংশও দর্শন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে যে সুন্দরবনের গল্প শুনছি, যার ছবি দেখি—তাকে সরাসরি একবার দেখার সাধ অন্তত মিটল। আমার এবারের প্রত্যাশা তাই ছিল। সুন্দরবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না হয় আবার আসব। দুপুরের দিকে আমরা ফিরে এলাম খুলনা সদরে।
সুদীপ্ত সালাম

রূপসা নদী থেকে কখন পশুর নদীতে উঠলাম, বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের লঞ্চটি একটি ঘোলা পানির উত্তাল নদীর মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটিই পশুর নদী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘পশোর’ নদী। এই নদীতে পড়ে সুন্দরবনের আভাস পাওয়া যায়। পাড়গুলোতে সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ জন্মেছে। পার্থক্য, এখানে অতটা ঘন নয় এবং একটু দূরেই গ্রাম ও ফসলি জমিগুলো স্পষ্ট।
‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ বইয়ে বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘সামনে বিস্তৃত পশোর নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতাল ঝোপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।’ আর আমার ধারণা ছিল পশুর শুধু নামেই নদী, আদতে একটি খাল। বিশালদেহী নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমি লজ্জাই পেলাম।
এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। পেশাগত কাজে আগে খুলনা ও বাগেরহাট আসা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এসেছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা পর্যন্ত। সুন্দরবনে এখনই হয়তো আসা হতো না যদি ‘ফেমাস ট্যুরস বিডি’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজির হোসেন রুবেল জোর আমন্ত্রণ না করতেন। যে লঞ্চের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘এমভি দ্য ভেসপার’। সকালে (১৪ জানুয়ারি, ২০২২) রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে ভেড়ানো ছিল। আমি ট্রেন থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখান থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। ঘাট থেকে একটি ট্রলার আমাকেসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে নিয়ে আসে লঞ্চটির কাছে। তিনতলা লঞ্চটির একদম নিচতলায় ইঞ্জিন, জেনারেটর ও রান্নাঘর। দ্বিতীয় তলায় অতিথিদের রুম এবং তৃতীয় তলায় হলরুম; এখানকার লোকজন বলে ‘লাউঞ্জ’। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমার রুমটি দ্বিতীয়তলার সামনের দিকে। সেখান থেকে বাইরের দৃশ্য দারুণ দেখায়। আমাদের দুই রাত, তিন দিনের সফর। এই কয়েকটা দিন এই লঞ্চে করেই জলে ভেসে বেড়াব আমরা।

লঞ্চের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ, নদী কাটার ঝিরঝির শব্দ ও হিমেল বাতাস, মনটা আনমনে করে দেয়। কী এক স্বর্গীয় ভালো লাগা ভর করে শরীরে। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় যত দূর চোখ যায়। কোথাও ইটপাথরের বড় বড় দালান নেই, যানজটের বালাই নেই, তীব্র হর্নের ডামাডোল নেই—নেই দম বন্ধ করা ধোঁয়া। বুঁদ হয়েছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। মন ভালো করা চলচ্চিত্রে হুট করেই ঢুকে পড়ল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পশুর নদীর পাড়েই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীর পাড়ে কি এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটছে—তা বুঝতে বিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ হতে হয় না। ওখানে গেলেই বোঝা যায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন—সুন্দরবনের কাছে একাধিক সিমেন্ট ও তরল গ্যাস তৈরির কারখানাও তো রয়েছে। যা হোক, বেলা দেড়টার দিকে আমাদের লঞ্চটি এসে থামল মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায়। আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, মুরগি, মাছ, পালং শাক, আলুর ভর্তা ও ডাল। খাবার সবই লঞ্চে রান্না হয়। খুবই সুস্বাদু, বাড়ির খাবারের মতো। বিশেষ করে কোরাল মাছের স্বাদ মুখে লেগে রইল অনেকক্ষণ। এই মাছ স্থানীয়দের কাছে ভেটকি বলে পরিচিত। মংলা এলাকায় নানা পণ্যের জাহাজ। এখানে রাতদিন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলে। জাহাজ আসছে, যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে হাতে এক কাপ চা নিয়ে লঞ্চের এদিক-ওদিক হাঁটছি। দেখলাম লঞ্চের পেছনের দিকে এক কোণে বসে এক নারী আমাদের নোংরা করা বাসনকোসন পরিষ্কার করছেন। তাঁকে দেখতে আমার মায়ের মতো। বয়সও একই, পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তাঁর গল্পটা শুনতে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নাম তাসলিমা বেগম। তিনি মূলত লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী। তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কাটা এবং থালা-বাসন ধোয়া তাঁর কাজ। তাসলিমা বেগমও আমাদের সঙ্গে এই লঞ্চে তিন দিন থাকবেন। শুনে অবাক হলাম, এই তিন দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পাবেন মাত্র ১ হাজার টাকা! ‘টাকা এত কম, কিছু বলেন না?’ জানতে চাইলাম। বললেন, লাভ নেই। বেশি দাবি করলে বাবুর্চি তাঁকে বাদ দিয়ে দেবেন। খুলনার তাসলিমা বেগমের একমাত্র ছেলের বাগেরহাটে একটি দোকান ছিল। তখন তাঁদের অবস্থা বেশ ভালোই। করোনাকালে লোকসান ও দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ছেলে এখন রিকশাভ্যান চালায়। আমি তাসলিমা বেগমকে কিছু টাকা দিলাম। টাকাটা পেয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। বললেন, ‘বাবা, আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’

বেলা ৪টার দিকে আমরা চলে এলাম হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম কেন্দ্রে। লঞ্চ থেকে আমরা উঠে পড়লাম লঞ্চের সঙ্গে থাকা ট্রলারটিতে। আমাদের নামতে দেখে দুজন নারী নৌকা বেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা ডাব বিক্রি করেন, আমরা যদি কিনি। সেই মোংলার একটি গ্রামে দুই বোন দিলারা ও হাজেরার বসবাস। প্রতিদিন সেখান থেকে ডাব এনে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করেন।
ছোট্ট নৌকাটির বইঠা বড় বোন দিলারার হাতে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। আর হাজেরার বয়স হবে চল্লিশের মতো। ডাবের দাম ঢাকা থেকেও বেশি। তবুও আমরা কয়েকজন ডাব কিনলাম। ট্রলারে করে ইকোপার্কের ঘাটে যেতে মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এটি বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য।
বনের এই অংশটিকে ঘিরে একটি কাঠের দীর্ঘ সেতু করা হয়েছে। সেই সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা চক্কর দেওয়া যায়। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। এখানে বাঘের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব; অর্থাৎ, এলাকাটি নিরাপদ। তবে একাধিক প্রজাতির বানর ও চিত্রা হরিণ অহরহ চোখে পড়বে। এই পার্কেই প্রথমবার বন্য হরিণের ছবি তুললাম। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমরা আবার ট্রলারে ফিরে এলাম। শীতকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, জাগেও অনেক বেলা করে। বিস্তীর্ণ সবুজ বন নিজেকে সঁপে দিল অন্ধকারের হাতে। সারা দিন যে বন দেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ—অন্ধকার নামলেই সেই বন থেকে সবাই পালাতে চায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের গতি ও শীতলতা। ভারী বাতাসের ছোঁয়ায় মনটাও কোনো কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়। ‘ভেসপার’ চলছে অন্ধকার ও শ্যালা নদী কেটে কেটে।
সাগর মোহনায় জোয়ার-ভাটা এবং নোনা ও মিষ্টি পানির প্রবাহ ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কারণ, পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় নদী যেখানে সাগরে মেশে, সাগর মোহনার যে অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে, সেখানেই ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন তেমনি একটি বন। এর বয়স তিন থেকে চার হাজার বছর। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সভায় দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। ঘোষণার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, অবদান ও পৃথিবীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি শর্ত বিবেচনা করা হয়। একই দিনে ইউনেসকো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ‘৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য’ এলাকা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত। এই তালিকাতেও আছে সুন্দরবনের নাম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই বিশেষ এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় একে ‘রামসার চুক্তি’ বলা হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কতটা কাজ করছি, তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।

আমাদের সঙ্গে আছেন ফরেস্ট গার্ড আলী হোসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত ১০-১২বার তিনি বাঘ দেখেছেন। একবার হয়েছেন মুখোমুখি। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তিনি মাত্র এসেছেন আন্ধারমানিক ক্যাম্পে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একে একে সবার অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে যায়, রইলেন শুধু তিনিই। পুরো ক্যাম্পে তিনি ও তাঁর বাবুর্চি। বনের মাঝখানে গা ছমছমে পরিবেশে তাঁদের ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি দু-তিনটি ঘর। ক্যাম্পের ভিতটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পের পাটাতনে নিরস্ত্র আলী হোসেন বসে আছেন। বাবুর্চিও নেই। তিনি শুনতে পেলেন পাটাতনের নিচে শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন বন্য শূকর। তিনি মুখে শব্দ করলেন, যাতে শূকরটি পালিয়ে যায়। একটু পর পাটাতনের নিচ থেকে বের হলো একটি পূর্ণবয়স্ক বেঙ্গল টাইগার!
বাঘটি ঘুরে আলী হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। আলী হোসেনের গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বাঘটি দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। সে বুঝে নিতে চাইছে তার শিকারটি অসহায় কিনা। আলী হোসেন বুঝলেন, এভাবে বসে থাকলে মরতে হবে। তিনি তাঁর সামনে থাকা টেবিলটি টেনে ঢালের মতো করে নিজের সামনে ধরলেন। বাঘটা গর্জন করে জানিয়ে দিল, কাজটি তার পছন্দ হয়নি। আলী হোসেনের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি শুনেছেন, বিকট শব্দে বাঘ ভয় পায়। তিনি সময় নষ্ট না করে টেবিলটিতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চাপড় মারতে লাগলেন। জোরে! আরও জোরে! এটাই বাঁচার শেষ চেষ্টা।
আলীর ভাগ্য ভালো; বাঘ সত্যিই ভয় পায়। ধীরে ধীরে বাঘটি ফিরে গেল। বাঘটি বনে মিলিয়ে যেতেই আলী হোসেন এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে আলী হোসেন জানিয়ে দিলেন, তিনি আর একা আন্ধারমানিক ক্যাম্পে থাকবেন না। তাঁকে রেঞ্জ অফিসেই রেখে দেওয়া হয়। গল্প শেষে আলী হোসেন বললেন, ‘ভাইজান, আমি এক মাস বাঘের ভয় থেইকা বাইর হইতে পারি নাই। একা বনে হাঁটলেই মনে হইতো আমার পিছনে বুঝি সেই বাঘটা আসতাছে।’ আরও বললেন, ‘খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক না। আমি জানি কারে কয় ছাড়া বাঘ।’
হাড়বাড়িয়া থেকে কটকা যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের লঞ্চ স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আছে সুন্দরবন। শ্যালা নদীর দুপাশে সুন্দরবন। বন যেন গার্ড অব অনার দিয়ে পর্যটক বোঝাই লঞ্চগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শীতের রাতে অদ্ভুত এক রূপে হাজির হয় সুন্দরবন। মাথার উপরে অবারিত ধূসর আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে থোকা থোকা মেঘ। যেন আকাশ ফেটে চৌচির। মেঘের আড়ালে চাঁদ। আড়ালে থেকেও আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে ওই আলোই তো ভরসা। বিভূতিভূষণের বর্ণনা, ‘ছোট খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই।’ আমিও দেখিনি।

জম্পেশ নৈশভোজ শেষে ঘুমাতে গেলাম। প্রথম রাতেই বুঝলাম এই মনোরম রুমটির একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন সমস্যাটা টের পাওয়া যায়। নোঙর ওঠানো-নামানোর যন্ত্রটা আমার রুমঘেঁষা। নোঙর নামানোর সময় ভয়ংকর দীর্ঘ শব্দ হয়, আর সে সময় যদি আপনি ঘুমে থাকেন, তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর একটিও নেই। ভোর তিনটায় আমি বিকট আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
লঞ্চ কটকা খালে নোঙর ফেলেছে। নোঙর ফেলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম সাড়ে ৫টার দিকে। তখনো ঘোর অন্ধকার। আকাশে মেঘ নেই। তবে চাঁদটি আকাশের শিরোমণি হয়ে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এখন গন্তব্য জামতলা সমুদ্রসৈকত। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ট্রলারে করে রওনা হলাম। কটকা থেকে আমাদের ট্রলার গিয়ে পড়ল জামতলা খালে। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো সুবিধা করতে পারছে না। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ঘাটে নামলাম। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। কখনো উন্মুক্ত প্রান্তর, কখনো ঘন বন। এদিকটায় অনেক বেশি টাইগার ফার্ন। বাংলাদেশে ২৫০ প্রজাতির ফার্ন হয়। এর বেশির ভাগই জন্মে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) বেশি দেখা যায়।
এই ফার্নের পাতার রঙের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। অনেক সময় শিকারের জন্য এই ফার্নের আড়ালে বাঘ ওত পেতে থাকে। আমার চোখ ঘুরেফিরে ওই ফার্নের ঝোপের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক চুপ করে বসে নেই তো! আমরা হেঁটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জামতলা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছালাম। সৈকতের এদিকটায় প্রচুর সুন্দরী গাছ। এখানে সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের চিহ্ন। একটি কথা বলে রাখি, আমরা এখন যেদিকেই যাচ্ছি চিত্রা হরিণ চোখে পড়ে। সুতরাং এই হরিণ ও বানর দেখা ডালভাত হয়ে গেছে।
আমরা যখন জামতলা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম, তখনো সূর্য কুয়াশার কবলে। সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়। এখানকার সমুদ্রের পানি নদীর পানির মতো ঘোলা। সমুদ্রে কেউ নামে না। তবু সমুদ্র তো সমুদ্রই, বড় বড় ঢেউ আছে—আছে গর্জনও। কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দূরে যেমন জাহাজ বা নৌকা দেখা যায়—এই সৈকত থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এখানকার বালিও ধূসর। এই সৈকতে আপনি যদি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, মনে হবে আপনিই প্রথম সৈকতটি আবিষ্কার করলেন। কারণ মানবসভ্যতার কোনো উপকরণ ত্রিসীমানায় নেই। এদিক থেকে এই সৈকতটি ভিন্ন। দুঃখজনক হলো, এখানে সেখানে বর্জ্য পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় খাবারের মোড়ক ও প্লাস্টিক বোতল ফেলে রেখে যায়। সমুদ্রও নানা বর্জ্য উগরে দেয় সৈকতে। এসব পরিষ্কার করার লোক আছে বলে মনে হয়নি।

