Ajker Patrika

মসজিদের মাইক ব্যবহারের সীমারেখা

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ
মসজিদের মাইক ব্যবহারের সীমারেখা

প্রশ্ন: মসজিদের মাইক ব্যবহারে ইসলামের নির্দেশনা কী? অতিরিক্ত উঁচু আওয়াজে আজান দেওয়া বা মসজিদ থেকে লাইন টেনে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বাসাবাড়ির ছাদে মাইক লাগানো যাবে কি? মসজিদের মাইকে আজান ছাড়া আর কী কী প্রচার করা যাবে? 
নওয়াজ উদ্দিন, ঢাকা

উত্তর: আজানের মাধ্যমে মূলত মুসলমানদের নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়। তাই ইসলামি শরিয়ত উচ্চ স্বরে আজান দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করে। বিভিন্ন হাদিস থেকে তা প্রমাণিত হয়। যেমন তিরমিজি ছাড়া সিহাহ সিত্তার সব কিতাবে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘মুয়াজ্জিনের আওয়াজের দূরত্ব পরিমাণ তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং প্রতিটি শুকনো ও ভেজা বস্তু (অর্থাৎ, জীবন্ত ও মৃত বস্তু) তার (ইমানের) পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।’ অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তুমি উঁচু আওয়াজে আজান দেবে। কেননা, মুসলিমের আজানের ধ্বনি যত দূর পৌঁছাবে, তত দূর পর্যন্ত জিন, মানুষ ও অন্যান্য—যারাই তা শুনবে, প্রত্যেকে তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।’ (বুখারি ও নাসায়ি) 
এসব হাদিসের আলোকে ফকিহগণ লাউড স্পিকার সিস্টেম আবিষ্কার হওয়ার পর আজানের জন্য তা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন।

তবে একটা সময় পর্যন্ত, যখন মসজিদের সংখ্যা কম ছিল, তখন দূর-দূরান্তে আজানের ধ্বনি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেশি বেশি মাইক লাগিয়ে উঁচু স্বরে আজান দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে যেহেতু আলহামদুলিল্লাহ মসজিদের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং প্রতিটি মসজিদে আজান দেওয়া হয়, তাই দূর-দূরান্তে মাইক লাগানো এবং অতিরিক্ত উঁচু স্বরে আজান দেওয়া অপ্রয়োজনীয়, বরং অনুচিত। কারণ ফকিহদের মতে, উচ্চ স্বরে আজান দেওয়া মুসতাহাব হওয়ার কারণ হলো কর্মব্যস্ত মানুষকে নামাজের সময় সম্পর্কে অবহিত করা। (ফাতহুল কাদির)

অল্প কয়েকটি মাইক ব্যবহার করে, পরিমিত ভলিয়মে, মসজিদের আশপাশের যাঁরা সেই মসজিদে নামাজ আদায় করবেন, তাঁদের কানে আজানের ধ্বনি পৌঁছে দিলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। এভাবে যে যার মসজিদের আজান শুনে মসজিদে যেতে পারবেন। সুতরাং, প্রশ্নের বর্ণনামতে, মসজিদ থেকে লাইন টেনে দূর-দূরান্তে বাসাবাড়ির ছাদে মাইক লাগানো এবং অতি উচ্চ ভলিউমে আজান দেওয়া শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে অপ্রয়োজনীয় ও অনুচিত কাজ। এটা কোরআনে নিষিদ্ধ ইতিদার (বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন) আওতায় পড়ে। কোরআনে সীমালঙ্ঘনকে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সীমালঙ্ঘন কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ 
(সুরা মায়িদা: ৮৭)

