মো. আবুবকর সিদ্দীক
২০২৫ সনের হজের আনুষ্ঠানিকতা মাত্রই শেষ হয়েছে। এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আগত হজযাত্রীর তাৎক্ষণিক মন্তব্য মিলেছে। কেউ কেউ পত্রিকায় নিবন্ধও লিখেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে অনেকেই হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন; নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া খুবই নগণ্য। সুষ্ঠু ও সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টার ফেসবুকের একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে।
হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের এরূপ উপলব্ধি ও প্রশংসাসূচক মন্তব্য ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের পুলকিত করার চেয়ে তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিকেই সুতীব্র করে। অধিকন্তু, ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে আরও শাণিত ও কার্যকর করার প্রতি সংশ্লিষ্টদের অভিনিবেশ সুতীক্ষ্ণ হয়।
জুলাই বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা ছিল সরকার তথা ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই হজের খরচ কমানোসহ সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে-এরূপ জন আকাঙ্ক্ষা ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যম ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যদিকে, হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের নতুন নতুন আইন-কানুন বা বিধিবিধানের কারণেও সরকারকে মাঝে মাঝে কিছু সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
প্রথমেই বলা রাখা প্রয়োজন, হজ ব্যবস্থাপনা মূলত বাংলাদেশ ও সৌদি প্রান্তে সম্পন্ন হয়। এ প্রান্তের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। তবে সৌদি প্রান্তের বিষয়টি সে দেশের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে থাকে। এ কারণে হজ ব্যবস্থাপনার একটি বিশাল অংশে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা রাখার তেমন সুযোগ নেই। বিশেষ করে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে সৌদি সরকারের নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র।
হজের খরচ যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি ছিল সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। সে লক্ষ্যে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। তবে বাস্তবতা হলো হজের খরচের যে খাতসমূহ রয়েছে তার অধিকাংশের খরচই সৌদি সরকার নির্ধারিত। বিমানভাড়া ও হোটেল ভাড়া-এই দুটি খাত ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য কোনো খাতে খরচ কমানোর বিষয়ে দর-কষাকষির সুযোগ নেই। হোটেল ভাড়া প্রধানত হারাম শরিফ হতে হোটেলের দূরত্ব ও হোটেলের মানের তারতম্য অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার দিনগুলোতে মিনা ও আরাফায় তাঁবুতে আবাসন, সেখানে অবস্থানকালে দেওয়া খাবারের মূল্য প্রভৃতি তাঁবুর জোন ও প্যাকেজভিত্তিক নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শুধু তাঁবুর জোন ও প্যাকেজ নির্বাচন করা ব্যতীত দর-কষাকষির কোনো সুযোগ কোনো দেশেরই নেই। সেবার মানভেদেই সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া, ভিসা ফি, স্বাস্থ্যবিমা, জমজমের পানিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও নির্ধারিত।
এ দেশ থেকে হজযাত্রায় বিমানভাড়া নিয়ে নানা রূপ আলোচনা-সমালোচনা আছে। বিমানভাড়া নির্ধারণের জন্য হজ প্যাকেজ ঘোষণার পূর্বে বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে কয়েক দফা মতবিনিময় বা সভা করে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তৎকালীন বিমান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। ফলস্বরূপ, বিমান ভাড়া গতবারের তুলনায় ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমাতে সক্ষম হয় সরকার।
এ দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় সরকার বাড়ি বা হোটেল ভাড়া করার ক্ষেত্রেও যতটা সম্ভব দর-কষাকষি করে এবং অত্যন্ত যৌক্তিক মূল্যে বাড়ি ভাড়া প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত কমিটি। এ বছর সৌদি রিয়ালের মূল্য গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ টাকা বেড়েছে। কিছু সার্ভিস চার্জও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত বছরের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে।