একই দিন, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গেলাম টাইগার টিলায়। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। একটু পরপরই হরিণের পাল দেখা যায়। এই এলাকায় প্রচুর সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, ধুন্দুল, ওরা ও বাইন গাছ। এদের অনেকের শুলো হয়। এই শুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। মাটি ভেদ করে এই শুলোগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুলোর জন্য হাঁটা মুশকিল। এই এলাকার প্রায় পুরোটাই শুলো দিয়ে ছাওয়া। টিলা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ঢিবিও না। একটু উঁচু স্থান। এমন কয়েকটা তথাকথিত টিলা পেলাম। এই টিলাগুলোতে নাকি বাঘ বিশ্রাম নেয়। টিলাগুলোতে পুরোনো অবকাঠামোর চিহ্ন স্পষ্ট, আর টিলা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃৎপাত্রের অসংখ্য টুকরো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এগুলোকে সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতির নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। আমার কাছে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলোকে প্রাচীন মনে হয়নি। আরও কিছু দূর গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম আরেকটি ধ্বংসস্তূপের সামনে। এটি নাকি কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি লবণ কারখানার নিদর্শন। আমি এবারও সম্মত হতে পারলাম না। যা হোক, একাধিক হরিণের পাল, কথিত প্রত্নকেন্দ্র ও শুলোর গালিচা দেখা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কটকা নামে খাল হলেও অনেক নদীর চেয়েও বড়। সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের লঞ্চটি সেই কটকা থেকে ছিটা কটকা বা ছোট কটকা খাল ধরে চলা শুরু করল। সবার আশা, এবার কুমির দেখা যাবে। আমার এই পুরো ভ্রমণের এই অংশটুকু বিশিষ্ট।
খাল ধরে চলতে গিয়ে সুন্দরবনের এক অনন্য রূপ দেখা গেল। খালগুলোকে সুন্দরবনের ধমনি বলা যায়। গাঙ্গেয় মোহনায় কয়েক শ দ্বীপাঞ্চল নিয়ে সুন্দরবনের পরিবার। তার আয়তন এখন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে নদী-নালা ও খাল-বিলই দখল করে আছে ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুন্দরবনের অধিকাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ—৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আমরা এখন লঞ্চ নিয়ে যে খাল ধরে যাচ্ছি, তা স্বাভাবিকভাবেই ওই জলভাগের অংশ। এলাকাজুড়ে ভীষণ নীরবতা। কখনো কখনো সেই নীরবতাকে ভাঙে পাখির ডাক। খাল বলেই হয়তো আমাদের লঞ্চটিও খুব ধীর গতিতে চলছে, ফলে শব্দও কম। খালের ঘোলা পানিতে গাছের ছায়া পড়ায় পানির রং সবুজ বলে ভ্রম হয়। সরু খাল ধরে লঞ্চ কখনো ডানে, কখনো বাঁয় যাচ্ছে। অনেক সময় বড় গাছ ঘেঁষে চলতে হচ্ছে লঞ্চটিকে। এদিকটায় নানা প্রজাতির মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। ছিটা কটকা থেকে কচিখালী খালে ওঠার একটু আগে কুমিরের দেখা মিলল। একঝলক। খালপাড়ে বসে ছিল একটি কুমির ছানা। লম্বায় মাত্র দেড় হাত হবে। লঞ্চ কাছে আসতেই দ্রুত পানিতে নেমে উধাও হয়ে গেল। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ তা দেখার সুযোগ পেল না। যারা দেখতে পেল না—তাদের সে কী আফসোস! বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনে প্রধানত পাঁচটি প্রাণী দেখার আছে—বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও কুমির। আমার চারটি দেখা হয়ে গেছে। বাঘ দেখতে পাব সে আশা আমার নেই। বেলা দেড়টার দিকে আমাদের ‘ভেসপার’ কচিখালী খালে উঠল।
লঞ্চ ছুটছে কচিখালী অফিস পার্কের দিকে। সেখানে অনেক হাঁটতে হবে, আমরা দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম। কচিখালী অফিস পার্কে পৌঁছাতে বেলা ২টা ৪০ বেজে গেল। পার্কের নামে সরকারি যত স্থাপনা আছে, সেগুলো এই বনাঞ্চলে একেবারেই বেমানান। এখানেও যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ভবন—দেখতে বিকট।
একজনকে দেখলাম মসজিদের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন। তানজির হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে আমাদের দলটি এসব ফেলে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল। তবে এবার সব পর্যটক এই দলে নেই। অর্ধেকই আরাম করতে লঞ্চে রয়ে গেছে। যা হোক, যত দূর চোখ যায় আধমরা কোমরসমান ঘাস (ছন) আর ছোট ছোট বুনোফুলের গাছ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আতঙ্ক জাগানো টাইগার ফার্ন এবং দু-একট বড় গাছও রয়েছে। তবে এই খোলা প্রান্তরেরও সীমানা রয়েছে। এর সীমানা প্রাচীর ঘন বন। কিছু দূর হাঁটতেই বুঝলাম আমরা এখানে কেন এসেছি। অদূরেই অসংখ্য চিত্রা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। নীরবে দেখতে লাগলাম সোনার হরিণের পাল। আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গেলাম। ক্যামেরা নিয়ে পড়লে এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা হবে না। আমরা যেমন হরিণ দেখছি, হরিণও কিন্তু একদল মানুষ দেখছে। সুতরাং হরিণগুলো ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই পুরো এলাকা সাফারি পার্কের মতো—আফ্রিকায় যেমন দেখা যায়। হরিণ দেখা শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুলে আমরা লঞ্চের দিকে পা বাড়ালাম।
এবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদের লঞ্চ—যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। ফেরার পথে দেখা হবে ডিমের চর ও করমজল। এখানে বলে রাখি, এই পুরো দলে আমারই কোনো উপদল ছিল না। আমি ঢাকা থেকে একাই এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনই আমার একটি দল তৈরি হয়। আমার এই দলে আছে এক তরুণ, এক শিশু আর দুই কিশোর—মাসুম, প্রত্যয়, প্রান্ত ও মাহী। ওরা থাকাতে আমার ভ্রমণটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়েছে। এবার আসি ‘ডিমের চর’ প্রসঙ্গে। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ডিমের চরে পা রাখলাম। এই চরের এই অদ্ভুত নামের কারণ কী? জানলাম, চরটি ডিম্বাকৃতির। তবে এর আরেকটি নামও রয়েছে—‘চর বিচ্ছু’।
এই চরের দক্ষিণ দিকে পক্ষীর চর। পাড় থেকেই বোঝা যায় চরটি গোল। ডিমের চরের চতুর্দিকে অথই পানি। এটি আসলে নদী ও সমুদ্রে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাড় থেকে ওপরের দিকে উঠতেই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে নানা ধরনের আবর্জনা পড়ে আছে। সাগর ও নদীতে ভেসে আসা আবর্জনার শেষ গন্তব্য এই চর। আর আবর্জনার স্তূপ আরও উঁচু করতে অনেক অসচেতন পর্যটক তো আছেই। এটিকে আবর্জনার চর বললেও ভুল হতো না। আবর্জনার কথা বাদ দিলে চরটি চমৎকার।
বিভূতিভূষণের ভাষায় বলতে হয়, ‘পিছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল—যেন কোন নূতন দেশের নূতন জীবনের সন্ধান পাইলাম এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।’
সত্যিই তাই, মনে হবে এই নির্জন দ্বীপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত! বালির গায়ে বসে যাওয়া সর্পিল পথ ধরে চরের ভেতরের দিকে (পূর্বদিক) এগিয়ে যাই। কিছু দূর গিয়ে আমরা থমকে গেলাম। একটু দূরেই ছনের বনে অগণিত চিত্রা হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি তারা টের পেল; কিন্তু পালাল না। হয়তো সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায়—সাহসও বেশি। ছনবনের পরেই ঘন বন। আমাদের সুন্দরবনের ডাঙার ৭০ শতাংশ ঘন গাছপালায় ছাওয়া। বাকি ৩০ শতাংশ ঘাসে আবৃত, চর এলাকা, সমুদ্রসৈকত, বালি ও কাদাময় প্রান্তর।
আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে আমরা আবার পাড়ের দিকে চলে এলাম। এখানে যখন নেমেছিলাম, তখন পানিতে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হয়েছিল পানিতে আগুন জ্বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে পানি তরল সোনায় পরিণত হয়েছে। যেন কেউ কোথাও নেই, আছে শুধু সূর্য ও তার জাদুর প্রতিবিম্ব। অন্ধকার বাড়ছে সূর্যও লাল হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে কিনা জানি না—সূর্য কিন্তু ডুবল না। পানিতে গা ডোবানোর আগেই নীরবে ধূসর আকাশে মিলিয়ে গেল। ঝপ করে নামল অন্ধকার। সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, খেয়ালই করিনি আমার পেছনে দুটো বন্য শূকর! আমার ভাগ্য ভালো তারা খাবারের খোঁজে ব্যস্ত ছিল। আমি ট্রলারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কী নিপুণভাবে নদী ও খাল পাড়ি দিচ্ছে নির্বিঘ্ন। কখনো গতি বাড়ছে, কখনো কমছে। কী রাত কী দিন—ভেসপার ভেসে চলেছে। আসলে তা চলে না—একজন তাকে চালায়। আর যিনি অবিরাম এটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি হলেন আবদুর রাজ্জাক। তৃতীয় তলার সামনের অংশে তাঁর অবস্থান। বয়স ত্রিশ। এই তরুণের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। ভেসপার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে আমাকে বললেন, তাঁকে কেউ বলে সারেং, কেউ বলে সুকানি, কেউ মাস্টার বলে। অনেকে নাকি ক্যাপ্টেন ও পাইলটও বলে।
শেষের লাইনটি বলে নিজেই হেসে ফেললেন রাজ্জাক। জানলাম, তিনি এখানে আছেন চার বছর ধরে। তার আগে কার্গো বোট চালাতেন, ঘুরতে হতো এক জেলা থেকে আরেক জেলা। তবে খুলনা এসে তিনি খুশি। জানতে চাইলাম, সুন্দরবন ভালো লাগে এ জন্য কাজটা করেন কিনা। উত্তর দিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া কিছু জানি না, তাই এটাই করি।’ রাজ্জাকদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিনি একাই। লঞ্চেই থাকা-খাওয়া। পর্যটন স্পট বন্ধ থাকলে অথবা ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফরিদপুরে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে ফেরা হয় না—দিনের পর দিন।
সুন্দরবনে এটিই শেষ রাত। তাই রাতের খাবারের মেনুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। মাছ ও মুরগির বারবিকিউ। কয়েকজন গান করলেন, নাচলেন—অনেক মজা হলো। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দূর থেকে রাতের সুন্দরবন দেখা হলো। সুন্দরবন দেবীর ঘুম যেন ভেঙে না যায়, সে জন্যই কি রাজ্জাক যতটা সম্ভব নীরবতা বজায় রেখে লঞ্চ চালাচ্ছেন? সুন্দরবনের রাত দেখে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘আবার আকাশে নক্ষত্র উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিচে অনন্ত সমুদ্র—মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম!’ যদিও এখন কুয়াশার কারণে খুব বেশি তারা আকাশে নেই। রাতের বাতাস বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে, লাউঞ্জে কেউ একজন গান ধরেছেন, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/ তোমায় আমি হলেম অচেনা...’ এই অচীন-অবর্ণনীয় নীরবতা কি মানুষের ভেতরের নীরবতাকেও উসকে দেয়? আর তখন পশুর নদীর মতোই কি ছলকে ওঠে সেই নীরবতা? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত একটার দিকে চাঁদপাই এলাকায় নোঙর ফেলল ভেসপার।
খুলনার দক্ষিণে দুবলার চরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে রূপসা নদী—যার একটি শাখা সমুদ্রে নেমেছে। অন্য শাখাটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী মংলা খালের সঙ্গে যুক্ত। এর পর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শিবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পশুর নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পশুর ভীষণ গভীর ও খরস্রোতা। সেই নদীকে আমি দুর্বল ভেবেছিলাম! সে জন্যই কিনা জানি না—আজ নিজের সক্ষমতা দেখাচ্ছে পশুর। সমুদ্রের মতো তার গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ, তীব্র তার স্রোত। তার আজ পশুর মতো বল। আচ্ছা নামটি পশুর কেন হলো? পশুর নামের গাছ থেকে? সুন্দরবনে প্রচুর পশুর গাছ জন্মে। বিভূতিভূষণ ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ নামের কিশোর উপন্যাসে এই পশুরকেই কি ভুলে ‘পশোর’ বলেছেন? নাকি মূল নাম পশোরই? পশোরের অর্থই-বা কী? যা হোক, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রলারে উঠে পড়লাম, গন্তব্য—করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র।
টালমাটাল অবস্থায় ট্রলার ১০ মিনিটের মধ্যেই বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে পৌঁছে গেল। কুমির দেখার জন্য জায়গাটি আদর্শ। বিভিন্ন চৌবাচ্চায় ছোট-বড় কুমির রয়েছে। একটি পুকুরে ‘রোমিও-জুলিয়েট’ নামে দুটি কুমিরের বসবাস। কেন্দ্রের লোকজন নাম ধরে ডাকলে সাঁতার কেটে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হয় তারা। এটি একটি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি চৌবাচ্চায় কয়েকটি কচ্ছপকে সাঁতার কেটে বেড়াতে দেখলাম। এই কেন্দ্রে যে প্রাণীগুলো সুখে-শান্তিতে নেই, তা বোঝা যায়। গোটা কেন্দ্রটিই শ্রীহীন, চৌবাচ্চার দেয়াল এবং খাঁচার লোহার জালগুলো ভাঙাচোরা, আর মানুষের উৎপাত তো রয়েছেই। বেলা ১১টার দিকে আমরা ফিরে এলাম।
বাঘ যে দেখা হলো না, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি বাঘ দেখতে আসিনি—এসেছি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হতে। পরিচয় বললাম, কারণ সুন্দরবনকে জানতে, বুঝতে মাসের পর মাস ব্যয় করলেও কম পড়তে পারে। আমরা গত দু-তিন দিনে বনদেবীর এক শতাংশও দর্শন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে যে সুন্দরবনের গল্প শুনছি, যার ছবি দেখি—তাকে সরাসরি একবার দেখার সাধ অন্তত মিটল। আমার এবারের প্রত্যাশা তাই ছিল। সুন্দরবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না হয় আবার আসব। দুপুরের দিকে আমরা ফিরে এলাম খুলনা সদরে।