মুফাসসিরগণ বলেন, অবৈধভাবে কিংবা বৈধ সীমা অতিক্রম করে কারও ক্ষতি করা কোরআনে নিষেধকৃত সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। (শাবাকাতুল আলুকাহ) এ জন্য আলিমগণ মুয়াজ্জিন অথবা অন্য কারও ক্ষতি হয় এমন উচ্চ স্বরে আজান দিতে নিষেধ করেছেন। শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ তাঁর একটি ফতোয়ায় বলেন, ‘উঁচু স্বরে আজান দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এর মাধ্যমে কান ফাটিয়ে দেবে অথবা আজানদাতা বা শ্রোতাদের ক্ষতি করে বসবে। বরং কারও ক্ষতি হয় এমন ভলিয়মে আজান দিতে মুয়াজ্জিনকে নিষেধ করা বাঞ্ছনীয়। (ইসলামকিউএডটকম) শায়েখ সালেহ আল উসাইমিন বলেন, যাদের জন্য আজান দেওয়া হচ্ছে, তাদের শোনা অনুপাতে আজান দেওয়া উচিত। অন্যদের শোনানোর প্রয়োজন নেই। (আশ শারহুল মুমাত্তি আলা জাদিল মুসতানকি)

তবে দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে দেখা যায়, মসজিদের পাশের বাড়ি, সংলগ্ন ফ্ল্যাট, লাগোয়া জানালা—কোনো কিছু চিন্তা না করে ফুল ভলিউমে আজান দেওয়া হয়। এখানে হার্টের রোগী, মুমূর্ষু বর্ষীয়ান নারী-পুরুষ, নবজাত ও অল্প বয়সী শিশু থাকে। সংলগ্ন হাসপাতাল, শিক্ষালয়, গবেষণাগার, সংবেদনশীল ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর অবস্থান থাকে। তাদের ভয় পাওয়া, চমকে ওঠা, ব্লাডপ্রেশার, হাইপারটেনশন বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে ভাবা হয় না।

আর মসজিদের বাইরের মাইকে আজান ছাড়া জুমার বয়ান, তারাবির তিলাওয়াত, নামাজ ইত্যাদি প্রচার করা জায়েজ নয়। কোরআনে বেশি উঁচু স্বরে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি নামাজে স্বর বেশি উঁচু কোরো না এবং ক্ষীণও কোরো না, বরং দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করো।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১১০) তদুপরি এতে বাড়িতে নামাজ আদায়কারী নারীদের নামাজ ও তাসবিহ-তাহলিলে ব্যাঘাত ঘটে। এ সম্পর্কে ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘যেসব ইবাদত উঁচু স্বরে করার প্রয়োজন নেই, সেগুলো উঁচু স্বরে করতে গিয়ে যদি কারও ইবাদত বিঘ্নিত হয়, তা নিষিদ্ধ। একদিন রাতে রাসুল (সা.) মসজিদে নামাজরত সাহাবিদের উঁচু স্বরে কোরআন তিলাওয়াত করতে দেখে বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর সঙ্গে একান্ত আলাপে লিপ্ত, সুতরাং একে অন্যকে কষ্ট দিয়ো না।’ (ফাতহুল বারি) 

উত্তর দিয়েছেন, মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ, শিক্ষক ও ফতোয়া গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

লজ্জাহীনতা—নৈতিক পতনের প্রথম ধাপ

শাব্বির আহমদ
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

চরিত্রের এক অসাধারণ ও স্বভাবজাত গুণ—লজ্জা। এই গুণ মানুষকে পশুত্বের স্তর থেকে পৃথক করে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। এটি যেমন মানবিক বৈশিষ্ট্য, তেমন ইসলামের দৃষ্টিতে ইমানের অপরিহার্য অঙ্গ। কেউ যখন লজ্জাবোধ হারায়, তার তখন নৈতিক পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কেননা কোনো পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে লজ্জাহীন ব্যক্তির আর কোনো দ্বিধা থাকে না।

নবী করিম (সা.) স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘লজ্জা ইমানের একটি বিশেষ শাখা।’ (সহিহ্ বুখারি)। আর এ লজ্জাবোধ মানুষকে ইমান ও স্বচ্ছতার পথে চলতে সহযোগিতা করে। বলা যায়, লজ্জা হলো একটি অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির কাঠগড়া, যা মানুষকে পাপ ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। যার মধ্যে লাজুকতা যতটুকু থাকে, সে পাপ ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে ততটাই সংকোচবোধ করে।