হজ এজেন্সির মাধ্যমে হজযাত্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর হজযাত্রীর ন্যূনতম সংখ্যা বা কোটা নির্ধারণ করে থাকে। গত ২০২৪ হজ মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য এই ন্যূনতম কোটা ছিল ২৫০ জন। কিন্তু এ মৌসুমে সৌদি সরকার বাংলাদেশের হজ এজেন্সি প্রতি সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা ২০০০ জন নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে হজ এজেন্সি প্রতি সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা এক হাজার নির্ধারণ করাতে সক্ষম হয় সরকার।
তবে লিড এজেন্সি গঠন নিয়ে সংকট ঘনীভূত হয়। জুলাই বিপ্লবের পরে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এর কমিটি নিয়েও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন বিভাগ/সংস্থা এবং হজ এজেন্সিসমূহের সহযোগিতায় সরকার ৭০টি লিড এজেন্সি গঠন করতে সমর্থ হয়। এই লিড এজেন্সিসমূহের অধীনেই বেসরকারি মাধ্যমের হজযাত্রীরা এ বছর হজ পালন করেছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হজযাত্রীদের জন্য মিনা ও আরাফায় তাঁবু বরাদ্দ নেওয়া এবং ক্যাটারিং সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সৌদি সরকার। এটিও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান, কঠোর মনিটরিং ও ফলো-আপ তৎপরতার কারণে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। এরপর সৌদি সরকারের নির্দেশনা অনুসারে Nusuk Masar প্ল্যাটফর্মে বাড়িভাড়া ও পরিবহন চুক্তি সম্পাদিত হয়। সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপে এ বছর সরকারি-বেসরকারি উভয় মাধ্যমে নিবন্ধিত হজযাত্রীদের ভিসার বিষয়টিও সম্পন্ন হয়।
এ মৌসুমের হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন হলো ‘লাব্বাইক’ মোবাইল অ্যাপ। সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হজের সফর সহজ, মসৃণ, নিরাপদ এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিরসনে এই অ্যাপ তৈরি করা হয়। এই অ্যাপের মাধ্যমে লোকেশন ট্র্যাকিং, নামাজের সময়সূচি, প্রতিদিনের করণীয়, দৈনিক হজ সিডিউল, হজযাত্রী ফ্লাইটের বিস্তারিত তথ্য, বাংলাদেশ মেডিকেল সেন্টার ও সৌদি হাসপাতালের তথ্যসহ একগুচ্ছ প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
এ বছর হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুক্ত হয়েছে হজ প্রি-পেইড কার্ড। হজযাত্রা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে সরকারের অনুরোধে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এই কার্ড চালু করে। এই কার্ড নগদ টাকার পরিপূরক। এ কার্ডে বাংলাদেশি টাকা লোড করে ডলার/সৌদি রিয়াল পাওয়া যায়। POS মেশিনে পেমেন্ট সুবিধাও রয়েছে এই হজ প্রিপেইড কার্ডে।
সরকারের পরামর্শে হজযাত্রীদের জন্য ‘গ্রামীণফোন’, ‘বাংলালিংক’ ও ‘রবি’ বিশেষ ফোন রোমিং প্যাকেজ চালু করে। এর ফলে হাজিরা সৌদি আরবে মোবাইল সিম ক্রয় ছাড়াই বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিজস্ব মোবাইল সিমের মাধ্যমে প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে।
হজ ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দল গঠনে জনবলের সংখ্যা যতটা সম্ভব যৌক্তিক করার চেষ্টা করে সরকার। গত বছর এ সকল দলের মোট সদস্য ছিল ৩৬৬ জন, এ বছর সেই সংখ্যা কমিয়ে ২৯৩ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
হজযাত্রীদের সেবায় মক্কা ও মদিনার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিযুক্ত করা হয় হজকর্মী। হজযাত্রীদের যেকোনো অভিযোগ/অনুযোগ খতিয়ে দেখে তাৎক্ষণিক সমাধানেরও চেষ্টা করা হয়। মিনায় এ দেশীয় হাজিদের সেবায় সুনির্দিষ্ট দায়িত্বসহ গঠন করা হয় ১৮টি টিম।
এবার হজযাত্রীদের লাগেজ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ধর্ম উপদেষ্টা ও ধর্ম সচিবের দিকনির্দেশনা এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ সংক্রান্ত কমিটি প্রায় শতভাগ লাগেজ হজযাত্রীদের হাতে পৌঁছে দিতে পেরেছে।
হজ ফ্লাইটের মধ্যবর্তী পর্যায়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট সংখ্যা বেশি থাকায় এবং হজ এজেন্সির বাড়িভাড়ার সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় হজযাত্রী পরিবহনে কিছুটা শঙ্কা দেখা দেয়। সেটিও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হজযাত্রী পরিবহনকারী তিনটি এয়ারলাইনসের সঙ্গে সমন্বয় করে সকল হজযাত্রীকে সৌদি আরব প্রেরণ করতে সক্ষম হয়।