রূপসা নদী থেকে কখন পশুর নদীতে উঠলাম, বুঝতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের লঞ্চটি একটি ঘোলা পানির উত্তাল নদীর মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটিই পশুর নদী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘পশোর’ নদী। এই নদীতে পড়ে সুন্দরবনের আভাস পাওয়া যায়। পাড়গুলোতে সুন্দরবনের গোলপাতা গাছ জন্মেছে। পার্থক্য, এখানে অতটা ঘন নয় এবং একটু দূরেই গ্রাম ও ফসলি জমিগুলো স্পষ্ট।
‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ বইয়ে বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘সামনে বিস্তৃত পশোর নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতাল ঝোপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।’ আর আমার ধারণা ছিল পশুর শুধু নামেই নদী, আদতে একটি খাল। বিশালদেহী নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আমি লজ্জাই পেলাম।
এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। পেশাগত কাজে আগে খুলনা ও বাগেরহাট আসা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এসেছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা পর্যন্ত। সুন্দরবনে এখনই হয়তো আসা হতো না যদি ‘ফেমাস ট্যুরস বিডি’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানজির হোসেন রুবেল জোর আমন্ত্রণ না করতেন। যে লঞ্চের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘এমভি দ্য ভেসপার’। সকালে (১৪ জানুয়ারি, ২০২২) রূপসার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে ভেড়ানো ছিল। আমি ট্রেন থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা স্টেশনে নামি। সেখান থেকে রিকশায় করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। ঘাট থেকে একটি ট্রলার আমাকেসহ প্রায় জনা পঞ্চাশেক পর্যটককে নিয়ে আসে লঞ্চটির কাছে। তিনতলা লঞ্চটির একদম নিচতলায় ইঞ্জিন, জেনারেটর ও রান্নাঘর। দ্বিতীয় তলায় অতিথিদের রুম এবং তৃতীয় তলায় হলরুম; এখানকার লোকজন বলে ‘লাউঞ্জ’। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমার রুমটি দ্বিতীয়তলার সামনের দিকে। সেখান থেকে বাইরের দৃশ্য দারুণ দেখায়। আমাদের দুই রাত, তিন দিনের সফর। এই কয়েকটা দিন এই লঞ্চে করেই জলে ভেসে বেড়াব আমরা।

লঞ্চের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ, নদী কাটার ঝিরঝির শব্দ ও হিমেল বাতাস, মনটা আনমনে করে দেয়। কী এক স্বর্গীয় ভালো লাগা ভর করে শরীরে। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় যত দূর চোখ যায়। কোথাও ইটপাথরের বড় বড় দালান নেই, যানজটের বালাই নেই, তীব্র হর্নের ডামাডোল নেই—নেই দম বন্ধ করা ধোঁয়া। বুঁদ হয়েছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। মন ভালো করা চলচ্চিত্রে হুট করেই ঢুকে পড়ল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পশুর নদীর পাড়েই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীর পাড়ে কি এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটছে—তা বুঝতে বিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ হতে হয় না। ওখানে গেলেই বোঝা যায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন—সুন্দরবনের কাছে একাধিক সিমেন্ট ও তরল গ্যাস তৈরির কারখানাও তো রয়েছে। যা হোক, বেলা দেড়টার দিকে আমাদের লঞ্চটি এসে থামল মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায়। আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, মুরগি, মাছ, পালং শাক, আলুর ভর্তা ও ডাল। খাবার সবই লঞ্চে রান্না হয়। খুবই সুস্বাদু, বাড়ির খাবারের মতো। বিশেষ করে কোরাল মাছের স্বাদ মুখে লেগে রইল অনেকক্ষণ। এই মাছ স্থানীয়দের কাছে ভেটকি বলে পরিচিত। মংলা এলাকায় নানা পণ্যের জাহাজ। এখানে রাতদিন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলে। জাহাজ আসছে, যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে হাতে এক কাপ চা নিয়ে লঞ্চের এদিক-ওদিক হাঁটছি। দেখলাম লঞ্চের পেছনের দিকে এক কোণে বসে এক নারী আমাদের নোংরা করা বাসনকোসন পরিষ্কার করছেন। তাঁকে দেখতে আমার মায়ের মতো। বয়সও একই, পঞ্চান্নর কাছাকাছি। তাঁর গল্পটা শুনতে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নাম তাসলিমা বেগম। তিনি মূলত লঞ্চের বাবুর্চির সহকারী। তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কাটা এবং থালা-বাসন ধোয়া তাঁর কাজ। তাসলিমা বেগমও আমাদের সঙ্গে এই লঞ্চে তিন দিন থাকবেন। শুনে অবাক হলাম, এই তিন দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পাবেন মাত্র ১ হাজার টাকা! ‘টাকা এত কম, কিছু বলেন না?’ জানতে চাইলাম। বললেন, লাভ নেই। বেশি দাবি করলে বাবুর্চি তাঁকে বাদ দিয়ে দেবেন। খুলনার তাসলিমা বেগমের একমাত্র ছেলের বাগেরহাটে একটি দোকান ছিল। তখন তাঁদের অবস্থা বেশ ভালোই। করোনাকালে লোকসান ও দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ছেলে এখন রিকশাভ্যান চালায়। আমি তাসলিমা বেগমকে কিছু টাকা দিলাম। টাকাটা পেয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলেও মুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। বললেন, ‘বাবা, আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’

বেলা ৪টার দিকে আমরা চলে এলাম হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম কেন্দ্রে। লঞ্চ থেকে আমরা উঠে পড়লাম লঞ্চের সঙ্গে থাকা ট্রলারটিতে। আমাদের নামতে দেখে দুজন নারী নৌকা বেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা ডাব বিক্রি করেন, আমরা যদি কিনি। সেই মোংলার একটি গ্রামে দুই বোন দিলারা ও হাজেরার বসবাস। প্রতিদিন সেখান থেকে ডাব এনে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করেন।
ছোট্ট নৌকাটির বইঠা বড় বোন দিলারার হাতে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। আর হাজেরার বয়স হবে চল্লিশের মতো। ডাবের দাম ঢাকা থেকেও বেশি। তবুও আমরা কয়েকজন ডাব কিনলাম। ট্রলারে করে ইকোপার্কের ঘাটে যেতে মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এটি বনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য।
বনের এই অংশটিকে ঘিরে একটি কাঠের দীর্ঘ সেতু করা হয়েছে। সেই সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা চক্কর দেওয়া যায়। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। এখানে বাঘের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব; অর্থাৎ, এলাকাটি নিরাপদ। তবে একাধিক প্রজাতির বানর ও চিত্রা হরিণ অহরহ চোখে পড়বে। এই পার্কেই প্রথমবার বন্য হরিণের ছবি তুললাম। সাড়ে ৫টা নাগাদ আমরা আবার ট্রলারে ফিরে এলাম। শীতকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, জাগেও অনেক বেলা করে। বিস্তীর্ণ সবুজ বন নিজেকে সঁপে দিল অন্ধকারের হাতে। সারা দিন যে বন দেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ—অন্ধকার নামলেই সেই বন থেকে সবাই পালাতে চায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের গতি ও শীতলতা। ভারী বাতাসের ছোঁয়ায় মনটাও কোনো কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়। ‘ভেসপার’ চলছে অন্ধকার ও শ্যালা নদী কেটে কেটে।
সাগর মোহনায় জোয়ার-ভাটা এবং নোনা ও মিষ্টি পানির প্রবাহ ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কারণ, পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় নদী যেখানে সাগরে মেশে, সাগর মোহনার যে অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে, সেখানেই ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন তেমনি একটি বন। এর বয়স তিন থেকে চার হাজার বছর। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সভায় দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। ঘোষণার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, অবদান ও পৃথিবীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি শর্ত বিবেচনা করা হয়। একই দিনে ইউনেসকো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ‘৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য’ এলাকা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত। এই তালিকাতেও আছে সুন্দরবনের নাম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই বিশেষ এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় একে ‘রামসার চুক্তি’ বলা হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা কতটা কাজ করছি, তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।

আমাদের সঙ্গে আছেন ফরেস্ট গার্ড আলী হোসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত ১০-১২বার তিনি বাঘ দেখেছেন। একবার হয়েছেন মুখোমুখি। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তিনি মাত্র এসেছেন আন্ধারমানিক ক্যাম্পে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একে একে সবার অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে যায়, রইলেন শুধু তিনিই। পুরো ক্যাম্পে তিনি ও তাঁর বাবুর্চি। বনের মাঝখানে গা ছমছমে পরিবেশে তাঁদের ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি দু-তিনটি ঘর। ক্যাম্পের ভিতটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পের পাটাতনে নিরস্ত্র আলী হোসেন বসে আছেন। বাবুর্চিও নেই। তিনি শুনতে পেলেন পাটাতনের নিচে শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন বন্য শূকর। তিনি মুখে শব্দ করলেন, যাতে শূকরটি পালিয়ে যায়। একটু পর পাটাতনের নিচ থেকে বের হলো একটি পূর্ণবয়স্ক বেঙ্গল টাইগার!
বাঘটি ঘুরে আলী হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়াল। আলী হোসেনের গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বাঘটি দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে। সে বুঝে নিতে চাইছে তার শিকারটি অসহায় কিনা। আলী হোসেন বুঝলেন, এভাবে বসে থাকলে মরতে হবে। তিনি তাঁর সামনে থাকা টেবিলটি টেনে ঢালের মতো করে নিজের সামনে ধরলেন। বাঘটা গর্জন করে জানিয়ে দিল, কাজটি তার পছন্দ হয়নি। আলী হোসেনের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি শুনেছেন, বিকট শব্দে বাঘ ভয় পায়। তিনি সময় নষ্ট না করে টেবিলটিতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চাপড় মারতে লাগলেন। জোরে! আরও জোরে! এটাই বাঁচার শেষ চেষ্টা।
আলীর ভাগ্য ভালো; বাঘ সত্যিই ভয় পায়। ধীরে ধীরে বাঘটি ফিরে গেল। বাঘটি বনে মিলিয়ে যেতেই আলী হোসেন এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে আলী হোসেন জানিয়ে দিলেন, তিনি আর একা আন্ধারমানিক ক্যাম্পে থাকবেন না। তাঁকে রেঞ্জ অফিসেই রেখে দেওয়া হয়। গল্প শেষে আলী হোসেন বললেন, ‘ভাইজান, আমি এক মাস বাঘের ভয় থেইকা বাইর হইতে পারি নাই। একা বনে হাঁটলেই মনে হইতো আমার পিছনে বুঝি সেই বাঘটা আসতাছে।’ আরও বললেন, ‘খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক না। আমি জানি কারে কয় ছাড়া বাঘ।’
হাড়বাড়িয়া থেকে কটকা যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের লঞ্চ স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আছে সুন্দরবন। শ্যালা নদীর দুপাশে সুন্দরবন। বন যেন গার্ড অব অনার দিয়ে পর্যটক বোঝাই লঞ্চগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শীতের রাতে অদ্ভুত এক রূপে হাজির হয় সুন্দরবন। মাথার উপরে অবারিত ধূসর আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে থোকা থোকা মেঘ। যেন আকাশ ফেটে চৌচির। মেঘের আড়ালে চাঁদ। আড়ালে থেকেও আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে ওই আলোই তো ভরসা। বিভূতিভূষণের বর্ণনা, ‘ছোট খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই।’ আমিও দেখিনি।

জম্পেশ নৈশভোজ শেষে ঘুমাতে গেলাম। প্রথম রাতেই বুঝলাম এই মনোরম রুমটির একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। যখন নোঙর ফেলা হয়, তখন সমস্যাটা টের পাওয়া যায়। নোঙর ওঠানো-নামানোর যন্ত্রটা আমার রুমঘেঁষা। নোঙর নামানোর সময় ভয়ংকর দীর্ঘ শব্দ হয়, আর সে সময় যদি আপনি ঘুমে থাকেন, তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর একটিও নেই। ভোর তিনটায় আমি বিকট আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
লঞ্চ কটকা খালে নোঙর ফেলেছে। নোঙর ফেলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম সাড়ে ৫টার দিকে। তখনো ঘোর অন্ধকার। আকাশে মেঘ নেই। তবে চাঁদটি আকাশের শিরোমণি হয়ে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এখন গন্তব্য জামতলা সমুদ্রসৈকত। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ট্রলারে করে রওনা হলাম। কটকা থেকে আমাদের ট্রলার গিয়ে পড়ল জামতলা খালে। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো সুবিধা করতে পারছে না। ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ঘাটে নামলাম। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। কখনো উন্মুক্ত প্রান্তর, কখনো ঘন বন। এদিকটায় অনেক বেশি টাইগার ফার্ন। বাংলাদেশে ২৫০ প্রজাতির ফার্ন হয়। এর বেশির ভাগই জন্মে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum) বেশি দেখা যায়।
এই ফার্নের পাতার রঙের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। অনেক সময় শিকারের জন্য এই ফার্নের আড়ালে বাঘ ওত পেতে থাকে। আমার চোখ ঘুরেফিরে ওই ফার্নের ঝোপের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক চুপ করে বসে নেই তো! আমরা হেঁটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জামতলা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছালাম। সৈকতের এদিকটায় প্রচুর সুন্দরী গাছ। এখানে সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের চিহ্ন। একটি কথা বলে রাখি, আমরা এখন যেদিকেই যাচ্ছি চিত্রা হরিণ চোখে পড়ে। সুতরাং এই হরিণ ও বানর দেখা ডালভাত হয়ে গেছে।
আমরা যখন জামতলা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম, তখনো সূর্য কুয়াশার কবলে। সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়। এখানকার সমুদ্রের পানি নদীর পানির মতো ঘোলা। সমুদ্রে কেউ নামে না। তবু সমুদ্র তো সমুদ্রই, বড় বড় ঢেউ আছে—আছে গর্জনও। কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দূরে যেমন জাহাজ বা নৌকা দেখা যায়—এই সৈকত থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এখানকার বালিও ধূসর। এই সৈকতে আপনি যদি একা দাঁড়িয়ে থাকেন, মনে হবে আপনিই প্রথম সৈকতটি আবিষ্কার করলেন। কারণ মানবসভ্যতার কোনো উপকরণ ত্রিসীমানায় নেই। এদিক থেকে এই সৈকতটি ভিন্ন। দুঃখজনক হলো, এখানে সেখানে বর্জ্য পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা যাওয়ার সময় খাবারের মোড়ক ও প্লাস্টিক বোতল ফেলে রেখে যায়। সমুদ্রও নানা বর্জ্য উগরে দেয় সৈকতে। এসব পরিষ্কার করার লোক আছে বলে মনে হয়নি।