লজ্জাহীনতা কেন নৈতিক পতনের প্রথম ধাপ? কারণ, যখন লজ্জা চলে যায়, তখন আর কোনো কিছুই নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে অবশিষ্ট থাকে না। নবীজি (সা.) চরম লজ্জাহীনতার পরিণতি বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘যখন তুমি নির্লজ্জ হয়ে পড়বে, তখন যা ইচ্ছা তা-ই করো।’ (সহিহ্ বুখারি)। তাঁর এ কথাটি মূলত একটি হুঁশিয়ারি। লজ্জাহীনতা মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও অশ্লীল কাজের দিকে ঠেলে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত তাকে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত করে। পক্ষান্তরে লজ্জাশীলতা মানুষকে জান্নাতের পথে নিয়ে যায়। হাদিসের ভাষায়, ‘লজ্জা ইমানের অঙ্গ, আর ইমানদারের স্থান জান্নাত। লজ্জাহীনতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ, আর দুশ্চরিত্রের স্থান জাহান্নাম।’ (জামে তিরমিজি)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজকের নামাজের সময়সূচি: ২১ অক্টোবর ২০২৫

ইসলাম ডেস্ক 
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত

জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে নামাজের কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের জন্য নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যম। এটি এমন এক ইবাদত—যা আমাদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, জীবনের প্রতিটি কাজে আনে বরকত। প্রতিদিন সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই জেনে নেওয়া যাক আজ কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন আদায় করতে হবে।

আজ মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫ ইংরেজি, ০৫ কার্তিক ১৪৩২ বাংলা, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৭ হিজরি। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নামাজের সময়সূচি তুলে ধরা হলো—

আজকের নামাজের সময়সূচি
নামাজওয়াক্ত শুরুওয়াক্ত শেষ
তাহাজ্জুদ ও সেহরির শেষ সময়০০: ০০৪: ৪২ মিনিট
ফজর০৪: ৪৩ মিনিট০৫: ৫৭ মিনিট
জোহর১১: ৪৪ মিনিট০৩: ৪৯ মিনিট
আসর০৩: ৫০ মিনিট০৫: ২৬ মিনিট
মাগরিব০৫: ২৮ মিনিট০৬: ৪২ মিনিট
এশা০৬: ৪৩ মিনিট০৪: ৪২ মিনিট

উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে যেসব বিভাগের সময় যোগ-বিয়োগ করতে হবে, সেগুলো হলো:

বিয়োগ করতে হবে—
চট্টগ্রাম: ০৫ মিনিট
সিলেট: ০৬ মিনিট

যোগ করতে হবে—
খুলনা: ০৩ মিনিট
রাজশাহী: ০৭ মিনিট
রংপুর: ০৮ মিনিট
বরিশাল: ০১ মিনিট

নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

আসুন, নামাজের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে তাঁর আরও কাছে নিয়ে যাই। জীবনে নিয়ে আসি ইমানের নুর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নীতি ও সাহসের প্রতীক ইমাম আবু হানিফা (রহ.)

রায়হান আল ইমরান
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

যশ-খ্যাতি ও পদ-পদবির জন্য জন্য আমরা কত কিছুই না করি। তবে ইতিহাসের পাতায় আমরা এমন অনেক উজ্জ্বল মনীষীর সন্ধান পাই, যাঁরা ক্ষমতা বা পদকে পদদলিত করে সর্বদাই নীতি ও আদর্শকে এগিয়ে রেখেছেন। এমনই একজন মহান মনীষী হলেন নুমান বিন সাবিত, যিনি মুসলিম বিশ্বে ইমাম আবু হানিফা নামে পরিচিত।

আবু হানিফা (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

তাঁর পুরো নাম, নুমান বিন সাবেত বিন মারজুবান আল-কুফি। তবে ‘আবু হানিফা’ উপাধিতেই বেশি পরিচিত। বর্ণনা অনুযায়ী, তৎকালীন কুফায় ‘হানিফা’ শব্দটি দোয়াত বা কলমের কালি বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। যেহেতু তিনি অধিকাংশ সময় গবেষণা ও লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন, তাই তিনি ‘আবু হানিফা’ উপাধি লাভ করেন।