এ বছর হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাওয়া গেছে। উদ্ভূত সকল পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অকুণ্ঠ সহায়তা করেছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সুষ্ঠু ও সাবলীল হজ ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পেশাদারি ও দূরদর্শিতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটির দিনগুলোতে ধর্ম সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা দপ্তরে কাজ করেছেন। যখনই কোনো ইস্যু সামনে এসেছে তখনই সেটা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এমনকি কোনো ইস্যু সামনে আসতে পারে-এরূপ সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ দেশের গণমাধ্যমসমূহ সব সময় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। হজ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে দেশবাসীকে অবহিত করেছে এবং নানা তথ্য দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছে।
হজ ব্যবস্থাপনা একটি টিম ওয়ার্ক। সকলে মিলে টিম স্পিরিট নিয়ে কাজ করতে পারলে যেকোনো ব্যবস্থাপনাই সুন্দর ও সাবলীল হবে—এটাই স্বাভাবিক। এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা তারই প্রতিচ্ছবি।
এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা সর্বৈব সুন্দর হয়েছে—এরূপে যারা বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন, তাদের মূল্যায়নে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। তবে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে এবারও সামান্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট হাজিদের নিকট দুঃখ প্রকাশ করছে। এবার যে ত্রুটিসমূহ গোচরে এসেছে তা ভবিষ্যতে যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় সচেষ্ট থাকবে। অনিন্দ্য ব্যবস্থাপনায় সাবলীল হজ নিশ্চিত করতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সদা তৎপর।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
২০২৫ সনের হজের আনুষ্ঠানিকতা মাত্রই শেষ হয়েছে। এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আগত হজযাত্রীর তাৎক্ষণিক মন্তব্য মিলেছে। কেউ কেউ পত্রিকায় নিবন্ধও লিখেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে অনেকেই হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন; নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া খুবই নগণ্য। সুষ্ঠু ও সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টার ফেসবুকের একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে।
হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের এরূপ উপলব্ধি ও প্রশংসাসূচক মন্তব্য ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের পুলকিত করার চেয়ে তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিকেই সুতীব্র করে। অধিকন্তু, ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে আরও শাণিত ও কার্যকর করার প্রতি সংশ্লিষ্টদের অভিনিবেশ সুতীক্ষ্ণ হয়।
জুলাই বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা ছিল সরকার তথা ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই হজের খরচ কমানোসহ সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে-এরূপ জন আকাঙ্ক্ষা ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যম ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যদিকে, হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের নতুন নতুন আইন-কানুন বা বিধিবিধানের কারণেও সরকারকে মাঝে মাঝে কিছু সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
প্রথমেই বলা রাখা প্রয়োজন, হজ ব্যবস্থাপনা মূলত বাংলাদেশ ও সৌদি প্রান্তে সম্পন্ন হয়। এ প্রান্তের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। তবে সৌদি প্রান্তের বিষয়টি সে দেশের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে থাকে। এ কারণে হজ ব্যবস্থাপনার একটি বিশাল অংশে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা রাখার তেমন সুযোগ নেই। বিশেষ করে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে সৌদি সরকারের নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র।
হজের খরচ যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি ছিল সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। সে লক্ষ্যে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। তবে বাস্তবতা হলো হজের খরচের যে খাতসমূহ রয়েছে তার অধিকাংশের খরচই সৌদি সরকার নির্ধারিত। বিমানভাড়া ও হোটেল ভাড়া-এই দুটি খাত ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য কোনো খাতে খরচ কমানোর বিষয়ে দর-কষাকষির সুযোগ নেই। হোটেল ভাড়া প্রধানত হারাম শরিফ হতে হোটেলের দূরত্ব ও হোটেলের মানের তারতম্য অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার দিনগুলোতে মিনা ও আরাফায় তাঁবুতে আবাসন, সেখানে অবস্থানকালে দেওয়া খাবারের মূল্য প্রভৃতি তাঁবুর জোন ও প্যাকেজভিত্তিক নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শুধু তাঁবুর জোন ও প্যাকেজ নির্বাচন করা ব্যতীত দর-কষাকষির কোনো সুযোগ কোনো দেশেরই নেই। সেবার মানভেদেই সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া, ভিসা ফি, স্বাস্থ্যবিমা, জমজমের পানিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও নির্ধারিত।