একই দিন, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গেলাম টাইগার টিলায়। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। একটু পরপরই হরিণের পাল দেখা যায়। এই এলাকায় প্রচুর সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, ধুন্দুল, ওরা ও বাইন গাছ। এদের অনেকের শুলো হয়। এই শুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। মাটি ভেদ করে এই শুলোগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুলোর জন্য হাঁটা মুশকিল। এই এলাকার প্রায় পুরোটাই শুলো দিয়ে ছাওয়া। টিলা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ঢিবিও না। একটু উঁচু স্থান। এমন কয়েকটা তথাকথিত টিলা পেলাম। এই টিলাগুলোতে নাকি বাঘ বিশ্রাম নেয়। টিলাগুলোতে পুরোনো অবকাঠামোর চিহ্ন স্পষ্ট, আর টিলা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃৎপাত্রের অসংখ্য টুকরো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এগুলোকে সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতির নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। আমার কাছে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলোকে প্রাচীন মনে হয়নি। আরও কিছু দূর গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম আরেকটি ধ্বংসস্তূপের সামনে। এটি নাকি কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি লবণ কারখানার নিদর্শন। আমি এবারও সম্মত হতে পারলাম না। যা হোক, একাধিক হরিণের পাল, কথিত প্রত্নকেন্দ্র ও শুলোর গালিচা দেখা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কটকা নামে খাল হলেও অনেক নদীর চেয়েও বড়। সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের লঞ্চটি সেই কটকা থেকে ছিটা কটকা বা ছোট কটকা খাল ধরে চলা শুরু করল। সবার আশা, এবার কুমির দেখা যাবে। আমার এই পুরো ভ্রমণের এই অংশটুকু বিশিষ্ট।
খাল ধরে চলতে গিয়ে সুন্দরবনের এক অনন্য রূপ দেখা গেল। খালগুলোকে সুন্দরবনের ধমনি বলা যায়। গাঙ্গেয় মোহনায় কয়েক শ দ্বীপাঞ্চল নিয়ে সুন্দরবনের পরিবার। তার আয়তন এখন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে নদী-নালা ও খাল-বিলই দখল করে আছে ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুন্দরবনের অধিকাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ—৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আমরা এখন লঞ্চ নিয়ে যে খাল ধরে যাচ্ছি, তা স্বাভাবিকভাবেই ওই জলভাগের অংশ। এলাকাজুড়ে ভীষণ নীরবতা। কখনো কখনো সেই নীরবতাকে ভাঙে পাখির ডাক। খাল বলেই হয়তো আমাদের লঞ্চটিও খুব ধীর গতিতে চলছে, ফলে শব্দও কম। খালের ঘোলা পানিতে গাছের ছায়া পড়ায় পানির রং সবুজ বলে ভ্রম হয়। সরু খাল ধরে লঞ্চ কখনো ডানে, কখনো বাঁয় যাচ্ছে। অনেক সময় বড় গাছ ঘেঁষে চলতে হচ্ছে লঞ্চটিকে। এদিকটায় নানা প্রজাতির মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। ছিটা কটকা থেকে কচিখালী খালে ওঠার একটু আগে কুমিরের দেখা মিলল। একঝলক। খালপাড়ে বসে ছিল একটি কুমির ছানা। লম্বায় মাত্র দেড় হাত হবে। লঞ্চ কাছে আসতেই দ্রুত পানিতে নেমে উধাও হয়ে গেল। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, আমরা দু-একজন ছাড়া কেউ তা দেখার সুযোগ পেল না। যারা দেখতে পেল না—তাদের সে কী আফসোস! বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনে প্রধানত পাঁচটি প্রাণী দেখার আছে—বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর ও কুমির। আমার চারটি দেখা হয়ে গেছে। বাঘ দেখতে পাব সে আশা আমার নেই। বেলা দেড়টার দিকে আমাদের ‘ভেসপার’ কচিখালী খালে উঠল।
লঞ্চ ছুটছে কচিখালী অফিস পার্কের দিকে। সেখানে অনেক হাঁটতে হবে, আমরা দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম। কচিখালী অফিস পার্কে পৌঁছাতে বেলা ২টা ৪০ বেজে গেল। পার্কের নামে সরকারি যত স্থাপনা আছে, সেগুলো এই বনাঞ্চলে একেবারেই বেমানান। এখানেও যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ভবন—দেখতে বিকট।
একজনকে দেখলাম মসজিদের উন্নয়নের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন। তানজির হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে আমাদের দলটি এসব ফেলে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল। তবে এবার সব পর্যটক এই দলে নেই। অর্ধেকই আরাম করতে লঞ্চে রয়ে গেছে। যা হোক, যত দূর চোখ যায় আধমরা কোমরসমান ঘাস (ছন) আর ছোট ছোট বুনোফুলের গাছ দেখা যায়। মাঝে মাঝে আতঙ্ক জাগানো টাইগার ফার্ন এবং দু-একট বড় গাছও রয়েছে। তবে এই খোলা প্রান্তরেরও সীমানা রয়েছে। এর সীমানা প্রাচীর ঘন বন। কিছু দূর হাঁটতেই বুঝলাম আমরা এখানে কেন এসেছি। অদূরেই অসংখ্য চিত্রা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। নীরবে দেখতে লাগলাম সোনার হরিণের পাল। আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গেলাম। ক্যামেরা নিয়ে পড়লে এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা হবে না। আমরা যেমন হরিণ দেখছি, হরিণও কিন্তু একদল মানুষ দেখছে। সুতরাং হরিণগুলো ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই পুরো এলাকা সাফারি পার্কের মতো—আফ্রিকায় যেমন দেখা যায়। হরিণ দেখা শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুলে আমরা লঞ্চের দিকে পা বাড়ালাম।
এবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদের লঞ্চ—যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। ফেরার পথে দেখা হবে ডিমের চর ও করমজল। এখানে বলে রাখি, এই পুরো দলে আমারই কোনো উপদল ছিল না। আমি ঢাকা থেকে একাই এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনই আমার একটি দল তৈরি হয়। আমার এই দলে আছে এক তরুণ, এক শিশু আর দুই কিশোর—মাসুম, প্রত্যয়, প্রান্ত ও মাহী। ওরা থাকাতে আমার ভ্রমণটি আরও বেশি উপভোগ্য হয়েছে। এবার আসি ‘ডিমের চর’ প্রসঙ্গে। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ডিমের চরে পা রাখলাম। এই চরের এই অদ্ভুত নামের কারণ কী? জানলাম, চরটি ডিম্বাকৃতির। তবে এর আরেকটি নামও রয়েছে—‘চর বিচ্ছু’।
এই চরের দক্ষিণ দিকে পক্ষীর চর। পাড় থেকেই বোঝা যায় চরটি গোল। ডিমের চরের চতুর্দিকে অথই পানি। এটি আসলে নদী ও সমুদ্রে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাড় থেকে ওপরের দিকে উঠতেই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে নানা ধরনের আবর্জনা পড়ে আছে। সাগর ও নদীতে ভেসে আসা আবর্জনার শেষ গন্তব্য এই চর। আর আবর্জনার স্তূপ আরও উঁচু করতে অনেক অসচেতন পর্যটক তো আছেই। এটিকে আবর্জনার চর বললেও ভুল হতো না। আবর্জনার কথা বাদ দিলে চরটি চমৎকার।
বিভূতিভূষণের ভাষায় বলতে হয়, ‘পিছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল—যেন কোন নূতন দেশের নূতন জীবনের সন্ধান পাইলাম এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।’
সত্যিই তাই, মনে হবে এই নির্জন দ্বীপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত! বালির গায়ে বসে যাওয়া সর্পিল পথ ধরে চরের ভেতরের দিকে (পূর্বদিক) এগিয়ে যাই। কিছু দূর গিয়ে আমরা থমকে গেলাম। একটু দূরেই ছনের বনে অগণিত চিত্রা হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি তারা টের পেল; কিন্তু পালাল না। হয়তো সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায়—সাহসও বেশি। ছনবনের পরেই ঘন বন। আমাদের সুন্দরবনের ডাঙার ৭০ শতাংশ ঘন গাছপালায় ছাওয়া। বাকি ৩০ শতাংশ ঘাসে আবৃত, চর এলাকা, সমুদ্রসৈকত, বালি ও কাদাময় প্রান্তর।
আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে আমরা আবার পাড়ের দিকে চলে এলাম। এখানে যখন নেমেছিলাম, তখন পানিতে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হয়েছিল পানিতে আগুন জ্বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে পানি তরল সোনায় পরিণত হয়েছে। যেন কেউ কোথাও নেই, আছে শুধু সূর্য ও তার জাদুর প্রতিবিম্ব। অন্ধকার বাড়ছে সূর্যও লাল হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে কিনা জানি না—সূর্য কিন্তু ডুবল না। পানিতে গা ডোবানোর আগেই নীরবে ধূসর আকাশে মিলিয়ে গেল। ঝপ করে নামল অন্ধকার। সূর্যাস্ত দেখতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, খেয়ালই করিনি আমার পেছনে দুটো বন্য শূকর! আমার ভাগ্য ভালো তারা খাবারের খোঁজে ব্যস্ত ছিল। আমি ট্রলারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কী নিপুণভাবে নদী ও খাল পাড়ি দিচ্ছে নির্বিঘ্ন। কখনো গতি বাড়ছে, কখনো কমছে। কী রাত কী দিন—ভেসপার ভেসে চলেছে। আসলে তা চলে না—একজন তাকে চালায়। আর যিনি অবিরাম এটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি হলেন আবদুর রাজ্জাক। তৃতীয় তলার সামনের অংশে তাঁর অবস্থান। বয়স ত্রিশ। এই তরুণের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। ভেসপার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে আমাকে বললেন, তাঁকে কেউ বলে সারেং, কেউ বলে সুকানি, কেউ মাস্টার বলে। অনেকে নাকি ক্যাপ্টেন ও পাইলটও বলে।
শেষের লাইনটি বলে নিজেই হেসে ফেললেন রাজ্জাক। জানলাম, তিনি এখানে আছেন চার বছর ধরে। তার আগে কার্গো বোট চালাতেন, ঘুরতে হতো এক জেলা থেকে আরেক জেলা। তবে খুলনা এসে তিনি খুশি। জানতে চাইলাম, সুন্দরবন ভালো লাগে এ জন্য কাজটা করেন কিনা। উত্তর দিলেন, ‘এই কাজ ছাড়া কিছু জানি না, তাই এটাই করি।’ রাজ্জাকদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিনি একাই। লঞ্চেই থাকা-খাওয়া। পর্যটন স্পট বন্ধ থাকলে অথবা ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফরিদপুরে থাকা তাঁর পরিবারের কাছে ফেরা হয় না—দিনের পর দিন।
সুন্দরবনে এটিই শেষ রাত। তাই রাতের খাবারের মেনুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। মাছ ও মুরগির বারবিকিউ। কয়েকজন গান করলেন, নাচলেন—অনেক মজা হলো। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দূর থেকে রাতের সুন্দরবন দেখা হলো। সুন্দরবন দেবীর ঘুম যেন ভেঙে না যায়, সে জন্যই কি রাজ্জাক যতটা সম্ভব নীরবতা বজায় রেখে লঞ্চ চালাচ্ছেন? সুন্দরবনের রাত দেখে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘আবার আকাশে নক্ষত্র উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিচে অনন্ত সমুদ্র—মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম!’ যদিও এখন কুয়াশার কারণে খুব বেশি তারা আকাশে নেই। রাতের বাতাস বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে, লাউঞ্জে কেউ একজন গান ধরেছেন, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা/ তোমায় আমি হলেম অচেনা...’ এই অচীন-অবর্ণনীয় নীরবতা কি মানুষের ভেতরের নীরবতাকেও উসকে দেয়? আর তখন পশুর নদীর মতোই কি ছলকে ওঠে সেই নীরবতা? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত একটার দিকে চাঁদপাই এলাকায় নোঙর ফেলল ভেসপার।
খুলনার দক্ষিণে দুবলার চরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে রূপসা নদী—যার একটি শাখা সমুদ্রে নেমেছে। অন্য শাখাটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী মংলা খালের সঙ্গে যুক্ত। এর পর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শিবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পশুর নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পশুর ভীষণ গভীর ও খরস্রোতা। সেই নদীকে আমি দুর্বল ভেবেছিলাম! সে জন্যই কিনা জানি না—আজ নিজের সক্ষমতা দেখাচ্ছে পশুর। সমুদ্রের মতো তার গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ, তীব্র তার স্রোত। তার আজ পশুর মতো বল। আচ্ছা নামটি পশুর কেন হলো? পশুর নামের গাছ থেকে? সুন্দরবনে প্রচুর পশুর গাছ জন্মে। বিভূতিভূষণ ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ নামের কিশোর উপন্যাসে এই পশুরকেই কি ভুলে ‘পশোর’ বলেছেন? নাকি মূল নাম পশোরই? পশোরের অর্থই-বা কী? যা হোক, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রলারে উঠে পড়লাম, গন্তব্য—করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র।
টালমাটাল অবস্থায় ট্রলার ১০ মিনিটের মধ্যেই বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে পৌঁছে গেল। কুমির দেখার জন্য জায়গাটি আদর্শ। বিভিন্ন চৌবাচ্চায় ছোট-বড় কুমির রয়েছে। একটি পুকুরে ‘রোমিও-জুলিয়েট’ নামে দুটি কুমিরের বসবাস। কেন্দ্রের লোকজন নাম ধরে ডাকলে সাঁতার কেটে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হয় তারা। এটি একটি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি চৌবাচ্চায় কয়েকটি কচ্ছপকে সাঁতার কেটে বেড়াতে দেখলাম। এই কেন্দ্রে যে প্রাণীগুলো সুখে-শান্তিতে নেই, তা বোঝা যায়। গোটা কেন্দ্রটিই শ্রীহীন, চৌবাচ্চার দেয়াল এবং খাঁচার লোহার জালগুলো ভাঙাচোরা, আর মানুষের উৎপাত তো রয়েছেই। বেলা ১১টার দিকে আমরা ফিরে এলাম।
বাঘ যে দেখা হলো না, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি বাঘ দেখতে আসিনি—এসেছি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচিত হতে। পরিচয় বললাম, কারণ সুন্দরবনকে জানতে, বুঝতে মাসের পর মাস ব্যয় করলেও কম পড়তে পারে। আমরা গত দু-তিন দিনে বনদেবীর এক শতাংশও দর্শন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে যে সুন্দরবনের গল্প শুনছি, যার ছবি দেখি—তাকে সরাসরি একবার দেখার সাধ অন্তত মিটল। আমার এবারের প্রত্যাশা তাই ছিল। সুন্দরবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না হয় আবার আসব। দুপুরের দিকে আমরা ফিরে এলাম খুলনা সদরে।

বিশ্বের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ বা শহর নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলোতে শহরের আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেসব গ্রামে আলাদা করে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই পরিষ্কার রাখার জন্য। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পরিচ্ছন্ন...
৩ ঘণ্টা আগে
এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ঋতু হেমন্ত। নীরব আবেগে ঠাসা। শেষ শরতে ছাতিমের গন্ধে হেমন্ত আসে শিশিরভেজা হালকা শীতের ঘ্রাণ নিয়ে। ধান উৎপাদনের ঋতু বলে একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে উঠত, আর হেমন্তের অঘ্রানে পেকেও যেত।
৭ ঘণ্টা আগে
আপনার অর্থভাগ্য আজ ‘খুব খারাপ’ ঘোষণা হয়ে গেছে (সূত্রমতে, ঋণগ্রস্ত হতে পারেন)। এর অর্থ, ওয়ালেট আজ আন্তর্জাতিক ছুটি ঘোষণা করেছে এবং পকেটের অবস্থা ম্যালেরিয়া রোগীর মতো—একেবারে রুগ্ণ। আজ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগে দশবার ভাবুন।
৭ ঘণ্টা আগে
অতিথি আপ্যায়নে পাতে আমিষের এক পদ তুলে না দিলে আপ্যায়ন যেন অপূর্ণ থাকে। রাঁধতে যখন হবে, একটু ভিন্ন স্বাদের আমিষ রেঁধে মন ভরিয়ে দিতে পারেন অতিথির। চেনা আমিষের ভিন্ন পদের রেসিপি...
৭ ঘণ্টা আগেফিচার ডেস্ক, ঢাকা

বিশ্বের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ বা শহর নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলোতে শহরের আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেসব গ্রামে আলাদা করে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই পরিষ্কার রাখার জন্য। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এই গ্রামগুলো শুধু সুন্দর নয়, একই সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতার অনন্য উদাহরণ।
পেংলিপুরান, ইন্দোনেশিয়া
বালির ব্যাংলি জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম পরিচ্ছন্ন গ্রাম পেংলিপুরান। এখানে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাড়ি, পাথরের রাস্তা, ফুল-বাগানসহ গ্রামীণ পরিবেশ অত্যন্ত যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। গ্রামটির প্রতিটি পরিবারের সবাই পরিবেশ বিষয়ে সচেতন। তারা বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং জৈব বর্জ্য সার ব্যবহার করে। সেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। গ্রামটিতে গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ। এর পাশাপাশি পর্যটকের সংখ্যা সীমিত রাখার কারণে সেখানকার পরিবেশ ও শান্তি ঠিক নির্বিঘ্ন আছে। পেংলিপুরান গ্রামের অধিবাসীদের ঐতিহ্যের অংশ পেনজোর ও বান্টেন উৎসব। এসব গ্রামের হোমস্টেগুলোতে থাকলে স্থানীয়দের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া যায়। সুযোগ পাওয়া যায় তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা দেখার। সব মিলিয়ে পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখায় পেংলিপুরান গ্রাম পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
গিয়েথুর্ন, নেদারল্যান্ডস

‘উত্তরের ভেনিস’ বলে খ্যাত নেদারল্যান্ডসের গিয়েথুর্ন গ্রাম। সেখানে পাওয়া যায় না গাড়ির শব্দ, নেই রাস্তাঘাটে ব্যস্ততা। আছে শুধু শান্ত পানিপথ, ফুলে ভরা বাগান আর ছোট ছোট বাড়ি। গ্রামটিতে চলাচলের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় নৌকার ওপর। আরেকটি ব্যবস্থা আছে, সেটা হলো হাঁটা। স্থানীয়রা পরিবেশ রক্ষায় বেশ সচেতন। গ্রামটির খালে পানিও থাকে বারো মাস। পুরো গ্রাম ঘুরেও কোনো প্লাস্টিক বর্জ্য চোখে পড়বে না। এ গ্রামের মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট না করতে পর্যটকদের অনুরোধ করে থাকে সব সময়। শীতকালে বরফে জমে যাওয়া খালে জমে ওঠে স্থানীয় মানুষদের স্কেটিং। গিয়েথুর্ন যেন আধুনিক সভ্যতার কোলাহলের বাইরে প্রকৃতির কোলে শান্ত জীবনের এক নিদর্শন।
মাওলাইনং, ভারত
এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে খ্যাত মাওলাইনং। গ্রামটিতে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয় এবং ব্যবহার করা হয় বাঁশের ডাস্টবিন। স্থানীয়রা নিয়মিত গ্রামের সবকিছু পরিষ্কার রাখে। গ্রামের প্রতিটি রাস্তা দেখলেই সেখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতার কথা উপলব্ধি করা যায়। গ্রামীণ সৌন্দর্যের উপভোগের পাশাপাশি সেখানকার পরিবেশ-সচেতনতা দেখতেও পর্যটকেরা ভিড় জমায় প্রতিবছর।

ইয়ানা, ভারত
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের আছে ইয়ানা নামের এই গ্রাম। ঘন জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা কালো চুনাপাথরের বিশাল শিলাখণ্ড ভৈরবেশ্বর ও মহাশক্তি শিখর গ্রামটির প্রধান আকর্ষণ। এখানের বাতাসে ভেসে বেড়ায় আসে বৃষ্টির গন্ধ আর পাখির ডাক। ইয়ানার বাসিন্দারা পরিচ্ছন্নতা ও প্রকৃতি রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন। গ্রামটিতে প্লাস্টিক ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পর্যটকদেরও বর্জ্য নিজের সঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। স্থানীয়রা পরিবেশবান্ধব পর্যটনকে উৎসাহিত করে, যাতে গ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক থাকে। গ্রামজুড়ে হাঁটার পথগুলো ঝকঝকে পরিষ্কার। আশপাশের ঝরনা ও পাহাড়ের দৃশ্য মিলিয়ে ইয়ানা ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য অভিজ্ঞতা দেয়।
খোনোমা, ভারত

‘গ্রিন ভিলেজ’ নামে পরিচিত ভারতের নাগাল্যান্ডের খোনোমা গ্রাম। এটি ভারতের প্রথম পরিবেশবান্ধব গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামের জনগণ একসময় শিকারনির্ভর জীবনে অভ্যস্ত ছিল। এখন গ্রামজুড়ে পরিষ্কার রাস্তা, কাঠের ছাদের ঐতিহ্যবাহী ঘর আর সবুজ ধানখেত মিলে তৈরি করেছে পোস্টকার্ডের মতো দৃশ্য। গ্রামটির মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করে, তারা অতিথিপরায়ণ এবং নিজেদের সংস্কৃতি গর্বের সঙ্গে তুলে ধরে।
এই গ্রামগুলো শুধু ভ্রমণের জন্যই পরিচিতি পায়নি। এসব গ্রাম আমাদের শিখিয়েছে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধু সরকারের নির্দেশ থাকলেই হয় না। কমিউনিটি উদ্যোগ, সচেতনতা ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে পরিবেশ ও জীবনধারা পরিচ্ছন্ন তো বটেই, উন্নত করাও সম্ভব।
সূত্র: ট্রিপ অ্যাডভাইজার, ফোর্বস, ইন্ডিয়া ট্রাভেল

বিশ্বের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ বা শহর নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলোতে শহরের আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেসব গ্রামে আলাদা করে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই পরিষ্কার রাখার জন্য। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এই গ্রামগুলো শুধু সুন্দর নয়, একই সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতার অনন্য উদাহরণ।
পেংলিপুরান, ইন্দোনেশিয়া
বালির ব্যাংলি জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম পরিচ্ছন্ন গ্রাম পেংলিপুরান। এখানে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাড়ি, পাথরের রাস্তা, ফুল-বাগানসহ গ্রামীণ পরিবেশ অত্যন্ত যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। গ্রামটির প্রতিটি পরিবারের সবাই পরিবেশ বিষয়ে সচেতন। তারা বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং জৈব বর্জ্য সার ব্যবহার করে। সেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। গ্রামটিতে গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ। এর পাশাপাশি পর্যটকের সংখ্যা সীমিত রাখার কারণে সেখানকার পরিবেশ ও শান্তি ঠিক নির্বিঘ্ন আছে। পেংলিপুরান গ্রামের অধিবাসীদের ঐতিহ্যের অংশ পেনজোর ও বান্টেন উৎসব। এসব গ্রামের হোমস্টেগুলোতে থাকলে স্থানীয়দের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া যায়। সুযোগ পাওয়া যায় তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা দেখার। সব মিলিয়ে পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখায় পেংলিপুরান গ্রাম পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
গিয়েথুর্ন, নেদারল্যান্ডস

‘উত্তরের ভেনিস’ বলে খ্যাত নেদারল্যান্ডসের গিয়েথুর্ন গ্রাম। সেখানে পাওয়া যায় না গাড়ির শব্দ, নেই রাস্তাঘাটে ব্যস্ততা। আছে শুধু শান্ত পানিপথ, ফুলে ভরা বাগান আর ছোট ছোট বাড়ি। গ্রামটিতে চলাচলের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় নৌকার ওপর। আরেকটি ব্যবস্থা আছে, সেটা হলো হাঁটা। স্থানীয়রা পরিবেশ রক্ষায় বেশ সচেতন। গ্রামটির খালে পানিও থাকে বারো মাস। পুরো গ্রাম ঘুরেও কোনো প্লাস্টিক বর্জ্য চোখে পড়বে না। এ গ্রামের মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট না করতে পর্যটকদের অনুরোধ করে থাকে সব সময়। শীতকালে বরফে জমে যাওয়া খালে জমে ওঠে স্থানীয় মানুষদের স্কেটিং। গিয়েথুর্ন যেন আধুনিক সভ্যতার কোলাহলের বাইরে প্রকৃতির কোলে শান্ত জীবনের এক নিদর্শন।
মাওলাইনং, ভারত
এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে খ্যাত মাওলাইনং। গ্রামটিতে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয় এবং ব্যবহার করা হয় বাঁশের ডাস্টবিন। স্থানীয়রা নিয়মিত গ্রামের সবকিছু পরিষ্কার রাখে। গ্রামের প্রতিটি রাস্তা দেখলেই সেখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতার কথা উপলব্ধি করা যায়। গ্রামীণ সৌন্দর্যের উপভোগের পাশাপাশি সেখানকার পরিবেশ-সচেতনতা দেখতেও পর্যটকেরা ভিড় জমায় প্রতিবছর।

ইয়ানা, ভারত
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের আছে ইয়ানা নামের এই গ্রাম। ঘন জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা কালো চুনাপাথরের বিশাল শিলাখণ্ড ভৈরবেশ্বর ও মহাশক্তি শিখর গ্রামটির প্রধান আকর্ষণ। এখানের বাতাসে ভেসে বেড়ায় আসে বৃষ্টির গন্ধ আর পাখির ডাক। ইয়ানার বাসিন্দারা পরিচ্ছন্নতা ও প্রকৃতি রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন। গ্রামটিতে প্লাস্টিক ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পর্যটকদেরও বর্জ্য নিজের সঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। স্থানীয়রা পরিবেশবান্ধব পর্যটনকে উৎসাহিত করে, যাতে গ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক থাকে। গ্রামজুড়ে হাঁটার পথগুলো ঝকঝকে পরিষ্কার। আশপাশের ঝরনা ও পাহাড়ের দৃশ্য মিলিয়ে ইয়ানা ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য অভিজ্ঞতা দেয়।
খোনোমা, ভারত

‘গ্রিন ভিলেজ’ নামে পরিচিত ভারতের নাগাল্যান্ডের খোনোমা গ্রাম। এটি ভারতের প্রথম পরিবেশবান্ধব গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামের জনগণ একসময় শিকারনির্ভর জীবনে অভ্যস্ত ছিল। এখন গ্রামজুড়ে পরিষ্কার রাস্তা, কাঠের ছাদের ঐতিহ্যবাহী ঘর আর সবুজ ধানখেত মিলে তৈরি করেছে পোস্টকার্ডের মতো দৃশ্য। গ্রামটির মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করে, তারা অতিথিপরায়ণ এবং নিজেদের সংস্কৃতি গর্বের সঙ্গে তুলে ধরে।
এই গ্রামগুলো শুধু ভ্রমণের জন্যই পরিচিতি পায়নি। এসব গ্রাম আমাদের শিখিয়েছে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধু সরকারের নির্দেশ থাকলেই হয় না। কমিউনিটি উদ্যোগ, সচেতনতা ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে পরিবেশ ও জীবনধারা পরিচ্ছন্ন তো বটেই, উন্নত করাও সম্ভব।
সূত্র: ট্রিপ অ্যাডভাইজার, ফোর্বস, ইন্ডিয়া ট্রাভেল

আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ...
২১ জানুয়ারি ২০২২
এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ঋতু হেমন্ত। নীরব আবেগে ঠাসা। শেষ শরতে ছাতিমের গন্ধে হেমন্ত আসে শিশিরভেজা হালকা শীতের ঘ্রাণ নিয়ে। ধান উৎপাদনের ঋতু বলে একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে উঠত, আর হেমন্তের অঘ্রানে পেকেও যেত।
৭ ঘণ্টা আগে
আপনার অর্থভাগ্য আজ ‘খুব খারাপ’ ঘোষণা হয়ে গেছে (সূত্রমতে, ঋণগ্রস্ত হতে পারেন)। এর অর্থ, ওয়ালেট আজ আন্তর্জাতিক ছুটি ঘোষণা করেছে এবং পকেটের অবস্থা ম্যালেরিয়া রোগীর মতো—একেবারে রুগ্ণ। আজ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগে দশবার ভাবুন।
৭ ঘণ্টা আগে
অতিথি আপ্যায়নে পাতে আমিষের এক পদ তুলে না দিলে আপ্যায়ন যেন অপূর্ণ থাকে। রাঁধতে যখন হবে, একটু ভিন্ন স্বাদের আমিষ রেঁধে মন ভরিয়ে দিতে পারেন অতিথির। চেনা আমিষের ভিন্ন পদের রেসিপি...
৭ ঘণ্টা আগেছন্দা ব্যানার্জি

এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ঋতু হেমন্ত। নীরব আবেগে ঠাসা। শেষ শরতে ছাতিমের গন্ধে হেমন্ত আসে শিশিরভেজা হালকা শীতের ঘ্রাণ নিয়ে। ধান উৎপাদনের ঋতু বলে একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে উঠত, আর হেমন্তের অঘ্রানে পেকেও যেত। এই রূপ শুধু প্রকৃতিতেই নয়, বাঙালির খাবারের ঐতিহ্যেও ফুটে উঠেছে।
হেমন্তের খাবার বাঙালির কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এই সময় নতুন ফসলের আমেজ নিয়ে আসে নতুন স্বাদ ও গন্ধ। নতুন চালের ভাত বাঙালির কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এখন যে সবজির ফলন হয়, ফুল ফোটে, ফল হয়, তা দুই বাংলার মানুষের বিশেষ আকর্ষণ আর ঐতিহ্যেরও বটে।
বাংলায় হেমন্তের খাদ্য উৎসব শুরু হয় আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে। কথায় আছে, আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়। কেউ কেউ বলেন ডাকসংক্রান্তি, আবার কেউ নলসংক্রান্তি। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে রাঢ়বঙ্গের দেশঘরে, ব্রত আর পার্বণের দিন শুরু হয় সে সময় থেকে। কৃষিজীবন আর অ-কৃষিজাত শাকসবজি, আনাজের কাছে ফিরে যাওয়ার দিন শুরু হয়। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসের মধ্যে ভেসে ওঠে খানিকটা খড়কুটোর মতো—গাডুর ডাল, সজলান্ন কিংবা ব্রতের ভাত।
গোলাভরা আউশের আশ্বাস আর খেতভরা আমনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গর্ভিণী ধানের সাধভক্ষণ—নলসংক্রান্তি। এই ধান্য লক্ষ্মীর পূজা আসলে পৃথিবীর কাছে ফিরে যাওয়ার দিন। গ্রাম-বাংলার অ-কৃষিজাত কন্দমূল ও গাছগাছালিকে চিনে নেওয়ার সময়ও হেমন্তকাল। বাংলাদেশে কত রকমের যে কচু ছিল, সেই সব দিয়ে, শালুকের গোড়া, মটর বা খেসারির ডাল দিয়ে যে গাডুর ডাল রান্না হয়, সেই ডালকে মানুষ বলে ‘আসমবারি’।
এই হেমন্তের শুরুতে আসে ধন্বন্তরি বা অশ্বিনী দেবের পূজা। এদের ডাকপুরুষও বলে। সেই পূজার উপোস ভাঙতে এই ডাল আর ব্রতের ভাত খাওয়া হয়। ব্রতের ভাত রান্না হয় শ্যামা চালে। রেসিপি আলাদা। এই ভাতের সঙ্গে ডাল, নারকেল, পাকা কলা, গুড়, গ্রাম-বাংলার চালের পিঠা সব দেবতাকে নিবেদন করে তারপর খাওয়া হয়। আসলে হেমন্ত ঋতুতে এই পূজাগুলো আমাদের শেখায়, কোন শস্য কখন খেতে হয়, কোন শস্য বিষাক্ত কোন সময়ে।
হেমন্ত ঋতুতে ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব এই নবান্ন। নতুন আমন ধান কাটার পর তা থেকে চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব এটি। কাঁচা দুধ, ছোট-বড় ছোলা, মটর, গোটা মটর, গোটা সবুজ মুগসহ ভেজানো ডালজাতীয় সব শস্যদানা, কামরাঙা, পানিফল, পেয়ারা, কমলালেবু, নারকেল ইত্যাদি হেমন্তে উৎপাদিত নানান ফলের টুকরা আর আমন ধান থেকে হওয়া নতুন চাল দিয়ে নবান্ন উৎসব হয়।
বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরের দিনেই নতুন চালের পায়েস, ক্ষীর, পিঠা আত্মীয়স্বজন এবং পড়শিদের ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। হেমন্ত ঋতুর শুরুতে খেজুর ও তালগাছের রস গ্রাম-বাংলার অত্যন্ত প্রিয় পানীয়। ভোরে সূর্যের তেজ বাড়ার আগেই তা করতে হয় এই পানীয়। এই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় খেজুর বা তালের গুড়।
হেমন্তে নতুন চাল থেকে তৈরি হয় খই। নতুন গুড় ও খই তৈরি হয় মোয়া, খেজুরের নতুন গুড়ের পায়েস, ক্ষীর, পিঠের আয়োজনে উৎসব শুরু হয়ে যায় পৌষ পার্বণের আগেই। এ ছাড়া হেমন্তকালের শুরুতে নদী, নালা, পুকুর, খাল, বিল—এসবের জল শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এই সময় অন্যান্য পরিচিত মাছের সঙ্গে পুঁটি, চাঁদা, খলসে, গেঁড়ি গুগলি এবং কাঁকড়া পাওয়া যায় প্রচুর। তাই সাধারণ বাঙালি ঘরে এসব দিয়ে রান্না করা হয় বিভিন্ন পদ। এসব খাবার শরীরে পুষ্টি ও প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে পুরো বছরের জন্য।
এই সবকিছু মিলিয়ে হেমন্তের সুঘ্রাণ দুই বাংলায় ছড়িয়ে থাকে।
ছন্দা ব্যানার্জি, রন্ধনশিল্পী ও খাদ্যবিষয়ক লেখক

এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ঋতু হেমন্ত। নীরব আবেগে ঠাসা। শেষ শরতে ছাতিমের গন্ধে হেমন্ত আসে শিশিরভেজা হালকা শীতের ঘ্রাণ নিয়ে। ধান উৎপাদনের ঋতু বলে একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে উঠত, আর হেমন্তের অঘ্রানে পেকেও যেত। এই রূপ শুধু প্রকৃতিতেই নয়, বাঙালির খাবারের ঐতিহ্যেও ফুটে উঠেছে।
হেমন্তের খাবার বাঙালির কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এই সময় নতুন ফসলের আমেজ নিয়ে আসে নতুন স্বাদ ও গন্ধ। নতুন চালের ভাত বাঙালির কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এখন যে সবজির ফলন হয়, ফুল ফোটে, ফল হয়, তা দুই বাংলার মানুষের বিশেষ আকর্ষণ আর ঐতিহ্যেরও বটে।
বাংলায় হেমন্তের খাদ্য উৎসব শুরু হয় আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে। কথায় আছে, আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়। কেউ কেউ বলেন ডাকসংক্রান্তি, আবার কেউ নলসংক্রান্তি। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে রাঢ়বঙ্গের দেশঘরে, ব্রত আর পার্বণের দিন শুরু হয় সে সময় থেকে। কৃষিজীবন আর অ-কৃষিজাত শাকসবজি, আনাজের কাছে ফিরে যাওয়ার দিন শুরু হয়। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসের মধ্যে ভেসে ওঠে খানিকটা খড়কুটোর মতো—গাডুর ডাল, সজলান্ন কিংবা ব্রতের ভাত।
গোলাভরা আউশের আশ্বাস আর খেতভরা আমনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গর্ভিণী ধানের সাধভক্ষণ—নলসংক্রান্তি। এই ধান্য লক্ষ্মীর পূজা আসলে পৃথিবীর কাছে ফিরে যাওয়ার দিন। গ্রাম-বাংলার অ-কৃষিজাত কন্দমূল ও গাছগাছালিকে চিনে নেওয়ার সময়ও হেমন্তকাল। বাংলাদেশে কত রকমের যে কচু ছিল, সেই সব দিয়ে, শালুকের গোড়া, মটর বা খেসারির ডাল দিয়ে যে গাডুর ডাল রান্না হয়, সেই ডালকে মানুষ বলে ‘আসমবারি’।
এই হেমন্তের শুরুতে আসে ধন্বন্তরি বা অশ্বিনী দেবের পূজা। এদের ডাকপুরুষও বলে। সেই পূজার উপোস ভাঙতে এই ডাল আর ব্রতের ভাত খাওয়া হয়। ব্রতের ভাত রান্না হয় শ্যামা চালে। রেসিপি আলাদা। এই ভাতের সঙ্গে ডাল, নারকেল, পাকা কলা, গুড়, গ্রাম-বাংলার চালের পিঠা সব দেবতাকে নিবেদন করে তারপর খাওয়া হয়। আসলে হেমন্ত ঋতুতে এই পূজাগুলো আমাদের শেখায়, কোন শস্য কখন খেতে হয়, কোন শস্য বিষাক্ত কোন সময়ে।
হেমন্ত ঋতুতে ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব এই নবান্ন। নতুন আমন ধান কাটার পর তা থেকে চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব এটি। কাঁচা দুধ, ছোট-বড় ছোলা, মটর, গোটা মটর, গোটা সবুজ মুগসহ ভেজানো ডালজাতীয় সব শস্যদানা, কামরাঙা, পানিফল, পেয়ারা, কমলালেবু, নারকেল ইত্যাদি হেমন্তে উৎপাদিত নানান ফলের টুকরা আর আমন ধান থেকে হওয়া নতুন চাল দিয়ে নবান্ন উৎসব হয়।
বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরের দিনেই নতুন চালের পায়েস, ক্ষীর, পিঠা আত্মীয়স্বজন এবং পড়শিদের ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। হেমন্ত ঋতুর শুরুতে খেজুর ও তালগাছের রস গ্রাম-বাংলার অত্যন্ত প্রিয় পানীয়। ভোরে সূর্যের তেজ বাড়ার আগেই তা করতে হয় এই পানীয়। এই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় খেজুর বা তালের গুড়।
হেমন্তে নতুন চাল থেকে তৈরি হয় খই। নতুন গুড় ও খই তৈরি হয় মোয়া, খেজুরের নতুন গুড়ের পায়েস, ক্ষীর, পিঠের আয়োজনে উৎসব শুরু হয়ে যায় পৌষ পার্বণের আগেই। এ ছাড়া হেমন্তকালের শুরুতে নদী, নালা, পুকুর, খাল, বিল—এসবের জল শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এই সময় অন্যান্য পরিচিত মাছের সঙ্গে পুঁটি, চাঁদা, খলসে, গেঁড়ি গুগলি এবং কাঁকড়া পাওয়া যায় প্রচুর। তাই সাধারণ বাঙালি ঘরে এসব দিয়ে রান্না করা হয় বিভিন্ন পদ। এসব খাবার শরীরে পুষ্টি ও প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে পুরো বছরের জন্য।
এই সবকিছু মিলিয়ে হেমন্তের সুঘ্রাণ দুই বাংলায় ছড়িয়ে থাকে।
ছন্দা ব্যানার্জি, রন্ধনশিল্পী ও খাদ্যবিষয়ক লেখক

আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ...
২১ জানুয়ারি ২০২২
বিশ্বের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ বা শহর নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলোতে শহরের আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেসব গ্রামে আলাদা করে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই পরিষ্কার রাখার জন্য। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পরিচ্ছন্ন...
৩ ঘণ্টা আগে
আপনার অর্থভাগ্য আজ ‘খুব খারাপ’ ঘোষণা হয়ে গেছে (সূত্রমতে, ঋণগ্রস্ত হতে পারেন)। এর অর্থ, ওয়ালেট আজ আন্তর্জাতিক ছুটি ঘোষণা করেছে এবং পকেটের অবস্থা ম্যালেরিয়া রোগীর মতো—একেবারে রুগ্ণ। আজ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগে দশবার ভাবুন।
৭ ঘণ্টা আগে
অতিথি আপ্যায়নে পাতে আমিষের এক পদ তুলে না দিলে আপ্যায়ন যেন অপূর্ণ থাকে। রাঁধতে যখন হবে, একটু ভিন্ন স্বাদের আমিষ রেঁধে মন ভরিয়ে দিতে পারেন অতিথির। চেনা আমিষের ভিন্ন পদের রেসিপি...
৭ ঘণ্টা আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