তিনি ৮০ হিজরি বর্তমান ইরাকের কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি তীক্ষ্ণ মেধাবী ও অধ্যবসায়ী ছিলেন। মেধা ও সাধনার সমন্বয়েই একসময় তিনি নিজেকে সময়ের শ্রেষ্ঠ ফকিহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হিসেবে গড়ে তোলেন।

হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা

তিনি ইসলামি ফিকহ তথা আইনশাস্ত্রের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ফিকহ গবেষণায় তাঁর গভীর যুক্তি, তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তি ও উপলব্ধিই একদিন তাঁকে পরিণত করে হানাফি মাজহাবের স্থপতিতে, যা আজও বিশ্বের বহু দেশে অনুসৃত।

তিনি একজন তাবেয়ি

তিনি ছিলেন একজন তাবেয়ি, যা তাঁর মর্যাদাকে ফুটিয়ে তোলে। তিনি কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবির সাক্ষাৎ পেয়ে ধন্য হোন। যাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন, তাঁরা হলেন হজরত আনাস বিন মালিক, আবদুল্লাহ বিন হারিস, আমর বিন হুরাইস, জাবির বিন আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহ বিন আবি আওফা, সাহল বিন সাদ, আবু তোফাইল, ওয়াসেলা বিন আসকা, আবদুল্লাহ বিন উনাইস, মাকিল বিন ইয়াসার, আয়েশা বিনতে আজরাদ (রা.)।

বিচারপতি পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি

তখন ক্ষমতার মসনদে ছিলেন উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন হুবায়রা। তিনি একদিন সময়ের শ্রেষ্ঠ ফকিহ ইমাম আবু হানিফা (রা.)-কে ডেকে পাঠান রাজপ্রসাদে। সেখানে এলে তিনি তাঁকে কুফার বিচারপতি (কাজি) হওয়ার প্রস্তাব দেন।

এ প্রস্তাব বাহ্যিকভাবে যদিও সম্মানের; কিন্তু এর পেছনে ছিল খলিফার চতুর রাজনীতি। খলিফা মনে করতেন—তিনি বিচারপতি হলে খিলাফতের ভিত মজবুত হবে, খলিফার বৈধতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

কিন্তু এ দায়িত্ব যে এতটা মসৃণ নয়; তা আবু হানিফা (রহ.) আগে থেকেই বুঝতে সক্ষম হোন। তাই তিনি স্পষ্টভাবে অস্বীকৃতি জানান।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এই স্পষ্ট অস্বীকৃতিতে থমকে যায় পুরো রাজদরবার। কিন্তু শাসকের ক্রোধ থামেনি। তিনি ইমামকে কঠোর শাস্তির নির্দেশ দেন।

শাসকের আদেশ লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই। তাই শুরু হয় মর্মান্তিক শাস্তি। প্রতিদিন ১০টি করে মোট ১০০টি বেত্রাঘাত করা হয় তাঁকে। তবু তিনি ন্যায়ের পথ থেকে একচুলও নড়েননি।

আবারও প্রস্তাব, আবারও প্রত্যাখ্যান

সময় গড়ায়। ক্ষমতায় আসেন আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল-মানসুর। এবার তিনিও আবু হানিফা (রহ.)-কে একই পদের প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবু হানিফা (রহ.) আগের মতোই দৃঢ়ভাবে নাকচ করেন এবং খলিফার রোষানলে পড়েন। খলিফা তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

কারাগারের জীবদ্দশায় খলিফা একদিন আবু হানিফা (রহ.)-কে ডেকে নেন এবং জিজ্ঞেস করেন, এ দায়িত্ব গ্রহণে কেন আপনি অনিচ্ছুক? তিনি জবাব দেন—আমি নিজেকে এ দায়িত্বের যোগ্য মনে করি না। তাঁর এ কথায় খলিফা ক্ষুব্ধ হন। বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ! আবু হানিফা (রহ.) দৃঢ়ভাবে জবাব দেন, যদি আমি সত্য বলি, তবে আমি অযোগ্য; আর যদি মিথ্যা বলি, তবে আপনি একজন মিথ্যাবাদীকে বিচারপতি বানাতে চাচ্ছেন। খলিফা তাঁর এমন যুক্তিসংগত কথায় খুব বেশি ক্ষিপ্ত হন এবং তাঁকে পুনরায় কারাগারে বন্দী ও বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন।