এ দেশ থেকে হজযাত্রায় বিমানভাড়া নিয়ে নানা রূপ আলোচনা-সমালোচনা আছে। বিমানভাড়া নির্ধারণের জন্য হজ প্যাকেজ ঘোষণার পূর্বে বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে কয়েক দফা মতবিনিময় বা সভা করে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তৎকালীন বিমান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। ফলস্বরূপ, বিমান ভাড়া গতবারের তুলনায় ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমাতে সক্ষম হয় সরকার।
এ দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় সরকার বাড়ি বা হোটেল ভাড়া করার ক্ষেত্রেও যতটা সম্ভব দর-কষাকষি করে এবং অত্যন্ত যৌক্তিক মূল্যে বাড়ি ভাড়া প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত কমিটি। এ বছর সৌদি রিয়ালের মূল্য গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ টাকা বেড়েছে। কিছু সার্ভিস চার্জও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত বছরের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে।
হজ এজেন্সির মাধ্যমে হজযাত্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর হজযাত্রীর ন্যূনতম সংখ্যা বা কোটা নির্ধারণ করে থাকে। গত ২০২৪ হজ মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য এই ন্যূনতম কোটা ছিল ২৫০ জন। কিন্তু এ মৌসুমে সৌদি সরকার বাংলাদেশের হজ এজেন্সি প্রতি সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা ২০০০ জন নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে হজ এজেন্সি প্রতি সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা এক হাজার নির্ধারণ করাতে সক্ষম হয় সরকার।
তবে লিড এজেন্সি গঠন নিয়ে সংকট ঘনীভূত হয়। জুলাই বিপ্লবের পরে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এর কমিটি নিয়েও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন বিভাগ/সংস্থা এবং হজ এজেন্সিসমূহের সহযোগিতায় সরকার ৭০টি লিড এজেন্সি গঠন করতে সমর্থ হয়। এই লিড এজেন্সিসমূহের অধীনেই বেসরকারি মাধ্যমের হজযাত্রীরা এ বছর হজ পালন করেছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হজযাত্রীদের জন্য মিনা ও আরাফায় তাঁবু বরাদ্দ নেওয়া এবং ক্যাটারিং সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সৌদি সরকার। এটিও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান, কঠোর মনিটরিং ও ফলো-আপ তৎপরতার কারণে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। এরপর সৌদি সরকারের নির্দেশনা অনুসারে Nusuk Masar প্ল্যাটফর্মে বাড়িভাড়া ও পরিবহন চুক্তি সম্পাদিত হয়। সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপে এ বছর সরকারি-বেসরকারি উভয় মাধ্যমে নিবন্ধিত হজযাত্রীদের ভিসার বিষয়টিও সম্পন্ন হয়।
এ মৌসুমের হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন হলো ‘লাব্বাইক’ মোবাইল অ্যাপ। সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হজের সফর সহজ, মসৃণ, নিরাপদ এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিরসনে এই অ্যাপ তৈরি করা হয়। এই অ্যাপের মাধ্যমে লোকেশন ট্র্যাকিং, নামাজের সময়সূচি, প্রতিদিনের করণীয়, দৈনিক হজ সিডিউল, হজযাত্রী ফ্লাইটের বিস্তারিত তথ্য, বাংলাদেশ মেডিকেল সেন্টার ও সৌদি হাসপাতালের তথ্যসহ একগুচ্ছ প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
এ বছর হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুক্ত হয়েছে হজ প্রি-পেইড কার্ড। হজযাত্রা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে সরকারের অনুরোধে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এই কার্ড চালু করে। এই কার্ড নগদ টাকার পরিপূরক। এ কার্ডে বাংলাদেশি টাকা লোড করে ডলার/সৌদি রিয়াল পাওয়া যায়। POS মেশিনে পেমেন্ট সুবিধাও রয়েছে এই হজ প্রিপেইড কার্ডে।
সরকারের পরামর্শে হজযাত্রীদের জন্য ‘গ্রামীণফোন’, ‘বাংলালিংক’ ও ‘রবি’ বিশেষ ফোন রোমিং প্যাকেজ চালু করে। এর ফলে হাজিরা সৌদি আরবে মোবাইল সিম ক্রয় ছাড়াই বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিজস্ব মোবাইল সিমের মাধ্যমে প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে।
হজ ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দল গঠনে জনবলের সংখ্যা যতটা সম্ভব যৌক্তিক করার চেষ্টা করে সরকার। গত বছর এ সকল দলের মোট সদস্য ছিল ৩৬৬ জন, এ বছর সেই সংখ্যা কমিয়ে ২৯৩ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
হজযাত্রীদের সেবায় মক্কা ও মদিনার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিযুক্ত করা হয় হজকর্মী। হজযাত্রীদের যেকোনো অভিযোগ/অনুযোগ খতিয়ে দেখে তাৎক্ষণিক সমাধানেরও চেষ্টা করা হয়। মিনায় এ দেশীয় হাজিদের সেবায় সুনির্দিষ্ট দায়িত্বসহ গঠন করা হয় ১৮টি টিম।
এবার হজযাত্রীদের লাগেজ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ধর্ম উপদেষ্টা ও ধর্ম সচিবের দিকনির্দেশনা এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ সংক্রান্ত কমিটি প্রায় শতভাগ লাগেজ হজযাত্রীদের হাতে পৌঁছে দিতে পেরেছে।
হজ ফ্লাইটের মধ্যবর্তী পর্যায়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট সংখ্যা বেশি থাকায় এবং হজ এজেন্সির বাড়িভাড়ার সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় হজযাত্রী পরিবহনে কিছুটা শঙ্কা দেখা দেয়। সেটিও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হজযাত্রী পরিবহনকারী তিনটি এয়ারলাইনসের সঙ্গে সমন্বয় করে সকল হজযাত্রীকে সৌদি আরব প্রেরণ করতে সক্ষম হয়।
এ বছর হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাওয়া গেছে। উদ্ভূত সকল পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অকুণ্ঠ সহায়তা করেছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সুষ্ঠু ও সাবলীল হজ ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পেশাদারি ও দূরদর্শিতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটির দিনগুলোতে ধর্ম সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা দপ্তরে কাজ করেছেন। যখনই কোনো ইস্যু সামনে এসেছে তখনই সেটা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এমনকি কোনো ইস্যু সামনে আসতে পারে-এরূপ সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ দেশের গণমাধ্যমসমূহ সব সময় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। হজ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে দেশবাসীকে অবহিত করেছে এবং নানা তথ্য দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছে।
হজ ব্যবস্থাপনা একটি টিম ওয়ার্ক। সকলে মিলে টিম স্পিরিট নিয়ে কাজ করতে পারলে যেকোনো ব্যবস্থাপনাই সুন্দর ও সাবলীল হবে—এটাই স্বাভাবিক। এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা তারই প্রতিচ্ছবি।
এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা সর্বৈব সুন্দর হয়েছে—এরূপে যারা বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন, তাদের মূল্যায়নে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। তবে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে এবারও সামান্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট হাজিদের নিকট দুঃখ প্রকাশ করছে। এবার যে ত্রুটিসমূহ গোচরে এসেছে তা ভবিষ্যতে যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় সচেষ্ট থাকবে। অনিন্দ্য ব্যবস্থাপনায় সাবলীল হজ নিশ্চিত করতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সদা তৎপর।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ঈদ, বিয়ে, ওলিমা, আকিকা, আত্মীয়স্বজনের পুনর্মিলনী কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিটি পরিবারে বছরের নানা সময়ে ভোজ অনুষ্ঠান চলে। অনুষ্ঠানের দাওয়াত যায় এক আত্মীয় থেকে আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে।
৫ ঘণ্টা আগেস্বার্থপরতা এক মানবিক দুর্বলতা—যা ব্যক্তির চিন্তা-চেতনাকে কেন্দ্রমুখী করে তোলে। যখন এই স্বভাব একক ব্যক্তি থেকে পরিবার এবং সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা নানাবিধ দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্নতা ও অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোরআন-সুন্নাহ এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করেছে, আর আধুনিক সমাজবিজ্ঞানও এ ধরনের আচরণের নেতিবাচক...
১৮ ঘণ্টা আগেকোরবানিদাতা কোরবানির পশু থেকে যে মাংস পান, সাধারণত তা থেকে কিছু অংশ গরিব-মিসকিন, আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে দেন, কিছু অংশ নিজেরা খান আর কিছু অংশ সংরক্ষণ করে রাখেন। কেউ কেউ আবার কোরবানির কোনো মাংস সংরক্ষণ করে রাখেন না; সবটুকু দান করে দেন বা খেয়ে ফেলেন।
১ দিন আগেমোমিনের কোনো কিছুই বৃথা যায় না। সে যে অবস্থারই সম্মুখীন হোক—তার দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মসিবতের বিনিময়ে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। তার গুনাহ মাফ হয়। এ হিসেবে দুঃখ-কষ্ট তার জন্য নেয়ামত ও রহমত। অবশ্য এটা নেয়ামত হবে তখন, যখন বান্দা তাতে সবর করবে। সবর না করলে কষ্টের কষ্টও হলো, আবার লাভও হলো না।
২ দিন আগে