মেষ
আপনার অর্থভাগ্য আজ ‘খুব খারাপ’ ঘোষণা হয়ে গেছে (সূত্রমতে, ঋণগ্রস্ত হতে পারেন)। এর অর্থ, ওয়ালেট আজ আন্তর্জাতিক ছুটি ঘোষণা করেছে এবং পকেটের অবস্থা ম্যালেরিয়া রোগীর মতো—একেবারে রুগ্ণ। আজ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগে দশবার ভাবুন। যদি ভাবা সম্ভব না হয়, তবে ভাবুন, ‘হতে পারে এটা আমার জীবনের সেরা কেনাকাটা!’ জ্যোতিষীরা বলছেন, প্রিয়জনের কুকর্মের জন্য বাড়িতে বিবাদ হতে পারে। সম্ভবত আপনার প্রিয়জন লুকিয়ে রাখা চকলেট বা রিমোট কন্ট্রোল চুরি করেছে—এর চেয়ে বড় কুকর্ম আর কী হতে পারে! কেউ যদি ‘বিনিয়োগ করুন, দ্বিগুণ হবে’ বলে, তবে দৌড়ে পালান। দৌড়াতে না পারলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকুন।
বৃষ
অফিসে কোনো সহকর্মীর সঙ্গে বিবাদ হতে পারে। মনে রাখবেন, বৃষ রাশির জাতক হিসেবে আপনার জেদ বা একগুঁয়েমি ষাঁড়ের মতোই খ্যাত! অফিসের ঝগড়াটা সম্ভবত বড় কোনো বিষয় নিয়ে হবে না—হতে পারে কে এসির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি কমিয়েছিল, অথবা কে শেষ বিস্কুটটা খেলো। যদি কেউ কোনো ‘অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে অধিক চর্চা’ করতে নিষেধ করে, তবে ধরে নিন সে আপনার নতুন প্রতিভাবান সহকর্মী, যে আপনার কফির বয়াম চুরি করতে পারে। অবসাদ এড়াতে, দুপুরে একটা শর্ট ন্যাপ নিন। যদি বস ধরে ফেলে, বলুন—ধ্যান করছিলাম, নক্ষত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছিলাম। আজ শান্ত থাকুন। যদি খুব রাগ হয়, তবে চেঁচানোর বদলে মনে মনে রবীন্দ্রসংগীত শুনুন।
মিথুন
নতুন প্রকল্পে কাজ শুরুর আগে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নিন। আপনার শত্রু আজ সক্রিয় থাকবে, কিন্তু আর্থিক লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে। আপনার ‘নতুন প্রকল্প’ যদি হয় ফ্রিজের পুরোনো খাবার পরিষ্কার করা, তবে সত্যিই ভালোভাবে চিন্তা করুন—গ্যাস মাস্ক লাগবে কি না। বন্ধুরা আজ আপনার সঙ্গে ভালো সময় কাটাবে, কারণ আপনার নতুন আয়ের খবর তারা জেনে গেছে। শত্রু সক্রিয় মানে এই নয় যে কেউ আপনার ক্ষতি করবে; হতে পারে সে শুধু আপনার ফেসবুক পোস্টগুলোতে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিয়ে যাবে। এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক আর কী আছে! আজ দ্বৈত-চরিত্রটি কাজে লাগান। এক মিথুন কাজ করবে, অন্য মিথুন হিসাব রাখবে।
কর্কট
দাম্পত্য জীবন সুখে কাটবে এবং প্রায় সব কাজই পূর্ণ হবে। তবে কথা বলার সময় সাবধান থাকুন। আপনার দাম্পত্য জীবন সুখে কাটবে কারণ...সম্ভবত সঙ্গী আজ সারা দিন ব্যস্ত থাকবেন এবং রিমোট কন্ট্রোলটির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য পাবেন। আপনার সব কাজ পূর্ণ হবে, এমনকি সেই কাজটিও—যেটা গত তিন সপ্তাহ ধরে ‘পরে করব’ বলে ফেলে রেখেছিলেন। সাবধানতা অবলম্বন করে কথা বলুন—বিশেষ করে যখন কেউ জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কি আমার জন্য কিছু কিনেছ?’ মিথ্যা বলা বারণ। যাত্রা শুভ।
সিংহ
পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন। অন্য কারও বিবাদে জড়াবেন না। আয় বাড়বে। আয় বাড়ার সুসংবাদ শুনেছেন, তাই আজ নিজেকে রাজা বা রানির মতো অনুভব করবেন। তবে অন্য কারও বিবাদে জড়াবেন না। কারণ, যেই মুহূর্তে মাঝখানে মধ্যস্থতা করতে যাবেন, সবাই আপনার বিরুদ্ধেই জোট বাঁধবে—সিংহ মশাই, সাবধান! ‘সামাজিক কাজে অংশ নিতে পারেন’ মানে সম্ভবত পাড়ার কোনো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রচুর খাবার খেতে পারেন। আপনার মনোমুগ্ধকর মনোভাব আজ কাজে লাগান—কিন্তু বিল মেটানোর সময় ভেজা বিড়াল হয়ে থাকুন।
কন্যা
আলস্য করবেন না। অচেনা ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকুন। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ পূর্ণ হবে। গ্রহরা যেন আজ আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে শাসিয়ে গেছে—‘আলস্য নৈব নৈব চ!’ যদি সকালে অ্যালার্ম বাজানোর পরও বিছানায় থাকার চেষ্টা করেন, তবে ধরে নিন, গ্রহদের কাছ থেকে কড়া বার্তা আসবে। অচেনা ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকুন, কারণ আজকের দিনে আপনার সবচেয়ে অচেনা ব্যক্তিটি হতে পারে সেই যিনি নিজেকে ‘ডায়েট চার্ট’ বা ‘ব্যালেন্স শিট’ বলে দাবি করছেন। আলস্য না করে অন্তত একবার টেবিল গুছিয়ে নিন—সেটাই আজ আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্য। পরিবারে আনন্দের পরিবেশ থাকবে, কারণ আপনি অবশেষে কাজ শুরু করেছেন!
তুলা
চাকরিজীবীরা সুখবর পাবেন। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। ঝুঁকি নেবেন না। চাকরিজীবীরা সুখবর পাবেন, যেমন—বস অবশেষে আপনার পাঠানো ই-মেলের রিপ্লাই দিয়েছেন। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন, কিন্তু সাবধান—সেটা যেন টিভি দেখার প্রতিযোগিতা না হয়। ‘ঝুঁকি নেবেন না’ মানে হলো, আজ কোনোমতেই সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করবেন না যে তার ওজন বেড়েছে কিনা। নতুন মানুষদের সঙ্গে দেখা হতে পারে, কিন্তু তারা আপনাকে নতুন দায়িত্বের ফাঁদে ফেলতে পারে—তাই হাসি-খুশি থাকুন, কিন্তু নীরব। আনন্দে দিন কাটবে, যদি আপনি মনের ভেতরের বিচারপতিকে আজ ছুটি দিতে পারেন।
বৃশ্চিক
আবেগগত যোগাযোগে আরও ভালো থাকবেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন হবে এবং শুভ সংবাদ পাবেন। আজ আবেগগতভাবে এত ভালো থাকবেন যে পথে কুকুর দেখলেও তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করতে পারে! আপনার ‘শুভ সংবাদ’ সম্ভবত এটাই যে আপনি পুরোনো প্যান্টের পকেটে কিছু টাকা খুঁজে পেয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন হবে—যেমন ধরুন, আপনি ইউটিউবের শর্টস দেখা শেষ করে অবশেষে মূল বা লং ভিডিও দেখা শুরু করবেন। অন্যদের আকৃষ্ট করার জন্য কথা বলার সময় সুন্দর থাকুন। তবে সুন্দর কথাগুলো যেন লোন বা ধার চাওয়ার জন্য ব্যবহার না হয়। আর্থিক বিষয়গুলো গতি পাবে, তাই আজই পুরোনো লোনগুলো পরিশোধ করার কথা ভাবুন...যদি পকেটে কিছু থাকে।
ধনু
নিজেকে অস্বস্তিকর ও চাপের মধ্যে অনুভব করতে পারেন। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকুন এবং খাওয়া-দাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন। আপনি অস্বস্তিকর বোধ করবেন কারণ আপনার মন আপনাকে সারা বিশ্বে ঘোরার জন্য চাপ দিচ্ছে, কিন্তু আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ঘরে বসে নেটফ্লিক্স দেখতে বলছে। ‘খাওয়া-দাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন’ এই পরামর্শটি আপনার জন্য আজ সম্পূর্ণ হাস্যকর। গ্রহরা কি জানে না যে, পৃথিবীতে এত মুখরোচক খাবার থাকতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব? নেতিবাচক আবেগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, যেমন ধরুন—অন্যের খাবার শেষ হয়ে গেলেও আপনার প্লেটে আরও আছে, এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকুন। ইতিবাচক থাকুন! আজ আপনি যা কিছু খাবেন, সেটাই আপনার জন্য শক্তি—এই সহজ সত্যিটা মেনে নিন।
মকর
লক্ষ্যের ওপর মনোযোগ বজায় থাকবে। কাঙ্ক্ষিত অফার পাবেন এবং কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। মকর রাশির জাতক হিসেবে আপনার লক্ষ্যের ওপর মনোযোগ বজায় থাকবে—বিশেষ করে, যদি লক্ষ্যটি হয় সময়মতো রাতের খাবার খাওয়া। আর আপনি কাঙ্ক্ষিত অফার পাবেন! সম্ভবত কোনো প্রিয় রেস্টুরেন্টে বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি-এর অফার। কাজের গতি কার্যকর থাকবে, যার ফলে অফিস থেকে সবার আগে বেরোনোর সুযোগ পাবেন। পেশাগত স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে— চেয়ারটা আজ আপনাকে সবচেয়ে বেশি আরাম দেবে। ব্যক্তিগত জীবনে ধৈর্য ও ধর্ম নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে—বিশেষ করে যখন কেউ আপনাকে কাজ শেখাতে আসে।
কুম্ভ
কাজের ব্যস্ততা বাড়তে পারে। স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন এবং পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিন। কাজের ব্যস্ততা বাড়বে, কারণ সমস্ত কাজ ফেলে রেখে নতুন করে কাজ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আজ যোগব্যায়াম করুন। যদি যোগব্যায়াম করতে আলস্য লাগে, তবে অন্তত ফ্রিজ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করুন, সেটাও একপ্রকার ব্যায়াম। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিন—কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হন যে, তাদের টিভি সিরিয়ালের সময়টা নষ্ট করছেন না। আজকের দিনটি স্বাভাবিক হতে চলেছে, মানে কোনো অলৌকিক ঘটনা না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। ক্যারিয়ারে রাজনীতির শিকার হওয়া এড়িয়ে চলুন। অর্থাৎ, বসের কানের কাছে কোনো গসিপ করতে যাবেন না।
মীন
প্রেমের জীবনে আজ একটি চমকের সম্মুখীন হতে পারেন। আর্থিক দিক থেকে দিনটি ভালো। শরীরকে বিশ্রাম দিন। প্রেমের জীবনে ‘চমক’ হয়তো এটাই যে, আপনার সঙ্গী আজ নিজেই শেষ চকলেটটি না খেয়ে আপনার জন্য রেখে দিয়েছে। আপনার আর্থিক দিক থেকে দিনটি ভালো, কিন্তু সেটার ব্যবহার করে একটা লটারি না কেটে বরং নিজের জন্য একটা ভালো কফি কিনুন। শরীরকে বিশ্রাম দিন—কিন্তু বিশ্রাম নিতে নিতে যদি ঘুমিয়ে পড়েন, তবে গ্রহরা আপনাকে দোষ দেবে না। কর্মক্ষেত্রের কাজ দ্রুত শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরুন। জ্যোতিষীরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে পার্কে বা সিনেমা দেখতে যেতে পারেন। যদি সিনেমা দেখতে ভালো না লাগে, তবে একাই বারান্দায় বসে প্রকৃতির নাটক দেখতে পারেন! আপনার নেওয়া একটি দৃঢ় পদক্ষেপ আজ ইতিবাচক ফল দেবে। হয়তো অবশেষে জামাকাপড় কাচার কাজটা শুরু করে দিয়েছেন!

মেষ
আপনার অর্থভাগ্য আজ ‘খুব খারাপ’ ঘোষণা হয়ে গেছে (সূত্রমতে, ঋণগ্রস্ত হতে পারেন)। এর অর্থ, ওয়ালেট আজ আন্তর্জাতিক ছুটি ঘোষণা করেছে এবং পকেটের অবস্থা ম্যালেরিয়া রোগীর মতো—একেবারে রুগ্ণ। আজ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগে দশবার ভাবুন। যদি ভাবা সম্ভব না হয়, তবে ভাবুন, ‘হতে পারে এটা আমার জীবনের সেরা কেনাকাটা!’ জ্যোতিষীরা বলছেন, প্রিয়জনের কুকর্মের জন্য বাড়িতে বিবাদ হতে পারে। সম্ভবত আপনার প্রিয়জন লুকিয়ে রাখা চকলেট বা রিমোট কন্ট্রোল চুরি করেছে—এর চেয়ে বড় কুকর্ম আর কী হতে পারে! কেউ যদি ‘বিনিয়োগ করুন, দ্বিগুণ হবে’ বলে, তবে দৌড়ে পালান। দৌড়াতে না পারলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকুন।
বৃষ
অফিসে কোনো সহকর্মীর সঙ্গে বিবাদ হতে পারে। মনে রাখবেন, বৃষ রাশির জাতক হিসেবে আপনার জেদ বা একগুঁয়েমি ষাঁড়ের মতোই খ্যাত! অফিসের ঝগড়াটা সম্ভবত বড় কোনো বিষয় নিয়ে হবে না—হতে পারে কে এসির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি কমিয়েছিল, অথবা কে শেষ বিস্কুটটা খেলো। যদি কেউ কোনো ‘অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে অধিক চর্চা’ করতে নিষেধ করে, তবে ধরে নিন সে আপনার নতুন প্রতিভাবান সহকর্মী, যে আপনার কফির বয়াম চুরি করতে পারে। অবসাদ এড়াতে, দুপুরে একটা শর্ট ন্যাপ নিন। যদি বস ধরে ফেলে, বলুন—ধ্যান করছিলাম, নক্ষত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছিলাম। আজ শান্ত থাকুন। যদি খুব রাগ হয়, তবে চেঁচানোর বদলে মনে মনে রবীন্দ্রসংগীত শুনুন।
মিথুন
নতুন প্রকল্পে কাজ শুরুর আগে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নিন। আপনার শত্রু আজ সক্রিয় থাকবে, কিন্তু আর্থিক লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে। আপনার ‘নতুন প্রকল্প’ যদি হয় ফ্রিজের পুরোনো খাবার পরিষ্কার করা, তবে সত্যিই ভালোভাবে চিন্তা করুন—গ্যাস মাস্ক লাগবে কি না। বন্ধুরা আজ আপনার সঙ্গে ভালো সময় কাটাবে, কারণ আপনার নতুন আয়ের খবর তারা জেনে গেছে। শত্রু সক্রিয় মানে এই নয় যে কেউ আপনার ক্ষতি করবে; হতে পারে সে শুধু আপনার ফেসবুক পোস্টগুলোতে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিয়ে যাবে। এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক আর কী আছে! আজ দ্বৈত-চরিত্রটি কাজে লাগান। এক মিথুন কাজ করবে, অন্য মিথুন হিসাব রাখবে।
কর্কট
দাম্পত্য জীবন সুখে কাটবে এবং প্রায় সব কাজই পূর্ণ হবে। তবে কথা বলার সময় সাবধান থাকুন। আপনার দাম্পত্য জীবন সুখে কাটবে কারণ...সম্ভবত সঙ্গী আজ সারা দিন ব্যস্ত থাকবেন এবং রিমোট কন্ট্রোলটির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য পাবেন। আপনার সব কাজ পূর্ণ হবে, এমনকি সেই কাজটিও—যেটা গত তিন সপ্তাহ ধরে ‘পরে করব’ বলে ফেলে রেখেছিলেন। সাবধানতা অবলম্বন করে কথা বলুন—বিশেষ করে যখন কেউ জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কি আমার জন্য কিছু কিনেছ?’ মিথ্যা বলা বারণ। যাত্রা শুভ।
সিংহ
পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন। অন্য কারও বিবাদে জড়াবেন না। আয় বাড়বে। আয় বাড়ার সুসংবাদ শুনেছেন, তাই আজ নিজেকে রাজা বা রানির মতো অনুভব করবেন। তবে অন্য কারও বিবাদে জড়াবেন না। কারণ, যেই মুহূর্তে মাঝখানে মধ্যস্থতা করতে যাবেন, সবাই আপনার বিরুদ্ধেই জোট বাঁধবে—সিংহ মশাই, সাবধান! ‘সামাজিক কাজে অংশ নিতে পারেন’ মানে সম্ভবত পাড়ার কোনো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রচুর খাবার খেতে পারেন। আপনার মনোমুগ্ধকর মনোভাব আজ কাজে লাগান—কিন্তু বিল মেটানোর সময় ভেজা বিড়াল হয়ে থাকুন।
কন্যা
আলস্য করবেন না। অচেনা ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকুন। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ পূর্ণ হবে। গ্রহরা যেন আজ আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে শাসিয়ে গেছে—‘আলস্য নৈব নৈব চ!’ যদি সকালে অ্যালার্ম বাজানোর পরও বিছানায় থাকার চেষ্টা করেন, তবে ধরে নিন, গ্রহদের কাছ থেকে কড়া বার্তা আসবে। অচেনা ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকুন, কারণ আজকের দিনে আপনার সবচেয়ে অচেনা ব্যক্তিটি হতে পারে সেই যিনি নিজেকে ‘ডায়েট চার্ট’ বা ‘ব্যালেন্স শিট’ বলে দাবি করছেন। আলস্য না করে অন্তত একবার টেবিল গুছিয়ে নিন—সেটাই আজ আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্য। পরিবারে আনন্দের পরিবেশ থাকবে, কারণ আপনি অবশেষে কাজ শুরু করেছেন!
তুলা
চাকরিজীবীরা সুখবর পাবেন। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। ঝুঁকি নেবেন না। চাকরিজীবীরা সুখবর পাবেন, যেমন—বস অবশেষে আপনার পাঠানো ই-মেলের রিপ্লাই দিয়েছেন। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন, কিন্তু সাবধান—সেটা যেন টিভি দেখার প্রতিযোগিতা না হয়। ‘ঝুঁকি নেবেন না’ মানে হলো, আজ কোনোমতেই সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করবেন না যে তার ওজন বেড়েছে কিনা। নতুন মানুষদের সঙ্গে দেখা হতে পারে, কিন্তু তারা আপনাকে নতুন দায়িত্বের ফাঁদে ফেলতে পারে—তাই হাসি-খুশি থাকুন, কিন্তু নীরব। আনন্দে দিন কাটবে, যদি আপনি মনের ভেতরের বিচারপতিকে আজ ছুটি দিতে পারেন।
বৃশ্চিক
আবেগগত যোগাযোগে আরও ভালো থাকবেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন হবে এবং শুভ সংবাদ পাবেন। আজ আবেগগতভাবে এত ভালো থাকবেন যে পথে কুকুর দেখলেও তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করতে পারে! আপনার ‘শুভ সংবাদ’ সম্ভবত এটাই যে আপনি পুরোনো প্যান্টের পকেটে কিছু টাকা খুঁজে পেয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন হবে—যেমন ধরুন, আপনি ইউটিউবের শর্টস দেখা শেষ করে অবশেষে মূল বা লং ভিডিও দেখা শুরু করবেন। অন্যদের আকৃষ্ট করার জন্য কথা বলার সময় সুন্দর থাকুন। তবে সুন্দর কথাগুলো যেন লোন বা ধার চাওয়ার জন্য ব্যবহার না হয়। আর্থিক বিষয়গুলো গতি পাবে, তাই আজই পুরোনো লোনগুলো পরিশোধ করার কথা ভাবুন...যদি পকেটে কিছু থাকে।
ধনু
নিজেকে অস্বস্তিকর ও চাপের মধ্যে অনুভব করতে পারেন। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকুন এবং খাওয়া-দাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন। আপনি অস্বস্তিকর বোধ করবেন কারণ আপনার মন আপনাকে সারা বিশ্বে ঘোরার জন্য চাপ দিচ্ছে, কিন্তু আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ঘরে বসে নেটফ্লিক্স দেখতে বলছে। ‘খাওয়া-দাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন’ এই পরামর্শটি আপনার জন্য আজ সম্পূর্ণ হাস্যকর। গ্রহরা কি জানে না যে, পৃথিবীতে এত মুখরোচক খাবার থাকতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব? নেতিবাচক আবেগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, যেমন ধরুন—অন্যের খাবার শেষ হয়ে গেলেও আপনার প্লেটে আরও আছে, এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকুন। ইতিবাচক থাকুন! আজ আপনি যা কিছু খাবেন, সেটাই আপনার জন্য শক্তি—এই সহজ সত্যিটা মেনে নিন।
মকর
লক্ষ্যের ওপর মনোযোগ বজায় থাকবে। কাঙ্ক্ষিত অফার পাবেন এবং কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। মকর রাশির জাতক হিসেবে আপনার লক্ষ্যের ওপর মনোযোগ বজায় থাকবে—বিশেষ করে, যদি লক্ষ্যটি হয় সময়মতো রাতের খাবার খাওয়া। আর আপনি কাঙ্ক্ষিত অফার পাবেন! সম্ভবত কোনো প্রিয় রেস্টুরেন্টে বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি-এর অফার। কাজের গতি কার্যকর থাকবে, যার ফলে অফিস থেকে সবার আগে বেরোনোর সুযোগ পাবেন। পেশাগত স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে— চেয়ারটা আজ আপনাকে সবচেয়ে বেশি আরাম দেবে। ব্যক্তিগত জীবনে ধৈর্য ও ধর্ম নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে—বিশেষ করে যখন কেউ আপনাকে কাজ শেখাতে আসে।
কুম্ভ
কাজের ব্যস্ততা বাড়তে পারে। স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন এবং পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিন। কাজের ব্যস্ততা বাড়বে, কারণ সমস্ত কাজ ফেলে রেখে নতুন করে কাজ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আজ যোগব্যায়াম করুন। যদি যোগব্যায়াম করতে আলস্য লাগে, তবে অন্তত ফ্রিজ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করুন, সেটাও একপ্রকার ব্যায়াম। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিন—কিন্তু তার আগে নিশ্চিত হন যে, তাদের টিভি সিরিয়ালের সময়টা নষ্ট করছেন না। আজকের দিনটি স্বাভাবিক হতে চলেছে, মানে কোনো অলৌকিক ঘটনা না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। ক্যারিয়ারে রাজনীতির শিকার হওয়া এড়িয়ে চলুন। অর্থাৎ, বসের কানের কাছে কোনো গসিপ করতে যাবেন না।
মীন
প্রেমের জীবনে আজ একটি চমকের সম্মুখীন হতে পারেন। আর্থিক দিক থেকে দিনটি ভালো। শরীরকে বিশ্রাম দিন। প্রেমের জীবনে ‘চমক’ হয়তো এটাই যে, আপনার সঙ্গী আজ নিজেই শেষ চকলেটটি না খেয়ে আপনার জন্য রেখে দিয়েছে। আপনার আর্থিক দিক থেকে দিনটি ভালো, কিন্তু সেটার ব্যবহার করে একটা লটারি না কেটে বরং নিজের জন্য একটা ভালো কফি কিনুন। শরীরকে বিশ্রাম দিন—কিন্তু বিশ্রাম নিতে নিতে যদি ঘুমিয়ে পড়েন, তবে গ্রহরা আপনাকে দোষ দেবে না। কর্মক্ষেত্রের কাজ দ্রুত শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরুন। জ্যোতিষীরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে পার্কে বা সিনেমা দেখতে যেতে পারেন। যদি সিনেমা দেখতে ভালো না লাগে, তবে একাই বারান্দায় বসে প্রকৃতির নাটক দেখতে পারেন! আপনার নেওয়া একটি দৃঢ় পদক্ষেপ আজ ইতিবাচক ফল দেবে। হয়তো অবশেষে জামাকাপড় কাচার কাজটা শুরু করে দিয়েছেন!

আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ...
২১ জানুয়ারি ২০২২
বিশ্বের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ বা শহর নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলোতে শহরের আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেসব গ্রামে আলাদা করে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই পরিষ্কার রাখার জন্য। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পরিচ্ছন্ন...
৩ ঘণ্টা আগে
এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ঋতু হেমন্ত। নীরব আবেগে ঠাসা। শেষ শরতে ছাতিমের গন্ধে হেমন্ত আসে শিশিরভেজা হালকা শীতের ঘ্রাণ নিয়ে। ধান উৎপাদনের ঋতু বলে একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে উঠত, আর হেমন্তের অঘ্রানে পেকেও যেত।
৭ ঘণ্টা আগে
অতিথি আপ্যায়নে পাতে আমিষের এক পদ তুলে না দিলে আপ্যায়ন যেন অপূর্ণ থাকে। রাঁধতে যখন হবে, একটু ভিন্ন স্বাদের আমিষ রেঁধে মন ভরিয়ে দিতে পারেন অতিথির। চেনা আমিষের ভিন্ন পদের রেসিপি...
৭ ঘণ্টা আগেফিচার ডেস্ক

অতিথি আপ্যায়নে পাতে আমিষের এক পদ তুলে না দিলে আপ্যায়ন যেন অপূর্ণ থাকে। রাঁধতে যখন হবে, একটু ভিন্ন স্বাদের আমিষ রেঁধে মন ভরিয়ে দিতে পারেন অতিথির। চেনা আমিষের ভিন্ন পদের রেসিপি ও ছবি দিয়েছেন রন্ধনশিল্পী আফরোজা খানম মুক্তা।
উপকরণ
ইলিশের রিং পিস ৫ থেকে ৬ টুকরা, হলুদগুঁড়া এক চা-চামচ, শুকনা মরিচ ৭ থেকে ৮টি, রসুনের কোয়া ১২ থেকে ১৪টি, সিরকা ৬ থেকে ৭ টেবিল চামচ, সরিষাবাটা ৪ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো, সরিষার তেল ৬ থেকে ৭ টেবিল চামচ।
প্রণালি
রিং পিস করা ইলিশ মাছ লবণ মাখিয়ে নেওয়ার পর ৩০ মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর শুকনা মরিচ, রসুনের কোয়া, সরিষাবাটা, লবণ, হলুদগুঁড়া, সিরকা দিয়ে ব্লেন্ডারে অথবা পাটায় পেস্ট করে নিন। এবার হাঁড়িতে সরিষার তেল দিন। তারপর পেস্ট করা মিশ্রণটি দিয়ে নেড়ে নিন। এরপর লবণ দিয়ে মাখা মাছ দিয়ে এপিঠ-ওপিঠ করে হালকা ভেজে ঢাকনা দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে রান্না করুন ১০ মিনিট। তারপর নামিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন ইলিশের উল্লাস।

অতিথি আপ্যায়নে পাতে আমিষের এক পদ তুলে না দিলে আপ্যায়ন যেন অপূর্ণ থাকে। রাঁধতে যখন হবে, একটু ভিন্ন স্বাদের আমিষ রেঁধে মন ভরিয়ে দিতে পারেন অতিথির। চেনা আমিষের ভিন্ন পদের রেসিপি ও ছবি দিয়েছেন রন্ধনশিল্পী আফরোজা খানম মুক্তা।
উপকরণ
ইলিশের রিং পিস ৫ থেকে ৬ টুকরা, হলুদগুঁড়া এক চা-চামচ, শুকনা মরিচ ৭ থেকে ৮টি, রসুনের কোয়া ১২ থেকে ১৪টি, সিরকা ৬ থেকে ৭ টেবিল চামচ, সরিষাবাটা ৪ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো, সরিষার তেল ৬ থেকে ৭ টেবিল চামচ।
প্রণালি
রিং পিস করা ইলিশ মাছ লবণ মাখিয়ে নেওয়ার পর ৩০ মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর শুকনা মরিচ, রসুনের কোয়া, সরিষাবাটা, লবণ, হলুদগুঁড়া, সিরকা দিয়ে ব্লেন্ডারে অথবা পাটায় পেস্ট করে নিন। এবার হাঁড়িতে সরিষার তেল দিন। তারপর পেস্ট করা মিশ্রণটি দিয়ে নেড়ে নিন। এরপর লবণ দিয়ে মাখা মাছ দিয়ে এপিঠ-ওপিঠ করে হালকা ভেজে ঢাকনা দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে রান্না করুন ১০ মিনিট। তারপর নামিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন ইলিশের উল্লাস।

আলো পড়ে যাচ্ছে বনের দিকে যাওয়া আর ঠিক হবে না। একটু পর হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। একটানা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের বলা হলো, সম্ভবত হরিণের পালের কাছাকাছি বাঘ...
২১ জানুয়ারি ২০২২
বিশ্বের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ বা শহর নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয়। কিন্তু এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলোতে শহরের আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেসব গ্রামে আলাদা করে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই পরিষ্কার রাখার জন্য। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পরিচ্ছন্ন...
৩ ঘণ্টা আগে
এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ঋতু হেমন্ত। নীরব আবেগে ঠাসা। শেষ শরতে ছাতিমের গন্ধে হেমন্ত আসে শিশিরভেজা হালকা শীতের ঘ্রাণ নিয়ে। ধান উৎপাদনের ঋতু বলে একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে উঠত, আর হেমন্তের অঘ্রানে পেকেও যেত।
৭ ঘণ্টা আগে
আপনার অর্থভাগ্য আজ ‘খুব খারাপ’ ঘোষণা হয়ে গেছে (সূত্রমতে, ঋণগ্রস্ত হতে পারেন)। এর অর্থ, ওয়ালেট আজ আন্তর্জাতিক ছুটি ঘোষণা করেছে এবং পকেটের অবস্থা ম্যালেরিয়া রোগীর মতো—একেবারে রুগ্ণ। আজ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার আগে দশবার ভাবুন।
৭ ঘণ্টা আগে