খলিফার কথামতো বেত্রাঘাতসহ নানা নিপীড়ন শুরু হয় তাঁর ওপর। ফলে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অতঃপর ১৫০ হিজরিতে, বন্দিদশায়ই আপন প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

তাঁর জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা

সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে, তবুও সত্য বলাই শ্রেয়। সম্মান বা পদ নয়, একজন মানুষের আসল পরিচয়—তার নীতি ও আদর্শ। ক্ষমতার মোহ সবাইকে পায় না; বরং কেউ হন ব্যতিক্রম, যিনি যুগে যুগে স্মরণীয় হয়ে থাকেন।

তথ্যসূত্র: উকুদুল জুমান ফি মানাকিবিল ইমাম আজম আবি হানিফা আন নুমান ও আল-খাইরাতুল হিসান ফি মানাকিবিল ইমাম আজম আবি হানিফা আন নুমান।

লেখক: ইসলামবিষয়ক গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অগ্নিকাণ্ড দেখলে মুমিনের করণীয় আমল

শাব্বির আহমদ
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ০১
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অগ্নিকাণ্ড মানবজীবনে একটি অপ্রত্যাশিত ও ভয়ংকর দুর্যোগ, যা মুহূর্তেই জান ও মালের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে। এমন চরম বিপদের মুহূর্তে একজন মুমিনের কর্তব্য হলো, আগুন নেভানোর পার্থিব চেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল করা। এই আমলগুলো কেবল মানসিক শক্তি জোগায় না, বরং আল্লাহর রহমতে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে।

১. উচ্চ স্বরে তাকবির দেওয়া: অগ্নিকাণ্ড দেখলে সর্বাগ্রে যে আমলটি রয়েছে, তা হলো তাকবির দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন কোথাও আগুন (লাগতে) দেখো, তখন (উচ্চ স্বরে) তাকবির দাও।’ (তাবরানি: ১ / ৩০৭)

২. কোরআনের আয়াত পাঠ: বিপদের সময় কোরআনের সাহায্য প্রার্থনা করা মুমিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। পবিত্র কোরআনে এমন একটি আয়াত রয়েছে, যা আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য আগুনের ক্রিয়া নিস্তেজ করে দিয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের সময় এই আয়াতটি পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ: ‘ইয়া না-রু কু-নি বারদাও ওয়া সালামান আলা ইবরাহিম।’ অর্থ: ‘হে আগুন, তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া: ৬৯)

৩. আল্লাহর কাছে সাহায্য ও আজান: তাকবির এবং আয়াত পাঠের পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নেভানোর নিয়তে উচ্চ স্বরে আজান দেওয়াও অনেক আলেম উত্তম বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ আজানের ধ্বনিও শয়তানকে বিতাড়িত করে। এ ছাড়া, সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) ও তওবা করা জরুরি।

আগুন মানুষকে মুহূর্তেই নিঃস্ব করে দিতে পারে, কিন্তু মুমিন কখনো নিরাশ হয় না। কারণ সে জানে, সব বিপদের নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর হাতেই। অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়ংকর দুর্যোগেও একজন ইমানদার আল্লাহর স্মরণে আশ্রয় নেয়, তাকবির ও কোরআনের আয়াত পাঠে মন স্থির রাখে এবং দোয়ার মাধ্যমে সাহায্য কামনা করে। পার্থিব চেষ্টা ও আধ্যাত্মিক আমলের এই সমন্বয়ই হলো প্রকৃত ইমানদারের পথ। কেননা, আগুন নেভানোর যন্ত্র যেমন বাহ্যিক আগুন নেভায়, তেমনি আল্লাহর স্মরণ অন্তরের ভয় ও অস্থিরতা নিভিয়ে দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত